১৮২৬ সালে ফরাসী বিজ্ঞানী জোসেফ নিসেফর নিয়েপ্স হেলিওগ্রাফ প্রক্রিয়ায় ছবি তোলার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। এর কয়েক বছরের মধ্যেই তার সহযোগী এবং আরেক ফরাসী ফটোগ্রাফার এবং উদ্ভাবক লুই ড্যাগার যখন অপেক্ষাকৃত দ্রুতগতিতে ড্যাগারোটাইপ প্রক্রিয়ায় ছবি তোলার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন, তখন থেকেই দেশে দেশে ফটোগ্রাফাররা ঘুরে বেড়াতে শুরু করেন আকর্ষণীয় দৃশ্যগুলোকে ফ্রেমে বন্দী করে রাখার উদ্দেশ্যে। স্বাভাবিকভাবেই প্রথমদিকে তোলা ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বিশ্বের প্রধান প্রধান শহরগুলোর বিখ্যাত স্থাপনা, প্রধান চত্বর, অথবা গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলো। চলুন দেখে নিই বিশ্বের প্রধান প্রধান শহরগুলোর তোলা প্রথম ছবিগুলো।
জেরুজালেম/আল-কুদস
১৮৪৪ সালে তোলা এই ছবিটি আল-কুদসের কোব্বাতুস সাখরা তথা ডোম অফ দ্য রকের সবচেয়ে প্রাচীন ছবি। সে সময় আল-কুদস ছিল উসমানীয় (অটোমান) সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছোট একটি শহর, যার জনসংখ্যা ছিল মাত্র ১৫,০০০। ছবিটি তুলেছিলেন ফরাসী ফটোগ্রাফার জোসেফ ফিলিবার্ট গিরো ডি প্রাঞ্জে। মূল ছবিটি ১৮৪৪ সালে তোলা হলেও তার সন্ধান পাওয়া যায় ১৯২০ সালে, তার মৃত্যুর বহু বছর পর, তার স্টোর রুম থেকে।
গিরো ডি প্রাঞ্জে মধ্যপ্রাচ্যের স্থাপত্যের প্রতি বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। ছবি তোলার প্রযুক্তি আবিষ্কারের পরপরই তিনি ফরাসী চিত্রশিল্পী এবং উদ্ভাবক লুই ড্যাগারের কাছ থেকে ড্যাগারোটাইপ পদ্ধতিতে ছবি তোলার উপর প্রশিক্ষণ নেন এবং মধ্যপ্রাচ্য ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের বিভিন্ন স্থাপত্যের প্রায় ৯০০ ছবি তোলেন।
বোম্বে
ফটোগ্রাফার চার্লস স্কটের তোলা “স্কচ চার্চ, কোর্টহাউজ এবং বোম্বে ডকইয়ার্ডের প্রবেশপথ” শিরোনাম বিশিষ্ট এই ছবিটি তোলা হয়েছিল ১৮৫০ সালে। বোম্বের অ্যাপোলো স্ট্রিট থেকে তোলা এই ছবিটির সর্ববামে অবস্থিত ভবনটি স্কচ চার্চ। এরপরই একটু আড়ালে থাকা গোলাকার গম্বুজ বিশিষ্ট বাড়িটি আইস হাউজ, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা বরফ সংরক্ষণ করা হতো। তার পেছনে অবস্থিত ভবনটি আদালত ভবন। কোর্টহাউজটি পূর্বে গভর্নর হর্নবাইয়ের বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হতো, পরবর্তীতে একে আদালত হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ১৮৭০ সালে এটিকে গ্রেট ওয়েস্টার্ন হোটেলে রূপান্তিরত করা হয়।
লন্ডন
সেন্ট্রাল লন্ডনের সিটি অফ ওয়েস্টমিনিস্টারে অবস্থিত ট্রাফালগার স্কয়ার থেকে লন্ডনের এই প্রথম ছবিটি তোলা হয়েছিল ১৮৩৯ সালে। সামনে অবস্থিত ভাস্কর্যটি ষোড়শ শতকের রাজা প্রথম চার্লসের ভাস্কর্য।
ছবিটি তোলার সময় রাস্তাটি জনাকীর্ণ ছিল। কিন্তু ড্যাগারোটাইপ পদ্ধতিতে ছবি তুলতে অনেক বেশি সময় লাগত বলে ভাস্কর্যের সামনে নিচে বসে থাকা দুজন মানুষ এবং একটু দূরে একটি থেমে থাকা ঘোড়ার গাড়ি ছাড়া চলমান কোনো মানুষ বা ঘোড়ার গাড়ির ছবি এখানে ওঠেনি।
রোম
ইতালির রাজধানী রোমের এই ছবিটি ১৮৪২ সালে তোলা। এটি একটি প্যানোরামিক ছবি। অর্থাৎ একাধিক ছবি একত্রিত করে ছবিটি তৈরি করা হয়েছে। ছবিটি তোলা হয়েছে ১২৫ ফিট উচ্চতা বিশিষ্ট ট্রাজান কলামের ওপর থেকে। রোমের কেন্দ্রকে ধারণ করা এই ছবির পেছনে ঐতিহাসিক রোমান অ্যাম্ফিথিয়েটার, কলোসিয়াম দৃশ্যমান। এই ছবিটিও ফরাসী ফটোগ্রাফার জোসেফ ফিলিবার্ট গিরো ডি প্রাঞ্জের তোলা। আর এটিও ড্যাগারোটাইপ পদ্ধতিতে তোলা ছবি।
টরন্টো
১৮৪০ সালে যখন ইউনাইটেড প্রভিন্স অফ কানাডা গঠিত হয়, তখনও কানাডার কোনো রাজধানী ছিল না। দেশটির পার্লামেন্ট পর্যায়ক্রমে একাধিক শহরে স্থানান্তরিত হতো। ১৮৫৬ সালে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, একাধিক শহরে স্থানান্তরের পরিবর্তে একটি শহরকে কানাডার রাজধানী নির্বাচিত করা হবে।
সে সময় রাজধানী হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার জন্য টরন্টো, মন্ট্রিয়াল, কিংস্টন, কুইবেক সিটি এবং অটোয়া পৃথক পৃথকভাবে প্রতিবেদন জমা দেয় নিজেদের শহরটি কেন রাজধানী হওয়ার জন্য বেশি উপযোগী, তা ব্যাখ্যা করে। টরোন্টো শহর কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিবেদনের সাথে শহরের নতুন তোলা কয়েকটি ছবি সংযুক্ত করে, যাতে শহরের উল্লেখযোগ্য প্রশস্ত রাস্তাঘাট, গুরুত্বপূর্ণ এবং দৃষ্টিনন্দন বহুতল ভবনগুলো প্রাধান্য পায়। কিন্তু টরন্টোর দুর্ভাগ্য, শেষ পর্যন্ত তারা রাজধানী হওয়ার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হয়।
১৮৫৬ অথবা ১৮৫৭ সালে তোলা টরন্টোর কিং স্ট্রিট ইস্টের এই ছবিটি ছিল টরন্টো রিপোর্টে সংযুক্ত ছবিগুলোর মধ্যে অন্যতম। এটি একই সাথে ছিল টরন্টো শহরের তোলা প্রথম ছবি।
ওয়াশিংটন ডিসি
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির প্রথম ছবি কোনটি সেটি নিয়ে বিতর্ক আছে। ব্রিটিশ বংশোদ্ভুত মার্কিন ফটোগ্রাফার জন প্লাম্ব ১৮৪৬ সালে কাছাকাছি সময়ে ওয়াশিংটনের অনেকগুলো ছবি তুলেছিলেন। যদিও তার তোলা প্যাটেন্ট অফিসের ছবিটিকে প্রথম ছবি হিসেবে ধরা হয়, কিন্তু ক্যাপিটল হিল এবং হোয়াইট হাউজের ছবিও কাছাকাছি সময়েই তোলা।
ওয়াশিংটনের পুরাতন প্যাটেন্ট অফিস বিল্ডিংয়ের এই ছবিটি ১৮৪৬ তোলা ওয়াশিংটনের প্রাচীনতম ছবিগুলোর মধ্যে একটি। বর্তমানে অবশ্য এই ভবনটি ন্যাশনাল পোর্ট্রেট গ্যালারি হিসেবে পরিচিত।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটল হিলের প্রাচীনতম ছবি এটি। ১৮৪৬ সালে এই ছবিতে ধারণকৃত ক্যাপিটল হিলের গঠন এর বর্তমান গঠনের চেয়ে অনেকটাই ভিন্ন। বর্তমান গম্বুজের চেয়ে ভিন্ন আকৃতির এই গম্বুজটি ১৮১৯ থেকে ১৮২৬ সালের মধ্যকার। পরবর্তীতে ১৮৫০ সাল থেকে ১৮৬০ সালের মধ্যে গম্বুজটিকে বর্তমানের চেহারা দেওয়া হয়। এছাড়া আয়তনেও বর্তমান ক্যাপিটল হল অনেক বড়।
একই সময়ে ১৮৪৬ তোলা হোয়াইট হাউজের ছবি এটি। হোয়াইট হাউজও সে সময় বর্তমানের চেয়ে আকারে ছোট ছিল।
নিউইয়র্ক
দীর্ঘদিন পর্যন্ত নিউইয়র্কের প্রথম ছবি হিসেবে এই ছবিটি প্রচলিত ছিল। ম্যানহাটনের ব্রডওয়ে এবং ফ্র্যাঙ্কলিন স্ট্রিটের এই ছবিটি তোলা হয়েছিল ১৮৫০ সালে। কিন্তু পরবর্তীতে নিউইয়র্কের আরেকটি ছবি পাওয়া যায়, যা তোলা হয়েছিল ১৮৪৮ সালে। ছবিটি নিউইয়র্ক সিটির আপার ওয়েস্ট সাইডের ব্রডওয়ের গ্রামাঞ্চলের একটি রাস্তার ছবি। ধারণা করা হয়, এই রাস্তাটি পবর্তীতে ১৮৯৯ সালে ব্লুমিংডেল ব্রডওয়ে হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এই ছবিটি সম্প্রতি ৬২,৫০০ মার্কিন ডলারে নিলামে বিক্রি হয়েছে।
এথেন্স
১৮৪৫ সালে তোলা হয় গ্রীসের রাজধানী এথেনসের দুটি ছবি। বাম পাশের ছবিটির স্থানে পরবর্তীতে ১৮৯৬ সালের অলিম্পিক গেমস উপলক্ষে মার্বেল স্টেডিয়াম তৈরি করা হয়। আর ডান পাশের ছবিটি হচ্ছে এথেন্সের বিখ্যাত অ্যাক্রোপলিসের ছবি। এর পাদদেশে যে ঘরবাড়িগুলো দেখা যাচ্ছে, সেগুলো হচ্ছে আধুনিক এথেন্সের নির্মাণকাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের ঘরবাড়ি।
প্যারিস
১৮৩৮ সালে প্যারিসের বুলেভার্দ দ্যু টেম্পলের এই ছবিটি প্যারিসের সর্বপ্রথম ছবি। এটি একই সাথে বিশ্বের সর্বপ্রথম মানুষের ছবি। এই ছবিতে দুজন মানুষ ধরা পড়ে। এই ছবিটির বাম দিকে নিচের কোণে দেখায় যায়, এক ভদ্রলোক তার জুতা পালিশ করাচ্ছেন। ছবিটি তোলেন ফরাসী ফটোগ্রাফার এবং উদ্ভাবক লুই ড্যাগার।
যদিও সে সময় রাস্তাটি মানুষে পরিপূর্ণ ছিল, কিন্তু সবাই চলাচল করছিল বলে তাদের ছবি ক্যামেরায় ধরা পড়েনি। শুধু এই ভদ্রলোক এবং জুতা পালিশকারক ছেলেটি পুরো ৭ মিনিট সময় ধরে স্থির থাকার কারণেই তাদের ছবি ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল।
টোকিও
ব্রিটিশ ফটোগ্রাফার ফেলিশ বিটোর তোলা এই ছবিটি জাপানের রাজধানী টোকিওর সবচেয়ে প্রাচীন ছবি। সে সময় টোকিওর নাম ছিল এদো। এর জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১০ লাখ। ছবিটি তোলা হয়েছিল ১৮৬৫ বা ১৮৬৬ সালে। ২৬ মিটার উঁচু আটাগোইয়ামা পাহাড়ের চূড়ার থেকে তোলা টোকিওর প্যানোরামিক ছবিটি টোকিওর পশ্চিমা বিশ্ব প্রভাবিত হওয়ার পূর্বের রূপ ধরা পড়েছে।
আলেকজান্দ্রিয়া
১৯৩৯ সালের ৭ই নভেম্বর তোলা এই ছবিটি মিসরের আলেকজান্দ্রিয়ার সবচেয়ে পুরানো ছবি। এটি মোহাম্মদ আলি পাশার হারেম প্রাসাদের ছবি। ছবিটি তুলেছিলেন ফরাসী ফটোগ্রাফার ফ্রেডেরিক গুপিল ফেস্ক।