খরগোশের পিছু নিয়ে বাগানের এক গর্তে প্রবেশ করলো ছোট্ট মেয়ে অ্যালিস। আর তারপর হঠাৎ বদলে যেতে থাকলো সব। আজব এক দুনিয়ার সন্ধান পেলো মেয়েটি। জাদুর সেই দুনিয়া। কেমন চোখের পলকেই বড় হয়ে যায় কেউ, আবার হয়ে যায় একদম ছোট! ছোট্ট অ্যালিসের জাদুর দেশের অভিযান নিয়ে লুইস ক্যারলের গল্প রচিত হয়েছে। এই কেচ্ছার দেখা মিলবে রূপালি পর্দায়ও।
ছোট্ট অ্যালিসের দুর্দান্ত সব রোমাঞ্চের ঘটনা কিন্তু কেবল গল্পেই দারুণ লাগে, বাস্তবে নয়। বাস্তবের কথা কেন হচ্ছে? গল্পের চরিত্রের সাথে মিলে যায় বলে একটা জটিল মনোরোগের নামকরণ হয়ে আছে অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড সিন্ড্রোম। আর তাই গল্পের সেসব কাহিনীকে বাস্তবে মোটেও দারুণ লাগবে না! অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড সিন্ড্রোমের কেচ্ছাকাহিনী নিয়েই সাজানো এই লেখা।
সমস্যার পরিচয়
অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড সিন্ড্রোম হচ্ছে এমন একটি অবস্থা, যেখানে সাময়িকভাবে বিকারগ্রস্ত দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিশৃঙ্খলার উদ্ভব ঘটে। জটিল লাগছে কথাটি? সহজ করে বলতে গেলে এভাবে বলা যায়, একজন মানুষের স্বাভাবিক ইন্দ্রিয়শক্তির বিকার ঘটার মতো একটি অবস্থা হলো অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড সিন্ড্রোম বা সংক্ষেপে এআইডব্লিউএস (AIWS), যেখানে এই বিকারগ্রস্ত দশা স্থায়ী হয় অল্প সময়ের জন্য। এই সিন্ড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তি নিজেকে প্রকৃত আকারের তুলনায় বড় কিংবা ছোট ভাবতে থাকেন, কিংবা আশেপাশে থাকা বস্তুকে মনে করেন স্বাভাবিকের চেয়ে কাছে অথবা দূরে! এমনই সব বিভ্রান্তিকর অনুভূতির সৃষ্টি হয় এই সিন্ড্রোমে ভুগতে থাকা ব্যক্তির মধ্যে। ব্রিটিশ মনোবিজ্ঞানী ডক্টর জন টড নামকরণ করেন অসুখটির, তাই একে টড’স সিন্ড্রোমও বলা হয়ে থাকে।
ইন্দ্রিয়ের এই বিকারগ্রস্ত দশা কিন্তু আদতে ইন্দ্রিয়ের ভুল নয়। মনে হতেই পারে, ব্যাপারটি চোখের ধোঁকা, বা শোনার ভুল, বিভ্রম ঘটছে কোনো। কিন্তু বাস্তবে ভুলটা করছে মস্তিষ্ক। চারপাশকে বা ব্যক্তির নিজের শরীরকে মস্তিষ্ক যেভাবে দেখে, পরিবর্তন আসছে তাতে, আর এই পরিবর্তনেই ব্যক্তির চৈতন্যলোপ হচ্ছে। অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড সিন্ড্রোম ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে দেখা, শোনা আর স্পর্শজনিত অনুভূতিকেও। এবং আক্রান্ত ব্যক্তির সময়জ্ঞানও লোপ পেতে পারে। বাস্তবের চেয়ে দ্রুত কিংবা ধীরগতিতে সময় পার হচ্ছে বলে ভাবতে থাকে রোগী।
অসুখের লক্ষণ
যেকোনো অসুখেরই কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য থাকে। তেমন কিছু সাধারণ ব্যাপার রয়েছে এআইডব্লিউএসের ক্ষেত্রেও।
- বাস্তবের তুলনায় নিজের শরীরকে বড় কিংবা ক্ষুদ্র লাগতে থাকা।
- আশেপাশের বস্তুসমূহকে দূরে ভাবা, দূরের বস্তুগুলো কাছাকাছি মনে করা।
- সরলরেখা বাঁকা দেখানো।
- স্থবির জিনিস চলমান দেখানো।
- চেহারা বিকৃত লাগা।
- বস্তুর রঙ পাল্টে যেতে দেখা, বা খুব উজ্জ্বল লাগা।
অসুখের ধরন এবং কারণ
এআইডব্লিউএসের স্বরূপ মানুষভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়। একজন ব্যক্তি নিজেও একেকবার একেকরকম অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারে। অর্থাৎ এই সিন্ড্রোমের বিভিন্ন রূপ দেখা দিতে পারে একেকবার, নতুন নতুন পর্বে। এই পর্বগুলো সাধারণত সংক্ষিপ্তই হয়ে থাকে, কয়েক মিনিট থেকে আধা ঘন্টার মতো ব্যাপ্তিকালের।
এই সিন্ড্রোমে ভোগা বেশিরভাগ ব্যক্তিই মাইগ্রেনের সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে থাকে। এবং শিশুদের মাঝেও অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড সিন্ড্রোম দেখা গেলে বড় হবার পর তাদের মাইগ্রেনের ঝুঁকি অধিক থাকে। আক্রান্ত হবার পর্যায়কালে ব্যক্তি মাইগ্রেন ব্যথায় ভুগতে পারে। আকার সঠিকভাবে অনুধাবন করার জ্ঞান লোপ পায় ব্যক্তির, হোক তা জড়বস্তুর বা নিজের শরীরের। নিজ দেহ কিংবা আশেপাশের বস্তুসমূহকে স্বাভাবিকের চেয়ে ছোট বলে মনে করার সমস্যাকে বলা হয় মাইক্রোপসিয়া, এবং এর বিপরীত ঘটনা অর্থাৎ সবকিছুকে স্বাভাবিকের চেয়ে বড় বলে মনে করার সমস্যাকে ম্যাক্রোপসিয়া বলা হয়। এআইডব্লিউএস পর্ব চলাকালে এই উভয় অবস্থাই দেখা দেয় আক্রান্ত ব্যক্তির মাঝে। সময়কে অত্যধিক ধীরগতি বা দ্রুতগতির বলে মনে হয়। যেকোনো শব্দকে খুব প্রবল বলে মনে হতে থাকে। অর্থাৎ ইন্দ্রিয় সংক্রান্ত যেকোনো জ্ঞানই লোপ পেতে পারে ব্যাপকভাবে।
গবেষকদের মতে, এআইডব্লিউএস মাইগ্রেনেরই একটি ধরন। এই সিন্ড্রোমে মস্তিষ্কের সেই অংশে পরিবর্তন আসে যা কি না ইন্দ্রিয়জাত তথ্যের বিশ্লেষণে কাজ করে, অর্থাৎ দেখা বা শোনার দিকগুলোকে সামলায়। কাজেই নিজেকে এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে অনুধাবন করার স্বাভাবিক ক্ষমতা লোপ পায় আক্রান্ত ব্যক্তির। এছাড়া মৃগীরোগে আক্রান্ত ব্যক্তির মাঝে দেখা যেতে পারে এআইডব্লিউএস। ব্রেইন টিউমার থাকাও এর একটি কারণ বলে ধরা হয়। গভীর বিষণ্নতা, সিজোফ্রেনিয়া ইত্যাদি সমস্যার উপস্থিতিও অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড সিন্ড্রোমের কারণ। এই সিন্ড্রোমের আরো একটি কারণ হচ্ছে এপস্টাইন-বার ভাইরাসের সংক্রমণ।
কফ সিরাপ, অ্যালার্জি বা অ্যান্টি-সিজার ওষুধ গ্রহণের পরও কখনো কখনো এআইডব্লিউএসে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে তুলনামূলকভাবে কমবয়সীদের মাঝেই এই অসুখের মাত্রা বেশি দেখা যায়। বিশেষ করে শিশু এবং সদ্য প্রাপ্তবয়স্কদের মাঝে। তবে স্বল্পমাত্রায় বয়স্ক মানুষদের মধ্যেও অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড সিন্ড্রোম বেড়ে ওঠে।
এআইডব্লিউএস ঘটার খুব নির্দিষ্ট কারণ চিহ্নিত করা যায়নি। এতটুকু নিশ্চিত যে, এটি কেবল ইন্দ্রিয়গত কোনো সমস্যা নয়, মানসিক ব্যাধি নয়, স্নায়বিক কোনো অসুস্থতাও নয় কেবল। এটি তার বাইরেও আরো কিছু, যা পুরোপুরি সংজ্ঞায়িত নয়। গবেষকগণ মনে করেন, মস্তিষ্কের অস্বাভাবিক বৈদ্যুতিক কার্যকলাপের কারণে সেসব অংশে স্বাভাবিক রক্ত প্রবাহ ব্যহত হয়, যা পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে বিশ্লেষণ করে এবং কোনোকিছু দর্শনের উপলব্ধি করায়, যার ফলে দেখা দিতে পারে অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড সিন্ড্রোম। কিছু ক্ষেত্রে বংশগতিও কারণ হয়ে দাঁড়ায় এই ব্যাধির। পরিবারের কারো মাইগ্রেন কিংবা এআইডব্লিউএস থেকে থাকলে এতে আক্রান্ত হবার বেশ বড় ঝুঁকি রয়ে যেতে পারে একজন ব্যক্তির।
প্রতিকার ব্যবস্থা
বিবৃত লক্ষণাদির ভেতর কোনোটি যদি নিজের মধ্যে দেখা দেয়, চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। নিউরোলজিস্ট বা মনোবিদগণ এই রোগের সঠিক শনাক্তকরণ এবং পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করতে পারেন। কিছু স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হতে পারে রোগ শনাক্ত করতে। কোনো ভাইরাস, যেমন এপস্টাইন-বার ভাইরাসের সংক্রমণ রয়েছে কি না জানতে রক্ত পরীক্ষা করা হতে পারে। এমআরআই স্ক্যানিং করা হতে পারে মস্তিষ্কের। ইইজি করা হতে পারে মস্তিষ্কের অভ্যন্তরীণ বৈদ্যুতিক কার্যাবলী পরিমাপ করতে।
অসুখটাই যেখানে খুব নির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত নয়, এর সঠিক চিকিৎসাও তাই নেই বললেই চলে। তবে কিছু বিষয় মেনে চললে এই অসুখের ক্ষতিকর প্রভাব এড়ানো সম্ভব হবে। অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড সিন্ড্রোমের লক্ষণগুলোকে চিহ্নিত করা গেলে সেগুলোর প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেয়াই এআইডব্লিউএসের বারবার ফিরে আসা প্রতিহত করবে। যেমন- যেসব কারণে মাইগ্রেনের সমস্যা বেড়ে যায়, সম্ভব হলে সেগুলো এড়িয়ে চলা এবং মাইগ্রেনের চিকিৎসা গ্রহণ করা। ক্ষতিকর ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়লে তার চিকিৎসা করানো, কিংবা গভীর বিষণ্নতা থাকলে সেটা কাটানোর ব্যবস্থা নেয়া।
সময়ের সাথে এই অসুখের তীব্রতা সাধারণত অনেকটাই কমে যায়। ক্ষতি সাধনের তেমন বড় কোনো লক্ষণও দেখা যায় না এর মাঝে। অর্থাৎ জটিলতা যা আছে তা আক্রান্ত হবার ক্ষণস্থায়ী সময়ের মধ্যেই তৈরি হয়, রেশ রেখে যায় না।
এআইডব্লিউএসের পর্ব চলাকালে সময়কে আপসে কেটে যেতে দেয়াই সবচেয়ে ভালো। এবং খুব জরুরিভাবে আক্রান্ত ব্যক্তিকে এটি বোঝাতে হবে যে এই অসুখ মোটেও ভয়ানক কিছু নয়। খুব জটিল একটি অসুখ যদি সত্যিকার অর্থে জীবনে বাড়তি জটিলতা না আনে, কিছুটা সময়ের জন্য তাকে সহ্য করে নিতে ক্ষতি কোথায়?