‘রক্ষক যখন ভক্ষক’ প্রবচনটি আমরা বহুবার শুনেছি। কিন্তু খুনি এবং সেবক (নার্স) কখনো একই মানুষ হতে পারে, এটা বোধহয় আমাদের কল্পনারও বাইরে। চার্লস এডমুন্ড, নিউজার্সির ইতিহাসে এমন একজন সিরিয়াল কিলার, যিনি কর্মজীবনে ছিলেন একজন সেবক। ধারণা করা হয়, আমেরিকান ইতিহাসে তার মতো ভয়ংকর সিরিয়াল কিলার আজ পর্যন্ত কাউকে পাওয়া যায়নি। তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, ১৬ বছরের কর্মজীবনে তিনি চল্লিশোর্ধ্ব রোগীকে খুন করেন! কিন্তু বিভিন্ন পুলিশ ও সাংবাদিকের সামনে সাক্ষাৎকার থেকে এটা জানা যায় যে, তিনি এর বেশি খুনের জন্য দায়ী, যাদের নাম বা মৃত্যুর ধরণ তিনি নিশ্চিতভাবে বলতে ব্যর্থ হন। তদন্ত কমিটির আনুমানিক হিসাবে এই সংখ্যা চার শতাধিক!
জন্ম ও ছেলেবেলা
কিউলেনের জন্ম ১৯৬০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি নিউজার্সির ওয়েস্ট অরেঞ্জে। বাসচালক পিতা ও গৃহিণী মাতার সংসারে আট ভাই-বোনের মাঝে সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। সাত মাস বয়সে বাবাকে হারান। অচিরেই এত বড় পরিবার যেন অথৈ জলে পড়ে যায়। তিনি সারাজীবনে বেশ কয়েকবার আত্মহত্যার প্রচেষ্টা চালান। সর্বপ্রথম নয় বছর বয়সে রাসায়নিক দ্রব্য সেবন করে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। পরবর্তীতে তিনি যেসব নার্সিং হোমে কাজ করতেন সেখান থেকেও রাসায়নিক দ্রব্য চুরি করে বেশ কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেন।
ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ১৯৭৭ সালে তার বোন গাড়ি চালাতে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় ভালোই আহত হন এবং এক দুর্ঘটনায় তার মা মারা যান। মায়ের মৃত্যু কিউলেনের জীবন আরো ছন্নছাড়া করে তোলে। তিনি স্কুল ছেড়ে নেভিতে যোগ দেন। সেখানে তিনি সাবমেরিন সার্ভিসের দায়িত্ব পান এবং পেটি অফিসার পদে পদোন্নতি হয়। কিন্তু মানসিকভাবে ভারসাম্যহীনতা প্রকট হওয়ায় সেখানেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। ১৯৮৪ সালে নেভি থেকে ছাড়পত্র নিয়ে তিনি নার্সিং স্কুলে ভর্তি হন। সফলভাবে ডিগ্রি নিয়ে ১৯৮৭ সালে নিউজার্সিতেই বারনাবাস মেডিকেল সেন্টারে বার্ন ইউনিটে নার্সিং পেশায় নিযুক্ত হন এবং সেই বছরই এড্রিনি টবের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
কর্মজীবন ও হত্যাযজ্ঞ
তার অপ্রকৃতস্থ মস্তিষ্ক এবং কর্মকাণ্ডের জন্য মাত্র চার বছরেই তাকে বারনাবাস ছাড়তে হয়। তার বক্তব্য অনুযায়ী, বারনাবাসেই তিনি প্রথম হত্যা করেন জর্জ জন ডব্লিউ ইয়েঙ্গো সিনিয়র নামক এক ব্যক্তিকে। ইয়েঙ্গো ড্রাগ সেবনে রক্তের এলার্জিজনিত রোগে ভুগছিলেন। কিউলেন তাকে ওভারডোজ ঔষধ দিয়ে হত্যা করেন। এরপর লিস্টে আরো অনেক নাম যুক্ত হতে থাকে, যাদের মধ্যে এইডস রোগীও অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাদের মৃত্যুর কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় ইনসুলিনের ওভারডোজ। ১৯৯২ সালে এসব মৃত্যুর কারণ পর্যলোচনায় সমীক্ষা বসলে কিউলেন বারনাবাস ত্যাগ করেন। যদিও তিনি স্বীকার করেননি, তবু সমীক্ষায় প্রায় ডজনখানেক মৃত্যুর জন্য কিউলেনকেই দোষী পাওয়া যায়।
বারনাবাসে চাকরি ছাড়ার এক মাসের মধ্যেই তিনি ওয়ারেন হাসপাতালে যোগ দেন। সেখানেও কিছুদিনের মাঝে তিনজন বয়স্ক মহিলাকে ওভারডোজ ঔষধ দিয়ে হত্যা করেন কিউলেন। যদিও একজন মহিলা আভাস দিয়েছিল ‘একজন পুরুষ নার্স’ ঘুমের ভিতর তাকে ইঞ্জেকশন দিলেই তার অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে, কিন্তু হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ এমনকি পরিবারের সদস্যগণও কোনো প্রমাণ পাননি, যার ফলে কিউলেন তেমনি অধরা রয়ে যান ভাগ্যগুণে। সেবছরই ডিভোর্স হয়ে যায় তার। দুই কন্যার ভরণপোষণের আংশিক দায়িত্ব কিউলেনের ওপর বর্তায়। পরবর্তীতে এটাকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করেন তিনি, বলেন, “সন্তানদের ভরণপোষণের খরচ যোগাতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি বাধ্য হন তার চাকরি ধরে রাখতে।”
সেই বছর মার্চ মাসের এক মধ্যরাতে তার একজন মহিলা সহকর্মীর ঘর ভেঙ্গে প্রবেশ করে উত্যক্ত করলে সেই মহিলা পুলিশে অভিযোগ করায় প্রথমবার গ্রেপ্তার হন তিনি। তারপরই পুনরায় তার মস্তিকের অবস্থার অবনতি ঘটে এবং সেখানে আবার তিনি আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। ১৯৯৩ সালের শেষের দিকে তিনি ওয়ারেন হাসপাতালের কাজ থেকে অব্যাহতি নেন।
পরবর্তীতে বেশ কিছু মেডিকেল সেন্টারে কাজ নেন কিউলেন এবং পর্যায়ক্রমে তার কাজের জন্য বহিষ্কৃত হন। ১৯৯৮ সালের দিকে এলেনটাউন সংশোধনাগার থেকে তাকে তলব করা হয় এবং সেখানে চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত ওষুধ খাওয়ানো আর সময়মত ওষুধ না দেওয়ার অভিযোগ উঠলে সেখান থেকেও বিদায় নেন তিনি। ১৯৯৯ সালে ইস্টন মেডিকেল সেন্টারে একবছর মেয়াদী কাজের সময় প্রমাণের অভাবে আবারো তিনি খুন করে পালাতে সক্ষম হন।
এত কিছুর পর এটা ভাবা স্বাভাবিক যে, তার কাজের এবং মস্তিস্কের অক্ষমতার পরও কেন তার বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এর একমাত্র কারণ স্বল্পসংখ্যক নার্স আর তখনকার রিপোর্টিং কার্যক্রম এখনকার মতো উন্নত ছিল না। এর ফলশ্রুতিতে তিনি অপ্রতিরোধ্য অবস্থায় তার হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যেতে থাকেন। ১৯৯৯ সালে লেহাই ভ্যালী হাসপাতালে বার্ন ইউনিটে একজনকে হত্যা এবং একজনকে হত্যার প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে সেখান থেকেও পালিয়ে যান। এরপর ছয় মাস চাকরিহীন থাকার কারণে তিনি সন্তানদের ব্যয়ভার থেকে মুক্তি নেন।
১৯৯৯ সালেই সেইন্ট লিউক্স হাসপাতালে যোগ দেন এবং সেখানে তিন বছরের চাকরিজীবনে পাঁচজন খুন ও দুজনকে খুনের চেষ্টা করেন এমন স্বীকারোক্তি পাওয়া যায়। ২০০২ সালে সমারসেট মেডিকেল সেন্টারে আটজনের খুনের বিবরণ দেন। ২০০৩ সালে পাঁচজন হত্যার পর অক্টোবর মাসের শেষের দিকে লো ব্লাডসুগারে একজন রোগী মারা গেলে কিউলেন প্রথমবারের মতো সাস্পেক্ট হন। তদন্তে তার পূর্ব ইতিহাস এবং হত্যার রহস্য প্রকাশ হতে শুরু করে। হাসপাতাল থেকে বহিষ্কার করা হয় তাকে। তদন্তের সম্পূর্ণ কার্যক্রম চলাকালীন সাত সপ্তাহ তাকে পুলিশ পর্যবেক্ষণে রাখে।
২০০৪ সালে তিনি নিউজার্সির আদালতে হত্যার অভিযোগ স্বীকার করেন। ২০০৫ সালে সমারসেট আদালতে সমস্ত তদন্তের ভিত্তিতে এ ধরনের হত্যাযজ্ঞের জন্য ১০০ বছর এবং ২০০৬ সালে নিউজার্সি আদালতে আরো কিছু খুনের সাজাপ্রাপ্তি ঘটে, যার হিসাবে ২,৪০৩ সালের পূর্বে তার মুক্তি লাভ সম্ভব নয়।
২০০৬ সালে তিনি নিজের সাবেক প্রেমিকার ভাইকে তার কিডনি দিয়ে সাহায্য করেন। তার উকিল মাস্ক এটাকে ‘Irony involvement’ বলে দাবি করেন।
উদ্দেশ্য
সবচেয়ে আজব ব্যাপার হলো তিনি সাক্ষাৎকারে বলেন, কোনো কোনো অসুস্থ ব্যক্তিকে সুস্থ করার প্রয়াস তিনি সহ্য করতে পারতেন না। তিনি তাদের হত্যা করতেন তাদের কষ্ট থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য। বেশ কিছুদিন তাদের ভুগতে দেখলে তিনি তাদের খুনের চিন্তা করতেন। কিন্তু ঐসব রোগীদেরই কেন বেছে নিয়েছিলেন তা তিনি সঠিকভাবে বলতে পারেননি। তার পুরো বক্তব্যে কেবলমাত্র তার বিকৃত মস্তিষ্কেরই প্রমাণ মেলে। বর্তমানে তিনি নিউজার্সি স্টেট কারাগারে কারাবন্দী অবস্থায় আছেন।