Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

দ্য আনসাং রেইডার লেফটেন্যান্ট জি এম মুশফিকুর রহমান, বীর উত্তম

৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৯
রাত আনুমানিক আড়াইটা
চেলাছড়া, দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি।

দীর্ঘ চার ঘণ্টা হেঁটে অবশেষে লেফটেন্যান্ট মুশফিক তার ১৭ জন রেইডার্স[1] আর একজন সোর্স (গোপন সংবাদদাতা) সহ টার্গেট এলাকায় এসে পৌঁছান। লক্ষ্মীছড়ি ক্যাম্প থেকে বেরোনোর পর পথে সাতটা ছড়া আর ছয়টা উঁচু পাহাড় পেরিয়ে আসতে হয়েছে। অবশ্য সোর্স রাস্তাটা বেশ ভালো করেই চিনত বলে দূরত্বের তুলনায় সময় বরং কমই লেগেছে বলা চলে।

গঙ্গারামছড়া পার হয়েই রেইডার্সরা সবাই একফাঁকে অস্ত্রের নল আর বাঁটে লাগা কাদাবালি পরিষ্কার করে নিয়েছেন। সিদ্দিকছড়ি ক্যাম্প থেকে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট সাইদের দলটাও ইতিমধ্যে উল্টাছড়ি গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা খালের পশ্চিম পারে পজিশন নিয়েছে বলে ওয়্যারলেসে জানা গেছে। পরিস্থিতি কোনো কারণে মুশফিকের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে সাইদ এগিয়ে আসবেন।

গা ছমছমে অন্ধকার ভেদ করে মুশফিক সামনের বিশাল পাহাড়ের গায়ে লুকানো জুম ঘরটা শনাক্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করলেন। আকাশটা আজ কিছুটা মেঘলা বলেই অপারেশনটা প্ল্যান করা, যেন প্রতিকূল আবহাওয়ার সুযোগে শত্রুর অগোচরে টার্গেটের খুব কাছাকাছি যাওয়া যায়। আঁধার অবশ্য দ্বিমুখী, নিজেদের দৃষ্টিসীমাও কমিয়ে দেয়। যা-হোক, অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়ে সোর্সকে ইশারায় পাশে ডাকলেন। এবার সোর্সের সহায়তায় দুটো জুমঘর শনাক্ত করা গেল; একটা পাহাড়ের পাদদেশেই, আরেকটা প্রায় চূড়ার কাছাকাছি।

প্ল্যানমতোই সব এগোচ্ছিল। মুশফিক নিজে হাবিলদার মেজবাহর ৫ জনের উপদলটাকে পাহাড়ের পাদদেশের টার্গেটের কাছে পজিশনে বসিয়ে দিয়ে মূল দলের কাছে ফিরে এলেন। এবার হাবিলদার নজরুলের ৬ জনের রিজার্ভ পার্টিটাকে[2] পজিশনে পৌঁছে দিয়ে বাকি ৫ জন নিয়ে মুশফিক রওনা দিলেন পাহাড়ের চূড়ার মূল টার্গেটের উদ্দেশ্যে।

প্রায় ৪০ মিনিট খুব সন্তর্পণে পাহাড় বেয়ে ওঠার পর মুশফিকেরা থামলেন। এবার মাটি কামড়ে প্রায় নিঃশব্দে ক্রল করতে করতে পৌঁছে গেলেন জুমঘরের ৫ গজের চৌহদ্দিতে। উত্তেজনা আর ক্লান্তিতে ফুঁপিয়ে উঠতে চাওয়া ফুসফুসটাকে দমিয়ে রেখে মুশফিক সবাইকে ইশারা করলেন আড়াআড়িভাবে ছড়িয়ে পড়তে। মুহূর্তের ভেতর প্রশিক্ষিত রেইডার্সরা এক্সটেন্ডেড লাইনে[3] পজিশন নিয়ে ফেললেন। সবাই যখন অন্ধকার চিরে আঁতিপাঁতি করে শত্রুর অস্তিত্ব খুঁজছেন; ঠিক তখনই হঠাৎ আকাশে বিদ্যুৎ চমকে উঠল।

দূরে কোথাও বাজ পড়ার শব্দটা কান পর্যন্ত আসার আগেই ওরা প্রতিপক্ষকে দেখতে পেল এবং প্রতিপক্ষও তাদের। কে আগে গুলি ছুড়ল তা জানার উপায় নেই। মিনিট খানেকের জন্য যেন নরক ভেঙে পড়ল চেলাছড়ার ওই পাহাড়চূড়ায়। মুখোমুখি মাজল ফ্ল্যাশ[4] আর বুলেটের বৃষ্টি ছাপিয়ে কর্ডাইটের গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে উঠল। মুশফিকের নল থেকেই হয়তো প্রথম বুলেটটা বেরিয়েছিল। তাই প্রতিপক্ষের প্রথম পশলা বুলেট তার দিকেই ধেয়ে এল। প্রায় পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ,[5] তাই কাভারের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়েও শেষ রক্ষা হলো না।

আহত মুশফিকের কথা ভেবে মুহূর্তের জন্য রেইডার্সদের ট্রিগারে রাখা আঙুল যেন স্রেফ জমে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে বুক বেয়ে উঠে আসা তীব্র যন্ত্রণাটাকে গিলে ফেলে মুশফিক ‘ফায়ার’ বলে চিৎকার করলেন। পরের ৫ মিনিটে রেইডার্সরা যেন ঝুলে থাকা অন্ধকারটাকেই গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিতে চাইলেন!

গোলাগুলি শেষে রেইডার্সরা সবাই মুশফিকের দিকে এগিয়ে আসতে চাইলে, তিনি নিজেই নিজের ক্ষত চেপে ধরে আগে অন্য সবাইকে নিরাপদে ওপরে উঠে আসার নির্দেশ দিলেন। আলো না জ্বেলেই সবাই টার্গেটের চারপাশ ক্লিয়ার করে নিয়ে অলরাউন্ড ডিফেন্স[6] নিলেন। সার্চ পার্টি দুটো রাইফেল, এসএমসি আর গোলাবারুদ সহ জলপাই রঙের শান্তি বাহিনীর ইউনিফর্ম পরা তিনটি মৃতদেহ পেল; দুজন পাহাড়ের চূড়ার টার্গেটে আরেক জন নিচের টার্গেটে। বাকিরা পালিয়েছে।

লেফটেন্যান্ট জি এম মুশফিকুর রহমান, বীর উত্তম । (৩০ নভেম্বর, ১৯৬৬ – ৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৯)। অলংকরণ: রহমান আজাদ

গুলির শব্দ শুনে ততক্ষণে সাইদ তার দল নিয়ে এগিয়ে আসতে শুরু করেছেন। সহরেইডার্সদের মুখ দেখেই মুশফিক ইতিমধ্যে যা বোঝার তা বুঝে নিলেন। হাবিলদার নজরুলকে বললেন, সাইদের দল কাছাকাছি এলেই যেন ট্রেসার রাউন্ড[7] ফায়ার করে পথ দেখিয়ে আনার ব্যবস্থা করেন। ৩টা বেজে ৪০ মিনিটে মুশফিকের অপারেটর আর অনুমতির তোয়াক্কা না করেই হেলিকপ্টার পাঠানোর জন্য মেসেজ দিলেন।

ভোর সাড়ে ৫টায় সাইদ যখন পৌঁছালেন, মুশফিক ততক্ষণে অত্যধিক রক্তক্ষরণে অনেকটাই নির্জীব। সাইদ কালবিলম্ব না করে হেলিপ্যাড বানাতে ছুটলেন। দূর চট্টগ্রামের ১নং স্কোয়াড্রনের রানওয়েতে একটা হেলিকপ্টারের রোটর তখন ঘুরতে শুরু করেছে; পাইলট সেই রাত চারটা থেকে ককপিটে বসে ভোরের আলো ফোটার অপেক্ষায় আছেন।

হাবিলদার মেজবাহ হন্যে হয়ে আরও উঁচু একটা বাঁশ খুঁজছেন, যেন পাইলট উইন্ড শকসটা[8] খুঁজে পেতে দেরি না করে ফেলেন। সাইদ নিজেই ওয়্যারলেস সেট আঁকড়ে ধরে ক্যাম্পের ডাক্তারের কাছ থেকে জানার চেষ্টা করে যাচ্ছেন, যেন করণীয় কিছুই করা বাদ না পড়ে। পূর্ণ গতিতে একটা হেলিকপ্টার মেঘ ভেঙে এগিয়ে আসছে। সাতক্ষীরার ছেলে মুশফিক সুদূর পার্বত্য চট্টগ্রামের অচেনা এক সবুজ পাহাড়ে তার রানারের কোলে মাথা রেখে মৃত্যুর প্রতীক্ষায়। অসহায় রানার থেমে থেমে অক্ষেপে বলে উঠছেন, ‘গুলিটা আমার গায়ে ক্যান লাগল না, স্যার?

আঁধার কেটে গিয়ে দিবালোক যখন প্রখরতর হয়ে উঠছে, মুমূর্ষু মুশফিকের চারপাশে তখন নিকষ আঁধার ঘনিয়ে আসতে শুরু করেছে। প্রথমে মা, তারপর বাবার মুখ ভেসে উঠল; তারও পরে আঁধার মেঘ ফুঁড়ে তিনটা চেনা মুখ উঁকি দেয়; হাতছানি দিয়ে ডাকে হাবিলদার হারুন, ল্যান্স নায়েক সুনীল আর ডিএমটি[9] নাজমুল হুদা। আজ থেকে ঠিক নয় দিন আগে বাগাইহাট থেকে ১০ নম্বর ক্যাম্পে যাওয়ার পথে এই শান্তি বাহিনীর পুঁতে রাখা বোমা বিস্ফোরণে তারা তিনজন প্রাণ হারিয়েছিলেন। কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে, তবু অঝোর কান্নায় ভেঙে পড়া রানারকে সান্ত্বনা দিতে মুশফিক বলে ওঠেন, ‘তোমার তো সংসার আছে, পরিবার আছে, তুমি মারা গেলে তাদের কী হবে? আমি মরলে এ দেশের কারও কোনো ক্ষতি হবে না।

৮ সেপ্টেম্বর ১৯৮৯; সকাল ৮টা বেজে ১৫ মিনিট। হলুদ উইন্ড শকসটা পতপত করে উড়ছে, দূর-দিগন্তে হন্তদন্ত হয়ে উড়ে আসা হেলিকপ্টারটা ক্রমশ বড় দেখাচ্ছে। মুশফিক ততক্ষণে হারুন, সুনীল আর নাজমুল হুদাদের সাথে মেঘেদের দেশে। সাতক্ষীরায় মুশফিকের মায়ের আজ কেন জানি বড্ড অস্থির লাগছে…

অলংকরণ: রহমান আজাদ

বীর উত্তম লেফটেন্যান্ট জি এম মুশফিকুর রহমানের সংক্ষিপ্ত জীবনী

বিএ-৩১৭৬ লেফটেন্যান্ট জি এম মুশফিকুর রহমান, ৩০ নভেম্বর ১৯৬৬ সাতক্ষীরা জেলার পারুলীয়া গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মো. আব্বাস আলী গাজী। তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৫তম বিএমএ লংকোর্সে যোগদান করেন এবং প্রশিক্ষণ শেষে ১ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারিতে কমিশনডপ্রাপ্ত হন। তিনি বাঘাইহাট জোনের লক্ষ্মীছড়ি ক্যাম্পের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন।

পার্বত্যাঞ্চলে ইনসার্জেন্সি[10] মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর অতি ক্ষুদ্র অংশের অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ। ‘শান্তিবাহিনী’[11] নামে নৃশংস আর দুর্ধর্ষ এক সশস্ত্র ইনসার্জেন্ট বাহিনী প্রতিষ্ঠার পর থেকেই একের পর এক পরিকল্পিতভাবে হত্যা করছিল অসংখ্য নিরীহ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, বাঙালি আর নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের। এই ইনসার্জেন্টদের উৎখাতের লক্ষ্যে ১৯৭৩ সাল থেকে সেখানে বিভিন্ন অপারেশন পরিচালিত হয়ে আসছে। শান্তিচুক্তির আগপর্যন্ত পার্বত্যাঞ্চলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দায়িত্ব ছিল অত্যন্ত ঝু্ঁকিপূর্ণ। দেশের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার স্বার্থে সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তাবাহিনীর অনেক সদস্যকে জীবন দিতে হয়েছে, অনেকে বরণ করে নিয়েছেন স্থায়ী পঙ্গুত্ব।

পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তা ও শান্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এভাবেই প্রাণ আর রক্ত দিয়ে গেছেন আমাদের বীর সেনানীরা। তারা আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার। তাদের দেশপ্রেম, ত্যাগ, বীরত্বগাথা ও চেতনাই আজকের নতুন প্রজন্মের সামনে এগিয়ে চলার পাথেয়।

গুলিবিদ্ধ মুসফিকুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত

বীর মুশফিকের নামে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়। ছবি: ফটো গ্রিড

ফুটনোট

[1] রেইডার্স মানে যারা ছোট ছোট দলে শত্রুর ওপর হানা দেয়; ইংরেজিতে হানা কে বলে রেইড।
[2] একটা হানা অভিযানে মূলত চারটি উপদল থাকে। কাট অফ পার্টির কাজ টার্গেট এলাকায় অপারেশন শেষ হবার আগ পর্যন্ত বাহির থেকে কাউকে ঢুকতে না দেয়া। হোল্ডিং পার্টির কাজ মূল অপারেশন চলাকালে আশেপাশের শত্রুদের ধ্বংস করা। একশন পার্টি মূল অপারেশন পরিচালনা করে, আর রিজার্ভ পার্টি প্রয়োজনে অ্যাকশন পার্টির শক্তিবৃদ্ধি করে থাকে।
[3] একজনের পাশে একজন দাঁড়ানো।
[4] গুলি বেরিয়ে যাবার সাথে সাথে অস্ত্রের নল দিয়ে বেরুনো পোড়া বারুদের হলকা।
[5] যে দূরত্বে নিশানা না করেই গুলি করে লক্ষ্যবস্তুতে লাগান সম্ভব।
[6] সবদিকে অস্ত্র মোতায়েন করে অবস্থান নেয়া যেন যেকোনো দিক থেকেই আক্রমণ আসলে প্রতিহত করা যায়
[7] অন্ধকারে ট্রেসার রাউন্ড এর পেছনে আলো জ্বলে।
[8] হেলিকপ্টারকে হেলিপ্যাড এলাকায় বাতাসের দিক বোঝানোর জন্য উড়ানো হলুদ রঙের পতাকা।
[9] ড্রাইভার মেকানিক্যাল ট্রান্সপোর্ট, (চালক)
[10] দেশের সরকারের বিরুদ্ধে কোনো গোষ্ঠীর বিদ্রোহ ঘোষণা
[11] পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকারীদের সশস্ত্র সন্ত্রাসীদল।

তথ্যসূত্র ও সহায়ক গ্রন্থাবলি

১।  বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইতিহাস, ১ম থেকে ৫ম খণ্ড, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শিক্ষা পরিদপ্তর কর্তৃক প্রকাশিত, এশিয়া পাবলিকেশনস, ৩৬/৭ বাংলাবাজার, ঢাকা, মে ২০১৫।
২। History of Counter Insurgency Operations in Chittagong Hill Tracts (1976-1999), Vol-2, Chapter – 3, 4 and 5, Page – Appendix 4E1-1.

ফিচার ছবি- রহমান আজাদ

[বি: দ্র: ডেল এইচ খানের লেখা অন্যান্য বীরদের বীরত্বের সবকটি গল্প পড়তে চাইলে দেখুন আদর্শ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের বীরগাথা‘ বইটি।]

Related Articles