তাকে ভাবা হতো আর্জেন্টিনার নতুন ম্যারাডোনা। অবশ্য আর্জেন্টাইনদের জন্য সেটা তো নতুন কিছু নয়। ম্যারাডোনা অবসরে যাবার পর নতুন কেউ ভালো খেললেই তাকে ম্যারাডোনার মতো ভাবা হয়েছিলো। তবে আরো অনেকের চাইতে এই ছেলেটা একটু আলাদা ছিলেন।
আর দশটা লাতিন ফুটবলারের মতো তারও জন্ম হয়েছিল একটা দরিদ্র পরিবারেই। আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্সের কুখ্যাত এলাকা ফোর্ট অ্যাপাচি’র রাস্তার পাশে এক বস্তিতে জন্ম নেওয়া তেভেজের ছোটবেলায় খাবার কিনে খাওয়ার সামর্থ্যটুকুও ছিল না। থাকবে কীভাবে? জন্মের পরপরই যে বাবা মা তাকে পরিত্যক্ত করেছিলেন। বড় হয়েছেন চাচার কাছে। সেই চাচারও ছিল পাঁচ সন্তান। যে পরিবেশে বড় হয়েছেন, সেখানে প্রতিনিয়ত দেখেছেন প্রতিবেশীদের রক্তক্ষয়ী মারামারি। বাল্যকালের ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুকে চোখের সামনে গুলি খেয়ে মারা যেতেও দেখেছেন। এরপরও সেই পরিবেশ থেকে ফুটবল খেলার অনুপ্রেরণা পেয়েছেন চাচার কাছ থেকেই।
অল্প বয়স থেকেই জীবনের সাথে যুদ্ধ করার সাথে সাথে ফুটবল মাঠেও লড়াইটা চালিয়ে যেতে হয়েছে। দশ মাস বয়সে তার গায়ে গরম পানি পড়ে, এ সময় তার শরীরে তৃতীয় মাত্রার পোড়া ক্ষত সৃষ্টি হয়, এবং এর ফলে তাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে প্রায় ২ মাস থাকতে হয়। কিন্তু তাদের দারিদ্র্য এতটাই তীব্র ছিল যে, দাগ মোছার জন্য সেভাবে চিকিৎসা করানো হয়নি। তবুও লড়াই করে নিজেকে একটা পর্যায় পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন।
যোদ্ধা এই খেলোয়াড়টির নাম কার্লোস তেভেজ।
জাতীয় দলের হয়ে তেভেজ
মানুষ ভুলে যায়। অবশ্য সেটা মানুষের দোষও নয়। বেশিরভাগ মানুষই দিনশেষে কেবল সফলদেরকেই মনে রাখে। আদৌ ক’জনের মনে আছে, এই তেভেজই ম্যারাডোনারই রেকর্ড ভেঙে সবচেয়ে কম বয়সে ‘দক্ষিণ আমেরিকান বর্ষসেরা ফুটবলার’ এর পুরস্কার জিতে নেন! মানুষ এটাও ভুলে যায়, আর্জেন্টিনার অলিম্পিকের স্বর্ণটা প্রথম তার হাত ধরেই আসে ২০০৪ সালে।
গ্রুপপর্বে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচটা বাদে প্রতিটা ম্যাচেই গোল করেন। কোয়ার্টার ফাইনালে কোস্টারিকার বিপক্ষে করেন হ্যাটট্রিক, সেমিতে ইতালির বিপক্ষে ৩-০ গোলে জেতা ম্যাচের প্রথম গোলটাই তেভেজের। এছাড়া ফাইনালে প্যারাগুয়ের বিপক্ষে ১-০ গোলে জয়ী ম্যাচের একমাত্র গোলটাও তেভেজেরই। ৮ গোল করে হন টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা।
অলিম্পিকের এই পারফরম্যান্স তেভেজকে আর্জেন্টিনার মূল দলেও ডাক পাইয়ে দেয়। ২০০৪ সালের কোপা আমেরিকার দলে তেভেজ সুযোগ পান, টুর্নামেন্টে অসাধারণ পারফর্মও করেন। কোয়ার্টার ফাইনালে পেরুর বিপক্ষে তেভেজের একমাত্র গোলেই আর্জেন্টিনা ১-০ গোলের জয় পায়। সেমিফাইনালেও কলম্বিয়ার বিপক্ষে ৩-০ গোলে জয়ের প্রথমটা তেভেজের। ফাইনালটা আর্জেন্টিনার হাতেই ছিল। ৯০ মিনিট পর্যন্ত এগিয়ে ছিল ২-১ গোলে। ৯২তম মিনিটে তেভেজকে সাব করা হয়, এবং ৯৩তম মিনিটেই আদ্রিয়ানোর ঝলকে সমতা ফেরায় ব্রাজিল। পরবর্তীতে টাইব্রেকারে ম্যাচটা জিতে নেয় ব্রাজিল।
২০০৫ সালের কনফেডারেশন কাপের দলেও ছিলেন তেভেজ। কিন্তু সেখানেও ফাইনালে ব্রাজিলের কাছে হার মানে আর্জেন্টিনা। ২০০৬ সালের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার দলে সুযোগ পেলেও গ্রুপপর্বে মাত্র ১টি গোল করতে সমর্থ হন তেভেজ। দলও বাদ পড়ে কোয়ার্টার ফাইনালে।
২০০৭ সালের কোপা আমেরিকায় আবারও ফাইনালে ওঠে আর্জেন্টিনা। বিধি বাম, এবারও ব্রাজিলের কাছে পরাজিত হয় তারা। ২০১০ সালের বিশ্বকাপে তেভেজ ২টি গোল করেন, ২টিই দ্বিতীয় পর্বে মেক্সিকোর বিপক্ষে। যদিও প্রথম গোলটার সময় তেভেজ অফসাইড পজিশনে ছিলেন। তেভেজ ম্যান অব দ্য ম্যাচও নির্বাচিত হন।
কোপা আমেরিকা ২০১১ কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনা টাইব্রেকারে উরুগুয়ের বিপক্ষে বাদ পড়ে তেভেজের একমাত্র পেনাল্টি মিসের কারণেই।
মাঝে ২০১৪ বিশ্বকাপের দলে সুযোগ না পেলেও ২০১৫ সালের কোপা আমেরিকার দলে আবারো সুযোগ পান। এবার উরুগুয়ের বিপক্ষেই কোয়ার্টার ফাইনালে টাইব্রেকারে দলের পক্ষে শেষ গোলটি করে দলকে সেমিতে নিয়ে যান।
কিন্তু চিলির বিপক্ষে ফাইনালে আবারও তার দল টাইব্রেকারে পরাজিত হয়, যদিও তেভেজ ফাইনালে ম্যাচে খেলার সুযোগ পাননি। আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে তেভেজ তার শেষ ম্যাচটি খেলেন ২০১৫ সালে প্যারাগুয়ের বিপক্ষে বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে।
ক্লাবের তেভেজ
জাতীয় দলের হয়ে প্রত্যাশিত ফলাফল না পেলেও ক্লাবের হয়ে সবসময়ই উজ্জ্বল ছিলেন তেভেজ।
মাত্র ১৬ বছর বয়সেই ২০০১ সালে বোকা জুনিয়র্সের হয়ে ‘আর্জেন্টাইন প্রিমিয়ার ডিভিশন’-এ তার অভিষেক হয়। বোকা জুনিয়র্সের হয়ে ২০০৩ সালে জেতেন প্রিমিয়ার ডিভিশনের শিরোপা। একই বছরে ব্রাজিলিয়ান ক্লাব সান্তোসকে হারিয়ে জেতেন দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ শিরোপা কোপা লিবার্তোদোরেস, তেভেজ নির্বাচিত হন আসরের সেরা খেলোয়াড়।
কোপা লিবার্তোদোরেস জেতার পর ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপের ফাইনালে মুখোমুখি হয় ইতালিয়ান ক্লাব এসি মিলানের। ইনজুরি থেকে ফিরে আসা তেভেজ প্রথম একাদশে জায়গা না পেলেও ৭৩তম মিনিটে মাঠে নামেন, এবং টাইব্রেকারে জয়ী দলের অংশ হন।
২০০৪ সালের কোপা সুদামেরিকানার ফাইনালটা জেতার পেছনেও তেভেজের অবদান ছিল। বলিভারের বিপক্ষে ফাইনালের প্রথম লেগে ১-০ গোলে হারার পর নিজেদের মাঠে দ্বিতীয় লেগে প্রয়োজন ছিল ২-০ গোলের জয়। তেভেজের গোলেই ২-০ গোলের জয়টা নিশ্চিত করে বোকা জুনিয়র্স।
শত্রুশিবিরেও মুগ্ধতা
২০০৫ সালে ব্রাজিলিয়ান ক্লাব করিন্থিয়ানস তাদের পরিকল্পনায় নিয়ে এলো তেভেজকে। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দেশের একজনকেই কেন, সেটা নিয়ে অনেকেই চিন্তিত ছিল। যতই ভালো খেলোয়াড় হোক না কেন, প্রশ্নটা ওঠাই স্বাভাবিক। কিন্তু দক্ষিণ আমেরিকার ট্রান্সফার ফি’র বিশ্বরেকর্ড গড়ে তেভেজকে নিয়ে আসলো করিন্থিয়ানস।
মৌসুমশেষে করিন্থিয়ানস বুঝতে পারলো, তারা ভুল করেনি। ৬ বছর পর করিন্থিয়ানস লিগ জিতলো, এবং তেভেজ জিতলেন লিগের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার। এছাড়া তেভেজ জিতলেন টানা তৃতীয়বারের মতো দক্ষিণ আমেরিকান বর্ষসেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার।
ইংল্যান্ড জয়
লাতিন খেলোয়াড়দের কেউই তেমন অর্থে ইংলিশ লিগে সফল নন। এছাড়া গ্রেট লাতিনরা ইংলিশ লিগটাকে কিছুটা এড়িয়েও চলতে চান। স্কিলনির্ভর খেলোয়াড় হওয়ায় ইংলিশ লিগের শরীরনির্ভর কৌশলকে এড়িয়ে চলাটাও বোকামি নয়। তবে কার্লোস তেভেজ সেই অর্থে লাতিন খেলোয়াড় হয়েও ইংলিশ লিগে সফল। করিন্থিয়ানস থেকে ওয়েস্টহ্যাম ইউনাইটেডে এসে এক মৌসুম খেলেন। সেখানে কোনো শিরোপা জিততে না পারলেও ফ্যানদের ভোটে ক্লাবের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারটা পান।
পরের মৌসুমে যোগ দেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে। ইউনাইটেডে যোগ দেবার পর ফার্গুসন বলেন,
‘তেভেজ আমার জন্য এই মৌসুমে ১৫টি গোল করবে, এবং সেগুলো হবে গুরুত্বপূর্ণ গোল।’
সেখানে তিন মৌসুম খেলে ২টি লিগ, ১টি লিগ কাপ, ১টি কম্যুনিটি শিল্ড, ১টি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ এবং ১টি ক্লাব বিশ্বকাপের শিরোপা জিতেন।
২০০৯-১০ মৌসুমে তেভেজ যোগ দেন ম্যানচেস্টার সিটিতে। সেখানে ৪ মৌসুম খেলে ১টি লিগ, ১টি এফএ কাপ এবং ১টি কম্যুনিটি শিল্ড জেতেন। উল্লেখ্য, ২০১১-১২ মৌসুমের লিগ জয়টা ছিল ১৯৬৭-৬৮ মৌসুমের পর প্রথম। এছাড়া ১৯৬৮-৬৯ মৌসুমের পর ২০১০-১১ মৌসুমের এফএ কাপ জয়, কিংবা ১৯৭২ সালের পর ২০১২ সালের কম্যুনিটি শিল্ডের শিরোপা জেতাটাও খুব তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। ব্যক্তিগতভাবে ২০১০-১১ মৌসুমে জেতেন লিগের গোল্ডেন বুট।
ইতালিতেও সফলতা
ইংল্যান্ড থেকে ২০১৩ সালে তেভেজ যোগ দেন ইতালিয়ান ক্লাব জুভেন্টাসে। জুভেন্টাসের হয়ে দুই মৌসুম খেলে দুইবারই লিগ জিতেন। এই দুই মৌসুমেই লিগে ক্লাবের পক্ষে সর্বোচ্চ গোলদাতা হন, এবং দুই মৌসুমেই জুভেন্টাসের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন। এছাড়া ২০১৪-১৫ মৌসুমে সিরি আ’র সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন।
২০১৫ সালে জুভেন্টাস থেকে আবারও বোকা জুনিয়র্সে ফেরত আসেন তেভেজ। মাঝে এক মৌসুম চায়না লিগে খেলে বর্তমানে বোকাতেই খেলে যাচ্ছেন। হয়তো ক্যারিয়ারটা শেষ করবেন ঘরের মাঠেই।
পরিসমাপ্তি
লড়াইটা তার একেবারে জন্মলগ্ন থেকেই। ১০ মাস বয়সে গরম পানির পোড়া দাগটা মুছতে পারেননি টাকার জন্য। এখন এতটাই ধনী তিনি, চাইলেই প্লাস্টিক সার্জারির হাসপাতালও খুলতে পারেন। কিন্তু এরপরও প্লাস্টিক সার্জারি করে দাগ মুছতে আগ্রহী নন তেভেজ। কারণ জানতে চাইলে বলেন,
‘এ দাগটা তো আমি কী ছিলাম, সেটা আমাকে মনে করায় সব সময়। আমি তো সেই মানুষই, দারিদ্র্যপীড়িত সাধারণ একজন। নিজের কাছে নিজেকে বদলাতে চাই না। মানুষের কাছেও বদলাতে চাই না।’
তেভেজ বদলাতে চান না, হয়তো প্রয়োজনও নেই বদলানোর।
আর্জেন্টিনার হয়ে ৭৬ ম্যাচে মাত্র ১৪টি গোল কোনোভাবেই তার সামর্থ্যটা বুঝাতে পারছে না। কিন্তু ফুটবল ইতিহাসের পারফর্মার তেভেজ নয়, বরং লড়াকু তেভেজই যুগ যুগ ধরে পিছিয়ে থাকা মানুষদের অনুপ্রেরণা যোগাবে, সেটা নিশ্চিত।