বিশ্বের সেরা বিমানবন্দর কোনটি? এমন প্রশ্নে একেক রকম উত্তর মিললেও আজ খুঁজে বের করার চেষ্টা করবো, আসলেও কোন বিমানবন্দরটি বিশ্বসেরা। বিশ্বের সেরা বিমানবন্দরের তালিকা নির্ধারণ করে থাকে স্কাইট্র্যাক্স নামে একটি প্রতিষ্ঠান। ১৯৯৯ সালে ‘ওয়ার্ল্ডস বেস্ট এয়ারপোর্ট অ্যাওয়ার্ড’ শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। সেরা বিমানবন্দর নির্ধারণের জন্য বেশ কিছু বিষয়কে ভিত্তি ধরে এই প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বের বিভিন্ন বিমানবন্দরে জরিপ চালায়। সেরা বিমানবন্দর নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, নিরাপত্তা, কর্মীদের সেবাপরায়ণতা, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা, কেনাকাটার সুবিধা, ব্যাগেজ ডেলিভারি, ইমিগ্রেশন ব্যবস্থা, ট্রানজিট প্যাসেঞ্জারদের সুযোগ সুবিধা, বিনোদনের ব্যবস্থা, খরচ ইত্যাদি বিষয়। ২০১৮ সালের সেরা বিমানবন্দর নির্বাচনের জন্য এই প্রতিষ্ঠানটি ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জরিপ চালায়। বিশ্বের প্রায় ৫৫০টি বিমানবন্দরের ১৩.৭৩ মিলিয়ন ডেটা জরিপ পদ্ধতির মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে স্কাইট্র্যাক্স ২০১৮ সালের সেরা যে বিমানবন্দরগুলো নির্বাচিত করেছে, তার মধ্য থেকে সেরা ১০টি বিমানবন্দর নিয়ে সাজানো হয়েছে এই লেখাটি।
১০. ফ্রাঙ্কফুর্ট এয়ারপোর্ট (জার্মানি)
ফ্রাঙ্কফুর্ট এয়ারপোর্টটি জার্মানির সবচেয়ে ব্যস্ততম বিমানবন্দর। এটি ইউরোপের ৩য় এবং সারা পৃথিবীর মধ্যে ১৩তম ব্যস্ত বিমানবন্দর। ফ্রাঙ্কফুর্ট শহর থেকে এর দূরত্ব প্রায় ১২ কিলোমিটার। এটি প্রায় ৫ হাজার একর জমি জুড়ে বিস্তৃত। এই বিমানবন্দরের মাধ্যমে বছরে প্রায় ৬৫ মিলিয়ন যাত্রী ২৫০টিরও বেশি গন্তব্যে যাতায়াত করে থাকে। এই বিমানবন্দর থেকে বিশ্বের ১০৫টি দেশে যাওয়া যায়। বিমানবন্দরটিতে ২টি প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল রয়েছে। ৩য় টার্মিনালটি নির্মাণাধীন রয়েছে। ২০২২ সালের মধ্যেই ৩য় টার্মিনালটির নির্মাণকাজ শেষ হবে।
৯. জুরিখ এয়ারপোর্ট (সুইজারল্যান্ড)
সুইজারল্যান্ডের সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হচ্ছে জুরিখ এয়ারপোর্ট। জুরিখ শহর থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান। এতে ৩টি টার্মিনাল এবং ৩টি রানওয়ে রয়েছে। বিশ্বের প্রায় ৬৭টি দেশের ২০৩টি গন্তব্যে এখান থেকে বিমান ছেড়ে যায়।
৮. লন্ডন হিথ্রো এয়ারপোর্ট (যুক্তরাজ্য)
যুক্তরাজ্যের প্রধান এবং ব্যস্ততম বিমানবন্দর এটি। যাত্রী সংখ্যার দিক থেকে এটি ইউরোপের ব্যস্ততম বিমানবন্দর। এটি ‘লন্ডন হিথ্রো’ নামেও পরিচিত। লন্ডন শহরের কেন্দ্র থেকে ২৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ২০১৮ সালে এই বিমানবন্দরটির মাধ্যমে ৮০.১ মিলিয়ন যাত্রী যাতায়াত করেছেন। বিমানবন্দরটিতে ২টি রানওয়ে এবং ৫টি টার্মিনাল রয়েছে। তবে ১ নং টার্মিনালটি এখন আর ব্যবহৃত হয় না। বিশ্বের ৮৪টি দেশের ১৮৫ গন্তব্যে এই বিমানবন্দর থেকে প্লেন ছেড়ে যায়।
৭. চুবু সেন্ট্রায়ার নাগয়া (জাপান)
বিমানবন্দরটির নাম চুবু সেন্ট্রায়ার নাগয়া এয়ারপোর্ট হলেও সাধারণত এটি ‘সেন্ট্রায়ার’ নামেই পরিচিত। ২০০৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি এর যাত্রা শুরু হয়। নাগয়া শহর থেকে এর দূরত্ব ৩৫ কিলোমিটার। একটি কৃত্রিম দ্বীপের উপর এটি তৈরি করা হয়েছে। নাগয়া শহর থেকে এই বিমানবন্দরে যেতে ট্রেনে লাগে ২৮ মিনিট এবং গাড়িতে লাগে ৪০ মিনিট। পুরো বিমানবন্দরটি দেখার জন্য এখানে ৩০০ মিটার লম্বা একটি ডেক রয়েছে। এটিকে বলা হয় ‘স্কাই ডেক’। এখান থেকে শুধু যাত্রীরা নয়, দর্শনার্থীরাও প্লেনগুলোকে কাছ থেকে দেখার সুবিধা পেয়ে থাকেন। ২০১৮ সালে এই বিমানবন্দরটি আভ্যন্তরীণ রুটের সেরা বিমানবন্দর হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। ২০১৪ সালে এই বিমানবন্দরটির মাধ্যমে ৯.৮ মিলিয়ন যাত্রী যাতায়াত করেছে।
৬. মিউনিখ এয়ারপোর্ট (জার্মানি)
মিউনিখ এয়ারপোর্ট জার্মানির দ্বিতীয় ব্যস্ততম বিমানবন্দর। ২০১৮ সালে ইউরোপের সেরা বিমানবন্দর হিসেবে নির্বাচিত হয় এটি। এখানে ১৫০টি রিটেইল স্টোর এবং ৫০টি জায়গা রয়েছে যেখানে খাদ্যদ্রব্য ও পানীয় পাওয়া যায়। এই বিমানবন্দরটি অনেকটা সিটি সেন্টারের মতো। এটি মিউনিখ শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এখানে ৩টি টার্মিনাল এবং ২টি রানওয়ে রয়েছে। ৩৮৯২ একর জমি জুড়ে বিস্তৃত এটি। ২০১৪ সালে ৩৯.৭ মিলিয়ন যাত্রী এই বিমানবন্দরটি ব্যবহার করেছেন।
৫. হামাদ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট (কাতার)
কাতারের দোহা শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে হামাদ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের অবস্থান। বিমানবন্দরটি তৈরির পরিকল্পনা করা হয় ২০০৩ সালে। ২০০৬ সাল থেকে এই বিমানবন্দরের কাজ শুরু হয়। ২০১৪ সাল থেকে এর যাত্রা শুরু হয়। বছরে প্রায় ৩০ মিলিয়ন যাত্রী এই বিমানবন্দরটি ব্যবহার করে থাকে। এটি স্থাপত্যের দিক থেকে অন্যতম সেরা। এটিকে বিশ্বের অন্যতম বিলাসবহুল বিমানবন্দর হিসেবেও ভাবা হয়। ২০১৮ সালে এটি মধ্যপ্রাচ্যের সেরা বিমানবন্দর হিসেবে নির্বাচিত হয়। এটিতে ২টি টার্মিনাল এবং ২টি রানওয়ে রয়েছে।
৪. হংকং ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট (হংকং)
বিশ্বের প্রায় ২২০টি গন্তব্যে হংকং ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে প্লেন ছেড়ে যায়। এটি বিশ্বের সেরা ট্রানজিট এয়ারপোর্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলো। ২০১৮ সালে এটি ডাইনিং সুবিধার জন্য সেরা বিমানবন্দর হিসেবে নির্বাচিত হয়। বিমানবন্দরটিতে ২টি টার্মিনাল এবং ৩টি রানওয়ে সিস্টেম রয়েছে। এটি ১২৫৫ হেক্টর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। ‘হংকং এয়ার অথরিটি’ দ্বারা এর পরিচালনা করা হয়।
৩. টোকিও হানেডা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট (জাপান)
এটি টোকিও স্টেশন থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এশিয়ার দ্বিতীয় এবং ২০০৯ সালে বিশ্বের চতুর্থ ব্যস্ততম বিমানবন্দর এটি। টোকিও অ্যাভিয়েশন ব্যুরো, ভূমি অবকাঠামো ও পরিবহন মন্ত্রণালয় এবং জাপান এয়ারপোর্ট টার্মিনাল এই বিমানবন্দরটি পরিচালনা করে থাকে। এখানে মোট ৩টি টার্মিনাল রয়েছে। ১ নম্বর এবং ২ নম্বর টার্মিনাল দুটি আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়াকওয়ে দ্বারা সংযুক্ত। ৩ নম্বর টার্মিনালটি ২০১০ সালের অক্টোবর মাসে চালু করা হয়। এই বিমানবন্দরে মোট ৪টি রানওয়ে রয়েছে। এখানে ১১৫.৭ মিটার উচ্চতার একটি এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল টাওয়ার রয়েছে। বছরে প্রায় ৬০ মিলিয়ন যাত্রী টোকিও হানেডা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট ব্যবহার করেন। ২০১৮ সালে এটি বিশ্বের পরিচ্ছন্ন এবং বিশ্বের আভ্যন্তরীণ সেরা এয়ারপোর্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়।
২. ইঞ্চিয়ন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট (দক্ষিণ কোরিয়া)
ইঞ্চিয়ন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট দক্ষিণ কোরিয়ার সবচেয়ে বড় বিমানবন্দর। ‘সিউল-ইঞ্চিয়ন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট’ হিসেবেও এটি পরিচিত। সিউল থেকে ৩২ মাইল দূরে এটির অবস্থান। পূর্বের গিম্পো ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে ২০০১ সালের মার্চ মাসে এই বিমানবন্দরটির যাত্রা শুরু হয়। এটি বিশ্বের ষষ্ঠ কার্গো বিমানবন্দর। এটি ২.৭ মিলিয়ন টন কার্গো বহনে সক্ষম। বিমানবন্দরটিতে দু’টি টার্মিনাল রয়েছে। ২০১৮ সালে এটি ওয়ার্ল্ডস বেস্ট এয়ারপোর্ট স্টাফ খেতাব লাভ করে।
১. চাঙ্গি এয়ারপোর্ট (সিঙ্গাপুর)
গত দুই দশকে চাঙ্গি এয়ারপোর্টটি ৯ বার বিশ্বের সেরা বিমানবন্দরের খেতাব অর্জন করেছে। বিশ্বের প্রায় ২০০টি গন্তব্যে এই বিমানবন্দর থেকে প্লেন যাতায়াত করে। চাঙ্গি বাণিজ্যিক এলাকা থেকে উত্তর-পূর্বে ১৭.২ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত এটি। চাঙ্গি এয়ারপোর্ট গ্রুপ এই বিমানবন্দর পরিচালনা করে। ৮০টি আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্সের মাধ্যমে সপ্তাহে প্রায় ৫ হাজার উড্ডয়ন এবং অবতরণ হয় এই বিমানবন্দরে। ২০১৭ সালে বিশ্বের প্রায় ১০০টি দেশের ৬০ মিলিয়ন যাত্রী এই বিমানবন্দরটি ব্যবহার করে। এটি কানটাস এয়ারওয়েজ এর দ্বিতীয় প্রধান কেন্দ্র। কানটাস এয়ারওয়েজ এই বিমানবন্দরের সবচেয়ে বড় বিদেশি এয়ারলাইন্স। এই বিমানবন্দরটিতে ৪টি টার্মিনাল রয়েছে। চতুর্থ টার্মিনালটি পরিচালিত হয় অটোমেশন পদ্ধতিতে। যাত্রী ভোগান্তি কমাতে ইমিগ্রেশন পদ্ধতি অটোমেশনের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়। বিমানবন্দরটিতে চব্বিশ ঘণ্টা আপডেটেড ব্লকবাস্টার সিনেমা প্রদর্শিত হয়। যাত্রা শুরুর পর থেকে এই বিমানবন্দরটি ৫০০ এরও অধিক অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছে। চাঙ্গি বিমানবন্দরের ছাদে রয়েছে সুইমিংপুল। এয়ারপোর্ট জুড়ে রয়েছে সানফ্লাওয়ার গার্ডেন। কয়েক’শ প্রজাপতি নিয়ে রয়েছে বাটারফ্লাই গার্ডেন। আর এই এয়ারপোর্টের খাবার নিমেষেই জিভে জল এনে দেয়।