প্রথম একদিনের আন্তর্জাতিক ওয়ানডে ম্যাচ মাঠে গড়ায় ১৯৭১ সালে ৫ই জানুয়ারি। এরপর প্রায় ৪০ বছর পর ২০১০ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি প্রথম ব্যাটসম্যান হিসাবে ওয়ানডেতে ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকায় কোনো ব্যাটসম্যান।
ব্যাট হাতে অনেক রেকর্ডের মালিক শচীন টেন্ডুলকার দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে এই কীর্তি গড়েন তিনি। এরপর রোহিত শর্মা তিনবার, ভিরেন্দর শেহওয়াগ, ক্রিস গেইল, মার্টিন গাপটিল, ফাখার জামান আন্তর্জাতিক একদিনের ম্যাচে ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকানোর গৌরব অর্জন করেছিলেন।
আন্তর্জাতিক একদিনের ক্রিকেটে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের ইনিংসটি রোহিত শর্মার দখলে থাকলেও লিস্ট-এ ক্রিকেটে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের ইনিংসটি রোহিতের দখলে নেই। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ২০১৪ সালে অপরাজিত ২৬৪ রানের ইনিংস খেলার এক যুগ আগে সারির মারকুটে ওপেনার আলিস্টার ব্রাউন কাউন্টি ক্রিকেটে ২৬৮ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। এই ওপেনার ১৯৯৭ সালে ৪০ ওভারের ম্যাচেও ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন। কিন্তু আলি ব্রাউন ইংল্যান্ডের হয়ে মাত্র ১৬টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছেন।
সারির তারকা ব্যাটসম্যান এবং ইনিংসের শুরু থেকেই বোলারদের উপর চড়াও হওয়া প্রথমদিককার কয়েকজন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে একজন আলি ব্রাউনকে নিয়েই আজকের লেখা।
১.
১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কা সবাইকে চমকে দিয়ে শিরোপা ঘরে তোলে। তাদের শিরোপা জয়ের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করেন দুই আক্রমণাত্মক ওপেনার সনাৎ জয়াসুরিয়া এবং রমেশ কালুভিতারানা। তারা দুইজন ইনিংসের প্রথম বল থেকেই প্রতিপক্ষের সেরা বোলারদের আক্রমণ করে খেলতেন। এবং ফিল্ডিং সীমাবদ্ধতার ১৫ ওভার যথাযথভাবে কাজে লাগাতেন। সেইসময় তাদের অনুকরণ করে অন্যান্য দলও ওয়ানডেতে হার্ড-হিটার ব্যাটসম্যানদেরকে দিয়ে ওপেন করাতো।
সেই সময়ে কাউন্টি ক্রিকেটে অন্যতম সেরা আক্রমণাত্মক ওপেনার ছিলেন সারির আলি ব্রাউন। ১৯৯৬ সালের ২৩শে মে দ্য ওভালে ভারতের বিপক্ষে অভিষেক ঘটে আলি ব্রাউনের। নিজের অভিষেক ম্যাচে তিনি ৫২ বলে ৩৭ রানের ইনিংস খেলেন। সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে রানের খাতা খোলার আগে সাজঘরে ফিরে গেলেও নিজের তৃতীয় ওয়ানডেতেই শতক হাঁকান ব্রাউন। ১৩৭ বলে দশটি চার এবং দুইটি ছয়ের মারে ১১৮ রানের ইনিংস খেলেন তিনি। শতক হাঁকানোর পরেও পরবর্তী ম্যাচে দল থেকে বাদ পড়েন ব্রাউন।
আলি ব্রাউন ইংল্যান্ডের হয়ে সর্বসাকুল্যে ১৬টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছেন। কখনোই তিনি একাধারে চারটি ওয়ানডের বেশি খেলার সুযোগ পাননি। যখনই খেলতে নামতেন, তখনই ভাবতে হতো এই ম্যাচে ভালো না খেললে পরবর্তী ম্যাচে তাকে বাদ দেওয়া হবে কি না! নব্বইয়ের দশকে ইংল্যান্ডের ওপেনাররা মোট দশটি শতক হাঁকিয়েছিলেন। তার মধ্যে একটি আলি ব্রাউনের, তবুও তিনি এর পরের ম্যাচে মূল একাদশে ছিলেন না।
২.
আধুনিক ক্রিকেটের জনক ইংল্যান্ড এখনও ওয়ানডে বিশ্বকাপ ঘরে তুলতে পারেনি। শুধুমাত্র ক্রিকেটারদের ব্যর্থতার কারণে তারা বিশ্বমঞ্চে ব্যর্থ, তা বলা যাবে না। বরাবরই টেস্ট ক্রিকেটকে গুরুত্ব দেওয়া ইংল্যান্ড ওয়ানডে বিশ্বকাপের জন্য সেভাবে প্রস্তুতিও নিতো না। এখন পর্যন্ত ইংল্যান্ডের কোনো ক্রিকেটার দুইশ ওয়ানডে ম্যাচ খেলার গৌরব অর্জন করেননি। সর্বোচ্চ ১৯৭ ওয়ানডে খেলা পল কলিংউডও ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছেন।
সারির হার্ড-হিটার ব্যাটসম্যান আলি ব্রাউনের সাথেও তা ঘটেছে। তিনি কখনও নির্বাচকদের সুনজরে ছিলেন না। ১৯৯৬ সালে ওয়ানডে ক্রিকেটে অভিষেক ঘটা আলি ব্রাউন তার পাঁচ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে মাত্র ১৬টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছেন। এই ১৬ ম্যাচে তিনি একটি শতক এবং একটি অর্ধশতক হাঁকিয়েছেন। ভারতের বিপক্ষে নিজের তৃতীয় ম্যাচে ১১৮ রানের ইনিংস খেলার পর ১৯৯৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৩১ বলে অর্ধশতক হাঁকিয়ে শেষপর্যন্ত ৪০ বলে ১১টি চারের মারে ৫৯ রানের ইনিংস খেলেন। এই দুইটি ম্যাচেই তিনি ম্যাচ সেরার পুরস্কার জেতেন।
৩.
আলিস্টার ডানকান ব্রাউনের লিস্ট-এ ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে ১৯৯০ সালে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ডাক পান এর দুইবছর পর ১৯৯২ সালে। কাউন্টি ক্রিকেটে অভিষেক ঘটার পর থেকে নিয়মিত পারফর্ম করে নির্বাচকদের নজরে আসেন ১৯৯৬ সালে। তারপর এই হার্ড-হিটার ব্যাটসম্যানকে ভারতের বিপক্ষে ঘরের মাটিতে অনুষ্ঠিত ওয়ানডে সিরিজে দলে ডাক দেয় ইংল্যান্ড। সুযোগ পেয়ে প্রথম ম্যাচে ৩৭ রান এবং দ্বিতীয় ম্যাচে ১১৮ রানের ইনিংস খেলে নিজের জাত চেনান তিনি। তবে এরপরের ম্যাচেই একাদশে জায়গা হয়নি ব্রাউনের।
একাদশে জায়গা না পেলেও ভেঙে পড়েননি আলি ব্রাউন। তিনি ১৯৯৭ সালের ২০শে জুলাই হ্যাম্পশায়ারের বিপক্ষে ৪০ ওভারের লিস্ট-এ ম্যাচে ২০৩ রানের ইনিংস খেলেন। তিনি ৫৬ বলে ১০০ রান, ৮৪ বলে ১৫০ রান এবং ১১৮ বলে ২০০ রান পূর্ণ করেন। তার ২০৩ রানের ইনিংসটিতে ১৯টি চার এবং ১১টি ছয়ের মার ছিলো।
দুর্দান্ত এই ইনিংসটি খেলার পর ১৯৯৭ সালের ১১ই ডিসেম্বর ভারতের বিপক্ষে দলে জায়গা করে নেন। ম্যাচটি ছিলো শারজাহ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ম্যাচ। তিনি ঐ টুর্নামেন্টের চার ম্যাচ খেলার পর আবারও দল থেকে বাদ পড়েন।
১৯৯৮ সালে কাউন্টিতে প্রথম শ্রেণির ম্যাচে মাত্র ৭২ বলে শতক হাঁকিয়ে আবারও আলোচনায় আসেন তিনি। ঐ বছর তিনি সবমিলিয়ে ছয়টি ওয়ানডে খেলার সুযোগ পান। তবে নিয়মিত সুযোগ পাননি। কয়েক ম্যাচ পারফর্ম করতে না পারলেই তাকে বাদ দেওয়া হতো। তবে যে কয়েক ম্যাচ সুযোগ পেয়েছেন ঐসব ম্যাচে নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী খেলতে পারেননি। ঐ বছর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ঝড়ো ৫৯ রানের ইনিংসটি ছিলো তার সর্বোচ্চ ইনিংস। ঐ ইনিংসে ৫৯ রান করে তিনি রান আউটের শিকার হয়েছিলেন।
আলি ব্রাউন ১৯৯৯ সাল এবং ২০০০ সালে ইংল্যান্ড দলে আর সুযোগ পাননি। তবে ঐ দুই মৌসুমে সারির হয়ে কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপ জেতেন তিনি। এবং ২০০০ সালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে নিজের সর্বোচ্চ ২৯৫* রানের ইনিংস খেলেন ব্রাউন। যার সুবাদে ২০০১ সালে আবারও দলে ডাক পান ব্রাউন। এইবারও মাত্র তিন ম্যাচ পরেই তাকে দল থেকে বাদ দেওয়া হয়। এই তিন ম্যাচও টানা খেলার সুযোগ পাননি তিনি। ঐ সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচ খেলার পর পরবর্তী তিন ম্যাচে দলের বাহিরে ছিলেন ব্রাউন। এরপর সিরিজের শেষ ম্যাচে দলে জায়গা পেলেও খেলেছেন মিডল অর্ডারে। ঐ সিরিজের পর তাকে আর দলে ডাক দেওয়া হয়নি।
৪.
২০০২ সালে দুর্দান্ত সময় কাটিয়েছিলেন আলি ব্রাউন। ঐ মৌসুমে সারির হয়ে কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ে বড় অবদান রেখেছিলেন আলি ব্রাউন।
২০০২ সালে লিস্ট-এ ক্রিকেটে গ্রায়েম পোলকের সর্বোচ্চ ২২২* রানের রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড গড়েছিলেন তিনি। দ্য ওভালে গ্ল্যামরগানের বিপক্ষে তিনি ২৬৮ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। যা এখন পর্যন্ত লিস্ট-এ ক্রিকেটে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রানের ইনিংস।
২০০২ সালের ১৯শে জুন দ্য ওভালে ন্যাটওয়েস্ট ট্রফির চতুর্থ রাউন্ডে গ্ল্যামরগানের বিপক্ষে টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সারি। ব্যাট করতে নেমে দুই উদ্বোধনীয় ব্যাটসম্যান ইয়ান ওয়ার্ড এবং আলি ব্রাউন ২৮৬ রান যোগ করেছিলেন। যা সারির হয়ে যেকোনো উইকেটে সর্বোচ্চ রানের জুটি। এর মধ্যে ইয়ান ওয়ার্ড ৯৫ বলে আটটি চার এবং চারটি ছয়ের মারে ৯৭ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। আলি ব্রাউন যখন সাজঘরে ফেরেন, তখন দলীয় সংগ্রহ ছিলো পাঁচ উইকেটে ৪৩১ রান। আলি ব্রাউন ১৬০ বলে ৩০টি চার এবং ১২টি ছয়ের মারে ২৬৮ রান করেন। তার দুর্দান্ত ইনিংসের উপর ভর করে সারি পাঁচ উইকেটে ৪৩৮ রান সংগ্রহ করেছিলো। পাহাড়সম রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে গ্ল্যামরগানও শেষপর্যন্ত লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন। এক বল বাকি থাকতে সবক’টি উইকেট হারানোর আগে ৪২৯ রান সংগ্রহ করেছিলো তারা।
আলি ব্রাউন ২০০৩ সালে ঐতিহাসিক টি-টোয়েন্টি কাপের ফাইনালে ৩৪ বলে অপরাজিত ৫৫ রানের ইনিংস খেলে সারির জয় নিশ্চিত করেন। ২০০৬ সালে তিনি লিস্ট-এ ক্রিকেটে ৩০টি ছয় হাঁকিয়েছিলেন। ঐ মৌসুমে তার চেয়ে বেশি ছয় হাঁকিয়েছিলেন শুধুমাত্র ক্যামেরুন হোয়াইট। এরকম দুর্দান্ত পারফর্ম করার পরেও ইংল্যান্ড দলে ডাক পাননি তিনি।
৫.
আলি ব্রাউন ২০০৭ সাল মৌসুম শুরু করেন গ্লৌচেস্টারশায়ারের বিপক্ষে মাত্র ৫০ বলে শতক হাঁকিয়ে। ঐ ম্যাচে জেমস বেনিংকে সাথে নিয়ে ২৯৪ রান যোগ করেছিলেন আলি ব্রাউন, যা সারির হয়ে যেকোনো উইকেটে সর্বোচ্চ রানের জুটি। পূর্বের রেকর্ডটিতেও তার অবদান ছিলো। গ্লৌচেস্টারশায়ারের বিপক্ষে তিনি ঐ ম্যাচে মাত্র ৯৭ বলে ২০টি চার এবং আটটি ছয়ের মারে ১৭৬ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। তার সঙ্গী জেমস বেনিং ১৩৪ বলে ১৫২ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। তাদের দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ের উপর ভর করে সারি ৫০ ওভার শেষে চার উইকেটে ৪৯৬ রান সংগ্রহ করেছিলো, লিস্ট-এ ক্রিকেটে যা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহ।
আলি ব্রাউন ২০০৮ মৌসুম শেষে সারি থেকে নটিংহ্যামশায়ারে যোগ দেন। এরপর ২০১১ সালে সবধরনের ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দেন তিনি। নিজের শেষ মৌসুমে নটিংহ্যামশায়ারের হয়ে কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছিলেন ব্রাউন।
আলিস্টার ডানকান ব্রাউন ১৯৭০ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি কেন্টে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৯২ সালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক হওয়ার পর ২৮৫ ম্যাচে ৪৭টি শতক এবং ৭৫টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৪২.৬৭ ব্যাটিং গড়ে ১৬,৮৯৮ রান করেছেন তিনি। তবুও কখনও ইংল্যান্ডের হয়ে টেস্ট ক্রিকেট খেলার সুযোগ হয়নি তার।
লিস্ট-এ ক্রিকেটে আলি ব্রাউন ৪০৪ ম্যাচের ৩৮৬ ইনিংস ব্যাট করে ৩০.৬৭ ব্যাটিং গড়ে ১৯টি শতক এবং ৫০টি অর্ধশতকের সাহায্যে ১১,২৫৭ রান করেছেন। ইংল্যান্ডের হয়ে লিস্ট-এ ক্রিকেটে দশ হাজারের বেশি রান করা স্বল্পসংখ্যক ক্রিকেটারদের মধ্যে তিনি একজন। ক্রিকেটের আধুনিক ফরম্যাট টি-টোয়েন্টিতেও তিনি ভালো নৈপুণ্য দেখিয়েছিলেন। ৭৯টি টি-টোয়েন্টিতে ১৪৯.৮৭ স্ট্রাইক রেইটে ১,৭৫৮ রান করেছেন। তবুও তিনি কখনও ইংল্যান্ডের হয়ে টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি।
লিস্ট-এ ক্রিকেটে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রানের ইনিংসের মালিক আলিস্টার ডানকান ব্রাউন সারির অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান হিসাবে ক্যারিয়ার শেষ করলেও ইংল্যান্ডের হয়ে মাত্র ১৬টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছেন।
ফিচার ইমেজ: Getty Images