১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট পৃথিবী দেখেছিল এক নতুন অস্ত্র- পারমাণবিক বোমা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একেবারে শেষের দিকে জাপানের হিরোশিমাতে পারমাণবিক বোমা ফেলে আমেরিকা। এর ঠিক তিনদিন পরেই আরেকটি বোমা ফেলে নাগাসাকিতে। ইতিহাসে এখন পর্যন্ত এই দুবারই পারমাণবিক বোমা হামলার ঘটনা ঘটলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই সবাই ভয়ে থাকে, এই না বুঝি শুরু হলো পারমাণবিক যুদ্ধ।
বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা আর সোভিয়েত ইউনিয়নের মাঝে চলা স্নায়ুযুদ্ধের কল্যাণে বেশ কয়েকবারই আশঙ্কা ছিল পরমাণু যুদ্ধের। সাম্প্রতিক সময়ে সিঙ্গাপুরে আমেরিকা ও উত্তর কোরিয়ার শীর্ষ নেতৃত্বের বৈঠকের পর উত্তেজনা প্রশমিত হলেও মাসখানেক আগেও দুই দেশের উত্তপ্ত রাজনৈতিক সম্পর্কের কারণেও আরেকবার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছিল পরমাণু যুদ্ধের। হিরোশিমা আর নাগাসাকির বোমা দুটি ছিল একেবারে প্রথম জেনারেশনের। এতদিনে অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্রের সাথে পারমাণবিক বোমারও যথেষ্ট উন্নতি ঘটেছে। কিন্তু হঠাৎ করে যদি কেউ পারমাণবিক হামলা চালায়, তাহলে কী হবে পৃথিবীর পরিণতি?
পারমাণবিক যুদ্ধের পরিণতি দেখার আগে শুরুতে জেনে নেয়া যাক কোন কোন দেশের পারমাণবিক অস্ত্রের সমাহার কী রকম। ম্যানহাটন প্রজেক্টের মাধ্যমে আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে প্রথম পারমাণবিক বোমা তৈরি করে। এরপর সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমানে রাশিয়া), ফ্রান্স, চীন, যুক্তরাজ্য, ভারত, পাকিস্তান ও উত্তর কোরিয়ার রয়েছে পারমাণবিক অস্ত্র। এর বাইরে ইসরাইল স্বীকার না করলেও তাদের কাছেও যে পারমাণবিক অস্ত্র আছে সেটি প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। এছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে আশির দশকে পারমাণবিক বোমা থাকলেও ‘৯০ এর দশকে সেগুলো ধ্বংস করে ফেলে। তবে অনেকেই ধারণা করে থাকেন, দক্ষিণ আফ্রিকার পারমাণবিক বোমাগুলো ছিল ইসরায়েলের সহায়তায় পরীক্ষা ও তৈরি করা। এর বাইরে তুরস্ক, ইতালি, নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম ও জার্মানিতে রয়েছে আমেরিকার পারমাণবিক বোমা।
পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা নিয়ে মূল প্রতিযোগিতা ছিল আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মাঝে, সেই স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে। ষাটের দশকে আমেরিকার কাছে ত্রিশ হাজার আর সোভিয়েতের কাছে মাত্র হাজার খানেক পারমাণবিক ওয়ারহেড ছিল। কিন্তু পরের বছরগুলোতে সোভিয়েত দ্রুত তাদের পারমাণবিক অস্ত্র বাড়াতে থাকে, যা আশির দশকের শেষে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রায় চল্লিশ হাজারে! তবে পারমাণবিক যুদ্ধ নিয়ে সবাই সচেতন হতে শুরু করায় আশির দশক থেকেই পারমাণবিক ওয়ারহেডের সংখ্যা কমাতে থাকে আমেরিকা। আর সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটার পরে রাশিয়া ও আমেরিকা উভয়েই তাদের ওয়ারহেডের সংখ্যা অর্ধেকের বেশি কমিয়ে গেলে। অন্যরা ষাটের দশক থেকেই নিজেদের পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলেও রাশিয়া ও আমেরিকার মতো প্রতিযোগিতায় নামেনি কেউই। ফলাফলস্বরূপ, আমেরিকা ও রাশিয়া বাদে অন্যান্যদের পারমাণবিক ওয়ারহেডের মোট সংখ্যা রাশিয়া কিংবা আমেরিকার বর্তমান ওয়ারহেডের সংখ্যার প্রায় সাত ভাগের এক ভাগ!
এবার আসা যাক যদি পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে যায় তাহলে পৃথিবীর পরিণতি নিয়ে। বর্তমানে আমেরিকার রয়েছে সাত হাজার নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড আর রাশিয়ার সাত হাজারের সামান্য কম। উভয় দেশেরই রয়েছে আন্তঃমহাদেশীয় মিসাইল অর্থাৎ রাশিয়ার মিসাইল আমেরিকায় ও আমেরিকার মিসাইল রাশিয়ায় আঘাত হানতে সক্ষম। অন্যান্যদের সক্ষমতা রাশিয়া কিংবা আমেরিকার মতো না হলেও প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য হুমকিস্বরূপ। বর্তমান প্রযুক্তিতে ১৯৪৫ সালের মতো বিমান নিয়ে বোমা ফেলতে হয় না, বরং দেশে থাকা মিসাইল সিলো কিংবা নৌবাহিনীর জাহাজ বা সাবমেরিন থেকেও মিসাইল ছোড়া যায়।
পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলোর একটিও যদি তার শত্রুর দিকে মিসাইল ছোড়ে তাহলে খুব স্বাভাবিকভাবেই এর জবাব পাবে সাথে সাথেই। আর পারমাণবিক যুদ্ধের শুরুটাও হবে এভাবেই। পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের পর প্রথম আঘাতটা হবে শকওয়েভ আর উত্তাপের। এর ফলেই বোমার সক্ষমতার উপর নির্ভর করে কয়েক মাইল থেকে কয়েকশ মাইলে ব্যাসার্ধের অধিকাংশ জীবিত প্রাণী ও গাছ মারা যাবে। যেসব প্রাণী ও গাছ বেঁচে যাবে তাদের জন্য অপেক্ষা করবে তেজস্ক্রিয়তার ভয়াবহতা। তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে শরীরের ডিএনএ পাল্টে যাবে, দেখা দেবে ভয়াবহ সব রোগ আর সেগুলো থেকেও যদি বেঁচে যায় কেউ তাহলে ভয়াবহতা অপেক্ষা করবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। কয়েক প্রজন্ম পর্যন্ত বহন করতে পারে তেজস্ক্রিয়তার ভয়াবহতা।
পারমাণবিক যুদ্ধের সবচেয়ে সেরা দৃশ্যকল্প (Best case scenario) হতে পারে শুধুমাত্র একটি দেশ মিসাইল ছুড়লো আর অন্যরা ছোড়ার সুযোগই পেল না। এ অবস্থায় পৃথিবীর পরিণতি কী হতে পারে সেটি নিয়ে গবেষণা করেছে মিশিগান টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটির একটি দল, যার নেতৃত্বে ছিলেন জশুয়া পিয়ার্স। তাদের হিসেবে, যে দেশ মিসাইল ছুড়েছিল প্রতিপক্ষের দিকে, সেই দেশেরই কয়েক লক্ষ মানুষ মারা যাবে প্রতিপক্ষের কোনো প্রতি আক্রমণ ছাড়াই! আর এর কারণ তেজস্ক্রিয়তা নয়, বরং একটি হামলার ফলে পুরো পৃথিবীর পরিবেশে যে পরিবর্তন আসবে সেটিতেই।
প্রতিপক্ষের জন্য ছোঁড়া মিসাইল কার্যকর হবার পরপরই পুরো এলাকার পরিবেশ বিপর্যস্ত হবে। আর বর্তমানে দেশগুলোর কাছে যে পরিমাণ পারমাণবিক অস্ত্র আছে তাতে পুরো এলাকা ছেয়ে যাবে কালো ধোঁয়া আর ছাইয়ে। ফলাফলস্বরূপ, পুরো পৃথিবীর তাপমাত্রা কমে যাবে কয়েক ডিগ্রি, কমে যাবে বৃষ্টিপাত, ভয়াবহ ক্ষতিগ্রস্থ হবে পুরো পৃথিবীর কৃষি ব্যবস্থা। আর বাতাসে বয়ে আসা তেজস্ক্রিয়তার ফলও ভোগ করতে হবে হামলার পাশ্ববর্তী এলাকাগুলোকে। এই গবেষক দল একপক্ষীয় আক্রমণের ভয়াবহতা বোঝানোর জন্য উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করেছেন তাদের দেশেরই পরিসংখ্যানকে।
তাদের তৈরি সিমুলেশন মডেল অনুযায়ী, আমেরিকার হাতে রয়েছে সাত হাজার পারমাণবিক ওয়ারহেড। আমেরিকা এর সবগুলো নিয়েই যদি একবারে প্রতিপক্ষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাহলে এর ফলে পুরো পৃথিবীতে সৃষ্টি হবে প্রায় ৩০ ট্রিলিয়ন গ্রাম ছাইয়ের। এর ফলে পুরো পৃথিবী ছেয়ে যাবে অন্ধকারে, সৃষ্টি হবে ‘নিউক্লিয়ার উইন্টারের’। আর এর ফলে মারা যাবে অন্তত ৫০ লক্ষ আমেরিকান। অর্থাৎ আমেরিকা মিসাইল ছুড়ে কোনো প্রতি আক্রমণ ছাড়াই ৫০ লক্ষ মানুষ হারাবে। যদি আমেরিকা তাদের সব ওয়ারহেড ব্যবহার না করে ১,০০০ ওয়ারহেড দিয়ে হামলা করে তাহলে সৃষ্টি হবে ১২ ট্রিলিয়ন গ্রাম ছাইয়ের। এর ফলে মারা যাবে প্রায় দেড় লাখ আমেরিকান। তবে যদি মাত্র ১০০টি ওয়ারহেড ব্যবহার করে তাহলে সৃষ্টি হবে ৪ ট্রিলিয়ন গ্রাম ছাইয়ের আর এর ফলস্বরূপ কোনো আমেরিকান মারা যাবে না।
তবে এই হিসেবগুলো শুধুমাত্র পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণে মারা যাবার। খুব স্বাভাবিক যে পরিবেশগত বিপর্যয়ের ফলে কৃষি, যোগাযোগ, নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। এর ফল পড়বে সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতেও। সরকার বিরোধীরা মাথা চাড়া উঠতে পারে, যেখানে সেখানে দাঙ্গা লাগতে পারে, যারা এত দুর্যোগের পরেও বেঁচে থাকবে তারা নিজেদের মধ্যেই খাবারের জন্য মারামারি করতে পারে। এর ফলে মোট নিহতের সংখ্যা যে এই সিমুলেশনের থেকে কয়েকগুণ বাড়বে তাতে কোনো সন্দেহ নেই এই গবেষকদের নিজেদেরই।
মিশিগানের এই গবেষক দলের উদাহরণের বাইরে গিয়ে যদি ভারতীয় উপমহাদেশের কথা চিন্তা করা হয় তাহলেও পারমাণবিক যুদ্ধের ভয়াবহতা বোঝা যায়। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান জন্মের পর থেকেই একে অপরের সাথে সম্পর্ক খারাপ। আবার দুই দেশই পারমাণবিক শক্তিধর। যদি ভারত পাকিস্তানে কিংবা পাকিস্তান ভারতে হামলা চালায় আর অপর দেশটি পাল্টা হামলা না-ও চালায়, তাতেও যে হামলা চালাবে সে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। কারণ পাশাপাশি অবস্থানের কারণে খুব সহজেই তেজস্ক্রিয়তা ও পরিবেশগত বিপর্যয় উল্টো নিজের ধ্বংস বয়ে নিয়ে আসবে।
এই হিসেবগুলো শুধুমাত্র একপক্ষীয় হামলার ক্ষেত্রে করা। সে হিসেবেই এত হতাহত, সেখানে যদি পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলো সবাই মিলে যদি একসাথে হামলা চালায় তাহলে কী পরিমাণ বিপর্যয় নেমে আসবে পৃথিবীর বুকে সেটা আন্দাজ করতে কোনো গবেষক হতে হয় না। বর্তমানে সবগুলো দেশের মোট পারমাণবিক ওয়ারহেডের সংখ্যা সব মিলিয়ে ১৫ হাজারের মতো। পরিবেশগত বিপর্যয় ছাড়াও তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব তো রয়েছেই।
চেরনোবিল দুর্ঘটনার পর কয়েক দশক কেটে গিয়েছে, অথচ সেখানে এখনো বসবাসের যোগ্য পরিবেশ ফিরে আসেনি। ইতিহাসের শুরু থেকেই মানুষ প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য যুদ্ধের আয়োজন করছে, নিজেদের যুদ্ধাস্ত্রের উন্নতি করছে। কিন্তু পারমাণবিক অস্ত্র এমন এক অস্ত্র, যা শুধু শত্রুকেই শেষ করবে তা নয়, বরং নিজের দেশের জন্যই ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। অথচ পারমাণবিক অস্ত্রের গবেষণা আর রক্ষণাবেক্ষণে প্রতিবছর দেশগুলো খরচ করছে প্রচুর অর্থ। এ অর্থ যদি মানবকল্যাণে ব্যয় হতো তবে যুদ্ধের হয়তো আর দরকারই হতো না। বিশ্ব নেতৃত্ব এ সহজ কথাটি যত দ্রুত বুঝতে পারবে তত দ্রুত নিজেদেরই মঙ্গল নিয়ে আসবে।