সব শেষ হয়ে গেছে।
আমি আমার শেষ বলটা করে ফেলেছি। আমি আমার শেষ উইকেটটা নিয়ে ফেলেছি। আজ আমি সব ফরম্যাটের ক্রিকেট থেকে অবসর ঘোষণা করছি।
আমি আশা করেছিলাম, আগামী বছরের মাঝামাঝি অবধি বিশ্বের নানা প্রান্তে বিভিন্ন টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট খেলা চালিয়ে যাবো। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে, আমার শরীর আপত্তি করতে শুরু করেছে।
এই বছরের ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ টুর্নামেন্টের সময় আমাকে পিঠের ব্যথা বেশ ভুগিয়েছে। ওটাই সম্ভবত আমার জন্য সংকেত ছিলো যে, এবার সরে দাঁড়ানোর সময় হয়েছে।
আমি যখন পার্থ স্কর্চার্সের নতুন কোচ অ্যাডাম ভোজেসের সাথে সম্প্রতি আমার ভবিষ্যত নিয়ে আলোচনা করতে বসেছিলাম, তিনি চাচ্ছিলেন, আমি যেন এই গ্রীষ্মেও খেলতে নামি। আমি বিশ্বাস করছিলাম যে, আমি এখনও খেলোয়াড়ি দলের একজন সদস্য হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা দিয়ে কিছু ভূমিকা রাখতে পারি। কিন্তু মানসিকভাবে আমি শেষ হয়ে গেছি।
আমি আমার খেলোয়াড় জীবন পেছনে ফেলে দিতে এবং জীবনের পরবর্তী পর্বে যেতে এখন পুরোপুরি প্রস্তুত। আমি অবসর নিয়ে ফেললাম। আমি মনে করি যে, আমি বুঝতে পারি, একবার কেউ যখন শেষ হয়, সে শেষই হয়ে যায়।
আমি যদি শতভাগ দিয়ে খেলতে না পারি তাহলে আমি আমার দলকে আমার সেরাটা দিতে পারবো না। আর আমার কাছে সবসময়ই দলই শেষ কথা।
অসামান্য গত দুটি গ্রীষ্ম আমাকে উপহার দেওয়ার জন্য আমি স্কর্চার্সকে ধন্যবাদ দিতে চাই। সেই সাথে আমার নতুন করে হওয়া হোম গ্রাউন্ড ওয়াকাকে সবকিছুর জন্য ধন্যবাদ দিতে চাই; গত এক দশক ধরে আমাকে সে যা দিয়েছে, সেজন্য ধন্যবাদ দিতে চাই। ক্রিস্টিয়ানা ম্যাথুস (ওয়াকার প্রধান নির্বাহী) ও তার দল সবসময় আমাকে সহায়তা করার জন্য ওখানে প্রস্তুত ছিলো।
এই সুযোগে আমি ভক্তদের একটা বিশাল ধন্যবাদ দিতে চাই। আমি কখনোই ওয়াকা গ্রাউন্ডের পরিবেশের কথা ভুলবো না। কিংবা শিশুদের ঐ হাসিমুখ কখনো ভুলবো না।
আমার ভেতরের প্রতিদ্বন্দ্বীতামূলক মানসিকতা কখনো আমাকে ছেড়ে যাবে না। আশা করি ভবিষ্যতে কোচ হিসেবে বা উপদেষ্টা হিসেবে আমি আমার এই মানসিকতাটার কোনো না কোনো ব্যবহার করতে পারবো। আমি বিশ্বাস করি, নিজের শক্তিতে শক্ত থাকতে হয়। আর ক্রিকেটই আমার শক্তি।
আমি জানি না, আমি এটাতে (কোচিংয়ে) ভালো করবো কি না। আমার ক্রিকেটে অনেক অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু অফিসিয়ালি কোচিংয়ে কোনো অভিজ্ঞতা নেই। যদিও আমি গত গ্রীষ্মে ওয়ার্নেরুতে (ক্রিকেট ক্লাব) কিছু কাজ করে ক্রিকেটারদের সহায়তা করতে চেয়েছি। আমি সবসময় তরুণ ক্রিকেটারদের সাথে কাজ করাটা উপভোগ করি।
আমার ক্রিকেট ক্যারিয়ার এখানেই শেষ হলো। তবে ২০১৩-১৪ অ্যাশেজ গ্রীষ্মের সেই স্মৃতি আমার আজীবন মনে থাকবে। মনে থাকবে ২০০৯ সালের দক্ষিণ আফ্রিকা সফর; যেখানে আমার একমাত্র টেস্ট সেঞ্চুরিটা এসেছিলো। আর বিশ্বকাপ মনে থাকবে।
আমি বেশিরভাগ ক্রিকেটারের চেয়ে জীবনে উত্থান-পতনটা বেশি দেখেছি। আমি গর্ব করে বলতে পারি, আমি বেশিরভাগ সময়, বিশেষ করে ক্যারিয়ারের শেষদিকে বারবার খারাপ অবস্থা থেকে লড়াই করে ফিরে আসতে পেরেছি এবং ধারাবাহিক পারফরম্যান্স করতে পেরেছি। আমি জীবনে ভুল করেছি এবং সেই ভুল থেকে শিখেছি।
বুড়ো আঙুলের গুরুতর চোট আমাকে শীর্ষস্থান থেকে ছিটকে দিয়েছিলো, আমি সরে গিয়েছিলাম অনেকটা। আমি তরুণ থাকতেই কুইন্সল্যান্ডের চুক্তি হারিয়েছিলাম। ফলে আমি জানি, জীবনের কঠিন সময়গুলোতে মানুষের কেমন অনুভূতি হয়।
আমি এটাও জানি যে, আবার ফিরে আসতে হলে কী করতে হয়। আমি যা পারি বলে মনে করতাম, আমি হয়তো সেটা ছিলাম না। আমি জানতাম, আমি যদি আবারও কঠোর পরিশ্রম করি, তাহলে আবার অস্ট্রেলিয়া দলে ফিরে আসবো এবং আমি সেটা প্রচন্ডভাবে চেয়েছিলাম।
সেরা সময়ে আমার মনে হতো, আমি এই মাঠে লড়াই করার জন্যই জন্মেছি। আমাকে সেজন্য নিজের ওপর কোনো জোর কখনো করতে হয়নি। স্রেফ হয়ে যেত সবকিছু।
আমার ম্যানেজার আমাকে সম্প্রতি মনে করিয়ে দিলেন যে, আমি দুবার আইসিসির বর্ষসেরা ক্রিকেটার হয়েছি। কিন্তু এসব পুরষ্কার, এসব খেলা, এসব ট্রফি, এসব স্বীকৃতির চেয়ে অনেক বেশি আমি মনে রাখবো আমার বন্ধুদের এবং আমার এই সহযোদ্ধাদেরই আমি মিস করবো।
ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সাথে কিছু অর্জনটা জীবনকে আরও রোমাঞ্চকর করে তোলে। আমি সৌভাগ্যবান যে, আমি খেলাটার সর্বকালের সেরা কিছু খেলোয়াড়ের সাথে একসাথে খেলার সুযোগ পেয়েছি। আমি যখন একটু আরাম করে বসি আর ভাবি, তখন বুঝতে পারি, আমি এসব স্মৃতি কখনো হারাতে চাই না।
আমরা সবাই যার যার জীবনযাপন করেছি এবং অবসরও নিয়ে ফেলেছি। তবে আমি একদিন ঠিকই ওদের আবার পানীয়র টেবিলে ধরতে চাই। বিশেষ করে রায়ান হ্যারিস ও পিটার সিডলের মতো ফাস্ট বোলারকে। আর নাথান লিওনকে তো বাদ দেওয়া যাবে না।
আমি সবসময়ই একজন গর্বিত কুইন্সল্যান্ডার। কিন্তু ওয়াকা (ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন) এখন আমার নতুন বাড়ি।
আমি এক দশক আগে আমার এখনকার স্ত্রী জেসিকার সাথে বসবাস করতে পার্থে চলে এসেছিলাম। আর এখানে আমি ওয়ারিয়র্সের হয়ে খেলেছি। এখন আমি যখন আমার খেলা শেষ করছি, তখন বুঝতে পারছি পরিবার গড়ে তোলার জন্য এর চেয়ে আদর্শ জায়গা আর হতে পারতো না।
আমি সম্প্রতি আমার ভাইয়ের ৩০তম জন্মদিন উপলক্ষে টাউন্সভিলে গিয়েছিলাম। সেখানে পরিবার ও বন্ধুদের সাথে অসাধারণ কিছু সময় কেটেছে। দেখলাম, জায়গাটা অনেক বদলে গেছে। কেবল আর্দ্রতাটাই যা বদলায়নি।
পার্থ আমার বাড়ি হতে পারে ১০ বছর ধরে। কিন্তু সারাটা ক্যারিয়ার ধরে ভ্রমণ করে বেড়ানোর ফলে এখন আমাকে আশা করতে হচ্ছে যে, এখানে এখন আমি আরেকটু ভালো একটা যোগাযোগ স্থানীয় সমাজের সাথে গড়ে তুলতে পারবো।
ক্রিকেটের বাইরে আমি মোটর স্পোর্টসের খুব ভক্ত। সম্ভবত অন্য সব খেলা বাদ দিয়ে আমি এখন থেকে ফর্মুলা ওয়ান আর মটোজিপিই বেশি দেখবো। যখন এনআরএলের (অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল রাগবি লিগ) কথা উঠবে, আমি অবশ্যই কাউবয়দের লোক। যদিও আমার এএফএলে সমর্থন করার মতো কোনো দল নেই।
মিশেল জনসন
১৯৮১ সালের ২ নভেম্বর কুইন্সল্যান্ডের টাউন্সভিলে জন্ম অস্ট্রেলিয়ার এক সময়ের ত্রাস সৃষ্টিকারী এই ফাস্ট বোলারের। মাত্র ১৭ বছর বয়সে ডেনিস লিলির চোখে পড়েন তিনি। লিলি তার সাবেক সতীর্থ রডনি মার্শের সাথে কথা বলেন জনসনকে নিয়ে। এই দুই গ্রেট তাকে নিয়ে আসেন অ্যাডিলেডে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে। এখানেই বিকশিত হয়ে ওঠেন এই ফাস্ট বোলার।
শুরুতে কুইন্সল্যান্ডের হয়ে খেললেও পরে ২০০৮ সালে চলে আসেন ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ায়।
২০০৫ সালে ওয়ানডে এবং ২০০৭ সালে টেস্ট অভিষেক হয় জনসনের। ৭৩ টেস্টে নিয়েছেন ৩১৩ উইকেট; টেস্টে একটি সেঞ্চুরি ও ১১টি ফিফটি আছে তার। ১৫৩ ওয়ানডেতে ২৩৯ উইকেট শিকার করেছেন।
২০১৫ সালে সব ফরম্যাটের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেন। এরপরও বিভিন্ন ফ্রাঞ্জাইজি টুর্নামেন্টে টি-টোয়েন্টি খেলছিলেন। কিন্তু শরীর আর সায় দিচ্ছে না বলে এবার অবসর নিয়ে নিলেন সব ধরনের ক্রিকেট থেকে। আর অবসরের ঘোষনা দিয়ে নিজে লিখেছেন এই লেখাটি।