Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সিন্ধুতে সম্রাট হুমায়ুন: পদে পদে ছেয়ে যাচ্ছিল ব্যর্থতায়

১৫৪১ সালের ২৬ জানুয়ারী সম্রাট হুমায়ুন চেনাব নদী পেড়িয়ে সিন্ধুর ভক্করের (Bukkur) রোহরীতে পৌঁছান। সিন্ধু হচ্ছে বর্তমান পাকিস্তানের চারটি প্রদেশের গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রদেশ। 

সিন্ধুর উত্তরে পাঞ্জাব, পূর্বে রাজপুত রাজ্য রাজপুতানা, দক্ষিণ-পূর্বে গুজরাট, পশ্চিমে বেলুচিস্তান আর দক্ষিণ-পশ্চিমে আছে বিস্তৃত সমুদ্র। স্বাভাবিকভাবেই সিন্ধুর ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক বেশি ছিল। তাই সবদিক ভেবে সম্রাট হুমায়ুন সিন্ধুর দিকেই অগ্রসর হলেন।

সম্রাট সিন্ধুতে গেলেন বটে, তবে সিন্ধুর শাসক শাহ হুসেন খুব বেশি খুশি হলেন না। যদিও তিনি সম্রাট বাবরের নামেই খুতবা পড়াতেন, এমনকি সম্রাটের গুজরাট আক্রমণের সময় তিনি উত্তর দিক থেকে গুজরাট আক্রমণ করে সম্রাটকে সহায়তাও করেছিলেন। কিন্তু তখন হুমায়ুন ছিলেন রাজ্যহারা। একজন রাজ্যহারা রাজা একটি রাজ্য ছাড়া আর কী-ই বা চাইতে পারে? আর অবস্থায় হুমায়ুন যে সিন্ধুর দিকে হাত বাড়িয়ে দেবেন না, তার নিশ্চয়তা কোথায়?

এদিকে সম্রাট হুমায়ুন ভক্করের রোহরীতে পৌঁছানোর সাথে সাথেই সতর্কতা হিসেবে ভক্করের গভর্নর সুলতান মাহমুদ দ্রুত রোহরী ত্যাগ করে ভক্কর দ্বীপের দুর্গে চলে গেলেন। তবে তিনি সম্রাটের বিপদের কথা জানতেন। সম্রাট আর সম্রাটের বাহিনীর জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পাঠিয়ে দিলেন।

১৮৩৮ সালে অঙ্কন করা ভক্কর দুর্গের একটি তৈলচিত্র; Image Source: flickr.com

এদিকে পরিস্থিতি প্রতিকূল দেখে সম্রাট আমীর তাহির আর আমীর সমন্দর নামক দুজন দূত পাঠালেন শাহ হুসেনের দরবারে। সম্রাট প্রথমেই বিনা অনুমতিতে সিন্ধুতে প্রবেশের জন্য শাহ হুসেনের নিকট ক্ষমা চাইলেন। তিনি শাহ হুসেনকে এই বলে আশ্বস্তও করলেন যে, সিন্ধু অধিকার করার কোনো ইচ্ছে তার নেই। শুধুমাত্র পরিস্থিতির কারণেই তিনি সিন্ধুতে আসতে বাধ্য হয়েছেন।

দূতের মাধ্যমে সম্রাট শাহ হুসেনের কাছে তিনটি জিনিস চাইলেন। এক, শাহ হুসেন সম্রাটের সামনে এসে উপস্থিত হোক। দুই, মুঘলদের গুজরাট আক্রমণে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা হোক। তিন, হেরেমের নারীদের নিরাপত্তার জন্য ভক্কর দুর্গটি কিছুদিনের জন্য মুঘলদের ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হোক।

শাহ হুসেন দেখলেন এ তো বিশাল ঝামেলা। রাজ্যহীন সম্রাটকে সাহায্য করার মানে হচ্ছে নিশ্চিতভাবেই শের শাহকে সিন্ধুতে আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসা। তাই তিনি যেভাবেই হোক হুমায়ুনকে এড়িয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তবে মুখে সম্রাটের নিকট হাজির হওয়া আর সম্রাটকে গুজরাট আক্রমণে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিলেন।

এরপর দ্রুত নিজের কন্যার সাথে কামরান মির্জার বিয়ে ঠিক করে সম্রাটকে বার্তা পাঠালেন কন্যার বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার কারণে তিনি এ মুহূর্তে সম্রাটের সাথে দেখা করতে পারছেন না। সম্রাট যেন ব্যাপারটিকে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখেন।

এদিকে সম্রাট ভক্করে অবস্থানকালে স্থানীয় সাফিয়ানি আর দরিজা গোত্রের অনেক যোদ্ধা সম্রাটের বাহিনীতে ভর্তি হলো। এতে সম্রাটের সামরিক শক্তি কিছুটা বেড়ে গেল। তবে সেই সাথে শিবিরে খাদ্য সংকটও বেড়ে গেল। ‘হুমায়ুননামা’ গ্রন্থের লেখক সম্রাটের বোন গুলবদন বেগম পরিস্থিতির বর্ননা করেছেন এভাবে,

খাদ্যদ্রব্য কখনো পাওয়া যেত, কখনো যেত না। ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য সৈন্যরা কখনো কখনো নিজেদের ঘোড়া ও উট জবাই করে খাচ্ছিল।

এদিকে সেনাবাহিনীতে সৈন্য ভর্তি করানো শুরু হলে শাহ হুসেন আতঙ্কিত হয়ে গেলেন। তিনি সম্রাটের শিবিরের খাদ্য সংকটের কথা জানতেন। তিনি সম্রাটকে পত্র পাঠিয়ে অনুরোধ করলেন সম্রাট যেন হাজকানে চলে যান। সেখানে প্রচুর খাদ্যশস্য পাওয়া যায়। আসলে ভদ্র ভাষায় শাহ হুসেন সম্রাটকে বলার চেষ্টা করলেন, আমার এলাকার বাইরে বেরিয়ে যান!

সম্রাট হুমায়ুনের নির্বাসনকালীন জীবনের বিভিন্ন ঘটনার সাথে সম্পর্কযুক্ত স্থান। এই লেখায় যে সময়ের কথা আলোচনা করা হচ্ছে, সে সময় সম্রাট ২ ও ৩ নাম্বার স্থানে ছোটাছুটি করছিলেন; Image Source: farbound.net

কথায় আছে, প্রেম ভালোবাসা নাকি স্থান-কাল-পাত্র কিছুই মানে না। সম্রাট হুমায়ুন নিজেই তার জীবনে এ কথাটি প্রমাণ করে দিয়েছিলেন। সম্রাটের শিবির থেকে বেশ কিছুটা দূরে পাত নামক জায়গায় মির্জা হিন্দালের শিবির অবস্থিত ছিল। একদিন সম্রাট মির্জা হিন্দালের শিবিরে গেলেন। উদ্দেশ্য হিন্দালের মা দিলদার বেগমসহ নিজ হেরেমের নারীদের সাথে সাক্ষাৎ করা। এই সাক্ষাৎকালেই সম্রাটের চোখ পড়ে যায় এক তরুণীর উপর। প্রথম দেখাতেই সেই তরুণীকে তিনি পছন্দ করে ফেললেন।

পরবর্তীতে সম্রাট হিন্দাল মির্জার কাছে সেই তরুণীর পরিচয় জানতে চান। হিন্দাল মির্জা জানান তরুণীর নাম হামিদা বানু। তার বাবা দোস্ত বেগ হিন্দাল মির্জার ধর্মীয় শিক্ষক। প্রসঙ্গত সম্রাট এটাও জানতে পারলেন হামিদা বানু এখনো অবিবাহিত এবং তার কোনো বাগদান হয়নি। পরের দিনই সম্রাট হুমায়ুন দিলদার বেগমের কাছে গিয়ে হামিদা বানুকে বিয়ে করার আগ্রহ প্রকাশ করলেন। যদিও এসময় সম্রাটের স্ত্রীর সংখ্যা ছিল ছয়জন।

সম্রাটের এই ইচ্ছার কথা শুনলেন হিন্দাল মির্জাও। শুনেই তিনি ভয়ানক রেগে গেলেন। রেগে সম্রাটকে বললেন,

আপনি আমাকে সান্ত্বনা কিংবা উৎসাহ দিতে আসেননি। এসেছেন নিজের জন্য স্ত্রীর ব্যবস্থা করতে। আপনি যদি এখনই এ ধরনের চিন্তাভাবনা ত্যাগ না করেন, তাহলে আমি আপনাকে ছেড়ে চলে যাবো।

হিন্দালের কথায় সম্রাট হুমায়ুন কিছু না বলে চুপ করে উঠে গেলেন। তিনি মন খারাপ করলেন নাকি ক্রোধান্বিত হলেন তা ঠিক বোঝা গেল না।

এদিকে দিলদার বেগম পড়লেন বেশ ভালো বিপদে। তিনি হুমায়ুনকে পছন্দ করতেন। হুমায়ুনের সাথে হিন্দালের এমন আচরণের জন্য তিনি কষ্ট পেলেন। তিনি হিন্দালকে ডেকে এনে মৃদু ভৎসর্না করলেন। আর হুমায়ুনের মন রক্ষায় তিনি তার নিকট পত্র লিখে জানালেন হুমায়ুনের সাথে হামিদা বানুর বিয়ের ব্যপারটি তিনি নিজেই দেখবেন। অগত্যা হিন্দাল মির্জার এই ব্যাপারটি মেনে নেওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় রইলো না।

কিছুদিন পর সম্রাট আবারো হিন্দালের শিবিরে আসলেন। দিলদার বেগমের সাথে দেখা করার পর সম্রাট হামিদা বানুর সাথে দেখা করার ইচ্ছা পোষণ করলেন। হামিদা বানুর নিকট সম্রাটের ফরমান পাঠানো হলো। তবে হামিদা বানু আসলেন না। সাফ জানিয়ে দিলেন সম্রাট তার জন্য গায়রে মাহরাম। সম্রাটের সাথে তার একবার ঘটনাক্রমে দেখা হয়ে গেছে, দ্বিতীয়বার দেখা করা জায়েজ নয়। এমনকি তিনি সম্রাটকে বিয়ে করতেও ইচ্ছুক নন।

দিলদার বেগম হামিদা বানুকে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। তিনি কিছুতেই সম্রাটকে বিয়ে করতে রাজী নন। তিনি বললেন,

বিয়ে তো আমি কাউকে অবশ্যই করবো। কিন্তু তাকে এমন মানুষ হতে হবে যার দারিদ্রতা আমার হাত স্পর্শ করবে। আমি এমন কাউকে বিয়ে করবো না, যার সীমানাও আমি স্পর্শ করতে পারবো না।

প্রায় ৪০ দিন সম্রাট অপেক্ষা করলেন। হামিদা বানু সম্রাটের সাথে দেখা করলেন না। তবে শেষ পর্যন্ত হামিদা বানুর অমত ধোপে টেকেনি। একপর্যায়ে প্রায় পথে বসা সাম্রাজ্যহীন এই সম্রাটকে বিয়ে করতে তিনি মত দেন।

১৫৪১ সালের ২৯ আগস্ট মুঘল সম্রাট নাসিরুদ্দিন মুহাম্মদ হুমায়ুন ও হামিদা বানুর বিয়ে হয়ে গেল। সম্রাটের বিয়ে পড়ালেন সম্রাট বাবরের আমলের খুবই বিশ্বস্ত একজন আমির মীর আবুল বকা। উপহার হিসেবে মীর আবুল বকাকে দুই লক্ষ রৌপ্য মুদ্রা প্রদান করা হলো।

হামিদা বানু কেন সম্রাটকে বিয়ে করতে ইচ্ছুক ছিলেন না, এ বিষয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। স্যার রিচার্ড বর্ন ও ড. ভিনসেন্ট স্মিথের বলেছেন, হামিদা বানু সম্ভবত অন্য কাউকে ভালোবাসতেন। অন্যদিকে সম্রাটের পানিবাহক জওহর আবতাবচি লিখেছেন, হামিদা বানুর বিয়ের কথবার্তা চলছিল। তবে কারো সাথে বাগদান সম্পন্ন হয়নি।

সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য মত হচ্ছে, সামাজিক মর্যাদাগত পার্থক্যের জন্যই হামিদা বানু সম্রাটকে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। তিনি এমন কাউকে বিয়ে করতে চাইতেন, যিনি তার জীবন ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে দেবেন, যার কাছে চাইলেই তার মনের চাহিদাটি যাওয়া যাবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে একজন সম্রাট তেমন নন। পাত্র হিসেবে যতই যোগ্য হোক না কেন, সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে সম্রাটদের মতো দায়িত্বশীল পদের কোনো ব্যক্তির পক্ষে হামিদা বানুর ইচ্ছে পূরণ করা সাধারণত অসম্ভব ছিল।

তবে শেষ পর্যন্ত সম্রাট হুমায়ুন ও হামিদা বানুর বিয়েটি সম্পন্ন হয়েছিল। সম্রাট হুমায়ুন ও হামিদা বানুর এই বিয়েটি শুধু একটি বিয়েই ছিল না, বরং ঐতিহাসিক দিক থেকে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় ছিল। হামিদা বানু একজন শিয়া মতাবলম্বী ছিলেন। সম্রাট যখন সব হারিয়ে পারস্যে আশ্রয় নেন, তখন হামিদা বানুর এই পরিচয়টি বেশ কয়েকবার সম্রাটাকে বিপদ থেকে রক্ষা করেছিল।

আর পরবর্তীতে এই বিয়ের মাধ্যমে সবচেয়ে উপকৃত হয়েছিল শিয়া সম্প্রদায়। সম্রাট হুমায়ুন যখন পুনরায় হিন্দুস্তান অধিকার করেছিলেন, তখন অনেক শিয়াই সাম্রাজ্যের উঁচু পদে উঠতে সমর্থ হয়েছিল। অন্যদিকে হামিদা বানুর গর্ভে একটি পুত্রসন্তান জন্মেছিল। যিনি পরবর্তী মুঘল সাম্রাজ্যের সম্রাট হয়েছিলেন। বেশ কিছু বিতর্কিত কাজ বাদ দিলে, সেই পুত্রসন্তান শুধু হিন্দুস্তানই নয়, বরং সারা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন সম্রাট হিসেবে নিজেকে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছিলেন।

সম্রাট হুমায়ুন হামিদা বানুকে বিয়ে করলেন ঠিকই, কিন্তু এর ফলে বিপদের দিনের বিশ্বস্ত ভাই হিন্দাল মির্জাকে হারালেন। সম্রাট হামিদা বানুকে বিয়ে করার পরেই হিন্দাল মির্জা অভিমান করে সম্রাটকে ছেড়ে কান্দাহারের দিকে চলে যান। হিন্দাল মির্জা সম্রাটের এই বিয়ের ব্যাপারে একমত ছিলেন না। চাপে পড়ে তিনি মত দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।

আসলে মির্জা হিন্দালকে দোষও দেওয়া যায় না। মুঘল সাম্রাজ্য সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হয়েছে। সম্রাট আর তার বিশ্বস্ত লোকেরা বিশৃঙ্খল একটা সেনাবাহিনী নিয়ে এলোমেলো ঘুড়ে বেড়াচ্ছে। বেশিরভাগ লোকই সম্রাটকে ত্যাগ করছে, এমন অবস্থায় সম্রাটের মাথায় চিন্তা থাকা উচিত ছিল কীভাবে হারনো ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করা যায়। সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে সম্রাট হুট করে দেখা মাত্রই নিজের চেয়ে ১৯ বছর ছোট এক মেয়েকে বিয়ে করে ফেললেন। তাও আবার নিজের ৬ জন স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও। এ ব্যাপারটিতে যে কেউই রাগ করবে। হিন্দাল মির্জাও তা-ই করেছেন। 

পরিণত বয়সে যুবরাজ মির্জা হিন্দাল; Image Source: Wikimedia Commons

এদিকে সিন্ধুর শাসক শাহ হুসেন হুমায়ুনকে সহায়তার নানা আশ্বাস দিলেও কোনো প্রতিশ্রুতিই তিনি রক্ষা করছিলেন না। তিনি বিভিন্নভাবে সম্রাটকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখছিলেন। শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে সম্রাট ভক্কর ও সেহওয়ান আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এসব ১৫৪১ সালের সেপ্টেম্বরের ঘটনা।

সে বছরই ৬ নভেম্বর সম্রাট ভক্কর থেকে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার দূরে সেহওয়ান দুর্গ অবরোধ করেন। মুঘলদের যুদ্ধ ঘোষণার প্রেক্ষাপটে সিন্ধুর শাসক শাহ হুসেন ভক্করে শক্তিবৃদ্ধি করে ভক্করে অবস্থান নেন। সিন্ধু তার নিজের এলাকা হওয়ায় তিনি বেশ কিছু ভৌগোলিক সুবিধা নিতে পেরেছিলেন, যার কারণে সম্রাট শীঘ্রই বেকায়দায় পড়ে যান। তিনি সম্রাটের শিবিরের রসদ সরবরাহ বন্ধ করে দিতে সক্ষম হন। ফলে যুদ্ধক্লান্ত মুঘল যোদ্ধারা তীব্র খাদ্য ও পানীয় সংকটে পড়ে যায়।

সেহওয়ান দুর্গ, আজ প্রায় ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। কথিত আছে, গ্রিক বীর আলেক্সান্ডার এই দুর্গটি নির্মাণ করিয়েছিলেন। তাই দুর্গটিকে আলেক্সান্ডারের দুর্গও বলা হয়; Image Source: discover-pakistan.com

সম্রাটকে আরো বেকায়দায় ফেলে দেয় দলত্যাগী আমিররা। চরম বিপদে সম্রাটের বাহিনীতে যেন দলত্যাগের হিড়িক পড়ে যায়। মুঘল শিবিরের এই দুর্দিনের পূর্ণ সুযোগ নেন শাহ হুসেন। তিনি হুমায়ুনের দলত্যাগে উৎসাহ দেয়ার জন্য মুক্ত হস্তে সম্পদ বিলাতে থাকেন। ফলশ্রুতিতে, খাজা গিয়াসউদ্দিন আর মীর তারিহের মতো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা হুমায়ুনকে ত্যাগ করে শাহ হুসেনের দলে যোগ দেন। 

প্রবাদ আছে, হাতি গর্তে পড়লে চামচিকাও লাথি মারে। ইয়াদগার নাসির মির্জা এই প্রবাদটাই যেন জীবন্ত করে তুললেন। হুমায়ুনের এই দুর্দিনের দুর্বলতার সুযোগে ইয়াদগার নাসির মির্জা বেঁকে বসেন। তিনি শর্ত দেন, সম্রাটকে তিনি সাহায্য করবেন, তবে সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার করলে তাকে সাম্রাজ্যের ভাগ দিতে হবে। উপায় না পেয়ে সম্রাটকে রাজী হতে হয়। কারণ সম্রাটের পাশে তার ভাইদের কেউই আর নেই। আর নিজের হারানো ভুখণ্ড পুনরুদ্ধার করতে হলে সম্রাটকে অবশ্যই ইয়াদগার নাসিরের সাহায্য নিতে হবে।

সম্রাট বাবরের বিশ্বস্ত আমির মীর আবুল বকার মধ্যস্ততায় ইয়াদগার নাসির মির্জা সাম্রাজ্যের তিন ভাগের এক ভাগ অংশ পাবেন, এই চুক্তিতে সম্রাটকে সাহায্য করার ব্যাপারে অঙ্গীকার করেন।

এর ফলে মুঘল সেনাবাহিনী দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল। একভাগ সম্রাট হুমায়ুনের পক্ষে, অন্য ভাগ ইয়াদগার নাসির মির্জার পক্ষে। যে সময় মুঘলদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল, সেসময় এভাবে বিভক্ত হয়ে মুঘলরা তাদের সুযোগ নষ্ট করছিল।

এদিকে ইয়াদগার নাসির মির্জা তখন ব্যস্ত ছিলেন ভক্করের রোহরীতে। তিনি রোহরী দুর্গে মরণকামড় দিয়েছেন, কিন্তু পদানত করতে পারছিলেন না। বিপরীতে রোহরী দুর্গও নাসির মির্জাকে পরাজিত করতে পারছিল না। সমানে সমানে লড়াই চলছিল।

কিন্তু এদিকে সেহওয়ানে বিপদে পড়লেন সম্রাট হুমায়ুন। তার শিবিরে দলত্যাগ এতটা মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল যে আক্রমণের জন্য কোনো সৈন্যই আর সম্রাটের হাতে অবশিষ্ট ছিল না। তাছাড়া সম্রাটের বিপুল সংখ্যক সৈন্য শাহ হুসেনের হাতে আটক হয়েছিল। সম্রাটের বাহিনীতে থাকা বাকি যোদ্ধাদের আতঙ্কগ্রস্থ করে তুলতে শাহ হুসেন বন্দী যোদ্ধাদের নদীতে ফেলে হত্যার নির্দেশ দেন। দেখতে দেখতে কয়েক দিনেই বিপুল সংখ্যক যোদ্ধাকে নদীতে ফেলে হত্যা করা হয়।

গুলবদন বেগম এভাবে নিহত মুঘল যোদ্ধার সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার বলেছেন। তবে সংখ্যাটা অতিরঞ্জিত। সম্রাটের সাথে এত বেশি যোদ্ধা থাকলে তিনি অনায়াসেই সেহওয়ান দখল করে নিতে পারতেন।

উপায় না পেয়ে সম্রাট ইয়াদগার নাসির মির্জার কাছে সাহায্যের হাত বাড়ালেন। ইয়াদগার নাসির মির্জা তড়িৎ গতিতে তরদী বেগ আর কাসিম বেগকে সম্রাটের নিকট প্রেরণ করলেন। নিজেও সম্রাটের নিকট যাওয়ার প্রস্তুতি নিলেন। 

মাঠের বাইরে থেকে এই খেলা দেখছিলেন আরেকজন। তিনি হলেন শাহ হুসেন। তিনি বুঝলেন মুঘলদের মাঝে যা একটু ঐক্য এখন আছে, তা ভেঙ্গে ফেলার এখনই মোক্ষম সময়। পুত্রহীন শাহ হুসেন ইয়াদগার নাসির মির্জার সাথে নিজের মেয়ের বিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিলেন। সেই সাথে আরো প্রস্তাব দিলেন তারা দুজনে মিলে গুজরাট দখল করে সিন্ধুর সাথে একীভূত করবেন।

ইয়াদগার নাসির মির্জা লোভের কাছে পরাজিত হলেন। তিনি ভেবে দেখলেন পুত্রহীন শাহ হুসেনের মেয়েকে বিয়ে করার মানে শাহ হুসেনের পর তিনিই সিন্ধুর শাসক হতে যাচ্ছেন। অন্যদিকে হুমায়ুনের সাথে থাকলে ভবিষ্যতের কোনো নিশ্চয়তা নেই। নিমেষেই তিনি তার দীর্ঘদিনের সম্রাট হুমায়ুনের আনুগত্য ত্যাগ করে তরদী বেগ আর কাসিম বেগকে ফেরত আসতে বললেন। অবশ্য তার এই বিশ্বাসঘাতকতার কথা তিনি তখনই প্রচার করলেন না।

ইয়াদগার নাসির মির্জার কাছ থেকে সেনা সহায়তা না পেয়ে সম্রাটকে সেহওয়ান অবরোধ পরিত্যাক্ত করতে হলো। তিনি ভক্করে ফেরত আসলেন। নাসির মির্জার কাছ থেকেও আশানুরূপ সাহায্য কিংবা আন্তরিকতা পাওয়া গেল না। একদিকে তার শিবিরে প্রচণ্ড খাদ্যভাব, অন্যদিকে শিবিরে দলত্যাগীদের সংখ্যা ক্রমেই আশঙ্কাজনক হারে বেড়েই চলছে।

শেষমেশ উপায় না পেয়ে সম্রাট ইয়াদগার নাসির মির্জাকে আবেগঘন এক পত্র পাঠালেন। পত্রে তিনি লিখলেন,

বাবা, তুমি আমার পুত্রের মতো। আমি আশা করেছিলাম তুমি আমার হয়ে শাহ হুসেনকে প্রতিরোধ করবে। সবসময়ই আশা ছিল আমার দুঃসময়ে আমি তোমাকে পাশে পাবো। কিন্তু তুমিও আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সম্রাট হুমায়ুনের সাথে ইয়াদগার নাসির মির্জার পিতা-পুত্রের মতো সম্পর্ক ছিল।

মুঘল সম্রাট হুমায়ুন; Image Source: Wikimedia Commons

ইয়াদগার নাসির মির্জার বিশ্বাসঘাতকতার পর সম্রাট হুমায়ুন তার ভবিষ্যত নিয়ে হতাশ হয়ে পড়লেন। তিনি সব ছেড়েছুড়ে মক্কা চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। সে যাত্রায় সম্রাটের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করালেন হামিদা বানুসহ সম্রাটের বিশ্বস্ত যোদ্ধা আর আমিরেরা। ঠিক তখনই হঠাৎ সম্রাটের মালদেবের কথা মনে পড়লো। সেহওয়াত আক্রমণের কয়েকমাস আগেই মালদেব তাকে যোধপুরে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সম্রাট মালদেবের আমন্ত্রণে সেখানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।

সম্রাট হুমায়ুনের লক্ষ্য এবার যোধপুর।  

মুঘল সাম্রাজ্য নিয়ে পূর্বে প্রকাশিত সবগুলো পর্ব একসাথে পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

তথ্যসূত্র

১. মোগল সম্রাট হুমায়ুন, মূল (হিন্দি): ড হরিশংকর শ্রীবাস্তব, অনুবাদ: মুহম্মদ জালালউদ্দিন বিশ্বাস, ঐতিহ্য প্রকাশনী, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারী ২০০৫

২. হুমায়ুননামা, মূল: গুলবদন বেগম, অনুবাদ: এ কে এম শাহনাওয়াজ, জ্ঞানকোষ প্রকাশনী, প্রকাশকাল: জানুয়ারী ২০১৬

ফিচার ইমেজ- kindertravelguide.com

Related Articles