মিরপুর শেরে বাংলার সংবাদ সম্মেলনে এসেছেন রশিদ খান। ইংরেজিটা বুঝলেও, বলতে পারেন না। সমস্যা নেই, সামলে নেবেন মিডিয়া ম্যানেজার। বাংলাদেশি সাংবাদিকদের কাছ থেকে যখন প্রশ্ন ছোঁড়া হচ্ছে তার কাছে, তিনি উত্তর দিচ্ছিলেন পাশতু ভাষায়। কখনও কখনও প্রশ্ন না বুঝলে তাকাচ্ছিলেন মিডিয়া ম্যানেজারের দিকে। তিনি পাশতুতে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন সবকিছু। রশিদও উত্তর দিচ্ছিলেন পাশতু ভাষায়। সেটাকে আবার ইংরেজিতে অনুবাদ করে সাংবাদিকদের জবাব দিচ্ছিলেন আফগানিস্তানের মিডিয়া ম্যানেজার। এতকিছু করতে গিয়ে স্বভাবতই দীর্ঘায়িত হচ্ছিলো রশিদের সংবাদ সম্মেলন। ব্যাপারটা তাকেও হতাশ করছিল বলে মনে হয়। কিন্তু সংবাদ সম্মেলনে চেয়ারে বসে কাজটা তার কাছে যতই কঠিন হোক না কেন, মাঠের পারফরম্যান্সে প্রতিপক্ষকেই হতাশ করতে পছন্দ তার।
ক’দিন আগে বাংলাদেশের বিপক্ষে দেরাদুনের রাজীব গান্ধী আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে বাংলাদেশকে ৩-০ তে সিরিজ হারিয়েছে রশিদের আফগানিস্তান। সেখানে ৩ ম্যাচে সর্বোচ্চ ৮ উইকেট একাই তুলে নিয়েছেন এই লেগস্পিনার। তার বিপক্ষেই সত্যি বলতে সিরিজ হেরেছেন সাকিব আল হাসানরা। কদিন আগে শেষ হওয়া ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদের হয়ে খেলেছেন। সেখানে ১৭ ম্যাচে নিয়েছেন ২১ উইকেট, যা আসরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
ক’দিন পরই ভারতের মাটিতে ভারতের বিপক্ষে নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম টেস্ট ম্যাচটি খেলতে নামবে আফগানিস্তান। যুদ্ধাহত একটি দেশ বোমা-বুলেটকে জয় করেছিল কেবলই ক্রিকেট দিয়ে। খুব অল্প সময়ে দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়ানো আফগানিস্তান ক্রিকেট দল টেস্ট স্ট্যাটাস পেতেও খুব দেরি করেনি। নিজেদের ঐতিহাসিক টেস্ট ম্যাচের সামনে দাঁড়িয়ে রোমাঞ্চিত দলের অন্যতম ‘তুরুপের তাস’ রশিদ। ফলাফল যা-ই হোক, এমন ভাবনা নেই তার। বিশ্বকে দেখিয়ে দিতে চান তারাও টেস্ট খেলার যোগ্য। স্বপ্ন দেখেন, একদিন বড় দলগুলোও নিজে থেকেই তাদের বিপক্ষে সাদা পোশাকের এই ক্রিকেটীয় রণকৌশল দেখতে চেয়ে একসঙ্গে খেলবে।
সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে নিজের ক্যারিয়ার, টেস্ট ক্রিকেট নিয়ে কথা বলেছেন আফগানিস্তানের হয়ে ৪৪ ওয়ানডে ম্যাচে ১০০ উইকেট ও ৩৩ টি-টোয়েন্টিতে ৫৭ উইকেট নেওয়া এই ১৯ বছর বয়সী ক্রিকেটার রশিদ। রোর বাংলার পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হলো।
প্রথমে যে প্রশ্নটা করতে চাই, সেটা হলো আপনি কি শচীন টেন্ডুলকারের টুইট দেখেছেন? যেখানে আপনাকে উনি টি-টোয়েন্টিতে সেরা বোলার হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যদি দেখে থাকেন, তাহলে প্রথমবারের মতো এমন একজন কিংবদন্তির কথা শুনে কেমন লেগেছে?
রশিদ খান: সবচেয়ে অবিশ্বাস্য হলো, আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করছেন, ‘আমি দেখেছি কিনা’। আমার মনে হয় না এখনও এমন কোনো ক্রিকেটপ্রেমী বাকি আছে যে তাঁর টুইট দেখেননি।
আমি যখন কলকাতায় ম্যাচ শেষ করলাম (আইপিএলে) তখন হোটেলে ফেরার পথে বাসে উঠেই মোবাইল চালু করি। শুরুতেই আমার কিছু বন্ধুর মেসেজ পাই। তারা আমাকে ঐ টুইটের স্ক্রিনশট পাঠিয়েছিল। আমি দেখলাম, শচীন আমাকে নিয়ে টুইট করেছেন। আমার মনে হয় ওই সময়টা আমার সেরা মুহূর্ত ছিলো। এটা আমাকে অনেক বেশি উৎসাহ দিয়েছে। আমি ঐ টুইট দেখার পর ২-৩ ঘণ্টা কেবল ওটা নিয়েই ভাবছিলাম কী উত্তর দেবো তা নিয়ে। কারণ তার মতো ক্রিকেটার পৃথিবীতে আর আসবে কি না জানা নেই। তার মতো একজন ক্রিকেটারের কাছ থেকে প্রশংসা পাওয়া আমার জন্য অনেক বড় ব্যাপার।
শচীন টেন্ডুলকারকে বল করা প্রত্যেক বোলারের স্বপ্ন। কিন্তু আপনি এমন একটা সময় জন্মেছেন, যখন আর তাকে প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে বল করা সম্ভব নয়। এটা আপনাকে হতাশ করে?
রশিদ খান: তাকে বল করতে পারলে খুব খুশি হতাম। আমি মনে করি তার উইকেট নেওয়া অনেক বড় ব্যাপার হতো। কিন্তু হ্যাঁ, উইকেটের চেয়েও বড় কথা হলো তাকে বল করা প্রতিটি ক্রিকেটার, প্রতিটি বোলারের স্বপ্ন। সেক্ষেত্রে আমি খানিকটা দুর্ভাগাই বটে। কারণ তাকে বল করার সৌভাগ্য আমার হলো না।
আপনি শহীদ আফ্রিদিকে রোল মডেল মানেন। সম্প্রতি আপনি তার সঙ্গে লন্ডনে একটি প্রীতিম্যাচ খেলেছেন। তার সাথে কি নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে কোনো আলাপ হয়েছে?
রশিদ খান: শহীদ ভাই ও অনিল কুম্বলে আমার প্রিয়। আমি তাদের খেলা খুব দেখতাম। তাদের বোলিং খুব পছন্দ আমার। আফ্রিদির সঙ্গে আমি কেবল বিশ্ব একাদশে একটি ম্যাচ খেলেছি। তার সাথে আমার কথা হয়েছে। শুরুতেই আইপিএলে আমার সফলতার জন্য আমাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। খুব খুশি হয়েছেন। তিনি বলেছেন, “তোমার পারফরম্যান্সে আমি খুশি। এটা ধরে রাখো। ভবিষ্যতে তুমি আরও সাফল্য পাবে, এই আশা করি।”
তিনি আমাকে অনেক সম্মান দিয়েছেন। আমাদের মধ্যে অনেক ভালো বিষয় নিয়ে কথা হয়েছে। সময় অল্প ছিল, কিন্তু ভালো ছিলো। আমি খুশি তার দেখা পেয়ে, কথা বলে।
ক’দিন পরই আপনাকে আমরা সাদা পোশাকে লাল বল হাতে বল করতে দেখব। এখন পর্যন্ত সাদা বলে আপনি সফল। তো, সাদা বলের ফরম্যাটে খাপ খাওয়াতে নিজের বোলিংয়ে কী ধরনের পরিবর্তন আনছেন?
রশিদ খান: জানি না আসলে। আমি যেকোনো কিছু পরিবর্তন করতে পারি। তাছাড়া আমি যদি বলের গতি যদি আরও বাড়াই, সেটা কাজে দেবে না। এটা করতে গেলে ব্যর্থ হবো। তাছাড়া আমি আমার হাতের কাজ আর গতি দিয়েই ব্যাটসম্যানকে বিপদে ফেলি। আমি মনে করি আমাকে এটাই চালিয়ে যেতে হবে। কেবল ভালো জায়গায় লেন্থ ঠিক রেখে বল করতে হবে। যে ফরম্যাটই হোক, খেলাটাকে উপভোগ করতে হবে। আপনাকে নিজের দক্ষতার উপর বিশ্বাস রাখতে হবে। তাহলেই আপনি খেলাটা উপভোগ করতে পারবেন।
নিজেদের অভিষেক টেস্ট ম্যাচ খেলতে যাচ্ছেন ভারতের বিপক্ষে। কিন্তু সেই ম্যাচে নেই বিরাট কোহলি। ঐতিহাসিক ম্যাচে তাকে না পাওয়াটা কি হতাশাজনক?
রশিদ খান: টেস্ট ক্রিকেটেও তাকে বল করতে পারলে ভালো লাগতো। এই মুহূর্তে সে বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যান। তবে আমার মনে হয়, বিশ্বমানের আরও কিছু ব্যাটসম্যান এই মুহূর্তে ভারতীয় দলে আছে। লোকেশ রাহুল আছে। রোহিত শর্মাকে আমি এই তালিকায় রাখছি না। তবে শিখর ধাওয়ান, আজিঙ্কা রাহানে, চেতেশ্বর পূজারার মতো ব্যাটসম্যানরা ভারত দলে আছে। তাদেরকে বল করতে ভালো লাগবেই। আমি টেস্ট ম্যাচটির জন্য মুখিয়ে আছি। অনেক রোমাঞ্চকর একটা ম্যাচ হবে।
প্রথমবারের মতো টেস্ট ক্রিকেট খেলছেন, আবেগটা মুখে বলতে পারবেন?
রশিদ খান: এই দিনটি আমাদের পুরো জাতির জন্য, দেশের জন্য, ক্রিকেটারদের জন্য। সত্যি বলতে আমরা সবাই ম্যাচটির জন্য মুখিয়ে আছি, অপেক্ষা করতে কষ্ট হচ্ছে। রোমাঞ্চকর একটা দিন হবে, আমরা কেবল ক্রিকেটার নয়; আফগানিস্তান দেশের নাগরিক হিসেবেও রোমাঞ্চিত। তো আকাঙ্ক্ষিত দিনটি আসবে, আমরাও নিজেদের সেরাটা অর্থাৎ, শতভাগ দিয়ে চেষ্টা করবো ভালো করার, দেশকে গর্বিত করার। ফলাফল যা-ই হোক, আমরা আমাদের সেরাটা দিতে চাই এবং পুরো বিশ্বকে দেখাতে চাই আমরা টেস্ট ম্যাচ খেলার যোগ্যতা রাখি। ইনশাআল্লাহ, দলের উপর আমার পূর্ণ বিশ্বাস আছে। ফিল্ডিং, ব্যাটিং, বোলিং- তিন বিভাগেই আমাদের মেধাবী ক্রিকেটার আছে। আশা করি তারা কেউ নিরাশ করবে না।
আফগানিস্তানের বিপক্ষে ক্রিকেটের অন্যান্য পূর্ণ সদস্য দেশগুলো নিয়মিত টেস্ট খেলবে, সে ব্যাপারে আপনি কতটা আত্মবিশ্বাসী?
রশিদ খান: বড় দলগুলোর বিপক্ষে লঙ্গার ভার্সনে খেলাটা অনেক ভালো ও বড় ব্যাপার। কিন্তু এখন যদি আপনি ক্রিকেটের আন্তর্জাতিক সূচি দেখেন, তাহলে টের পাবেন পুরোটাই লম্বা শিডিউল। এর মধ্যে ম্যানেজ করে ম্যাচ আয়োজন করা কঠিন ব্যাপার। আমরা কেবলই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সংস্থার (আইসিসি) পূর্ণ সদস্য হলাম টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার মধ্যে দিয়ে। আমি আশাবাদী, অবস্থানটা পরিবর্তন হবে। আমাদের ব্যাপারে ধীরে ধীরে আগ্রহ বাড়বে সবার। ধরুন, এক বছরে আমরা ২-৩টি টেস্ট ম্যাচ খেললাম। প্রতি বছরে এটা বাড়বে।
এটা বছরে ৫-৬ টেস্ট হবে, সেখান থেকে বছরে ১০ টেস্ট হবে। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম। বড় দলগুলোর বিপক্ষে খেলতে পারলে আমরা অনেক খুশি হবো, আনন্দিত হবো। কিন্তু এই মুহূর্তে সূচির মধ্যে থেকে সময় বের করা একটু কঠিন কাজ। তারপরও আশাবাদী, ভবিষ্যতে সূচিতে খানিকটা ব্যবধান থাকবে যেন আমরা ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, শ্রীলঙ্কা, নিউজিল্যান্ড, পাকিস্তানের মতো দলগুলোর বিপক্ষে টেস্ট খেলতে পারবো।
আমরা আসলে যেকোনো দলের বিপক্ষে খেলতে চাই। টেস্ট ম্যাচ খেলা স্পেশাল ব্যাপার।
ফিচার ইমেজ- Wisden