সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে ভালো জনপ্রিয়তা পেয়েছে রাইড শেয়ারিং সেবা। শাব্দিক অর্থ যা-ই হোক, বর্তমানে মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করে পছন্দের গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য গাড়ি ভাড়া পাওয়া বা ভাড়া দেওয়ার সেবাটিকেই মূলত রাইড শেয়ারিং বলে অভিহিত করা হয়। সেবা পৌঁছে দেওয়ার এ বিষয়টির আরো কিছু পরিভাষা হচ্ছে পিয়ার টু পিয়ার (Peer to Peer) বা পি-টু-পি রাইড শেয়ারিং, রিয়েল টাইম (Real-time) রাইড শেয়ারিং, অন-ডিমান্ড (On-Demand) রাইড শেয়ারিং, কারপুলিং (Carpooling) ইত্যাদি। রাইড শেয়ারিংকে বলা যায় পরিবহনের এমন পদ্ধতি, যাতে একাধিক মানুষ একই গন্তব্যে যেতে একটি গাড়ি মিলেমিশে ব্যবহার করতে পারে।
এই পদ্ধতিতে যেকোনো যাত্রী কোনো প্রতিষ্ঠানের অ্যাপের মাধ্যমে তাৎক্ষনিক গাড়ি পাওয়ার সেবার জন্য অনুরোধ করে থাকেন। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে নিবন্ধিত একজন গাড়ির চালক যখন গ্রাহকের অনুরোধ পান, তখন তিনি সেই যাত্রীকে পরিবহন করার জন্য নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে পৌঁছান। সাধারণ বাণিজ্যিক গাড়ি ভাড়া প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবাও যদিও অনেকটা একই রকম, কিন্তু তফাৎটা হচ্ছে সেই সেবা প্রদান করে কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু রাইড শেয়ারিং এর ক্ষেত্রে এই সেবা প্রদান করে যেকোনো ব্যক্তিগত গাড়ির মালিক, যাদের গাড়িগুলোর উদ্দেশ্য পুরোপুরি বাণিজ্যিক নয়।
বর্তমান সময়ে রাইড শেয়ারিং খুবই সহজ ও সহজলভ্য! আর এ কারণে সময়ের সাথে বেড়েই চলছে এর জনপ্রিয়তা। এবার তাহলে চলুন জেনে নেয়া যাক, রাইড শেয়ারিংয়ের এই পুরো বিষয়টা কীভাবে কাজ করে।
মোবাইল অ্যাপ
মোবাইলভিত্তিক অ্যাপগুলো দিয়েই মূলত রাইড শেয়ারিংয়ের প্রধান কাজটি সমাধা হয়। যাত্রী এবং চালক, দুজনই এই সেবার সাথে যুক্ত থাকেন মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমেই। তবে যাত্রী ও চালকের অ্যাপ সাধারণত আলাদা হয়। মোবাইল অ্যাপের গঠন কিন্তু তেমন জটিল নয়। অ্যাপটি মোবাইলের ইন্টারনেট ব্যবহার করে, সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের সার্ভারের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে। অ্যাপের মাধ্যমে যখন কেউ এই সেবার জন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে নিবন্ধন করেন, তখন সেই তথ্য জমা হয় সেই প্রতিষ্ঠানের সার্ভারে। জিপিএসের মাধ্যমে অ্যাপগুলো যাত্রী ও চালকের অবস্থান সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রতিষ্ঠানের কাছে বা তাদের সার্ভারে পাঠায়।
জিপিএস এই সেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সেই সাথে অ্যাপের আরেকটি প্রধান অংশ হচ্ছে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের নিখুঁত মানচিত্র। অধিকাংশ রাইড শেয়ারিং সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত গুগল ম্যাপের মতো সুপরিচিত মানচিত্রকে ব্যবহার করে। যাত্রার স্থান ও গন্তব্য মানচিত্রের মাধ্যমে নির্দিষ্ট করা হয়। অতঃপর গন্তব্য ঠিক করে নিশ্চিত করার পর সেই তথ্য প্রতিষ্ঠানের সার্ভারের মাধ্যমে নিকটস্থ চালকদের কাছে বার্তা পৌঁছে দেয়। তবে এই বার্তা পৌঁছানোর মধ্যে থাকতে পারে প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব অ্যালগারিদম, যা কোন চালকের কাছে আগে বার্তা যাবে বা কার কাছে যাবে না তা নির্ধারণ করে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অ্যাপগুলোর ইউজার ইন্টারফেসে পার্থক্য থাকলেও কার্যপদ্ধতি মূলত একই।
জিপিএস: অবস্থান নির্ণয় হয় যেভাবে
রাইড শেয়ারিং সেবা প্রদানের জন্য অবস্থান নির্ণয় একটি বড় কাজ। আর সেই কাজটি করে জিপিএস। জিপিএস বা গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম হচ্ছে অবস্থান নির্ণয়ের জন্য একটি স্যাটেলাইটভিত্তিক কার্যক্রমের নাম। পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় এই ব্যবস্থায় নিখুঁতভাবে অবস্থান নির্ণয় করা যায়। এজন্য প্রায় ত্রিশটি স্যাটেলাইট পৃথিবীর কক্ষপথে এমনভাবে স্থাপন করা আছে, যাতে প্রত্যেকটি জায়গা একই সময় অন্ততপক্ষে চারটি স্যাটেলাইটের আওতায় থাকে। এই স্যাটেলাইটগুলো পৃথিবীতে অবিরাম সংকেত প্রদান করে এবং সেই সংকেতের সাথে তা পাঠানোর সময় এবং কোন স্যাটেলাইট থেকে পাঠানো হয়েছে তা সংযুক্ত থাকে। মোবাইলগুলোতে সংযুক্ত জিপিএস রিসিভার সেই সংকেত গ্রহণ করার পর সেই স্যাটেলাইট থেকে দূরত্ব ও পাঠানো সময়ের সাথে গাণিতিক হিসাবের মাধ্যমে নিজের অবস্থান নির্ণয় করে। অন্ততপক্ষে চারটি স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া সংকেতকে হিসাব করে অবস্থানের নিখুঁত হিসাব বের করা হয়।
প্রক্রিয়াকারী সার্ভার
কোনো চালক কিংবা যাত্রী কোনো প্রতিষ্ঠানের রাইড শেয়ারিং সেবায় নিবন্ধন করার পর, চালক ও যাত্রীদের সকল তথ্য মূলত জমা থাকে একটি সার্ভারে। চালক ও যাত্রীরা তাদের অ্যাপগুলো চালু করার পর প্রথমত সংশ্লিষ্ট সার্ভারের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে। সার্ভারটি তখন যাত্রী, চালক ও সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করে। যাত্রীদের অ্যাপ থেকে যেকোনো অনুরোধের তথ্য সার্ভারে পৌঁছার পর সার্ভারের অ্যালগারিদম ও অ্যাপ্লিকেশন সেই তথ্যগুলো পরীক্ষা করে নিকটস্থ চালকদের কাছে পৌঁছায়। ঠিক একই পদ্ধতিতে চালকের তথ্যও পৌঁছায় যাত্রীর কাছে। কোনো রাইড শেষ করার পর সেই তথ্য কিংবা হিসাবনিকাশগুলোও সার্ভারে জমা হয়।
মূলত রাইড শেয়ারিংয়ের আসল প্রক্রিয়াটা ঘটে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সার্ভারে। সার্ভারের তথ্যগুলোই যাত্রী ও চালকের দুই প্রান্তে অ্যাপের মাধ্যমে দৃশ্যমান হয়। সার্ভারকে মূলত দুই ভাগে ভাগ করা হয়- ওয়েব সার্ভার ও অ্যাপ্লিকেশন সার্ভার। ওয়েব সার্ভার শুধুমাত্র নির্দিষ্ট তথ্যগুলোই ব্রাউজারের কাছে পাঠাতে পারে। যেমন- ছবি, অডিও, ভিডিও ইত্যাদি। আর অ্যাপ্লিকেশন সার্ভারে বিভিন্ন রকমের সফটওয়্যার সংযুক্ত থাকে। গ্রাহকের চাহিদামতো অ্যাপ্লিকেশন সার্ভার তথ্যকে সংযোজন, বিয়োজন কিংবা প্রক্রিয়া করতে পারে।
সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কাজ কী?
রাইড শেয়ারিং সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে মূলত বলা হয় পরিবহন নেটওয়ার্ক কোম্পানি। কারণ তারা কোনো পরিবহন সেবা প্রদান করে না, বরং চালক ও যাত্রীর মধ্যে একটি সংযোগ স্থাপন করে।
কোনো প্রতিষ্ঠান একবার রাইড শেয়ারিং সফটওয়্যারের সমন্বিত কার্য প্রক্রিয়াটাকে দাঁড় করানোর পর সেটা একধরনের স্বয়ংক্রিয় অবস্থায় চলে আসে। সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের মূল কাজ হয় সেবাসমূহকে নজরদারী, গ্রাহক সেবা ও অর্থনৈতিক বিষয়গুলো দেখভাল করা। সেই সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে ক্রমাগত প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হয় তাদের নেটওয়ার্কটাকে বড় করার। কারণ বেশি চালক, বেশি যাত্রী আর সেই সাথে বেশি লাভের অংক! কারণ প্রত্যেক রাইডের উপর একটা নির্দিষ্ট অংকের কমিশনই রাইডিং সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের আয়ের উৎস।
রাইড শেয়ারিং: কিছু তথ্য
- যাত্রীরা যেমন খুব সহজেই নিজের কাছাকাছি চালকদের অবস্থান দেখতে পান, কোনো চালক কিন্তু যাত্রীর গন্তব্য সাধারণত দেখতে পান না (যেমন উবার, লিফট)। কোনো রাইড গ্রহন করার পরই কেবল চালক যাত্রীর গন্তব্য সম্পর্কে জানতে পারেন। এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক কৌশল লুকনো থাকে, যাতে কোনো চালক তার পছন্দসই গন্তব্য না হলে তা এড়িয়ে না যায়।
- রাইড শেয়ারিং সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো মানচিত্র, যানজটের অবস্থা, দূরত্ব পরিমাপ ইত্যাদি অনেক বিষয়েই গুগল ম্যাপ কিংবা গুগল ট্রাফিক ইত্যাদি সেবাগুলো কাজে লাগায়। কাজেই এসবের পেছনে আলাদা করে বিনিয়োগের প্রয়োজন হয় না।
- নগদ টাকা কিংবা ই-ওয়ালেট- দু’ভাবেই পরিশোধ করার ব্যবস্থা রাখে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান। ভাড়া নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সাধারণত দূরত্ব, সময়, যানজট ইত্যাদি বিষয়কে হিসেবের আওতায় আনা হয়। আর যেকোনো রাইডেই একটি ‘বেজ প্রাইজ’ বা নির্ধারিত ভাড়া নির্ধারণ করা থাকে।
অ্যাপভিত্তিক এই সেবার উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটেছে গত এক দশকের মধ্যেই। এই সেবার পথিকৃৎ মূলত উবার ও লিফট। ২০০৯ সালে এই ধরনের সেবা নিয়ে আসে উবার, আর তার দুই বছর পর ২০১১ সালে আসে লিফট ও সাইডকার। লিফট ও উবারের মধ্যে প্রচন্ড রকম প্রতিযোগিতায় এই সেবা দ্রুতই জনপ্রিয় হয়।
- বাংলাদেশে ২০১৫ সালের দিকে রাইড শেয়ারিং সেবা প্রথম শুরু করে ‘চলো’ নামের দেশীয় প্রতিষ্ঠান। এরপর ২০১৬ সালের দিকে ‘শেয়ার এ মোটরসাইকেল’ বা ‘স্যাম’ ঢাকায় যাত্রা শুরু করে। এরপর ২০১৬ সালের নভেম্বরে উবার ঢাকায় যাত্রা শুরু করলে এই সেবা দ্রুতই জনপ্রিয় হয়। বর্তমানে এই সেবা দিচ্ছে প্রায় বিশটির মতো প্রতিষ্ঠান ।
যা-ই হোক, রাইড শেয়ারিং এখন একটি জনপ্রিয় ধারণার নাম। নিজের কোনো গাড়ি না থাকলেও সামান্য কারিগরি জ্ঞান আর ইচ্ছা থাকলে আপনি নিজেও শুরু করতে পারেন পরিবহন খাতে একটি রাইড শেয়ারিং সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান। কোনো না কোনো শহর হয়তো আছে আপনার অপেক্ষায়!
ফিচার ইমেজ- cleanfleetreport.com