“আইজ্যাক নিউটন জ্ঞানযুগের প্রথম মানব নন, বরং তিনি যুগের শেষ যাদুকর।”- জন মেনার্ড কীন্স, ১৯৪২
হ্যাঁ, অবাক হবার কিছু নেই, যে অর্থেই কীন্স এ কথা বলে থাকুন না কেন, জীবনের যে বড় অধ্যায় নিউটন অতিপ্রাকৃত, আলকেমি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে গবেষণা করেন তাতে তাকে বিজ্ঞানীর পরিচয়ের পাশাপাশি জাদুকর না বলাটাই ভুল। যুগের শেষ জাদুকর। তার রহস্যময় জীবনে প্রবেশের আগে আমাদের প্রথমে তার জীবনের প্রথামার্ধও জানা প্রয়োজন বটে! কীভাবে তিনি আকৃষ্ট হলেন অন্যদিকে?
১৬৪২ সালের বড়দিন।
সারা ইংল্যান্ডে আজ কেবল আনন্দ আর আনন্দ। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ছুটে বেড়াচ্ছে রাস্তায়, তুষারের বল নিয়ে হুড়োহুড়ি করছে। নতুন পাওয়া ক্রিসমাস উপহার নিয়ে মাতামাতি চলছে। ক্রিসমাসের টার্কির গন্ধে সুবাসিত রাস্তাঘাট।
কিন্তু আনন্দ নেই একটি ঘরে। লিঙ্কনশায়ারের উলসথর্প ম্যানরে আজ কোনো আনন্দ নেই। প্রসব বেদনায় কাতরাচ্ছেন হান্না। আত্মীয়স্বজন তাকে ঘিরে আছে।
হান্নার স্বামী মারা গিয়েছেন তিন মাস আগেই। তার অনাগত সন্তান জন্ম থেকেই হবে পিতাহারা। কোনো দিন নিজের বাবাকে চিনবে না সে। বাবাহারা এ সন্তানকেই বা ক’জন চিনবে?
কিছুক্ষণ পর হান্না সন্তান প্রসব করলেন। ছেলে হয়েছে তার। কিন্তু নবজাত শিশুকে দেখে খুশির বদলে তিনি ডুকরে কেঁদে উঠলেন, কারণ, এই শিশু অপরিপক্ব হয়েছে, বাঁচবে না। এতই ছোট তার দেহ যে, একটা মগেও এঁটে যায়।
কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে ছোট শিশুটি মারা যায়নি। মায়ের আনন্দ দেখে কে? যে বাবার দেখা শিশুটি কোনোদিন পাবে না, তার নামেই শিশুর নাম রাখলেন তিনি। অন্তত ছেলের নাম দিয়ে হলেও যেন বাবার নাম বেঁচে থাকে।
শিশুর নাম রাখা হল আইজ্যাক। আইজ্যাক নিউটন।
এটা ছিল সেই বছর, যে বছরে গালিলিও গালিলি মারা যান। এক নক্ষত্রের মৃত্যু, আরেক নক্ষত্রের উদয় হয় এই ১৬৪২ সালে।
এ পর্বে আমাদের চরিত্র নিউটন। আগের পর্ব পর্যন্ত ছিলেন নিকোলাস ফ্লামেল। সাথে সাথে কিছু লোককথাও চলে আসবে আর একপর্যায়ে মিলে যাবে দুজনের জীবন একটি বিন্দুতে। তার আগে চলুন নিউটনের কর্মজীবনও জেনে আসা যাক!
নিউটনের বয়স তখনমাত্র তিন। তখন তার মা তাকে ছেড়ে নতুন বিয়ে করলেন আর নিউটনকে রেখে আসলেন তার নানি মার্জারির কাছে। নিউটনের সৎ বাবার নাম ছিল রেভারেন্ড বারনাবাস স্মিথ।
ছোট্ট নিউটন কিছুতেই তার মায়ের এ বিয়ে মেনে নিতে পারতেন না। খুব ঘৃণা করতেন তার নতুন বাবাকে। আর এজন্য নিজের মায়ের সাথেও তার বনিবনা হত না। এতটাই রাগ ছিল তার যে, তিনি একবার তাদের ঘর আগুনে পুড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন!
১২ বছর থেকে ১৭ বছর পর্যন্ত নিউটনকে পড়তে হয়েছিল কিংস স্কুলে। স্কুলের লাইব্রেরির জানালায় এখনও তার স্বাক্ষর দেখা যায়! পরে এ স্কুল থেকে তাকে সরিয়ে নেয়া হয়।
১৭ বছর যখন তার বয়স, তখন তার মা আবার বিধবা হন। তাই নতুন তিন সন্তান নিয়ে তিনি ফিরে আসেন। এবার নিউটনকে জোর করেন তিনি কৃষক বানানোর জন্য। কিন্তু নিউটন কৃষিকাজ ঘৃণা করতেন রীতিমতো।
পরে তার স্কুলের শিক্ষক হেনরি স্টোক্স নিউটনের মাকে রাজি করান তাকে আবার পড়াশোনা করতে পাঠাতে। তা-ই করা হলো। ১৮ বছর বয়সে তার লেখাপড়ার ফলাফল ছিল খুবই সন্তোষজনক। তখন সালটা ছিল ১৬৬০।
১৬৬১ সালের জুনে, নিউটন কলেজে পড়তে গেলেন। ১৯ ছুঁই ছুঁই করছে তার বয়স। তার কলেজ ছিল কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজ। অনেকটা কাজের বিনিময়ে পড়ালেখা গোত্রের ছাত্র ছিলেন তিনি। কলেজের পড়াশোনা ছিল অ্যারিস্টটলভিত্তিক। কিন্তু নিউটন এর সাথে যোগ করে নিলেন দেকারতে (Decartes), কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও এবং কেপলারকে।
একটা মজার ব্যাপার অনেকেই জানেন না, নিউটন তার যত বৈজ্ঞানিক গবেষণা করেছেন, তার প্রায় সবই নিজের ২১ থেকে ২৭ বছর জীবনের মধ্যে করা। ২৭ এর পর থেকে তিনি মশগুল হয়ে পড়েন অন্য এক জগতে। তবে সে জগতের গবেষণা তার মৃত্যুর আগে প্রকাশিত হয়নি। ২১ থেকে ২৭ বছরের মধ্যে যেসব জিনিস তিনি আবিষ্কার করেন সেগুলোই তিনি কয়েক বছর অন্তর অন্তর প্রকাশ করেন। আর সেগুলোই আমরা ‘ক্লাসিক্যাল নিউটনিয়ান সায়েন্স’ হিসেবে আজও পড়ছি। যেমন ধরুন, ১৬৬৫ সালে নিউটন কলেজে থাকতেই আবিষ্কার করেন দ্বিপদী উপপাদ্য।
১৬৬৫ সালেই তিনি ডিগ্রি অর্জন করেন। কিন্তু আগস্ট মাসে কলেজ বন্ধ হয়ে যায় প্লেগের কারণে। দু’বছরের জন্য তিনি তখন নিজের বাসায় ফিরে আসেন। সেখানে নীরবে নিভৃতে তিনি কাজ করে যান। এ সময়টাতে তিনি আবিষ্কার করেন ক্যালকুলাস, অপটিক্সের সূত্রগুলো আর অভিকর্ষ-মহাকর্ষের সূত্রগুলো। এ সময় তিনি তার টেলিস্কোপ বানিয়ে ফেলেন। এছাড়াও তরলের সান্দ্রতা নিয়েও গবেষণা করেন, করেন তাপগতিবিদ্যা নিয়েও।
আর এ সময়টাতে একটা ঘটনা ‘ঘটে’ যা কি না সর্বকালের সবচেয়ে বেশি বলা একটা কাহিনীতে পরিণত হয়, সেটা হলো নিউটনের মাথায় আপেল পড়ার কাহিনী
কিন্তু, আসলে নিউটনের মাথায় কোনো আপেল পড়েনি। তবে হ্যাঁ, তিনি আপেল পড়া লক্ষ্য করেছিলেন। তার জীবনীকার ভলতেয়ার প্রথম লেখেন, নিউটন আপেলের পতন দেখে অভিকর্ষ তত্ত্ব বুঝতে পারেন। কিন্তু, আসলে একটা মাত্র ঘটনা তাকে এ তত্ত্ব বুঝতে সাহায্য করেনি। বরং এ ঘটনা হয়তো তাকে তার তত্ত্ব সম্পূর্ণ করার দিকে এগিয়ে নিয়েছিল। এটা ছিল একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া। নিউটন কিন্তু প্রায়ই এ আপেলের ঘটনার উদাহরণ দিতেন, কারণ এটা দিয়ে সহজে বোঝানো যেত তার তত্ত্ব।
আসুন আমরা এবার তার মুখ থেকে শুনি আপেলের কাহিনী। উইলিয়াম স্টাকলির লেখা ‘মেময়েরস অফ স্যার আইজ্যাক নিউটন’ -এ উল্লেখ আছে-
“আমরা নিউটনের বাসার বাগানে গেলাম, সেখানে গিয়ে বসলাম আপেল গাছের ছায়ায়। বসে চা খেলাম। তিনি তখন আমাকে বললেন, ঠিক এরকম একটা অবস্থায় অনেক বছর আগে তিনি দেখেছিলেন একটা আপেল পড়তে গাছ থেকে। তখনই তার মাথায় এসেছিল ধারণাটি। ‘কেন আপেলটা লম্বভাবে পড়লো মাটিতে? উপরে গেল না কেন? অথবা ডানে বায়ে? কারণ, নিশ্চয়ই পৃথিবী তাকে টানছে। তাহলে পদার্থের নিশ্চয়ই আকর্ষণ ক্ষমতা আছে… আর এটা নিশ্চয়ই ভরের উপর নির্ভর করে। সুতরাং আপেল যেমন পৃথিবীকে টানছে, তেমনই পৃথিবীও আপেলকে টানছে।’ ” [১৫ এপ্রিল, ১৭২৬]
সেই আপেল গাছের কিছু বংশধর কয়েক জায়গায় লাগানো হয়েছে। যেমন-
যা-ই হোক, ২ বছর পর ১৬৬৭ সালে তিনি আবার গেলেন কেমব্রিজে, তবে এবার ফেলো (fellow) হিসেবে। ১৬৬৯ সালেই তিনি হয়ে যান লুকাসিয়ান প্রফেসর অফ ম্যাথ! বয়স তখন মাত্র ২৭; এরপর ৮৪ সালে তিনি নিজের সূত্রগুলো দিয়ে চমকে দেন হ্যালির ধূমকেতুর আবিষ্কারক স্যার এডমান্ড হ্যালিকে।
একটি ব্যাপারে সমস্যা শুরু হলো, ফেলো হলেই কাউকে অবশ্যই যাজক হতে হতো। কিন্তু নিউটন তো প্রচলিত খ্রিস্টধর্ম মানতেন না! তাহলে তিনি যাজক হবেন কীভাবে? এটা নিয়ে কাঠখড় পোড়াতে হয়। কিন্তু কী ছিল নিউটনের ধর্মবিশ্বাস? সে প্রসঙ্গে আসছে পরে।
নিউটন তার গবেষণা প্রকাশ করেছেন পরে, কিন্তু করে রেখেছিলেন আগেই। এর মাঝেই কিন্তু একই বিষয় নিয়ে অন্যান্য বিজ্ঞানীরাও গবেষণা শুরু করে দেন। এভাবেই ইতিহাসের একটা বড় বিতর্ক শুরু হয়- কে প্রথম ক্যালকুলাস আবিষ্কার করেন? নিউটন, নাকি লিবনিজ?
আসলে, দুজন আলাদা আলাদাভাবে গবেষণা করে নিজের সিদ্ধান্তে পৌঁছান। কিন্তু, সমস্যা শুরু হয় আবিষ্কারকের সম্মান কাকে দেয়া হবে সেটা নিয়ে।
নিউটন ১৬৯৩ এর দিকে সব প্রকাশ করা শুরু করেন, কিন্তু লিবনিজ প্রকাশ শুরু করেন ১৬৮৪ সাল থেকে। লিবনিজের সেই ডিফারেন্সিয়াল মেথড এখন বিশ্বব্যাপী ব্যবহৃত হয়।
১৬৯৯ সালে ইংল্যান্ডের রয়াল সোসাইটির সদস্যরা লিবনিজকে দায়ী করেন তত্ত্বচোর হিসেবে, তিনি নাকি নিউটনের কাছ থেকে ক্যালকুলাসের ধারণা চুরি করেছেন আর নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছেন। রয়েল সোসাইটির একজন সদস্য ছিলেন নিউটনও।
১৭১১ সালে পুরো দমে এ বিতর্ক জ্বলে উঠে। রয়াল সোসাইটি দাবি করে, নিউটন আসল উদ্ভাবক আর লিবনিজ একজন ভণ্ড। এ বিতর্ক চলতে থাকে যতদিন না লিবনিজ মারা যান, ১৭১৬ সালে।
বেশিরভাগই হয়তো লিবনিজকে ভণ্ডই ভেবেছিলেন। কিন্তু পরে যখন দেখা গেল রয়াল সোসাইটির সেই ‘লিবনিজ একজন ভণ্ড’-এই মর্মের প্রত্যয়নটা আসলে নিউটনেরই লেখা, তখন সন্দেহ ঘনীভূত হল। আসলে লিবনিজকে অপমান করার জন্য নিউটনের একটা চাল ছিল এটি, কোনো প্রকার সমালোচনা সহ্য করতে পারতেন না নিউটন। তাই এই ব্যবস্থা করেন তিনি।
একটা ঘটনা বলা যায় এখানে, গণিতবিদ বারনুলির নাম হয়ত অনেকেই শুনে থাকবেন। তিনি দুটো সমীকরণ দিয়ে ছয় মাস সময় দিয়েছিলেন সমাধান করার জন্য, ‘ওপেন চ্যালেঞ্জ’। ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও কেউ কোনো সমাধান নিয়ে এলো না। হঠাৎ একদিন লিবনিজ বললেন তিনি একটা সমাধানে আসতে পেরেছেন। প্রায় একই সময়ে, নিউটন একদিন কাজ থেকে বাসায় ফিরে মেইলবক্স চেক করতে গিয়ে বারনুলির কাছ থেকে একটা পত্র পেলেন। খুলে দেখেন সেই সমীকরণ দুটো। তখন বাজে বিকেল চারটা। সেই যে নিউটন বসলেন, ১২ ঘণ্টার আগে তিনি উঠলেন না, রাত ৪টায় তিনি সমীকরণ দুটো সমাধান করে শেষ করলেন। কিন্তু তিনি সেটা নিজের নামে প্রচার করলেন না। ‘অ্যানোনিমাস’ বা নামহীন হিসেবে তিনি রয়াল সোসাইটি থেকে পাবলিশ করলেন, কিন্তু জনাব বারনুলি ঠিকই ধরে ফেললেন এটা নিউটনের। শেষ পর্যন্ত এক্ষেত্রে বারনুলি সমীকরণের সমাধানকারী হিসেবে লিবনিজ আর নিউটন দুজনকেই স্বীকৃতি দেয়া হয়। কিন্তু, ব্যাপারটা লিবনিজের ভালো লাগলো না। যেখানেই লিবনিজ চেষ্টা করেন, সেখানেই কেন নিউটন হানা দেবেন?
আপনি জানেন কি, নিউটন ইংল্যান্ডের সংসদেরও একজন সদস্য ছিলেন? ১৬৮৯ সালে তিনি সাংসদ হন। তবে সংসদের হয়ে তিনি কোনো কাজ করেননি জীবনে। একটা মাত্র কাজের রেকর্ড পাওয়া যায় তার। তিনি “চেম্বারে বেশি ঠাণ্ডা বাতাস আসে”- এ মর্মে একটি অভিযোগ করেন, আর এজন্য “জানালা বন্ধ রাখা”র অনুরোধ করেন তিনি।
নিউটনের বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা মূলত শেষ হয়ে যায় নব্বইয়ের দশকেই। এরপরই শুরু হয় তার অতিপ্রাকৃত বিষয় নিয়ে গবেষণা!
১৬৯০ থেকে নিউটন বাইবেলের ব্যাখ্যা লেখা শুরু করেন। তার ব্যাখ্যা থেকে বোঝা যায়, তিনি খ্রিষ্টানদের ট্রিনিটি বিশ্বাসে একদমই বিশ্বাস করতেন না, ভ্রান্ত ধারণা ভাবতেন, তিনি ছিলেন কঠিনভাবে একত্ববাদী- কেবল এক ঈশ্বরেই বিশ্বাস ছিল তার। বলা হয়, তিনি যদি তার বিশ্বাস নিয়ে লেখাগুলো প্রকাশ করতেন সে যুগে, তবে চার্চ থেকে তাকে ধর্মত্যাগী ঘোষণা করা হতো। তবে এ লেখা প্রকাশিত হয় তার মৃত্যুর অর্ধ শতাব্দী পর, ১৭৮৫ সালে। এবং আর যা যা প্রকাশিত হয়, তা থেকেই আমরা নিউটনের বাকি জীবনের আলকেমি নিয়ে গবেষণা জানতে পারি, জানতে পারি নানা ভবিষ্যৎবাণী নিয়ে তার কাজ! দেখুন না তার নিজের হাতে করা আলকেমির একটি কাজ-
চলবে ষষ্ঠ পর্বে!
পড়তে ক্লিক করুন:
অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে-৬: স্যার আইজ্যাক নিউটনের বাইতুল মুকাদ্দাস গবেষণা
অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে-৭: অমরত্বের সুধার খোঁজে
আগের পর্ব:
অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে-১: আলকেমি আর পরশমণি
অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে-২: পরশমণির খোঁজে আলকেমিস্ট নিকোলাস ফ্লামেল
অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে-৩: নিকোলাস ফ্লামেলের রহস্যময় জীবন
অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে-৪: নিকোলাস ফ্লামেলের ‘রহস্যময়’ অন্তর্ধান