স্কটল্যান্ডের হরিণ শিকারের প্রাচীন ও জনপ্রিয় এক খেলা ‘ডিয়ার স্টকিং’। ওয়াল্টর স্কট থেকে শুরু করে প্রিন্স আলবার্ট– সবাই ছিলেন এই খেলার ভক্ত। স্যার ওয়াল্টার স্কটের লেখায় বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে রোমাঞ্চকর এই হরিণ শিকারের মুহূর্ত। মহারানী ভিক্টোরিয়ার স্বামী প্রিন্স আলবার্টও এই খেলায় বেশ উৎসাহী ছিলেন। কী এই খেলা? আধুনিক এ যুগেও কীভাবে চলছে এই প্রাচীন খেলা তাই জানাবো আপনাদের।
ডিয়ার স্টকিং কী?
‘ডিয়ার স্টকিং’ শব্দটি ইংরেজদের বহুল ব্যবহৃত একটি শব্দ। সাধারণত মাংসের জন্য বা নিছক খেলার উদ্দেশ্যে কিংবা হরিণ বা এ জাতীয় প্রাণীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে গেলে তা নিয়ন্ত্রণের জন্য নির্দিষ্ট কিছু শিকারকে টার্গেট করে সেই শিকারকে পায়ে পায়ে অনুসরণের যে পদ্ধতি তাকে ডিয়ার স্টকিং (Deer Stalking) বলে অভিহিত করা হয়।
কীভাবে সূত্রপাত হলো এই খেলার?
প্রাচীনকালে পাহাড়ী অঞ্চল বা বনভূমির কাছাকাছি বসবাস করা জনগোষ্ঠীগুলো তাদের উৎপাদিত ফসলের ক্ষয়ক্ষতি রোধে এবং ফসলের উৎপাদন যাতে কোনো পশুপাখির কারণে ক্ষতি না হয় সেজন্য এসব অঞ্চলে পশুপাখি শিকারের আয়োজন করা হতো। স্কটল্যান্ড ও তার আশেপাশের অঞ্চলের কৃষকদের ফসল সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে হরিণ শিকারের যে খেলাটি শুরু হয়েছিল, উনবিংশ শতকের দিকে এসে তা জনপ্রিয় খেলা হিসেবে পরিচিতি পেতে থাকে। ডিয়ার স্টকিং আর কিছুই নয়, হরিণের নিজস্ব আবাসেই চুপিসারে তাকে ধোঁকা দিয়ে শিকার করা। প্রাণবন্ত, রোমাঞ্চকর এক শিকারের খেলা, যার প্রতিটি স্তরেই রয়েছে তীব্র উত্তেজনাকর মুহূর্ত। ডালপালা ছড়ানো বিশাল শিং নিয়ে দাঁড়ানো বলশালী এক পুরুষ হরিণ আর তার সাথে স্কটল্যান্ডের পাহাড়ি অঞ্চলের মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এই খেলায় এনেছে এক বিশেষ মাত্রা।
স্কটল্যান্ডের মনোরম পাহাড়ি পরিবেশে ডিয়ার স্টকিংয়ের জনপ্রিয়তা
নৈসর্গিক পর্বতমালা, নিম্ন সমতলভূমি, বিস্তৃত বনাঞ্চলের কারণে স্কটল্যান্ড ও তার আশেপাশের অঞ্চলের মানুষদের হরিণ শিকারের এই প্রাচীন খেলায় বছরের পর বছর উদ্বুদ্ধ করে গেছে। শুধু স্কটল্যান্ডেই নয়, ইংল্যান্ডেও এ খেলা বেশ জনপ্রিয় ছিল। তবে এই খেলার সূত্রপাত ঘটেছিল স্কটল্যান্ডেই। ২০০৫ সালে ইংল্যান্ডে এই খেলা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলেও স্কটল্যান্ডে এখনো বেশ জনপ্রিয় এই খেলা।
স্কটল্যান্ডের পাহাড়ি অঞ্চলে বিস্তীর্ণ বনভূমি ঘিরে হরিণ শিকারের এই আদিম খেলা শতাব্দীর পর শতাব্দী চলে এসেছে। বড়সড় একটি হরিণের দলকে পাহাড়ের চূড়ার দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হতো। তারপর তীর-ধনুক বা ছররা-বন্দুকের সাহায্যে তাদের শিকার করা হতো। কেউ কেউ আবার শিকারের সুবিধার্থে ওই হরিণের দলটিকে লক্ষ্য করে বড়-বড় হাউন্ড কুকুর ছেড়ে দিতেন।
শিকার হওয়া হরিণের প্রকারভেদ
স্কটল্যান্ডে পাহাড়ি বনাঞ্চলে ছয় ধরনের হরিণের প্রজাতি দেখতে পাওয়া যায়- রেড ডিয়ার (Red Deer), রো ডিয়ার (Roe Deer), ফ্যালো ডিয়ার (Fallow Deer), সিকা ডিয়ার (Sika Deer), মুন্টজাক ডিয়ার (Muntjac Deer) এবং চাইনিজ ওয়াটার ডিয়ার (Chinese Water Deer)। তবে শিকারীদের কাছে রেড ডিয়ারের কদর সবচেয়ে বেশি।
মূলত ঝোপজঙ্গলের অধিবাসী হলেও রেড ডিয়ার পাহাড়ি জঙ্গলে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে। হরিণ অধ্যুষিত স্কটল্যান্ডের এরকম একেকটি জঙ্গলের আয়তন প্রায় দশ হাজার একর থেকে শুরু করে আশি হাজার একর অবধি হয়ে থাকে।
একশো একর জমিতে বড়জোর চারটি হরিণ-পরিবার বাস করতে পারে। আর ওসব জঙ্গলে হরিণের সংখ্যা নির্ধারণ করলে দেখা যায়, পুরুষ ও স্ত্রী-হরিণের সংখ্যার অনুপাতে খুব একটা বেশি হেরফের ঘটে না। বুনো পুরুষ হরিণ সাধারণত ১২-১৩ বছরের মধ্যে পূর্ণবয়স্ক যুবকে পরিণত হয়। তখনই তার মাথাটা দেখতে সবচেয়ে সুন্দর হয়।
ডালপালা ছড়ানো সতেজ শিং গজিয়ে ওঠা বলশালী এক পুরুষ হরিণের মাথা শিকারীদের প্রধান লক্ষ্য। শিকারীরা সবসময় এদেরই খোঁজ করে বেড়ায়। এসব পুরুষ হরিণ উঁচু জমিতে গিয়ে জোটবদ্ধ হয়ে থাকে। মাঝে মাঝে এরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে। তখন পাহাড়ের অনেক দূরেও এসব রাগী যুবক হরিণের গর্জন শোনা যায়।
নিয়ম
হরিণ শিকারের এই খেলায় প্রথমেই যা দরকার, তা হলো হরিণের আচার-আচরণ সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান। শিকারী দলটিকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জেনে নিতে হবে হরিণ কীভাবে থাকে, কোথায় থাকে, কোন অবস্থায় কেমন আচরণ করে। ডিয়ার স্টকিংয়ে সাধারণত একদল শিকারি থাকেন। এই দলের নেতৃত্ব দেন এমন একজন, যিনি গোটা অঞ্চলটা ভালোভাবে চেনেন, জঙ্গলের এই অঞ্চলের হরিণদের সব সুলুকসন্ধান যার নখদর্পণে। প্রচলিত ভাষায় তাকে ‘গিলি’ বলা হয়।
শিকারী নিজের উপস্থিতি হরিণকে বিন্দুমাত্র আঁচ করতে না দিয়ে, তাকে পেছন পেছন অনুসরণ করেন। গিলিরা দূরবীন দিয়ে দেখেন কোথায় হরিণের পাল চরে বেড়াচ্ছে। হরিণের দলটিকে ভালো করে দেখে তাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, এখানে শিকারের উপযোগী কোনো যুবক-হরিণ আছে কি না।
‘স্টকার’ বা জঙ্গলের পরিবেশে দক্ষ শিকারিরা দূরে থেকে হরিণের চোখকে ফাঁকি দিতে পারেন। হরিণের দল অধিকাংশ সময়েই খুব দূরের জিনিস ঠাহর করতে পারে না। কিন্তু হরিণের ঘ্রাণেন্দ্রিয় বেশ প্রখর। আধা মাইলেরও বেশি দূরে কোনো মানুষ থাকলে বাতাসে ঘ্রাণ শুঁকেই হরিণ সেই মানুষের অস্তিত্ব টের পেয়ে যায়। সুতরাং, যেদিকে বাতাস বইছে, স্টকারকে দাঁড়াতে হয় তার উল্টো দিকে। হরিণরা সাধারণ বড় বড় ‘কোরিস’ (Corries) বা ফাঁকা জায়গায় শুয়ে থাকে, সেখানে সবদিক দিয়েই বাতাস হু-হু করে ছুটে আসে। এসব জায়গায় হরিণকে বাগে পাওয়া বেশ শক্ত। পরিবশে যখন অনুকূল থাকে, তখনই স্টকার সুযোগ বুঝে তার শিকার করতে উদ্যত হয়।
হরিণ শিকারের এই খেলা ইংল্যান্ডে নিষিদ্ধ হলেও স্কটল্যান্ডে এখনো রমরমিয়ে চলছে। এই খেলার কারণে যাতে হরিণের সংখ্যা কমে না যায় সেজন্য স্কটল্যান্ডের পাহাড়ি অঞ্চলে হরিণের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য হরিণ পালনের বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে বর্তমানে এই খেলায় এসেছে বেশ কিছু পরিবর্তন। এই খেলার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে কোন ধরনের হরিণ শিকার করা হবে আর কোন ধরনের নয়। শুধুমাত্র বছরের একটি বিশেষ সময়ে এই খেলার আয়োজন করা হয়। পশুপ্রেমিক বিভিন্ন সংগঠন এখনো এই নিষ্ঠুর খেলা বন্ধের বিরুদ্ধে প্রচার প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে।
ফিচার ইমেজ- jeremyhanarays.co.nz