বাতিঘরের ইতিহাস বেশ প্রাচীন। বাতিঘর ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে প্রকৃতির অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে মানুষের অদম্য লড়াইয়ের গল্প। এক সময় মানুষের জীবনযাত্রার সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িয়ে ছিল সমুদ্র। বেঁচে থাকার জন্য খাবারের সংস্থান করতে কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্যে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনতে সমুদ্র যাত্রা ছিল অবধারিত। আর যেদিন থেকে মানুষ সমুদ্রে পাড়ি দিয়েছে, সম্ভবত সেদিন থেকেই বাতিঘরের ধারণা জন্ম নেয়। কারণ প্রাচীনকালের মানুষ প্রকৃতির কাছে বারবার বিপর্যস্ত হয়েছে।
প্রাচীনকালে সমুদ্রে যেতে হলে নাবিকদেরকে একটা অলিখিত নিয়ম মেনে চলতে হতো। সূর্যোদয়ের সাথে সাথেই নৌকা ছুটতো সমুদ্রের পথে, আবার সূর্য অস্ত যাওয়ার পূর্বেই তীরে নৌকা ভেড়াতো নাবিকরা। কিন্তু কখনও কখনও প্রকৃতির হিংস্রতার কাছে তাদেরকে আত্মসমর্পণ করতে হতোই। সূর্যাস্তের পরও অনেক সময় বাড়ি ফেরা কঠিন হয়ে পড়তো। প্রকৃতির কারণে সূর্য ডোবার আগে নাবিকেরা ঘরে ফিরতে না পারলে তাদের আত্মীয়স্বজনেরা আগুন জ্বালিয়ে সমুদ্রের তীরে অপেক্ষা করতেন। আগুন জ্বালিয়ে তীরের নিশানা দেখানোর ধারণা থেকেই গড়ে উঠেছে বাতিঘর।
ঐতিহাসিকদের মতে, পৃথিবীর প্রাচীনতম লাইট হাউজ হলো ফারো অব আলেকজান্দ্রিয়া। গ্রিক ‘ফারো’ শব্দের অর্থ আলো। এই থেকেই এসেছে ফারোলজি বা বাতিঘর বিদ্যা। যিশুর জন্মের প্রায় তিনশো বছর আগে ফারো অব আলেকজান্দ্রিয়া তৈরি হয়েছিল। তবে চতুর্দশ শতাব্দীতে এক ভূমিকম্পে এই লাইট হাউজ ধ্বংস হয়ে যায় বলে ধারণা করা হয়। তবে সমুদ্রের বকে লাইট হাউজ নির্মিত হয় আরও পরে। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষের দিকে সমুদ্রের বুকে প্রথম লাইট হাউজ নির্মিত হয় ইংল্যান্ডে।
আটলান্টিক মহাসাগরের যে অংশ ইংল্যান্ড আর ফ্রান্সের মাঝে রয়েছে তাকে ইংলিশ চ্যানেল বলে। সেই ইংলিশ চ্যানেলের এক জায়গায় একটি আধডোবা পাহাড় রয়েছে। এডিস্টোন রক নামে পরিচিত পাহাড়টি প্লাইমাউথ বন্দর থেকে প্রায় চৌদ্দ মাইল দূরে অবস্থিত। পাহাড়টির মাঝখানের চূড়ার নাম এডিস্টোন রক। ইংরেজি ‘এডি’ শব্দের অর্থ ঘূর্ণি। পাহাড়টি খুবই সাধারণ। তবে এই পাহাড়ের কারণে সমুদ্রের পানি এই পাহাড়ের কাছে কেন জানি রুদ্রমূর্তি ধারণ করে। সমুদ্রের পানি এই পাহাড়ের কাছে সবসময়ই বিপজ্জনকভাবে পাক খেতে থাকে। আর সে কারণে এই পাহাড়টির নাম হয়েছে এডিস্টোন রক বা ‘ঘূর্ণির পাহাড়’।
সমুদ্রের পানিতে যখন জোয়ার আসে, তখন পাহাড়ের চূড়া প্রায়ই পানিতে ডুবে যায়। তখন জায়গাটিকে চেনা খুব মুশকিল। এই পাহাড়ের পাশ দিয়ে অসংখ্য জাহাজ প্রতিদিন যাতায়াত করে। একসময় কত না জাহাজ সমুদ্রের ওই মারাত্মক ঘূর্ণিতে পড়ে ধ্বংস হয়েছে। যুগ যুগ ধরে এডিস্টোন রক ছিল নাবিকদের কাছে এক বিভীষিকার নামান্তর। বিশেষ করে রাতের বেলা কোনো জাহাজই ওই পথ দিয়ে যেতে চাইতো না। অনেক সময় পথ ভুলে বা জোয়ারের পানিতে পাহাড়টিকে দেখতে না পেয়ে কোনো জাহাজ ওই এলাকা অতিক্রম করার চেষ্টা করতো তখনই ঘটতো বড় ধরনের বিপর্যয়।
যে মানুষটি প্রথম নাবিকদের এই আতঙ্ক থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করেছিলেন তার নাম হেনরি উইনস্ট্যানলি। লাইট হাউজ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পথিকৃত হিসেবে তার নাম বাতিঘর নির্মাণ ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লেখা রয়েছে। উইনস্ট্যানলি পেশায় ছিলেন একজন জাহাজ ব্যবসায়ী। কিন্তু তার নেশা ছিল ছবি-আঁকা আর পাথর কেটে মূর্তি গড়া।
১৬৯৫ সালের কথা। উইনস্ট্যানলির বয়স তখন ৫১ বছর। ব্যবসায়ী হিসেবে বেশ সুনাম অর্জন করেছেন। সে সময় তার ব্যবসার কাজে নিয়োজিত পাঁচটি জাহাজের দুটি এই এডিস্টোন রকের কাছে ধাক্কা খেয়ে ধ্বংস হয়। ফলে তার ব্যবসা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ে। তখনই উইনস্ট্যানলি ঠিক করেন, ওই পাহাড়ের ওপরই তিনি একটি আলোকস্তম্ভ নির্মাণ করবেন। এই কাজের জন্য তিনি যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতিও নিয়ে রাখলেন। ১৬৯৬ সালের জুলাই মাসে উইনস্ট্যানলি বাতিঘর নির্মাণের কাজ শুরু করেন। পরিকল্পনা এবং পরিচালনার দায়িত্ব তিনি সরাসরি নিজের কাঁধে তুলে নেন।
জোয়ারের সময় ওই পাহাড়ের যে চূড়োটা জলের ওপরও জেগে থাকতো তার ওপর কাঠের কাঠামো দিয়ে গ্রানাইট পাথরের বারো ফুট ভিত তৈরি করা হলো। পাথরগুলো মাপ পমতো কেটে প্লাইমাউথ বন্দর থেকে জাহাজে করে ওই পাহাড়ে নিয়ে আসা হতো। এই কাজ দ্রুত শেষ করার জন্য উইনস্ট্যানলি প্রচুর সংখ্যক শ্রমিক নিয়োগ করেন। হঠাৎই এই কাজ চলার সময় এক অনাকাঙ্খিত বাধা আসে।
এই সময় ইংল্যান্ড আর ফ্রান্সের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। ফরাসি সৈন্যদের হাত থেকে নির্মাণকর্মীদের রক্ষা করার জন্য উইনস্ট্যানলি একটি যুদ্ধ জাহাজকে ওই পাহাড়ের কাছে সবসময় পাহারা দেয়ার ব্যবস্থা করেন। ফলে ফরাসি সৈন্যরা পাহাড়ের দিকে যাওয়ার খুব একটা চেষ্টা করতো না। কিন্তু একদিন ঘটলো অন্য এক ঘটনা।
কোনো এক কারণে একদিন সেই যুদ্ধ জাহাজটি শ্রমিকদের পাহারা দেয়ার জন্য আসতে পারেনি। পাহাড়ের কাছে কোনো যুদ্ধ জাহাজ দেখতে না পেয়েই ফরাসি সৈন্যরা পাহাড়টিকে ঘিরে ফেলে। তারা উইনস্ট্যানলিকে বন্দী করে নিয়ে যায়। তখন ফ্রান্সের সম্রাট ছিলেন চতুর্দশ লুই। ফরাসি সৈন্যরা বন্দী উইনস্ট্যানলিকে সম্রাটের কাছে নিয়ে আসে। সম্রাট পুরো ঘটনা শোনার পর ফরাসি সৈন্যদের ওপর খুবই ক্ষেপে যান এবং তৎক্ষণাৎই তাদের শাস্তি দেয়ার ব্যবস্থা করেন। তারপর উইনস্ট্যানলিকে প্রচুর পুরস্কার দিয়ে ইংল্যান্ডে সসম্মানে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। এই সময় রাজদরবারে সম্রাট এক ঐতিহাসিক উক্তি করেন যা আজও ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছে। তিনি বলেছিলেন, “ফ্রান্সের যুদ্ধ ছিলো ইংল্যান্ডের বিপক্ষে, মানবতার বিপক্ষে না।”
তিন বছরের অক্লান্ত চেষ্টার ফলে বিশ্বে সর্বপ্রথম মাঝ সমুদ্রে বাতিঘর তৈরি হলো। ১৬৯৮ খ্রিস্টাব্দের ১৪ নভেম্বর এডিস্টোন রক লাইট হাউজের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়। এই লাইট হাউজটির উচ্চতা ছিল ১২০ ফুট। এর মাথায় কঠিন চর্বির তৈরি মোমের আলো জ্বালিয়ে উদ্বোধন করেন উইনস্ট্যানলি। পাঁচ বছর ধরে এই বাতিঘরের আলোর সংকেত ওই অঞ্চলের সমুদ্রগামী জাহাজের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে সমর্থ হয়। তবে এই লাইট হাউজটি খুব বেশি দিন দীর্ঘস্থায়ী ছিল না।
১৭০৩ সালের ২৬ নভেম্বরের এক সকালবেলায় উইনস্ট্যানলি সদলবলে এলেন লাইট হাউজ পরিদর্শনে। বাতিঘর পর্যবেক্ষণ আর নিয়মিত কিছু বাঁধাধরা মেরামতির কাজ করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। তবে এই মেরামতির কাজ শেষ করতে করতে বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল। তাই উইনস্ট্যানলি ও তার দল এই বাতিঘরের সামনেই রাতটি কাটিয়ে দেবেন বলে মনঃস্থির করেন। কিন্তু সেই রাতেই ইংল্যান্ডের পশ্চিম উপকূল দিয়ে বয়ে গেল প্রলয়ঙ্কারী এক ঝড়। সেই ঝড় তছনছ করে দিলো সবকিছু। সমুদ্র উপকূলবর্তী বাড়ি-ঘর, গাছপালা মুহূর্তের মধ্যেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো। মারা গেল প্রায় দেড়শো মানুষ। সমুদ্রে ১৫০টি জাহাজডুবির ঘটনা ঘটলো। আর সেই জাহাজডুবিতে প্রাণ হারালো প্রায় ৮,০০০ নাবিক ও যাত্রী।
সেদিনও সন্ধেবেলায় নিয়মমাফিক এডিস্টোন রকের বাতিঘরের আলো জ্বলেছিল। কিন্তু সেই ঝড়ের পরদিন সকালে দেখা গেল এডিস্টোন রক তার আদিম চেহারা ফিরে পেয়েছে। নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে বিশ্বের প্রথম ‘ঢেউয়ে ভেজা’ বাতিঘর। আর সেই সাথে চিরকালের জন্য হারিয়ে গেছেন হেনরি উইনস্ট্যানলি। ওই প্রলয়ঙ্কারী ঝড়ে সলিল সমাধি ঘটে উইনস্ট্যানলি ও তার সঙ্গীদের। মাত্র ৫ বছর স্থায়ী ছিল এডিস্টোন রকের ওপর তৈরি প্রথম বাতিঘর।
এই ঘটনার কয়েক বছর পর, ১৭০৯ সালে জন রডইয়ার্ড নামের একজন ইঞ্জিনিয়ারের তত্ত্বাবধানে ওক কাঠ এবং লোহার তৈরি দ্বিতীয় একটি বাতিঘর ওই স্থানে নির্মাণ করা হয়। তবে এই বাতিঘরটিও ১৭৫৫ সালে আগুনে পুড়ে যায়। পরবর্তীকালে ১৭৫৬ সালে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার জন স্মিটন তৃতীয় এডিস্টোন লাইট হাউজ নির্মাণ কাজ শুরু করেন। কংক্রিটের তৈরি লাইট হাউজটি নির্মাণ করতে সময় লাগে তিন বছর। ১৮৮২ সালে স্যার জেমস এন ডগলাসের তত্ত্বাবধানে চতুর্থবারের মতো ওই স্থানে নতুন অত্যাধুনিক প্রযুক্তির বাতিঘর নির্মাণ করা হয়। এই বাতিঘরের উচ্চতা ছিল ১৩৩ ফুট।
বর্তমানে এডিস্টোন পাহাড়ের ওপর জেমস এন ডগলাসের বাতিঘরটি অক্ষত আছে। ইতিহাসের পরিক্রমায় নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে বাতিঘর নির্মাণ আজ এক স্থায়ী রূপ পেয়েছে। তবে এখনও লাইট হাউজ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অগ্রপথিক হিসেবে হেনরি উইনস্ট্যানলির নাম ইতিহাসে অমর হয়ে রয়েছে।
ফিচার ইমেজ- Wikimedia Commons