বাঙালির গর্ব হিসেবে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত জগতে নিরন্তর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে যাওয়া শিল্পীদের মধ্যে কৌশিকী চক্রবর্তী অন্যতম। ১৯৮০ সালের ২৪শে অক্টোবর কলকাতার এক বিখ্যাত সঙ্গীত পরিবারে জন্ম নেন কৌশিকী। তার পিতা পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী একজন বিখ্যাত শাস্ত্রীয় সংগীত শিল্পী। মা চন্দনা চক্রবর্তীও একজন স্বনামধন্য সংগীতজ্ঞ। পরিবারেই তার সঙ্গীতের শিক্ষা শুরু হয়। ছোটবেলা থেকেই কৌশিকী প্রভাবিত হয়েছেন বাবা অজয় চক্রবর্তী দ্বারা। পাশাপাশি সঙ্গীত প্রশিক্ষক হিসেবে পেয়েছেন মা চন্দনা চক্রবর্তীকে।
মাত্র দুই বছর বয়স থেকেই সঙ্গীতের প্রতি তার আগ্রহ প্রকাশ পেতে শুরু করে। কলকাতা রোয়িং ক্লাবে তারানা পরিবেশনের মাধ্যমে মাত্র সাত বছর বয়স থেকে তার সঙ্গীত জীবনের সূচনা হয়। দশ বছর বয়সে গুরু জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ মহাশয়ের অধীনে তার সঙ্গীত প্রশিক্ষণ শুরু হয়। উল্লেখ্য, গুরু জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ কৌশিকীর বাবা স্বয়ং পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীরও সঙ্গীত শিক্ষক ছিলেন। পরবর্তীতে কৌশিকী আইটিসি সঙ্গীত একাডেমিতে ভর্তি হন এবং এখান থেকে সাফল্যের সাথে ২০০৪ সালে সঙ্গীত প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেন।
আইটিসিতে থাকার সময় বাবা অজয় চক্রবর্তীর পাশাপাশি তৎকালীন আইটিসি সঙ্গীত একাডেমির পরিচালক বিজয় কিসলু মহাশয়ের তত্ত্বাবধানে খেয়াল গায়নে দক্ষতা অর্জন করেন। খেয়াল ও ঠুমরির পাশাপাশি তিনি দক্ষিণ ভারতীয় সঙ্গীতেও পারদর্শিতা অর্জন করেন। বালমুরলী কৃষ্ণের কাছ থেকে তিনি ২০০২ সাল থেকে দক্ষিণ ভারতীয় সঙ্গীতের পাঠ নেন।
সঙ্গীতের পাশাপাশি লেখাপড়ার ক্ষেত্রেও কৌশিকী এক অনবদ্য অনুপ্রেরণার নাম। ক্লাস ফোরে পড়ার সময় ভূগোলে ১০০ নম্বরের মধ্যে মাত্র পেয়েছিলেন ২। দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় নির্বাচনী পরীক্ষায় ইতিহাসে পেয়েছিলেন কেবল মাত্র পাস নম্বর। লেখাপড়া তার খুব একটা ভালো লাগত না। অথচ এই মানুষটিই দর্শনশাস্ত্রে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পাশ করবার সময় হয়েছিলেন প্রথম শ্রেণিতে প্রথম। সংগীতশাস্ত্রে তার দক্ষতা দেখে অনেক শিক্ষকই বলেছিলেন পড়াশোনাতে আর স্নাতকোত্তর না করে সঙ্গীতেই পূর্ণ মনোযোগ দিতে। কিন্তু কৌশিকী নিজের লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন। পড়ালেখায় অমনোযোগী একজন সাধারণ শিক্ষার্থীর মান থেকে নিজের চেষ্টায় আর পরিশ্রমে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ স্তরের পরীক্ষাগুলোতে অনবদ্য ফল করা তার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা আর স্থিরচিত্তের সাক্ষ্য বহন করে।
শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রখ্যাত শিল্পীদের সামনে তিনি সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন বিভিন্ন সময় এবং সমাদৃতও হয়েছেন প্রবলভাবে। কৌশিকী নিজে পাতিয়ালা ঘরানার হলেও অন্যান্য ঘরানার গান তিনি গেয়েছেন অসাধারণ মুনশিয়ানার সাথে। তার গায়কীতে রয়েছে অনন্য এক শৈলী। তন্ময়ভাবে তিনি শ্রোতাকে নিয়ে প্রবেশ করেন সুরের গভীরে। তাই গাইবার সময় সঙ্গীতের ঐন্দ্রজালিকের মতো তিনি এক অসাধারণ সুরের আবেশ সৃষ্টি করেন। শুধু খেয়াল নয়, ঠুমরী, তারানাসহ বিভিন্ন সেমিক্ল্যাসিকাল কম্পোজিশন নিয়ে তিনি কাজ করেছেন। সুরের বিভিন্ন চলনে তিনি তার রস পরখ করে দেখেছেন। পাতিয়ালা ঘরানার মধ্যে এই প্রজন্মে নারীশিল্পী হিসেবে তিনি ভীষণ অনুপ্রেরণার একজন নাম। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তার পেশাদারিত্ব, দক্ষতা আর গায়নশৈলীর চমৎকারিত্ব ধীরে ধীরে তাকে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জগতে দিচ্ছে অনন্য মাত্রা।
বিভিন্ন চলচ্চিত্রেও তিনি প্লেব্যাক করছেন। প্লেব্যাকে কৌশিকীর চলাটা শুরু হয়েছিল বাবা পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর হাত ধরেই। ২০০৫ সালে তিনি ‘ওয়াটার’ ছবিতে এ.আর. রহমানের সংগীতায়োজনে অজয় চক্রবর্তীর সঙ্গে নরসিং মেহতার লেখা ‘বৈষ্ণব জানা তু’ গানটি দিয়ে তার প্লেব্যাক শুরু। কিন্তু তাই বলে তিনি সস্তা জনপ্রিয়তার আশায় আর দশজনের মতো গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেননি। নিজেকে তৈরি করেছেন ধীরে ধীরে, কাজ করেছেন বেছে বেছে। তাই এর পরের ১০ বছরে তিনি প্লেব্যাক করেছেন মাত্র ১০টি চলচ্চিত্রে, যেগুলোর বেশির ভাগই বাংলা। যার মধ্যে জানি দেখা হবের ‘ফিরে যা রে মন যা’, পঞ্চ অধ্যায়-এর ‘রাহু তেরি পিছে’, হৃদ মাঝারের ‘উড়ে যায়’ উল্লেখযোগ্য। সুরকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানাভাবে তার বিভিন্ন রূপ দেখতে চেয়েছেন কৌশিকী সারাক্ষণ। কোক স্টুডিওতে তার আত্মপ্রকাশ মূলত সেই ভাবনা থেকেই। শান্তনু মৈত্রের সুরে অসাধারণ একটি সঙ্গীতদ্যোতনা সৃষ্টি হয়েছে কৌশিকীর কণ্ঠে। ‘লাগি লাগি’ নামের সেই গানটি ইউটিউবে দেখা হয়েছে প্রায় দেড় মিলিয়ন বার।
রবীন্দ্রসঙ্গীতেও কৌশিকীর আগ্রহ অপরিসীম। শ্রাবণী সেন, জয়তি চক্রবর্তীর সাথে তিনি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সঙ্গে মিলিয়েছেন রবিঠাকুরের বেশ কয়েকটি রাগভিত্তিক গানকে। এই ফিউশন কম্পোজিশনগুলোতে করা প্রত্যেকটি গান শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও রবীন্দ্রনাথের মেলবন্ধনকে ফুটিয়ে তুলেছে চমৎকারভাবে।
ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ইতিহাসে সর্বপ্রথম তিনি তৈরি করেছেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সঙ্গীত ব্যান্ড ‘সখী’। ২০১৫ সালের জানুয়ারির ২০ তারিখ কলামন্দিরে পরিবেশনার মাধ্যমে ‘সখী’র যাত্রা শুরু হয়। উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে, এ দলের প্রত্যেক সদস্যই নারী। তিনি তার এই স্বপ্নের প্রকল্প সম্বন্ধে বলেছেন,
“প্রত্যেক দেশের একটি ‘অল গার্ল মিউজিক ব্যান্ড’ আছে। আমাদের এখানে নেই। দেখুন, পশ্চিম থেকে আমরা অনেক কিছু শিখেছি। জিন্স পরতে শিখেছি, আধা ইংরেজি বলতে শিখেছি, কিন্তু মিউজিকালি ‘ওম্যানহুড’ সেলিব্রেট করা হয়নি কখনো। ‘সখী’ সেটার চেষ্টা করবে। আমরা মীরাকে যেমন করে সেলিব্রেট করেছি, সেরকমভাবে কার্টিজ্যানদের গান, নৃত্যকে কি সেলিব্রেট করেছি? করিনি। অথচ ঠুমরী, দাদরা এগুলো তো তাদের হাত ধরেই এসেছে।”
ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও ভারতীয় সঙ্গীতের নারী শিল্পীদের অনবদ্য ভূমিকা সর্বস্তরে সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যেই যেন এক অনবদ্য উদাহরণ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে এই সঙ্গীত দলটি। প্রাচীন শাস্ত্র মতে, গীত, বাদ্য ও নৃত্য- এই তিনের মিলিত মূর্ছনাকে সঙ্গীত বলে আখ্যা দেওয়া হয়। তাই কৌশিকী ‘সখী’কে শুধুমাত্র গানের একটি দল হিসেবে গড়ে না তুলে কণ্ঠসংগীত, যন্ত্রসংগীত এবং নৃত্য- এই তিনটির সমন্বয়ে পূর্ণাঙ্গ সঙ্গীত দল হিসেবে গড়ে তুলেছেন। ছয়জন শিল্পী এই দলে কাজ করছেন। কৌশিকী কণ্ঠসঙ্গীতে রয়েছেন, দেবপ্রিয়া চট্টোপাধ্যায় বাঁশি বাজাচ্ছেন, মহিমা উপাধ্যায় পাখোয়াজ বাদনে রয়েছেন, নন্দিনী শঙ্কর রয়েছেন বেহালাবাদক হিসেবে আর তবলায় আছেন সাওয়ানী তালওয়ারকর।
আজ থেকে অনেক অনেক বছর আগে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চর্চা ও বিকাশে যে সমস্ত নারী ভূমিকা রেখেছিলেন তাদেরকে সে সময়ে অপাংক্তেয় বলে গণ্য করা হতো। তাদের স্মৃতি ও কর্মের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এবং তাদের বিস্মৃতপ্রায় অতীত সঙ্গীতের সমৃদ্ধ শৈলী প্রকাশে ‘সখী’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে তিনি মনে করেন। তার ভাষায়,
“কার্টিজ্যানদের কথা ভুললে চলবে না। তারাই তো এই গানের স্রষ্টা। সমাজ তাদের শিল্পীর সম্মান দেয়নি। কখনো ভেবে দেখেছেন, খেয়ালে রচয়িতার নাম থাকে, কিন্তু ঠুংরি বা দাদরায় কেন সেটা থাকে না? আসলে কার্টিজ্যানরা জানতেন তাদের নামের কোনো গুরুত্বই নেই! এই রিজেকশন একজন মহিলা সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে আমি মেনে নিতে পারিনি। এবং এ কারণেই ‘সখী’র কথা ভেবেছি। একই প্ল্যাটফর্মে ‘রাধা’, ‘মীরা’, ‘দুর্গা’, ‘কার্টিজ্যান’-কে সম্মানের সঙ্গে অডিও ভিজ্যুয়ালি পারফর্ম করা হবে। এই গানটা ধরুন, ‘শ্যাম ভায় ঘনশ্যাম নেহি আয়ে আকেলি ডর লাগে’ … আমি একটা মেয়ে হয়ে ‘একেলি ডর লাগে’ যেভাবে বলবো, সেটা একজন পুরুষের পক্ষে বলা সম্ভব নয়। প্রচুর মেয়ে আজও গান শিখে হারিয়ে যায়, মঞ্চে পৌঁছতে পারে না। ‘সখী’ তাদের শিল্পকে প্যাশন দিয়ে ধরে রাখতে উৎসাহ দেবে। একটা প্ল্যাটফর্মটা তৈরি করবে।”
কৌশিকী চক্রবর্তী ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন আরেক শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পী পার্থসারথি দেশিকানের সঙ্গে। ব্যক্তিজীবনে তাদের একটি সন্তান রয়েছে। কৌশিকীর সঙ্গীতে সাফল্যের পেছনে স্বামী পার্থসারথি ভীষণ অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করেন। পাশাপাশি তার গান আরো নিখুঁত হওয়ার পেছনে তিনি একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে শুধু নন কাজ করেন একজন পরামর্শক-সমালোচক-শ্রোতা হিসেবে।
অসম্ভব বিনয়ী কৌশিকী সর্বদা বিনম্রচিত্তে তার গুরুদের কথা, তার জীবনে বাবা-মায়ের ভূমিকার কথা স্মরণ করেন। যতদিন গান গাইবেন ততদিন মানুষের হৃদয়ে প্রবল আন্তরিকতা ও শ্রদ্ধার আসন নিয়েই থেকে যেতে চান। চিরকাল গানের সংখ্যার চাইতে তিনি গানের মানের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে এসেছেন। সেরকমই থাকতে চান। দৃষ্টিনন্দন-শ্রুতিনন্দন কৌশিকী চক্রবর্তী তাই ক্রমে আত্মপ্রকাশ করছেন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সুরসম্রাজ্ঞী হিসেবে।
সহায়ক তথ্যপঞ্জি
- মুখোমুখি, আনন্দবাজার পত্রিকা ২৫ অক্টোবর, ২০১৪
- The blend of three ‘gharanas’, a musical experience beyond words, dnaindia.com. 14 February 2011
- Kaushiki Chakraborty’s Sakhi:Women in Indian Music, Carnegiehall Organization, 16 October 2015
- The Girl With The Runaway Taan: Tehelka Magazine, Vol 7, Issue 38, Tehelka Magazine. 25 September 2010
- Banerjee, Meena (29 May 2009). Thinking of khayal in Bengal, The Hindu
Feature Image: kaushikichakraborty.com