বিরান মরুভূমির মাঝে অচেনা এক পাহাড়ের ওপর একাকী দাঁড়িয়ে এক সময়ের যুবরাজ আর এখন মেষপালক মুসা (আ) অবাক হয়ে আবিষ্কার করলেন, বিশ্বজগতের স্রষ্টা তার সাথে কথা বলছেন!
পূর্বের পর্ব: মিসরের রাজপ্রাসাদ থেকে সিনাই পর্বত
জ্বলন্ত ঝোপ থেকে আওয়াজ এলো মুসা (আ) এর কানে, “হে মুসা! আমি আল্লাহ, বিশ্বজগতের পালনকর্তা।” (কুরআন, সুরা কাসাস, ২৮:২৯-৩২)
মুসা (আঃ)-কে তখন জিজ্ঞেস করা হলো, “তোমার ডান হাতে ওটা কী?”
তিনি উত্তর দিলেন, “এটা আমার লাঠি। আমি এটাতে ভর দেই, আর এটা দিয়ে আঘাত করে মেষপালের জন্য পাতা ঝরিয়ে থাকি। এছাড়া এটা অন্যান্য কাজেও লাগে আমার।”
আল্লাহ বললেন তার হাতের লাঠিটা মাটিতে ছুড়ে ফেলতে। তিনি লাঠিটি ছুড়ে ফেলতেই সেটিকে সাপের মতো ছোটাছুটি করতে দেখলেন। ভয়ে তিনি উল্টো দিকে দৌড় দিলেন, ফিরেও তাকালেন না। কিন্তু আওয়াজ এলো, “মুসা, সামনে এসো এবং ভয় করো না। তোমার কোনো আশংকা নেই।”
তিনি কাছে এলে বলা হলো, “মুসা, এটাকে ধরো, ভয় করো না। আমি এটাকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনবো।”
ইবনে কাসিরের আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থে বর্ণিত আছে, মুসা (আ) পশমের কাপড়ের আস্তিনে হাত দিয়ে সাপটির মুখে ধরলেন। আর ইহুদি বর্ণনা মতে, তিনি সাপের লেজে ধরেছিলেন। ধরতেই সেটি আগের মতো লাঠি হয়ে গেল।
এবার আদেশ করা হলো, “তোমার বগলে হাত রাখো।” তিনি হাত রাখবার পরপরই হাত চাঁদের মতো উজ্জ্বল হয়ে বেরিয়ে এলো। বলা হলো, “ভয় দূর করতে তোমার হাত তোমার উপর চেপে ধর।”
সিনাই পাহাড়ের উপর এ দুটো ‘মুজেজা’ বা অলৌকিক নিদর্শন মুসা (আ)-কে দেয়া হলো। পবিত্র কুরআন (সুরা বনি ইসরাইল ১০১-১০২) অনুযায়ী মুসা (আ)-কে মোট নয়টি নিদর্শন দেয়া হয়েছিল। জ্বলন্ত ঝোপের মাধ্যমে নবুয়ত প্রাপ্তির এ ঘটনার সময় ইহুদি হিসেব মতে মুসা (আ) এর বয়স তখন ছিল ৮০ বছর।
আল্লাহ সিনাই পাহাড়ে মুসা (আ)-কে নির্দেশ দিলেন ফারাও বা ফিরাউন ও তার পারিষদবর্গের কাছে যেতে। তাওরাত (হিজরতঃ ৩) অনুযায়ী তিনি তাকে বনী ইসরাইলকে মিসর থেকে বের করে আনতে বললেন। তাদের জন্য তিনি পবিত্র ভূমি ঠিক করে রেখেছেন।
তখন মুসা (আ) বললেন যে, তিনি আশংকা করছেন মিসরিয়রা তাকে হত্যা করে ফেলবে, কারণ তিনি চলে আসবার আগে তাদের একজনকে হত্যা করে এসেছিলেন। মুসা (আ) তোতলা হবার কারণে কথা বলতেও সমস্যায় পড়েন, ওদিকে তার ভাই হারুন অপেক্ষাকৃত বাগ্মী, তাই তাকেও যদি তার সঙ্গী করে পাঠাতেন আল্লাহ, তবে ভালো হতো। মুসা (আঃ) প্রার্থনা করেছিলেন, “আমার বক্ষ প্রশস্ত করে দিন। এবং আমার কাজ সহজ করে দিন। এবং আমার জিহবা থেকে জড়তা দূর করে দিন, যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে।” (কুরআন, তোয়া-হা, ২০ঃ২৪-২৮) আল্লাহ তার প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন এবং তাকে ভাইসহ ফিরাউনের দরবারে গিয়ে নিদর্শন প্রদর্শন করতে বললেন।
ইসলামি বর্ণনায় মুসা (আ) এর ফিরাউনের দরবারে আসার আগ পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহ উল্লেখ নেই। তাওরাত (হিজরত: ৪) জানাচ্ছে, সিনাই পর্বতে নবুয়াত লাভের পর মুসা (আ) তার শ্বশুর শোয়াইবের (আ) কাছে ফিরে গিয়ে তাকে বললেন, “মিসর দেশে আমার আত্মীয়-স্বজনদের কাছে আমাকে ফিরে যেতে দিন। আমি গিয়ে দেখতে চাই তারা এখনও বেঁচে আছেন কি না।”
শোয়াইব (আ) মূসা (আ)-কে বললেন, “আচ্ছা, সহিসালামতে যাও।”
তখন মূসা (আ) তার স্ত্রী ও ছেলেদের একটা গাধার পিঠে বসালেন এবং তাদের নিয়ে মিসর দেশে ফিরে চললেন। সেই লাঠিটাও তিনি হাতে করে নিলেন।
ওদিকে হারুন (আ)-কেও আল্লাহ জানিয়ে দিলেন যেন মুসা (আ) এর সাথে গিয়ে দেখা করেন। অবশেষে হোরেব পাহাড়ের কাছে তারা মিলিত হলেন। সেখানে মুসা (আ) তার ভাইকে সব জানালেন, আল্লাহ তাদেরকে কী কী করতে আদেশ দিয়েছেন। তখন হারুন (আ) এর বয়স ছিল ৮৩ বছর।
তারা দুজন একত্রে মিসরের গোশেন এলাকায় ফিরে আসলেন, যেখানে হিব্রুরা থাকত। মুসা (আ)-কে আল্লাহ যে দুটো মুজেজা দিয়েছিলেন তখন, সে দুটো তিনি তাদের দেখালেন। বনী ইসরাইল তখন আশান্বিত হয়ে উঠলো, তাদের দুর্ভোগের দিন বুঝি ফুরালো, ইমরানের পুত্র দুজন তাদের উদ্ধার করতে চলেছে। কিন্তু তখনো তারা জানত না তাদের সামনে দুর্ভোগ আরো বাড়তে চলেছে।
এরপর এক দিন মুসা (আ) আর হারুন (আ) ফিরাউনের রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করলেন। (অবশ্য, ইবনে ইসহাক (র) এর মতে, দু’বছর পর ঢোকার অনুমতি পেলেন তারা) কোনো এক অজ্ঞাত কারণে দুজন হিব্রু পুরুষ যে রাজপ্রাসাদে ঢুকে পড়ছেন, তাদের একদমই আটকালো না স্তম্ভিত প্রহরীরা। ফিরাউনের অন্দরমহলের কাছে পাহাড়ায় থাকা হিংস্র পোষা পশুগুলোকে পেরিয়ে দরবারে ঢুকে পড়লেন দুজন। সভাসদসহ ফিরাউন- সকলেই অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন।
মুসা (আঃ) বললেন, “আমরা বিশ্বজগতের পালনকর্তার প্রেরিত দূত। তুমি বনী-ইসরাঈলকে আমাদের সাথে যেতে দাও।” (কুরআন, শুয়ারা, ২৬ঃ১৫-১৬)
এবার ফিরাউনের দিক থেকে দেখা যাক। পরিস্থিতি এতটাই অবাক করা ছিল যে প্রথমে এই দুজন অপরিচিত লোককে চেনাই যাচ্ছিল না, তার উপর মিসররাজের দরবারে অদ্ভুত সব আবদার! তার চেয়েও বড় কথা, পরাক্রমশালী মিসরের আমুন-রা, আইসিস, অসাইরিস, হোরাস, আনুবিসদের ছেড়ে এক হিব্রু উপাস্যের আদেশে এক দাসজাতিকে চলে যেতে দিতে হবে, তবে কাজগুলো করবেটা কে? এ আবদার আবার করা হচ্ছে মিসরীয় দেবতাদের জীবন্ত রূপ ফারাওয়ের সামনে? আর যে মানুষটি এ আবদার করছে, তাকে তো এই ফিরাউনই লালনপালন করেছিলেন, তাদেরই একজনকে খুন করে পালিয়ে গিয়েছিলো, কোন মুখে এমন অমূলক আবদার করতে সাহস করছে?
কুরআনেও ঠিক এ কথাই বলা হচ্ছে, ফিরাউন চেষ্টা করলেন তাকে অপরাধবোধে ভোগাতে, যাকে কি না বলা হয় ‘গিল্ট ট্রিপ’ (Guilt Trip)। “আমরা কি তোমাকে শিশু অবস্থায় আমাদের মধ্যে লালন-পালন করিনি? তুমি আমাদের মধ্যে জীবনের বহু বছর কাটিয়েছ! তুমি সেই- তোমার অপরাধ যা করবার করেছ। তুমি হলে কৃতঘ্ন, অকৃতজ্ঞ।” (কুরআন, শুয়ারা, ২৬ঃ১৮-১৯)
মুসা (আ) যেন প্রস্তুতই ছিলেন, কথার মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে একসময় বাবা ডাকা মানুষটিকে বললেন, “আমি সে অপরাধ যখন করেছি, তখন আমি ভ্রান্ত ছিলাম। এরপর আমি ভীত হয়ে তোমাদের কাছ থেকে পালিয়ে গেলাম। তারপর আমার পালনকর্তা আমাকে জ্ঞান দান করেছেন এবং আমাকে নবী করেছেন। আমার প্রতি তোমার যে অনুগ্রহের কথা বলছ, এই যে, তুমি বনী-ইসরাঈলকে দাস বানিয়ে রেখেছ!” (কুরআন, শুয়ারা, ২৬ঃ২০-২২)
কথোপকথনের অপরাধবোধ অংশটুকু তাওরাতে অনুপস্থিত, কারণ তাওরাত অনুযায়ী মুসা (আ)-কে লালন পালন করা ফিরাউন আগেই মারা গিয়েছেন, যখন তিনি মাদায়েন ছিলেন। এখনের ফিরাউন তার পূর্বের সৎভাই, যে তার ভাই ছিল শিশুকালে। কুরআনে এটি উল্লেখ নেই আগের ফিরাউন মারা গিয়েছিলেন কি না। অবশ্য, মিসরের সব শাসকই সেই সময়কালে ফিরাউন (ফারাও) উপাধি পেতেন।
ফিরাউনের অপরাধের ফিরিস্তি প্রসঙ্গ আসতেই ফিরাউন কথা ঘুরিয়ে নিলেন, এবার তার প্রশ্ন, এই নতুন শোনা ঈশ্বরটা কে? “বিশ্বজগতের পালনকর্তা আবার কী?” (কুরআন, ২৬ঃ২৩) আরো বললেন, “কে আবার এই মাবুদ, যে আমি তার হুকুম মেনে বনি-ইসরাইলদের যেতে দেব? এই মাবুদকেও আমি চিনি না আর ইসরাইলীয়দেরও আমি যেতে দেব না।” (তাওরাত, হিজরত, ৫)
মুসা উত্তর দিলেন, “তিনি নভোমন্ডল, ভূমন্ডল ও এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সবকিছুর পালনকর্তা।” (কুরআন, ২৬ঃ২৪)
এবার হাসবার পালা ফিরাউনের। পারিষদদের দিকে অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে তাকিয়ে তিনি বললেন, “তোমরা কি শুনছ না?” (কুরআন, ২৬ঃ২৫)
জীবন্ত ঈশ্বর দাবি করা ফিরাউনের উদ্দেশ্যে মুসা (আ) ছুড়ে দিলেন, “তিনি তোমাদের পালনকর্তা এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদেরও পালনকর্তা।” (২৬ঃ২৬)
কৌতুক করতে থামলেন না ফিরাউন, হিব্রুদের কথা উল্লেখ করে বলে বসলেন, “তোমাদের (হিব্রুদের) প্রতি প্রেরিত এ দূতটি নিশ্চয়ই বদ্ধ একটা পাগল।” (২৬ঃ২৭)
মুসা (আ) না দমে যোগ করলেন, “তিনি পূর্ব, পশ্চিম ও এর মাঝের সব কিছুর পালনকর্তা।” (২৬ঃ২৮)
এবার রাগ থামাতে পারলেন না ফিরাউন, “তুমি যদি আমার পরিবর্তে অন্যকে উপাস্যরূপে গ্রহণ কর তবে আমি অবশ্যই তোমাকে কারাগারে নিক্ষেপ করব।”
মুসা (আ) বললেন, “যদি স্পষ্ট নিদর্শন দেখাই, তাহলেও?”
ফিরাউন বললেন, “যদি সত্যি বলে থাকো, তবে দেখাও!” (২৬ঃ২৯-৩১)
তখন মুসা (আ) তাদেরকে তার নিদর্শন দুটো দেখালেন, লাঠির সাপ হয়ে যাওয়া আর তার বগল থেকে শ্বেতশুভ্র হাত বের করা। কিন্তু ফিরাউন ও সভাসদরা এতে মোটেও অবাক হলো না। কারণ, মিসরে জাদুবিদ্যার প্রচলন এতই বেশি ছিল যে, এরকম সম্মোহনী জাদু প্রায়শই দেখা যেত।
ফিরাউন সভাসদদের বললেন, “নিশ্চয় এই লোক সুদক্ষ জাদুকর। সে তার জাদুবলে তোমাদেরকে তোমাদের দেশ থেকে বহিস্কার করতে চায়। তো, তোমাদের মত কী?”
সভাসদেরা বললেন, “তাকে ও তার ভাইকে কিছু অবকাশ দিন এবং শহরে শহরে ঘোষক প্রেরণ করুন। তারা যেন আপনার কাছে প্রত্যেকটি দক্ষ জাদুকরকে উপস্থিত করে।” (কুরআন ২৬ঃ৩৪-৩৭)
ফিরাউন আসলেই তখন মুসা (আ)-কে অবকাশ দিলেন নির্দিষ্ট দিনে সেই জাদু প্রতিযোগিতা (‘ডুয়েল’) অনুষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত।
মিসরীয় ইতিহাস আমাদের জানায়, জাদুবিদ্যা প্রাচীন মিসরীয়দের কাছে অবাক করা কিছু ছিল না, এমনকি তারা জাদুবিদ্যাকে হাতের কারসাজি হিসেবে মনেও করত না। তাদের মতে, পুরো বিশ্ব সৃষ্টি যেমন হয়েছে জাদুর সাহায্যে, চলছেও সেভাবে জাদুবলেই। ইজিপ্টোলজিস্ট (মিসরবিদ) জেমস হেনরি ব্রেস্টেড যেমন বিখ্যাত একটি কথা বলেছিলেন, “জাদু প্রাচীন মিসরীয়দের কাছে ছিল ঘুম আর খাওয়ার মতোই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার।”
আর প্রাচীন মিসরীয়রা বিশ্বাস করতো, জাদু বিষয়টার নিয়ন্ত্রক ওষুধ ও জাদুবিদ্যার দেবতা হেকা। হেকার কোনো মন্দির ছিল না, এমনকি অসাইরিস কিংবা আইসিসের মতো জনপ্রিয়ও ছিলেন না। বিশ্বাস করা হত, দেবতাদের ক্ষমতার পেছনে দায়ী হেকা। রাজকীয় পোশাক পরা হেকার হাতে থাকত লাঠি, যার মাথায় দুটো সাপের মূর্তি, একে অন্যকে জড়িয়ে আছে।
আধুনিককালে ওষুধের ক্ষেত্রে প্রতীক ব্যবহার করা হয় প্রাচীন মিসরের চিকিৎসার দেবতা এই হেকার চিহ্নকে স্মরণ করে। অবশ্য এটি স্টাফ অফ হারমিস নামেও পরিচিত, সেক্ষেত্রে আমরা এর গ্রিক উৎস নিয়েও ধারণা পেতে পারি। ‘হেকা’ শব্দের অর্থই ছিল ‘জাদু’। হেকার সহায়তাতেই দেবতা আতুম মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেন বলে বিশ্বাস ছিল।
প্রাচীন মিসরে এক বস্তু থেকে আরেক বস্তুতে রূপান্তরের জাদু ছিল একটি সাধারণ সম্মোহনী কাণ্ড। লাঠি আর সাপের কারসাজিও পরিচিত ছিল বলে ধারণা করা যায়। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চদশ শতকের মিসরীয় পুরোহিতদের লাঠির যে ছবি আমরা দেখতে পাই সমাধির দেয়ালে, সেখানে স্পষ্টতই সর্পদণ্ড দেখা যায়। শুধু পুরোহিত না, দেবতাদের ছবিতেও তা-ই দেখা যায়।
চতুর্থ ডাইনেস্টির ফারাও শিওপসের দরবারে তার সন্তানেরা পাঁচটি কাহিনী শুনিয়েছিলেন, সেগুলো ওয়েস্টকার প্যাপিরাস নামে সংরক্ষিত আছে। বার্লিনের মিসরীয় জাদুঘরে সেটি প্রদর্শিত হয়। সে প্যাপিরাসে চতুর্থ যে গল্পটি আছে, তাতে দেখা যায় দেদি নামের এক মহাশক্তিমান জাদুকরের কথা। দেদি মানুষের কাটা মুণ্ডু অন্য প্রাণীর ধরে বসিয়ে দিতে পারতেন। অর্থাৎ অবাক করা ‘জাদু’র সাথে মানুষ পরিচিত ছিল, আর তারা জাদু প্রদর্শনী দেখতেও বেশ পছন্দ করত। প্যাপিরাসে আমরা এমন জাদুর উল্লেখও পাই যেখানে পানি সরিয়ে রাস্তা হয়ে গিয়েছে, কিন্তু সেগুলো ছিল ছোট পরিসরে।
মুসা (আ) যে জাদুকর নন, সেটা প্রমাণ করবার জন্য জাদুকরদের ‘জাদু’কে পরাভূত করবার মতো বড় কিছু করা দরকার ছিল, কেবল লাঠি থেকে সাপের মতো সাধারণ কিছু যথেষ্ট ছিল না। আর লোকে লোকারণ্য যে হবেই সেই জাদু প্রতিযোগিতা সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না।
কিন্তু তাওরাত বলছে, মুসা (আ) যে দাবি নিয়ে গিয়েছিলেন ফিরাউনের কাছে, তাতে মুসা (আ)-কে কিছু না করলেও রাগান্বিত হয়ে হিব্রু দাসদের কাজের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়া হয় বহুগুণে। এতে বনী ইসরাইলীরা মুসা (আ) এর প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, যা পরবর্তীতে আরো অনেকবার পুনরাবৃত্তি হয়।
দেখতে না দেখতে সেই ‘জাদু’ প্রতিযোগিতার দিন হাজির হলো। মুসা (আ) এর অনুরোধে সেটি সকাল বেলা করা হয়েছিল। নানাজন নানা মত প্রকাশ করেছেন যে, কয়জন জাদুকর উপস্থিত ছিলেন, সংখ্যাটা সত্তর জন থেকে সত্তর হাজার জন পর্যন্ত দেখা যায়। তারা সকলে বিশাল মাঠে উপস্থিত হল, আর দর্শক হিসেবে নানা শ্রেণীর নানা মানুষ জড়ো হলো, তাদেরকে জড়ো হতে আহবান করা হয়েছিল।
জাদুকরেরা বললো ফিরাউনকে, “যদি আমরা বিজয়ী হই, তবে আমরা পুরস্কার পাব তো?”
ফিরাউন বললেন, “হ্যাঁ, তোমরা আমার কাছের মানুষ হবে।” (কুরআন, শুয়ারা, ২৬ঃ৪১-৪২)
এরপর জাদুকরেরা মুসা (আ)-কে বলল, “হয় তুমি মারো আগে না হয় আমরা মারি ছুঁড়ে।”
মুসা (আ) বললেন, “তোমরাই মারো।”
তারা ছুঁড়ে মারার সাথে সাথে বলল, “ফেরাউনের সম্মানের কসম, আমরাই বিজয়ী হব।”
মুসা (আ) এর কাছে মনে হলো, তাদের জাদুপ্রভাবে দড়ি ও লাঠিগুলো ছুটাছুটি করছে। তিনি ভয় পেয়ে গেলেন। আল্লাহ তখন বললেন, “ভয় করো না, তোমার ডান হাতে যা আছে, ছুঁড়ে মারো। সেটা ওগুলো খেয়ে ফেলবে। ওরা যা করেছে সেটা কেবল জাদুকরের কৌশল। জাদুকর কোথাও সফল হবে না।” (সুরা তোয়া হাঃ ৬৫-৬৯)
মুসা (আ) এরপর লাঠি ছুঁড়ে মারতেই সেটি সাপ হয়ে বাকি সবগুলোকে গলাধঃকরণ করে ফেলল। এটা এতটাই অবাক করা ছিল যে জনতা তো বটেই, এমনকি জাদুকরেরাও স্তম্ভিত হয়ে গেল। কারণ, জাদুর কারসাজিতে আর যা-ই সম্ভব হোক না কেন, এই গলাধঃকরণ সম্ভব ছিল না, কারণ লাঠিগুলো আর ফেরত আসেনি। যেকোনো জাদুর শেষে সেটি আগের অবস্থায় ফেরত গিয়ে স্বাভাবিক হবার কথা, এখানে সেটি হয়নি বিধায় সেটি যে যেনতেন কোনো জাদু প্রদর্শনী না সেটি বুঝতে জাদুকরদের বাকি রইলো না। (তাওরাত, হিজরত ৭)
তখন জাদুকররা সেজদায় নত হয়ে গেল। তারা বলল, “মূসা ও হারুনের রব আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস আনলাম।”
ফিরাউন বলল, “আমার অনুমতি দানের পূর্বেই তোমরা কি তাকে মেনে নিলে? নিশ্চয়ই মুসা তোমাদের প্রধান, যে তোমাদেরকে জাদু শিক্ষা দিয়েছে। তোমরা সজ্ঞানে এ চক্রান্ত করেছ যেন নগরবাসীদের দেখাতে। শীঘ্রই তোমরা পরিণাম জানতে পারবে। আমি অবশ্যই তোমাদের হাত ও পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলব। এবং তোমাদের সবাইকে শূলে চড়াব।” (সুরা তোয়া হা ও সুরা আরাফঃ১২৩)
কুরআন অনুযায়ী জাদুকরেরা বলল, “কোনো ক্ষতি নেই। আমরা আমাদের পালনকর্তার কাছে প্রত্যাবর্তন করবো। আমরা আশা করি, আমাদের পালনকর্তা আমাদের ক্রটি-বিচ্যুতি মার্জনা করবেন। কারণ, আমরা বিশ্বাস স্থাপনকারীদের মধ্যে অগ্রণী।” (তোয়া হাঃ ৫১-৫২)
ফিরাউন তাদের কঠোর শাস্তি দিলেন। তার হৃদয় কঠিন থেকে কঠিনতর হলো।
ফিরাউন নিজেকে জীবন্ত ঈশ্বর দাবি করতেন, তবে তার মানে এই না যে মিসরীয় দেব-দেবীদের কথা তিনি অস্বীকার করবেন। তাদের বাস্তবিক অস্তিত্ব নেই, তাদের অবর্তমানে তিনিই বাস্তবিক ঈশ্বর তার প্রজাদের কাছে। তিনি যে অন্যান্য দেবতাদের কথা বলেছিলেন, তা দেখা যায় কুরআনে বর্ণিত ফিরাউনকে উদ্দেশ্য করে করা পরবর্তী উক্তিতে, “ফিরাউনের সম্প্রদায়ের র্সদাররা বলল, আপনি কি এমনি ছেড়ে দেবেন মূসা ও তার সম্প্রদায়কে? দেশময় হৈ-চৈ করার জন্য এবং আপনাকে ও আপনার দেবদেবীকে বাতিল করে দেবার জন্য? ফিরাউন বলল, আমি এখনি হত্যা করব তাদের পুত্র সন্তানদেরকে; আর জীবিত রাখব মেয়েদেরকে।” (সুরা আরাফঃ ১২৭)
ক্রোধের আগুন জ্বলতে থাকা ফিরাউনের তখনও ধারণাই ছিল না যে কতগুলো অভিশাপ অপেক্ষা করছে তার জন্য। ঠিক তখনই শুরু হলো একের পর এক গজব, যেগুলো পরিচিত ‘মিসরীয় প্লেগ’ নামে।
নবম পর্ব: মিসরের অভিশাপ
এ সিরিজের পর্বগুলো হলো:
প্রথম পর্ব: ইহুদী জাতির ইতিহাস: সূচনা পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব: মিশরে যাবার আগে কেমন ছিল বনি ইসরাইল?
তৃতীয় পর্ব: হযরত ইউসুফ (আ): দাসবালক থেকে মিসরের উজির- ইহুদী জাতির ইতিহাস
চতুর্থ পর্ব: ইউসুফ-জুলেখার কাহিনীর জানা অজানা অধ্যায়
পঞ্চম পর্ব: মসজিদুল আকসা আর বাইতুল মুকাদ্দাসের ইতিবৃত্ত
ষষ্ঠ পর্ব: দাসবন্দী বনী ইসরাইল এবং হযরত মুসা (আ:) এর জন্ম
সপ্তম পর্ব: মিসরের রাজপ্রাসাদ থেকে সিনাই পর্বত
অষ্টম পর্ব: সিনাই পর্বত থেকে ফারাওয়ের রাজদরবার
নবম পর্ব: মিসরের অভিশাপ
দশম পর্ব: দ্বিখণ্ডিত লোহিত সাগর, এক্সোডাসের সূচনা
একাদশ পর্ব: মরিস বুকাইলি আর ফিরাউনের সেই মমি
দ্বাদশ পর্ব: তূর পর্বতে ঐশ্বরিক সঙ্গ এবং তাওরাত লাভ
ত্রয়োদশ পর্ব: ইসরাইলের বাছুর পূজা এবং একজন সামেরির ইতিবৃত্ত
চতুর্দশ পর্ব: জীবন সায়াহ্নে দুই নবী
পঞ্চদশ পর্ব: রাহাব ও দুই গুপ্তচরের কাহিনী
ষোড়শ পর্ব: জেরিকোর পতন এবং স্যামসনের অলৌকিকতা
সপ্তদশ পর্ব: এক নতুন যুগের সূচনা
বোনাস প্রাসঙ্গিক আর্টিকেল:
দ্য ফার্স্ট মুসলিম: একজন ইহুদীর চোখে মহানুভব হযরত মুহাম্মাদ (সা)
ইজরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত: কী, কেন এবং কীভাবে এর শুরু?