আরো একটি নতুন বছরের শুরু। আরো অনেক কিছুর সাথে শুরু হয়ে গেছে অ্যাওয়ার্ড দেওয়া-নেয়ার মৌসুম। গেল বছরের মুক্তি পাওয়া সিনেমা, সিরিজ, শর্ট-ফিল্ম, অ্যানিমেশন ফিল্ম, মিনি-সিরিজ সব ধরনের ক্যাটাগরিতে জুরি-বোর্ড এবং পপুলার চয়েসে সেরাদের সেরার হাতে তুলে দেওয়া হবে এবারের পুরষ্কার। এরই ধারাবাহিকতায়, প্রতিবছরের মতো এবারো দুইদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় হয়ে গেল গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ডের ৭৬তম আসর।
ইন্টারনেটের কারণে অনেকেই অবশ্য ইতোমধ্যেই অবগত হয়ে গেছেন কে বা কারা ঘরে তুলে নিলেন এবারের গোল্ডেন গ্লোব। বিজয়ীদের তালিকায় একটি নাম বেশ উজ্জ্বল হয়ে ধরা দেবে এবং তিনি রীতিমত সাড়া ফেলে দিয়েছেন গোল্ডেন গ্লোবের এবারের আসরে। তিনি হলেন সান্ড্রা ওহ। প্রথম এশিয়ান হিসেবে ৩৯ বছর পর বিবিসি আমেরিকার কিলিং ইভ সিরিজের প্রধান চরিত্রে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরষ্কার পেয়েছেন।
কে এই স্যান্ড্রা ওহ?
স্যান্ড্রা আমেরিকান ইন্ডাস্ট্রিতে প্রায় ৩০ বছরের কাছাকাছি কাজ করলেও এই প্রথম কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রধান চরিত্রের পুরস্কার জিতেছেন। যারা নিয়মিত আমেরিকান সিরিজ দেখেন বা খোঁজখবর রাখেন তাদের কাছে স্যান্ড্রা ওহ খুব একটা অপরিচিত চেহারা নয়। যে কারণে তিনি মূলত লাইমলাইটে আসেন সেটি হলো এবিসি চ্যানেলের জনপ্রিয় মেডিকেল ড্রামা সিরিজ ‘গ্রেজ অ্যানাটমি’ তে ড ক্রিস্টিনা ইয়াং চরিত্রটি।
ক্রিস্টিনা সিয়াটলের একটি মেডিকেল স্কুলের সেরা ছাত্রী হিসেবে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে। এরপর ইন্টার্ন হিসেবে সেই হাসপাতালে কাজ শুরু করে। যে কিনা একজন হার্ট সার্জন হওয়ার প্রবল ইচ্ছা নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। মূল চরিত্র মেরেডিথ গ্রের সাথে ক্রিস্টিনার বন্ধুত্ব স্যান্ড্রা ওহকে আমেরিকার মানুষের কাছে খুবই পরিচিত মুখ করে তোলে।
মেরেডিথ-ক্রিস্টিনার বন্ধুত্ব এখন পর্যন্ত ছোটপর্দায় দেখা সেরা কয়েকটি বন্ধুত্বের রসায়নের গল্পের একটি। এই চরিত্রের জন্য তিনি অ্যামি অ্যাওয়ার্ডসে পার্শ্বচরিত্রে টানা ৫ বার মনোনয়ন পান এবং ২০০৬ সালে পার্শ্বচরিত্রে সেরা অভিনেত্রীর গোল্ডেন গ্লোব জিতে নেন। টানা ১০ বছর এই চরিত্রে কাজ করার পর অবশেষে ২০১৪ সালে স্যান্ড্রা এই সিরিজ থেকে ইস্তফা নেন।
অবশ্য স্যান্ড্রা তার ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন ১৯৯৪ সালে একটি কানাডিয়ান সিনেমা ডাবল হ্যাপিনেস এর মাধ্যমে। সেই সিনেমায় প্রধান চরিত্রে অভিনয় করে জনপ্রিয়তা এবং সমালোচকদের প্রশংসার পাশাপাশি জিতে নেন কানাডার অস্কার হিসেবে খ্যাত জিনি অ্যাওয়ার্ডস। এর আগে কয়েকটি থিয়েটারে পারফর্ম করলেও এটিই ছিল মূলধারার মিডিয়াতে তার প্রথম কাজ।
যেটির সাফল্যের কারণে তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এরপর একে একে তিনি বিন (১৯৯৭), লাস্ট নাইট (১৯৯৮), দ্য প্রিন্সেস ডায়রিজ (২০০১), আন্ডার দ্য টাসকান সান (২০০৩), সাইডওয়েজ (২০০৪), উইলবি ওয়ান্ডারফুল (২০০৪), সরি হেটারস (২০০৫), হার্ড ক্যান্ডি (২০০৫), দ্য নাইট লিসেনার (২০০৬), ব্লাইন্ডনেস (২০০৮), র্যাবিট হোল (২০১০), ক্যাটফাইট (২০১৬) সিনেমাগুলোতে অভিনয় করেন। এর মাঝে তিনি থিয়েটারেও বেশ নিয়মিত অভিনয় করে গেছেন।
গ্রেজ অ্যানাটমির ক্রিস্টিনা ইয়াং চরিত্রটি স্যান্ড্রার জীবন বদলে দেয়া একটি চরিত্র হলেও স্যান্ড্রার মাথায় ছিল ভিন্ন প্ল্যান। তিনি এখানেই থেমে থাকতে চাননি। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থেকে সিরিজটি থেকে বেরিয়ে আসার পর ৪ বছর তিনি আর কোনো বড় কাজে হাত দেননি। তিনি অপেক্ষা করেছেন এমন একটি চরিত্রের জন্য যা ক্রিস্টিনা ইয়াংকেও ছাপিয়ে যাবে।
আর কোনো পার্শ্ব চরিত্রের ভূমিকায় নয় বরং প্রধান চরিত্রে কাজ করবেন। যা তিনি পেয়ে যান গেল বছরের বিবিসি আমেরিকার কিলিং ইভ থ্রিলার সিরিজের মাধ্যমে। যেখানে স্যান্ড্রা ইভ পোলাস্ট্রি নামক একজন এমআই – ফাইভ ইন্টেলিজেন্স অপারেটরের চরিত্রে অভিনয় করছেন। যেখানে তিনি ভিলানেলে নামের একজন মানসিক ভারসাম্যহীন হত্যাকারীকে ধরার মিশনে নেমে পড়েন। যেখানে দুজন নারীই একে অপরের সাথে ইঁদুর-বিড়ালের মতো একটি থ্রিলিং গেমে মেতে ওঠেন।
যার প্রথম সিজন ব্যাপক সাড়া ফেলায় দ্বিতীয় সিজনের কাজ ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। বোঝাই যাচ্ছে, স্যান্ড্রা এত দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে অবশেষে সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছেন। কারণ এই চরিত্রটিই তাকে এ বছরের গোল্ডেন গ্লোবে সেরা অভিনেত্রীর পুরষ্কার এনে দিয়েছেন।
গোল্ডেন গ্লোবে স্যান্ড্রা ওহ
এটি স্যান্ড্রার প্রথম গোল্ডেন গ্লোব না হলেও এবারের গোল্ডেন গ্লোব শুরুর আগে থেকেই স্যান্ড্রা ইতিহাস গড়ে ফেলেছেন। আর তা হলো প্রথম এশিয়ান হিসেবে হলিউডের কোনো অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে সঞ্চালকের ভূমিকা পালন করা। এর পাশাপাশি আরো যে দুইটি রেকর্ড গড়েছেন তা হলো প্রথম এশিয়ান হিসেবে দুইবার মর্যাদাপূর্ণ গোল্ডেন গ্লোব জিতেছেন এবং আরেকটি হলো ৩৯ বছর পর কোনো এশিয়ান প্রধান চরিত্রে গোল্ডেন গ্লোব জিতেছেন। (এর আগে ১৯৮০ সালে ইয়োকো শিমাদা শটগান মিনি-সিরিজের জন্য এই পুরস্কার লাভ করেন)।
স্যান্ড্রা অনেকদিন ধরেই হলিউডে এশিয়ানদের অবহেলা করা নিয়ে কথা বলে আসছেন। তিনি এও বলেছেন, এশিয়ানদের শুধুমাত্র এশিয়ান চরিত্রের জন্যই নেয়া হয়। এশিয়ানদেরকে প্রধান চরিত্রে অভিনয়ের জন্য কখনো ভাবা হয় না।
তাই যখন তিনি কিলিং ইভ এর প্রস্তাব পেয়েছিলেন, স্বাভাবিকভাবেই একটু দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলেন।
আপনারা আসলে ঠিক কোন চরিত্রের জন্য আমাকে ভেবেছেন? কারণ এই সিরিজে কোন এশিয়ান চরিত্র নেই।
এজন্যই তিনি সঞ্চালনার এক মুহূর্তে বলেছিলেন,
আমি আজ রাতে এখানে থাকার ভয়কে ‘হ্যাঁ’ বলেছি। কারণ আমি এই মুহূর্তে উপস্থিত সকলের দিকে তাকিয়ে এই পরিবর্তনটি নিজের চোখে দেখতে চেয়েছি।
তিনি শুধু সঞ্চালনাই করেননি, জিতেও গেছেন। হয়তোবা পুরষ্কারটি তার কাছে অনেকটাই অপ্রত্যাশিত ছিল তাই সেটি নিতে গিয়ে খুবই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন স্যান্ড্রা। দর্শকসারিতে বসা তার মা-বাবাকে কোরিয়ান ভাষায় ধন্যবাদ জানান। বলে রাখা ভাল, স্যান্ড্রার মা-বাবা ইমিগ্র্যান্ট হিসেবে কোরিয়া থেকে কানাডায় আসেন। ব্যবসায়ী বাবা ও রসায়নবিদ মায়ের সবসময় প্রত্যাশা ছিল স্যান্ড্রা পরিবারের বাকিদের মতো পড়াশোনায় তুখোড় হবেন এবং প্রতিটি মধ্যবিত্ত পরিবারের মতো তাদেরও আশা ছিল মেয়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার অথবা উকিল হবে। তাই স্যান্ড্রা যখন পড়াশোনা ছেড়ে অভিনয়ের সিদ্ধান্ত নেন, তারা সেটাকে ভালোভাবে নেননি।
এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেছিলেন,
আমার পরিবারে আমিই একমাত্র সদস্য যার কোনো মাস্টার্স বা পিএচডি ডিগ্রি নেই। তারা অভিনয়কে খুবই খারাপ একটা পেশা হিসেবে দেখতেন। তার সবসময় বলতেন, আমি এই কাজ করে সমাজকে কী দিব? তাই এটা এখন আমার মা-বাবার কাছে অনেক বড় একটি ব্যাপার যে, তাদের মেয়ে যা করছে সেটা প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে এবং প্রভাব ফেলছে।
স্যান্ড্রার এই সাফল্যকে অনেকেই হলিউডে এশিয়ানদের নতুন উত্থান হিসেবে দেখছেন। যদিও ২০১৮ তে বেশ কিছু এশিয়া কেন্দ্রিক সিনেমা মুক্তি পেয়েছে এবং এশিয়ান অভিনেতা-অভিনেত্রীরা বেশ ভালোও করছেন সেগুলোতে। এক সাক্ষাতকারে এই পেশায় আসা নতুন অভিনেতাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন,
আমি এখানে আছি আপনাদের জন্য। আমি প্রতিনিয়ত সেগুলো করার চেষ্টা করবো যা আমি জানি আপনাদের এই মুহূর্তে প্রয়োজন এবং যা এখনো একটি কমিউনিটি হিসেবে আমাদের নেই।
স্যান্ড্রার জন্য শুভকামনা। আশা করছি, ভবিষ্যতে তিনি আরো ভালো ভালো কাজের মাধ্যমে হলিউডে এশিয়ানদের শক্ত অবস্থান গড়ে তুলবেন। আর এই গোল্ডেন গ্লোবটি হোক তার আরও বড় বড় মাইলফলক অর্জনের একটি সূচনা।