শিল্পের সৌন্দর্য কি পূর্ণতায়? নাকি অসমাপ্ততাও দিতে পারে পূর্ণতার স্বাদ? কিছু শিল্পকর্ম হয়ত অসমাপ্ত রয়ে যায় কোনো দুর্ঘটনার কারণে, আর কিছু হয়ত সাজানোই হয় অসমাপ্ততা দিয়ে। বিশেষ করে চিত্রকর্মের ক্ষেত্রে এই অসমাপ্ততা যোগ করে নতুন মাত্রা। কেননা এতে চিত্রের বাহ্যিকতা ছাপিয়ে এর পেছনের অনেক ব্যাপার চোখে পড়ে; যেমন: একদম শুরুর দিকে চিত্রটি কেমন ছিল, প্রস্তুতিমূলক কিছু স্কেচ, কিংবা ছবিটির মূল কাঠামোটা যাকে রঙ তুলিতে প্রাণের ছোঁয়া দিতে গিয়েও দেয়া হয়নি- সবকিছুই একধরনের রহস্যের আবরণে চিন্তার খোরাক যোগায়। আসুন জেনে নিই বিশ্ববিখ্যাত এমন কিছু চিত্রকর্ম সম্পর্কে, শিল্পীর তুলিতে যা পূর্ণতা পায়নি শেষপর্যন্ত।
লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ‘দ্য এডোরেশন অফ দ্য ম্যাজাই’
‘ভালো মানের কাজ সময়সাপেক্ষ’ এই বিবৃতির মূর্তরূপ বলা যায় লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চিকে। একইসাথে অনেক ক্ষেত্রে সমপরিমাণ প্রতিভাধর হওয়ার ফলস্বরূপ প্রায়সময়ই তাঁর চিত্রকর্ম শেষ হতে বেশ সময় লেগে যেত। এমনকি কিছু কাজ শুরু করার পরেও আগ্রহ হারিয়ে ফেলার কারণে শেষ করা হত না। এই চিত্রকর্মটিও তাঁর ব্যতিক্রম নয়।
১৪৮১ সালে ফ্লোরেন্সে থাকাকালীন অগাস্টানিয়ান (রোমান ক্যাথলিক চার্চের এক ধর্মীয় গোষ্ঠী) সন্ন্যাসীরা ভিঞ্চিকে ‘এডোরেশন অফ দ্য ম্যাজাই’ এঁকে দেয়ার দায়িত্ব দেন, যাতে বর্ণিত হত যীশুর সাথে তিন জ্ঞানী ব্যক্তির দেখা করতে আসার ঘটনা। পরবর্তী এক বছরের মধ্যে ভিঞ্চি সাত ফুটের ক্যানভাসে ছবিটির একটি রূপ দাঁড় করান। তবে চিরাচরিত লিওনার্দো কায়দায় তিনি ম্যাজাইর গতানুগতিক অর্থ বদলে তাকে নতুন রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেন। যীশু, মেরি ও ম্যাজাই ছাড়াও তিনি চিত্রে কিছু ছুটন্ত ঘোড়া ও ভীত মানুষ আঁকেন, যার কারণে সন্ন্যাসীরাও খুব প্রসন্ন ছিল না। উপরন্তু, তিনি ছবিটি অসমাপ্ত রেখেই মিলানে চলে যান। পরবর্তীতে এই ছবি পুনরায় আঁকেন ফিলিপিনো লিপ্পি। বর্তমানে দুটি ছবিই ফ্লোরেন্সের উফফিজি গ্যালারীতে রাখা আছে।
বেঞ্জামিন ওয়েস্টের ‘ট্রিটি অফ প্যারিস’
আমেরিকান বিপ্লবের শেষের দিকে সংশ্লিষ্ট দলগুলো চুক্তির সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা খুঁজছিল। তাই ১৭৮৩ সালে ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ, ডাচ ও ব্রিটিশদের সাথে আলোচনা শুরু করার জন্য জন এডামস ও বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিন সহ একটি মার্কিন প্রতিনিধিদল প্যারিসের দিকে রওনা হয়। এই আলোচনা আমেরিকানদের জন্য বিশাল সাফল্যের ছিল। তাই এই ঘটনাটি ছবিতে ধরে রাখতে ঐতিহাসিক চিত্রশিল্পী বেঞ্জামিন ওয়েস্টকে নিযুক্ত করা হয়। এখানে বাদ সাধে ব্রিটিশরা; ব্রিটিশ প্রতিনিধিরা তাদের ছবি আঁকার অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানায়। কেননা তারা মনে করছিল তাদের পরাজয় ছিল লজ্জাজনক। তাই ছবির যে জায়গাটিতে তাদের থাকার কথা ছিল সে জায়গাটি ফাঁকা রাখা হয়।
তবে তাদের না থাকায় ছবিটির মূল্য এতটুকুও কমেনি, বরং এই অর্ধ-সমাপ্ত চিত্রটি ম্যাসাচুসেটস এর অ্যাডামস ন্যাশনাল হিসটোরিক্যাল পার্কে এখনো শোভা পাচ্ছে।
পিয়েট মন্ড্রিয়ানের ‘ভিক্টোরি বুগি উগি’
মৌলিক রঙ ও আকৃতির মাধ্যমে শহরের নকশা ফুটিয়ে তোলার জন্য ডাচ শিল্পী পিয়েট মন্ড্রিয়ানের বিমূর্ত চিত্রগুলো বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। তাঁর সর্বশেষ কাজ ভিক্টোরি বুগি উগিতে নিউ ইয়র্কের সংগীতের প্রভাব প্রতিফলিত হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য, এই কাজটি শেষ করার আগেই মারা যান তিনি। ছবিটি মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকা ও তার মিত্রপক্ষের জয়ের প্রতি শিল্পীর বিশ্বাস ও উদ্যমের বহিঃপ্রকাশ ছিল।
১৯৯৮ সালে নেদারল্যান্ডের একটি মিউজিয়ামে থাকাকালীন চিত্রকর্মটির ৪০ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়, যখন প্রকাশ পায় সেই ডলার ডাচ সেন্ট্রাল ব্যাংক থেকে দেয়া হয়েছিল। এই ঘটনার ফলে প্রশ্ন ওঠে, আসলেও চিত্রকর্মটির দর ৪০ মিলিয়ন ডলার হতে পারে কি না।
পারমিজিয়ানোর ‘ম্যাডোনা উইথ দ্য লং নেক’
জিরোলামো ফ্রান্সেসকো মারিয়া ম্যাজোলা, পারমাতে জন্মগ্রহণের কারণে যিনি পারমিজিয়ানো নামে পরিচিত, ছিলেন ইতালির রেনেসাঁ যুগের চিত্রশিল্পী। পারমিজিয়ানো প্রসিদ্ধ ছিলেন তাঁর ‘ম্যানারিজম’ শৈলীর জন্য, যেখানে সৌন্দর্য ও লাবণ্য ফুটিয়ে তোলার জন্য কিছুটা অতিরঞ্জিত ও সম্প্রসারিত অনুপাতে চিত্র আঁকা হয়। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া কক্ষে মেরি ও যীশুর একটি ছবি আঁকার জন্য তিনি নিযুক্ত হন এবং ১৫৪০ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সেই ছবি অর্থাৎ ‘ম্যাডোনা উইথ দ্য লং নেক’ এর উপর কাজ করে গেছেন।
‘পারফেকশনিস্ট’ হিসেবে সুখ্যাত পারমিজিয়ানো ছবির খুঁটিনাটির দিকে নজর দিতে গিয়েই হয়ত ছবিটির কিছু অসম্পূর্ণতার দিকে তাঁর নজর পড়েনি। ছবিটিতে কেবল আকাশ ও থামই অসম্পূর্ণ ভাবে আঁকা নয়, সেইন্ট জেরোমির মূর্তির ডান কোণায় একটি ভাসমান পা-ও দেখা যায়।
এলিস নিলের ‘জেমস হান্টার ব্ল্যাক ড্রাফটি’
একটি চিত্রকর্ম কীভাবে অসমাপ্ত হয়েও সম্পূর্ণ হতে পারে তাঁর অন্যতম উদাহরণ আমেরিকার প্রতিকৃতি শিল্পী এলিস নিলের তেলচিত্র ‘জেমস হান্টার ব্ল্যাক ড্রাফটি’। এলিস নিল মনে করেন, তিনি যে আবেগ প্রকাশ করতে চান তা কেবল ছবিটির অসম্পূর্ণ রূপের মাধ্যমেই ফুটে উঠতে পারে। কেন ছবিটি অসম্পূর্ণ এর পেছনে বেশ দুঃখের একটি ঘটনা আছে। ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময়ে কাজের যোগ্য প্রশংসা না পাওয়া নিল প্রায়ই অপরিচিত লোকদের প্রতিকৃতি এঁকে দিতেন। ১৯৬৫ সালে তিনি জেমস হান্টারকে প্রতিকৃতি এঁকে দেবার আমন্ত্রণ জানান। ঐ সময়েই জেমস হান্টার জানতে পারেন ভিয়েতনাম যুদ্ধে যাওয়ার জন্য তার নাম মনোনীত হয়েছে। প্রতিকৃতি আঁকার প্রথম অধিবেশনে তার মনমরা ও চিন্তাযুক্ত চেহারা ধরা পরে।
প্রথম দিন নিল তার চেহারার অধিকাংশ এবং বাকী শরীরের আউটলাইন আঁকেন। কিন্তু হান্টার এরপর আর দ্বিতীয় অধিবেশনের জন্য কখনোই আসেনি। রহস্যজনকভাবে তার নাম ভিয়েতনাম যুদ্ধের সৈন্যদের স্মারকে আসেনি। এখনো পর্যন্ত তিনি কোথায় আছেন তা অজানা।
গিলবার্ট স্টুয়ার্টের ‘পোরট্রেইট অফ জর্জ ওয়াশিংটন’
নিজ সময়ের খ্যাতিমান প্রতিকৃতি শিল্পী গিলবার্ট স্টুয়ার্ট, মার্কিন প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে ইউরোপের রাজা-রানী সহ প্রায় এক হাজারেরও বেশি ব্যক্তির প্রতিকৃতি এঁকেছেন। তবে ইচ্ছাকৃতভাবে অসম্পূর্ণ রাখা জর্জ ওয়াশিংটনের প্রতিকৃতিটি তার সবচেয়ে বিখ্যাত শিল্পকর্ম। ১৭৯৬ সালে জর্জের স্ত্রী মার্থা, স্টুয়ার্টকে জর্জের এই ছবিটি আঁকতে বলেন। কিন্তু মুখ আর পেছনের পটভূমি আঁকার পর তিনি ছবিটি আঁকা বন্ধ করে দেন।
একজন ধুরন্ধর ব্যবসায়ীর মত স্টুয়ার্ট এই ছবিটি অসম্পূর্ণ রেখে দেন যাতে সেটি নিজে রেখে দিয়ে এর প্রতিলিপি তৈরী করে অর্থাৎ কপি করে তা বিক্রি করতে পারেন। তিনি এরপর এই ছবি প্রতিটি ১০০ ডলার করে বিক্রি করেন। প্রায় সত্তরের মত কপি তিনি বিক্রি করেন। জর্জ ওয়াশিংটনের এই ছবিটিই বর্তমানে ১ ডলারের বিলে দেখা যায়।
এলিজাবেথ শোমেটফের ‘আনফিনিশড পোরট্রেইট অফ রুজভেল্ট’
এলিজাবেথ কোনো এক কারণে প্রথমে ফ্রাংক্লিন ডি রুজভেল্টের প্রতিকৃতি আঁকতে চাননি। ব্যাপারটা তার জন্য পূর্বপরিকল্পিত ছিল না মোটেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এর মাধ্যমেই তিনি ইতিহাসে ছোট একটি জায়গা করে নিয়েছেন। ১৯৪৩ সালে প্রথমবার রুজভেল্টের একটি প্রতিকৃতি আঁকেন তিনি। কিন্তু সেটা মনঃপূত না হওয়ায় রুজভেল্টের তেজ ও বৈচিত্র্য ছবিতে ধারণ করতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে তিনি আবার ছবি আঁকতে আসেন।
সে সময়টায় রুজভেল্ট শারীরিকভাবে সুস্থ না হলেও ছবি আঁকাতে উৎসাহ প্রকাশ করেন। শোমেটফের ছবি আঁকা চলা অবস্থায় রুজভেল্ট হঠাৎ মাথা ব্যথার কথা বলেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই অজ্ঞান হয়ে পরে যান। তিনি ঐ মুহুর্তে স্ট্রোক করেন এবং পরে সেদিনই মারা যান। শোমেটফ পরবর্তীতে রুজভেল্টের আরেকটি সম্পূর্ণ প্রতিরূপ বা রেপ্লিকা তৈরী করেন। মূল ছবিটির একটি ফটোগ্রাফ তিনি নিউ ইয়র্ক ডেইলী নিউজের কাছে পঁচিশ হাজার ডলারে বিক্রি করেন। পরবর্তীতে তিনি অসম্পূর্ণ চিত্রকর্মটি লিটল হোয়াইট হাউজে দান করেন, যেখানে রুজভেল্ট মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
মাইকেল এঞ্জেলোর ‘দ্য এনটোম্বমেন্ট’
ক্রুশবিদ্ধের পর যীশুর মৃতদেহ কবরে স্থাপন করাকে চিত্রায়িত করে আঁকা অসম্পূর্ণ এই ছবিটি। রহস্যে ঘেরা ছবিটিতে নেই শিল্পীর স্বাক্ষর, বেশ কিছু চরিত্র গায়েব, এমনকি ছবিটি নিজেই কয়েক শতাব্দী নিরুদ্দেশ ছিল। তবে কাজটি যে মাইকেল এঞ্জেলোর এর আংশিক প্রমাণ হল রোমের সেন্ট অগাস্টিনো চার্চ কর্তৃক তাদের বেদীর প্যানেলে আঁকার জন্য নিযুক্ত হওয়া ও পরবর্তীতে চার্চের দেওয়া অর্থ ফেরত পাঠানো। দুর্ভাগ্যজনকভাবে চার্চ তাকে কী আঁকতে বলেছিল তার কোনো নথিপত্র পাওয়া যায় নি কিংবা মাইকেল এঞ্জেলোও কোথাও এই ছবির উল্লেখ করেনি।
কিন্তু কেন মাইকেল এঞ্জেলো ছবিটি শেষ করেননি? এটি নিশ্চিত যে ঐ সময়টায় তিনি রোম থেকে ফ্লোরেন্সের দিকে গিয়েছিলেন যেসময়ে ঐ ছবিটি পরিত্যক্ত হয়। এক ঘটনায় বলা হয়, তিনি সেখানে গিয়ে ‘ডেভিড’ নামে একটি ভাস্কর্য বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় চিত্রটি শেষ করা হয়নি। স্কটিশ একজন আলোকচিত্রী ও চিত্রশিল্পী রবার্ট ম্যাকফারসন এটি খুঁজে বের করার আগে ১৮৪৬ সাল পর্যন্ত এটির খোঁজ কেউ জানত না। কোনো এক কাজে বিনষ্ট করার উদ্দেশ্যে রাখা অনেকগুলো চিত্রকর্ম ঘাটতে গিয়ে তিনি এটি পান। এক ডলারে চিত্রটি কিনে নিয়ে দুই হাজার ডলারে ন্যাশনাল গ্যালারীর কাছে বিক্রি করেন।
লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ‘গ্র্যান ক্যাভেলো’
শেষ করব যে অসমাপ্ত কাজটি দিয়ে তা মূলত চিত্রকর্ম না, অসমাপ্ত একটি ঘোড়ার মূর্তি। যদিও ভিঞ্চি বিখ্যাত ছিলেন সহজেই আগ্রহ হারিয়ে যেকোনো কাজ পুরো না করার জন্য, তবে এক্ষেত্রে ব্যাপার একটু আলাদা। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত অসমাপ্ত মাস্টারপিস অসম্পূর্ণ থেকে যায় তাঁর খামখেয়ালির কারণে নয়, বরং তাঁর আওতার বাইরের কিছু পরিস্থিতির কারণে। পিতার সম্মানে মিলানের ডিউক, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চিকে একটি ঘোড়ার মূর্তির নকশা বানানোর কাজ দেন। ভিঞ্চি বারো বছর সেই মূর্তির উপর কাজ করেন। অবশেষে ১৪৯২ সালে ২৩ ফুট উচ্চতার মাটির তৈরী ঘোড়ার মডেল ‘গ্র্যান ক্যাভেলো’ উন্মোচন করেন।
অনেকেই এটিকে এখন পর্যন্ত তৈরী সৃষ্টিশীল কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম হিসেবে গণ্য করেন। কিন্তু ঘোড়ার ছাঁচটির উপর ব্রোঞ্জ দেওয়ার আগেই ফ্রান্স আর ইতালির মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। ডিউক তখন গ্র্যান ক্যাভেলোর জন্য বরাদ্দকৃত দুই লক্ষ পাউন্ড মূল্যের ধাতব পদার্থ সেনাবাহিনীকে দিয়ে দেন যা দিয়ে তৈরী হয় কামান। দ্য ভিঞ্চির এই বিশাল ঘোড়ার মূর্তিটি আর কখনোই গড়া হয়নি। বলা হয়, আক্রমণকারী ফ্রেঞ্চ তীরন্দাজরা মাটির ঐ মূর্তিটির উপর তীর চালনা অনুশীলন করত।