ব্যান্ডেজে মোড়ানো মমি, রহস্যঘেরা পিরামিড, ক্ষমতাধর ফারাও কিংবা মনোমুগ্ধকর হায়ারোগ্লিফ- প্রাচীন মিশরের কথা শুনলে যে কারো মাথায় সবার আগে এ চারটি জিনিসের যেকোনো একটির চিন্তাই আসে। তবে মজার ব্যাপার হলো, এসবের বাইরেও সেই আমলে তাদের জীবনযাপনের এমন আরো অনেক দিক রয়েছে, যা আমাদের অধিকাংশেরই অজানা। তেমন ৭টি অজানা বিষয় নিয়েই সাজানো হয়েছে এই লেখা।
১. উকুনের জ্বালায় টাক মাথা
প্রাচীন মিশরের নানা ছবি এবং অন্যান্য এলাকার মানুষদের বর্ণনা থেকে তৎকালীন মিশরের এক অদ্ভুত ফ্যাশন সম্পর্কে জানা যায়। সেসব জায়গায় উল্লেখ আছে, মিশরের অনেক মানুষই নাকি মাথা টাক করে রাখতো। শুরুতে বাইরের লোকজন বুঝতে পারতো না, কেন এই টাক মাথাকে মিশরের লোকজন সৌন্দর্যচর্চার অংশ হিসেবে বেছে নিল। অবশেষে প্রত্নতত্ত্ববিদদের গবেষণা থেকে হয়েছে এর রহস্যোদ্ধার।
তৎকালে মিশরের সবদিকে উকুন ছড়িয়ে পড়েছিল ভয়াবহ মাত্রায়। এসব উকুন সবচেয়ে বেশি ছিল মৃত মিশরীয় শাসকদের কবরে। ধারণা করা হয়, সেখান থেকেই বোধহয় সেগুলোর উৎপত্তি ঘটেছিল। তৎকালে যে তাদের কাছে উকুন প্রতিরোধের কোনো ওষুধ ছিল না তেমনটা বলা যাবে না। তবে সেগুলো তেমন কাজের ছিলো না। তাই উপায়ন্তর না দেখে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই মাথার চুলগুলো ফেলে দিয়েছিল। নারীরা মাথায় উইগ ব্যবহার করতো। কেউ কেউ আবার এক ধাপ এগিয়ে মাথার চুল তো বটেই, গায়ের লোম পর্যন্ত শেভ করে ফেলেছিল!
২. অদ্ভুত জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা
চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতিতে এসেছে যুগান্তকারী পরিবর্তন। আজকের দিনে অপরিকল্পিত গর্ভধারণ রোধে জন্মবিরতিকরণ পিল, কনডম সহ বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। আজ থেকে হাজার বছর আগে এমনটা চিন্তাও করা যেত না। কিন্তু তাই বলে কি তারা জন্ম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতো না? অবশ্যই করতো। তবে তাদের সেসব পদ্ধতির কথা শুনলে আজকের দিনে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যে কারোরই গা গুলিয়ে উঠবে।
প্রাচীন মিশরের কথাতেই আসা যাক না। তাদের নারীরা বিভিন্ন জিনিসই ব্যবহার করতো অপরিকল্পিত গর্ভধারণ রোধে। এর মাঝে অপেক্ষাকৃত ভালো জিনিস ছিল মধু। আর খারাপ বললে উঠে আসে পাতা ও কুমিরের মলের মিশ্রণের কথা। একজন নারী এসব জিনিস তার গোপনাঙ্গে মাখিয়ে নিত জন্মনিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি হিসেবে!
পুরুষদের জন্মনিয়ন্ত্রণের পদ্ধতিও কম বিচিত্র ছিল না। তারা তাদের লিঙ্গের অগ্রভাগের ত্বকে পেঁয়াজের রস মাখিয়ে নিত!
৩. সুন্দরী নারীদের দুর্ভাগ্য
প্রাচীন মিশরের সাথে যে শব্দটি সবচেয়ে বেশি যায় তা হলো ‘মমি’। আসলে মিশরের কথা শুনলেই আমাদের চোখে মমি আর পিরামিডের ছবি একত্রে ভেসে ওঠে। সাধারণত শাসকেরাই তাদের দেহকে মমি করে রাখতো। তবে এখানেও ছিল ভিন্নতা, যা নির্ধারিত হতো তার লিঙ্গের ভিত্তিতে।
যদি মৃত ব্যক্তি পুরুষ হতেন, তাহলে তার দেহকে মমি করার প্রক্রিয়া খুব দ্রুতই শুরু হয়ে যেত। তবে তিনি যদি নারী হতেন, তাহলেই মানা হতো ভিন্ন নিয়ম। যদি কোনো সুন্দরী ও ক্ষমতাবান নারী মারা যেতেন, তাহলে প্রথমে তার দেহটি কয়েকদিন রেখে দেয়া হতো যেন সেটি পচে যায়। এরপর সেটি দেয়া হতো মমিকরণের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের কাছে।
দেহকে পচিয়ে এরপর মমি করতে দেয়ার কারণ জানতে চান? আসলে এ প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের উপর ঠিক ভরসা করতে পারতো না মিশরের মানুষেরা। এমনটা করার পেছনে আছে এক মর্মান্তিক ইতিহাস। একবার মিশরীয় রাজপরিবারের এক নারী প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই মৃত্যুবরণ করেন। রাজপরিবারের সদস্য বলে তার দেহ মমি করার জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয়। দুর্ভাগ্যক্রমে সেদিন যারা এ দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল, তাদের মাঝে একজন ছিল বিকৃত যৌনরুচির অধিকারী। কাজ করার ঘরে সে যখন মৃতদেহটিকে একা পেয়ে যায়, তখনই সে সেই মৃতদেহের সাথে যৌনমিলনে লিপ্ত হয়ে যায়!
ঠিক এমন সময়ই লোকটির আরেক সহকর্মী ঘরে প্রবেশ করে। সঙ্গীকে এমন ন্যাক্কারজনক কাজ করতে দেখে সে কিছুতেই মেনে নিতে পারে নি। তাই সে সাথে সাথেই বিচার বিভাগকে এ বিষয়ে জানিয়ে দেয়। মৃতদেহের সাথে যৌনমিলন অর্থাৎ নেক্রোফিলিয়ায় লিপ্ত হওয়া সেই লোকটির ভাগ্যে পরে কী ঘটেছিল তা জানা না গেলেও এরপর মমিকরণের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের উপর মানুষের বিশ্বাসের স্তম্ভ বেশ ভালোভাবেই নাড়া খেয়ে যায়।
৪. জোলাপের ব্যবহার
অর্থের আধিক্য মিশরের রাজপরিবারের সদস্যদের সারাদিন খাওয়াদাওয়ার উপরেই রাখতো। ফলে তারা অধিকাংশই বেশ মুটিয়ে গিয়েছিল। তবে এমনটা যে তাদেরও খুব ভালো লাগতো, তা কিন্তু নয়। বরং তারাও চাইতো চিকন হয়ে সুস্বাস্থ্যের স্বাদ উপভোগ করতে। ফলে যেকোনো উপায়েই তারা এটা করতে চাইতো।
মিশরের অনেকেই মাসে কমপক্ষে তিনবার জোলাপ ব্যবহার করতো। রেড়ীর তেল দিয়ে বানানো সেই জোলাপ ব্যবহার করে দিনের বাকিটা সময় তারা প্রকৃতির বড় ডাকে সাড়া দিতে টয়লেটেই কাটিয়ে দিত। তখন আবার এখনকার মতো এত চমৎকার পয়ঃনিষ্কাষণ প্রণালীও ছিল না। ফলে কাজ সারার পর নিজ হাতে সেগুলো পরিষ্কারও তাদেরই করা লাগতো।
৫. গুহ্যদ্বারের রাখাল
তৎকালের হিসেবে মিশরের ওষুধ বেশ ভালোই উন্নত হয়েছিল। আমাদের আজকের যুগের মতো তাদের সময়েও শরীরের বিভিন্ন অংশের জন্য বিভিন্ন ডাক্তার ছিল। দাঁতের জন্য ডেন্টিস্ট, চোখের জন্য অপ্টোমেট্রিস্ট আর পশ্চাদ্দেশের কোনো সমস্যার তারা দ্বারস্থ হতো প্রোক্টোলজিস্টের। এর মাঝে প্রোক্টোলজিস্টের মিশরীয় নামটা ছিল বেশ মজার। তারা তাকে যে নামে ডাকতো তার বঙ্গানুবাদ দাঁড়ায় ‘গুহ্যদ্বারের রাখাল’।
এই গুহ্যদ্বারের রাখালদের মূল কাজ ছিল লোকজনের পশ্চাদ্দেশে এনেমা দেয়া। এক্ষেত্রে একজন মানুষকে কোষ্ঠকাঠিন্যের হাত থেকে রেহাই দিতে তার মলদ্বার দিয়ে বিশেষ একপ্রকারের সিরিঞ্জ ব্যবহার করে তরল পদার্থ প্রবেশ করানো হত।
৬. গর্ভধারণের পরীক্ষা
মাতৃত্বের স্বাদ যেকোনো নারীর জন্যই চরম আকাঙ্ক্ষিত এক অনুভূতি, পরম এক পাওয়া। একজন নারী মা হতে যাচ্ছেন কিনা তা নিশ্চিত হতে বিভিন্ন রকম পরীক্ষার উপকরণ আজকাল আশেপাশের ফার্মেসিতেই পাওয়া যায়। তবে আমরা আজ যে মিশরের গল্প করছি, তা আজ থেকে হাজার হাজার বছর আগের সময়ের। ফলে তখনকার দিনে গর্ভধারণের পরীক্ষা আজকের যুগের তুলনায় আলাদা হবে সেটাই স্বাভাবিক। তবে তাদের সেই পদ্ধতি এতটাই অদ্ভুত লাগবে যে, আজকের দিনে কোনো নারী সেটা জানলে হাঁ হয়ে যেতে বাধ্য।
এক পরীক্ষায় সম্ভাব্য গর্ভবতী নারীর পুরো শরীর জুড়ে প্রথমে তেল মাখাত ডাক্তার। এরপর তাকে বলা হত সকাল পর্যন্ত শুয়ে থাকতে। সকালে যদি বেশ সতেজ ও চনমনে দেখাত, তাহলে ধরে নেয়া হত সেই নারী মা হতে যাচ্ছেন, অন্যথায় বিপরীত খবর শুনতে হত।
আরেকটি পরীক্ষার কথা শুনলে তো চোখ কপালে উঠতে বাধ্য। এ পরীক্ষায় একটি রসুনের কোয়া বা আস্ত পেঁয়াজ একজন নারীর যোনিপথে রেখে সকাল পর্যন্ত শুয়ে থাকতে বলা হত। সকালে ডাক্তার তার শ্বাসপ্রশ্বাসের ঘ্রাণ নিতেন। তৎকালে মিশরের লোকজন বিশ্বাস করতো যে, একজন নারীর দেহের প্রতিটি বহির্মুখই একে অপরের সাথে সংযুক্ত এবং মুখ থেকে একটি টিউব একেবারে দেহের নিচ পর্যন্ত নেমে গিয়েছে। যদি সকালে নারীর শ্বাসপ্রশ্বাসে রসুন বা পেঁয়াজের গন্ধ পাওয়া যেত, তাহলে এর অর্থ হতো তার ভেতরের টিউবগুলো পরিষ্কার এবং তিনি সন্তান ধারণে সক্ষম। অন্যদিকে যদি গন্ধ পাওয়া না যেত, তাহলে বোঝা যেত কোনো কারণে টিউব বন্ধ হয়ে আছে এবং সেই নারী কোনোদিনই মা হতে পারবেন না।
৭. পুরুষদের ঋতুস্রাব
প্রাচীন মিশরে রোগশোক সবসময় লেগেই থাকতো। বিশেষত Schistosomiasis এ আক্রান্ত ছিল তাদের অনেকে। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির মলমূত্রের সাথে রক্তও চলে আসে। এটা তখনকার সময় এতটাই ভয়াবহ হারে ছড়িয়ে পড়েছিল যে, লোকে এটাকে আর অসুখই মনে করতো না!
সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপারটি ঘটেছিল পুরুষদের বেলায়। তারা যখন দেখলো তাদের প্রস্রাবের রাস্তা দিয়েও রক্তপাত হচ্ছে, তখন তারা ধরে নিল বয়স বৃদ্ধির সাথে নারীদের মতো তাদেরও মাসিক হচ্ছে এবং এটাই স্বাভাবিক! অনেকে আবার এটাকে ভালো লক্ষণ ধরে নিত, মনে করতো এমন হওয়া মানে সেই পুরুষ সন্তান জন্মদানে সক্ষম! একজন পুরুষ যে পরিবার গঠনে সক্ষম হয়েছে সেটা বুঝতে এ বিষয়টি তাদের অনেকের কাছেই সংকেত হিসেবে কাজ করতো।