প্রযুক্তির জগত প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। আজকে আপনি যে মডেলের একটি স্মার্টফোন কিনলেন, কিছুদিন পরই এর উন্নত সংস্করণ এসে হাজির হবে বাজারে। এখানে স্থির হয়ে থাকার কোনো সুযোগ নেই, প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ডিভাইস ও সিস্টেমের উন্নয়নের ধারা অব্যহত রাখতে হবে। এ গতি ধরে রাখার জন্য কোম্পানিগুলোকে সচেষ্ট থাকতে হয় সবসময়। এ প্রতিনিয়ত উন্নতির প্রবণতা ইলেকট্রনিক্সের শুরু থেকেই চলে এসেছে।
বিশ শতকের শুরুর দিকটা ইলেকট্রনিক্সের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়ে ভ্যাকুয়াম ডায়োড, ট্রায়োড ডিভাইসের কল্যাণে সত্যিকারের ইলেকট্রনিক্সের গোড়াপত্তন হয়, মানুষের হাতে আসে ইলেকট্রন নামক অমিত সম্ভাবনাময় একটি সত্ত্বাকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা (এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে এ নিবন্ধটিতে)। রেডিও, টেলিফোন ইত্যাদি যোগাযোগ ব্যবস্থায় ভ্যাকুয়াম ইলেকট্রনিক্স এক অসাধারণ জোয়ার নিয়ে আসে। এরপর থেকে এ ভ্যাকুয়াম ডিভাইসকে প্রতিনিয়ত উন্নত করে, ইলেকট্রনিক্সের অগ্রগতি চলছিল।
চল্লিশের দশকের মাঝামাঝিতে এসে ইলেকট্রনিক্স জগতের এ অগ্রগতি কিছুটা স্থবির হয়ে পড়ে। কারণ ভ্যাকুয়াম ট্রায়োড এ সময় উন্নতির সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এ সময় সবাই বুঝতে পেরেছিলেন, ভ্যাকুয়াম ট্রায়োডের বিকল্প খোঁজার সময় চলে এসেছে। AT&T কোম্পানির প্রসিদ্ধ গবেষণাগার বেল ল্যাবরেটরিজে তখন শুরু হয় সেমিকন্ডাক্টর ডিভাইসের মাধ্যমে ট্রায়োডের বিকল্প খোঁজার প্রচেষ্টা। তারা এমন একটি সেমিকন্ডাক্টর ডিভাইস উদ্ভাবন করতে গবেষণা শুরু করেন, যা বিদ্যুৎ সিগন্যাল এমপ্লিফিকেশন ও সুইচিং করতে পারবে। (বেল ল্যাবস ও তাদের এ প্রচেষ্টা শুরুর বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে এ নিবন্ধটিতে)।
বেল ল্যাবসের গবেষকদের এ প্রচেষ্টা থেকেই আবিষ্কৃত হয় ট্রানজিস্টর। একটি ক্ষুদ্র ডিভাইস, যার হাত ধরে ইলেকট্রনিক্সের জগত সমূলে বদলে যায় (এ বৈপ্লবিক পরিবর্তনের বিষয়ে বিস্তারিত আছে এ নিবন্ধটিতে)। আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয় হলো এ অনন্য ডিভাইসটির উদ্ভাবনের গল্প। শুধু প্রযুক্তিগত উন্নতিই নয়, এখানে দেখা মেলে অসাধারণ মেধাবী সব ইঞ্জিনিয়ার ও তাদের ঈর্ষা-দ্বন্দ্বের গল্পও।
দৃশ্যপটে সেমিকন্ডাক্টরের আগমন
মূল কাহিনীতে প্রবেশ করার পূর্বে চলুন একটু এর আগে সেমিকন্ডাক্টর নিয়ে কী কী কাজ হয়েছিল সেদিকে একটু চোখ বুলিয়ে নেয়া যাক।
- ১৮৭৪ সালে জার্মান বিজ্ঞানী কার্ল ফার্ডিন্যান্ড ব্রাউন আকস্মিকভাবে গ্যালেনা (লেড সালফাইড) পদার্থ দিয়ে রেক্টফায়ার ডিভাইস (ডায়োড) তৈরি করতে সক্ষম হন। গ্যালেনা রেক্টিফায়ার মানের দিক থেকে ছিল একদমই দুর্বল প্রকৃতির।
- ১৮৯৮ সালে বাঙালী বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু ব্রাউনের রেক্টিফায়ারকে ব্যবহার করেন তড়িৎ-চুম্বক তরঙ্গের রিসিভারে। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম সেমিকন্ডাক্টর ডিভাইসের পেটেন্টও তার।
- পরবর্তীতে শখের রেডিও অপারেটররা কম খরচে নিজেদের রেডিও তৈরি করতে রিসিভার হিসেবে এটি ব্যবহার করতে শুরু করে।
- গ্যালেনার থেকে উন্নত পদার্থ খুঁজতে গিয়ে দেখা যায় সিলিকন, জার্মেনিয়ামসহ পর্যায় সারণির চৌদ্দ নাম্বার গ্রুপের মৌলগুলো এ বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে।
- সেমিকন্ডাক্টর সম্পর্কে তখনো তেমন কেউ বিস্তারিত জানতো না। সর্বপ্রথম এর বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করেন বৃটিশ বিজ্ঞানী অ্যালান এইচ উইলসন।
- ১৯৩১ সালে উইলসন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নীতি প্রয়োগ করে সেমিকন্ডাক্টরের বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করতে সমর্থ্য হন। তার কাজের ফলে সেমিকন্ডাক্টর নিয়ে গবেষণা সলিড-স্টেট ফিজিক্সের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে।
- ১৯৩৮ সালে জার্মান বিজ্ঞানী ওয়াল্টার শটকি সেমিকন্ডাক্টর রেক্টিফায়ারের পেছনের বিজ্ঞান নিয়ে ‘Metal-Semiconductor Junction Rectification’ শিরোনামে একটি পেপার প্রকাশ করেন।
শটকির এ পেপারটিই সেমিকন্ডাক্টর-প্রযুক্তি নিয়ে আরো অগ্রসর হওয়ার ভিত্তি তৈরি করে দেয়। তার এ পেপার প্রকাশ হওয়ার পূর্বেই বেল ল্যাবসের ডিরেক্টর অব রিসার্চ মারভিন কেলি ট্রায়োডের বিকল্প খুঁজতে শুরু করেছিলেন, তিনি ভেবেছিলেন সেমিকন্ডাক্টর থেকে যেহেতু ডায়োড তৈরি সম্ভব হয়েছে তবে ট্রায়োডের বিকল্পও তৈরি সম্ভব হতে পারে। কীভাবে এগোতে হবে এ বিষয়ে তার কোনো ধারণা ছিল না, কিন্তু তিনি বুঝতে পেরেছিলেন সেমিকন্ডাক্টর ট্রায়োড তৈরির গবেষণার মধ্যে সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে।
এ গবেষণার নেতৃত্ব দিতে কেলি খুঁজে এনেছিলেন পদার্থবিদ উইলিয়াম শকলিকে (শটকি ও শকলির নামের মধ্যে গুলিয়ে ফেলবেন না যেন)। শকলি তখন সবে ২৭ বছর বয়স্ক খ্যাপাটে তরুণ, প্রচন্ড উচ্চভিলাষী আর অনেকটাই অসামাজিক। পদার্থবিজ্ঞান ও গণিতের বাইরে তার ছিল দ্রুতগতির গাড়ি, বন্দুক ও পাহাড়ে চড়ার নেশা। এমন আত্মপ্রত্যয়ী একজন তরুণের মাঝেই সম্ভাবনা দেখেছিলেন কেলি। বেল ল্যাবসে শকলির প্রথম দিনেই, কেলি তার মাঝে তার স্বপ্নের বীজ বুনে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি শকলিকে বেল ল্যাবসের যেকোনো প্রকল্পে তার ইচ্ছেমতো অংশ নেয়ার স্বাধীনতা দিয়েছিলেন।
শকলিও সলিড-স্টেট ট্রায়োড উদ্ভাবনের লক্ষ্যে তার কাজ শুরু করে দেন। তিনি বেল ল্যাবসের বিভিন্ন প্রকল্পে ইচ্ছেমতো অংশ নিতে থাকলেন। সেমিকন্ডাক্টর বিষয়ে পাওয়া যেকোনো গবেষণাপত্র পড়তে থাকলেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই এর মধ্যে ছিল ওয়াল্টার শটকির সেই বিখ্যাত গবেষণাপত্রটিও। এর বাইরে বেল ল্যাবসের একজন গবেষক ওয়াল্টার ব্র্যাটেইনের কিউপ্রাস অক্সাইড নিয়ে একটি পরীক্ষামূলক কাজ তার নজর কাড়ে। কিউপ্রাস অক্সাইড ব্যবহার করে একটি ট্রায়োড ডিজাইনের ধারণা আসে তার মাথায়।
কয়েক মাসের চেষ্টায় শকলি তত্ত্বীয়ভাবে কিউপ্রাস অক্সাইড স্ল্যাব ব্যবহার করে একটি ট্রায়োড ডিজাইনও করে ফেলেন। তত্ত্বীয় দিক থেকে তার এ ডিজাইনটি চমৎকার ছিল। শকলিও বেশ আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে, তিনি এমন একটি ‘সলিড স্টেট ডিভাইস’ ডিজাইন করতে সক্ষম হয়েছেন যা বিদ্যুৎ সিগন্যালকে অ্যামপ্লিফাই করতে সক্ষম হবে। কিন্তু পরীক্ষামূলকভাবে এটি তৈরি করতে তিনি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হলেন। তার ট্রায়োড বিদ্যুৎ প্রবাহে বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলতেও সক্ষম হলো না। এর কারণও তিনি খুঁজে ফেলেন না।
নিজে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে তিনি ওয়াল্টার ব্র্যাটেইনের দ্বারস্থ হন। পরীক্ষামূলক গবেষণায় তিনি ছিলেন বেল ল্যাবসের শ্রেষ্ঠ গবেষকদের একজন। কিন্তু তিনিও শকলির তত্ত্বীয় ডিজাইনকে বাস্তবে রূপ দিতে অক্ষম হলেন। আসলে সেমিকন্ডাক্টরের আচরণ অনেকগুলো নিয়ামকের (ফ্যাক্টর) দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। এসব বিষয়ে স্পষ্ট জানাশোনা তখনও তাদের ছিল না। এর মধ্যে ঠিক কোনটির কারণে যে শকলির তত্ত্ব বাস্তবে রূপ নেয়নি তাও তারা ধরতে পারেননি।
অবশ্য এ নিয়ে তাদের আর বেশি দিন কাজ করার সুযোগ হয়নি। ১৯৪১ সালের দিকে এসে আমেরিকা বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। অধিকাংশ বিজ্ঞানী ও ইঞ্জিনিয়ারদের ডাক পড়ে সামরিক প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করার জন্য। শকলিকেও বেল ল্যাবস ছাড়তে হয় সামরিক গবেষণায় যোগ দেয়ার জন্য। স্থগিত হয়ে পড়ে ট্রায়োড নিয়ে তার কাজ।
এদিকে এ সময় বেল ল্যাবে বেশ বড়সড় একটি বিষয় ঘটে যায়। ব্রিটেন থেকে আসা কিছু প্রযুক্তিতে দেখা যায়, তারা ভ্যাকুয়াম ডায়োডের বদলে সিলিকন, জার্মেনিয়াম ইত্যাদি দিয়ে তৈরি রেক্টিফায়ার ব্যবহার করছে। সেখান থেকে বেল ল্যাবসে সিলিকন, জার্মেনিয়াম ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা শুরু হয়। এ প্রকল্পের একজন ইঞ্জিনিয়ার রাসেল ওহলের একটি পর্যবেক্ষণের সূত্র ধরে ল্যাবে উদ্ভাবিত হয় পি-এন জাংশন।
পয়েন্ট কন্টাক্ট ট্রানজিস্টর উদ্ভাবন
পি-এন জাংশনের উদ্ভাবন মারভিন কেলিকে গবেষণার অগ্রগতির বিষয়ে আশান্বিত করে তোলে। ১৯৪৫ সালে যখন যুদ্ধ শেষে কেলি সহ অন্যান্য বিজ্ঞানীরা ল্যাবে ফিরে আসেন তখন তিনি ট্রায়োড নিয়ে গবেষণার জন্য একটি দল গঠন করেন। এর নেতৃত্বের ভার দেওয়া হয় শকলির ওপর। তার অধীনে গবেষকদের মধ্যে ব্র্যাটেইন সহ আরো অনেক জ্যেষ্ঠ গবেষক ছিলেন। এর মধ্যে জন বারডিন নামে নৌবাহিনী থেকে আসা একজন গবেষকও ছিলেন।
বারডিন শকলির উৎসাহে বেল ল্যাবসে যোগ দিলেও তারা দুজন ছিলেন একদমই বিপরীত প্রকৃতির। দলে আসার পর বরং বার্ডিন ও ব্র্যাটেইনের রসায়ন বেশ জমে ওঠে। তারা শকলির সেই ট্রায়োডটি নিয়ে আবারো গবেষণা করতে শুরু করেন। এবার আর কিউপ্রাস অক্সাইড নয়, তারা পরিশুদ্ধ সিলিকন, জার্মেনিয়াম ও পি টাইপ, এন টাইপ সেমিকন্ডাক্টরের জ্ঞান ব্যবহার করে এ গবেষণা চালিয়ে যান। শকলি দলনেতা হলেও এ সময় তাদের গবেষণায় সরাসরি অংশ নেননি। তাই বলে যে এই বিষয়ে শকলি আগ্রহী ছিলেন না এমনটি নয়, তিনি ব্যক্তিগতভাবে পি-এন জাংশন ব্যবহার করে কীভাবে ট্রায়োড তৈরি করা যায় সে বিষয়ে পর্যালোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
এদিকে লাগাতার প্রচেষ্টার ফলে একপর্যায়ে, ব্র্যাটেইন ও বার্ডিন শকলির ট্রায়োডের সমস্যাটি ধরতে পারেন। আরো অনেক প্রচেষ্টার পর তারা এর সমাধানও করতে সক্ষম হন। ১৯৪৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর ব্র্যাটেইন ও বার্ডিনের মিলিত প্রচেষ্টায় উদ্ভাবিত হয় সর্বপ্রথম পয়েন্ট কন্টাক্ট ট্রানজিস্টর। তারা সলিড স্টেট ট্রায়োড তৈরি করতে সক্ষম হন, সফল করে তোলেন মারভিন কেলির স্বপ্ন। বেল ল্যাবসের কর্তারা তাদের এ উদ্ভাবনে অত্যন্ত খুশি হন, তারা আশা করেছিলেন এ ট্রানজিস্টরই হবে তাদের ভবিষ্যতের বাজির ঘোড়া।
তবে আজকে এত বছর পরে এসে আমরা যখন তাদের সেই ট্রানজিস্টরের দিকে তাকাই, এর গঠন দেখে আমাদের কিছুটা যেন হাসিই পায়। এর জটিলতা দেখে মনে প্রশ্ন জাগে, আসলে তারা করতে চেয়েছিলেনটা কী? এর কারণ বর্তমানে আমরা যে সরল গঠনের ট্রানজিস্টর দেখি তার তুলনায় এটি ছিল অনেক জটিল একটি ডিভাইস। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, সেমিকন্ডাক্টর বিষয়ে সেসময়কার জ্ঞানের পরিধির কথা। সে সাপেক্ষে এটি ছিল অত্যন্ত সফল একটি উদ্ভাবন।
বেল ল্যাবসের পক্ষ থেকে বিশ্ববাসীকে এটি জানাতে একটি সংবাদ সম্মেলনও করা হয়। অবশ্য এটি তখন তেমন কোনো আলোড়ন সৃষ্টি করেনি। নিউইয়র্ক টাইমসের ৪৬তম পাতায় ছোট একটু স্থান করে নিয়েছিল খবরটি। পৃথিবী তখনো এর ভবিষ্যৎ প্রভাব কতটা হতে পারে তা টের পায়নি। এছাড়া বেল ল্যাবস এ বিষয়ে একটি প্যাটেন্টেরও আবেদন করে, ব্র্যাটেইন ও বার্ডিনকে উদ্ভাবক হিসেবে দেখিয়ে।
দ্বন্দ্ব
যখন ব্র্যাটেইন ও বার্ডিনের নামে পেটেন্টের আবেদন করা হয়, শকলি তখন ইউরোপে ছিলেন। ফিরে এসে যখন দেখতে পান এ উদ্ভাবনের কৃতিত্ব তার অধীনস্থ দুজন গবেষক পেয়ে গেছে, তখন প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েন তিনি। তার যুক্তি ছিল, উদ্ভাবনটি ওরা দুজন করলেও মূল ডিজাইনটি তার ছিল, তাই এ কৃতিত্ব তারও প্রাপ্য। কিন্তু ব্র্যাটেইনের যুক্তি ছিল, শকলির মূল ডিজাইন তো কাজ করেনি, এরপর এই যে এটি নিয়ে এই এতটা সময় তারা গবেষণা চালিয়ে গেলেন, শকলি তো এ সময় সরাসরি অংশ নেননি এতে। তার কৃতিত্ব তবে থাকবে কেন?
এ দ্বন্দ্ব মেটাতে বেল ল্যাবস শকলির প্রথম ডিজাইনটির জন্য আলাদা একটি পেটেন্টের আবেদন করে। কিন্তু পরে দেখা যায় কানাডার একজন অখ্যাত গবেষক অনেক আগেই প্রায় কাছাকাছি একটি পেটেন্ট করে রেখেছিলেন, ফলে সেটিও সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। এটিও না হওয়ায় তারা বিষয়টিকে কিছুটা শান্ত করতে অন্য একটি কৌশল অবলম্বন করেন। ট্রানজিস্টর উদ্ভাবন সম্পর্কিত সকল খবরে তাদের তিনজনের একত্রে ছবি প্রকাশ করা হয়, যাতে মনে হয় এতে তিনজনেরই সমান কৃতিত্ব রয়েছে।
এ কৌশলও যে খুব ভালো কাজে লেগেছে এমনটি বলা যাবে না। এ সময়ের ছবিগুলো থেকেই আসে তাদের তিনজনের সেই বিখ্যাত ছবিটি। যেখানে দেখা যায় শকলি কাজ করছেন, এবং ব্র্যাটেইন ও বারডিন উৎসুক শিক্ষার্থীর মতো তাকিয়ে আছে পেছন থেকে। ছবিটি ব্র্যাটেইনের জন্য যে খুব সুখকর কিছু ছিল না সেটা সহজেই অনুমান করা যায়। এভাবে গোটা বিষয়টিকে কেন্দ্র করে শকলি ও ব্র্যাটেইনের মধ্যে বেশ ভালো রকমের দ্বন্দ্বের জন্ম নেয়। বরাবরই খ্যাপাটে ও আত্মম্ভরী শকলি বিষয়টি সহজভাবে নিতে পারেননি।
শকলির শেষ হাসি
পয়েন্ট কন্টাক্ট ট্রানজিস্টর একটি অসামান্য উদ্ভাবন হলেও ব্যবহারিকভাবে এটি তেমন কাজে আসেনি। এ উদ্ভাবনের পর AT&T থেকে তাদের যন্ত্রপাতি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল এর বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করার জন্য। কিন্তু এ ডিভাইসটির গাঠনিক জটিলতা এতটাই বেশি ছিল যে প্রায় এক বছর ধরে ক্রমাগত চেষ্টার পরও একে বাণিজ্যিক উৎপাদনের যোগ্য করে তোলা সম্ভব হয়নি।
শকলি এ সমস্যা দূর করার তাগিদেই হোক কিংবা ব্র্যাটেইনের প্রতি ঈর্ষা থেকেই হোক, একটি উন্নত ট্রানজিস্টর উদ্ভাবনের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলেন। তাকে চিন্তা থেকে বিচ্যুত করতে পারে এমন সকল কিছুকে দূরে সরিয়ে শিকাগোর একটি হোটেল কক্ষে নিজেকে আবদ্ধ করলেন তিনি। পয়েন্ট কন্টাক্ট ট্রানজিস্টরের বদলে পি-এন জাংশন ব্যবহার করে কীভাবে ট্রানজিস্টর ডিজাইন করা যায় সে লক্ষ্যে এগোচ্ছিলেন তিনি। বড়দিনের থেকে শুরু করে নববর্ষের গোটা ছুটিতে তিনি এটি নিয়েই মগ্ন ছিলেন।
ছুটি শেষে শকলি ব্যাল ল্যাবসে ফিরে আসেন। ততদিনে তত্ত্বীয়ভাবে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের একটি ট্রানজিস্টরের ডিজাইন সম্পন্ন করেছেন তিনি। কেবলমাত্র একটি দুর্বলতা রয়ে গিয়েছিল তার ডিজাইনে। বেল ল্যাবসে তখন পয়েন্ট কন্টাক্ট ট্রানজিস্টরকে উন্নত করে তোলার চেষ্টা চলছে। এ দলের প্রযুক্তিবিদরা প্রায়ই অভ্যন্তরীণ সেমিনার আয়োজন করতেন তাদের গবেষণার নতুন ফলাফল সবাইকে জানাতে।
এমন একটি সেমিনারে একজন গবেষকের বক্তব্যে শকলি তার ডিজাইনের দুর্বলতার সমাধান খুঁজে পান। সেই সেমিনার শেষে শকলি উঠে দাঁড়ান। কারণ তার পি-এন জাংশনভিত্তিক ট্রানজিস্টরের কথা সবাইকে বলার সময় এসে গেছে। সেখানে উপস্থিত সকল গবেষককে হতভম্ব করে দিয়ে তিনি তার জাংশন ট্রানজিস্টরের ডিজাইন বর্ণনা করেন। তত্ত্বীয় দিক থেকে এটি ছিল একদম সরল ও অসাধারণ একটি ডিজাইন। বারডিন, ব্র্যাটেইন সহ সকল গবেষক হতভম্ব হয়ে পড়েন, কারণ শকলি যে এতটা অসাধারণ একটি কাজ করে বসে আছেন তা কারো সাথে একবার আলোচনাও করেনি। এর কোনো আভাসও পাননি তারা।
শকলির সেই ট্রানজিস্টরকেই আমরা আজকে বাইপোলার ট্রানজিস্টর (বিজেটি) হিসেবে জানি। শকলির সেই তত্ত্ব পরবর্তীকালের ট্রানজিস্টর ও আই.সির জন্য ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। এ ট্রানজিস্টরটির উদ্ভাবক হিসেবে তিনি একটি পেটেন্টের আবেদন করেছিলেন, আর অবশ্যই সেখানে তার নাম ছিল একমাত্র উদ্ভাবক হিসেবে। তবে ট্রানজিস্টর উদ্ভাবনের জন্য পৃথিবী এখন তাদের তিনজনকেই শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। এ অসামান্য উদ্ভাবনের জন্য ১৯৫৬ সালে তারা নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
তথ্যসূত্র
- Conquering the Electronby Derek Cheung, Eric Brach, page (181-212)
- A history of the invention of the transistor and where it will lead us by W.F. Brinkman ; D.E. Haggan ; W.W. Troutman
ফিচার ইমেজ: Yale Joel