কয়েক মৌসুম আগেও ভারতকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই টেস্ট জেতাতো স্পিনাররা। পেস সহায়ক উইকেটে তাদের পেসাররা ছিল নখদন্তহীন। তাই ম্যাচের ফলাফলও আগে থেকেই অনুমান করা যেতো। যুগে যুগে কপিল দেব, জহির খান, জাভাগাল শ্রীনাথদের মতো পেসারদের আবির্ভাব ঘটলেও একসাথে কখনওই একের অধিক ভালো মানের পেসারের দেখা পায়নি ভারত।
ভারতের কিংবদন্তি পেস অলরাউন্ডার কপিল দেবকে একবার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিলো, আরও ভালো পেসার হতে হলে সুষম খাদ্যাভ্যাস প্রয়োজন। তখন তিনি বলেছিলেন, ভারতে কোনো পেসার নেই।
ভারতীয় ক্রিকেটে এমন একটা যুগ ছিল, যখন পেসারদের কাজ ছিল বল পুরাতন করা। মাঝেমধ্যে এই কাজ করতেন সুনীল গাভাস্কার এবং একনাথ সোলকারের মতো পার্টটাইম বোলাররাও।
অথচ বর্তমানে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে গেছে। ২০১৮ সালে ভারত জোহানসবার্গ এবং পার্থ টেস্টে কোনো স্বীকৃত স্পিনার ছাড়াই মাঠে নামে। এর আগে তাদের ক্রিকেট ইতিহাসে এমন ঘটনা ঘটেছিলো মাত্র একবার।
ভারত ২০১৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে টেস্ট সিরিজ খেলে। চ্যালেঞ্জিং সফরে টেস্ট জিততে হলে পেসারদেরই মূল ভূমিকা পালন করতে হতো। তিন নিয়মিত পেসার জাসপ্রিত বুমরাহ, মোহাম্মদ শামি এবং ইশান্ত শর্মা বছরজুড়েই দুর্দান্ত বোলিং করে এই তিন দেশে টেস্ট জিততে সহায়তা করেন।
দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো দ্রুতগতির পেসার না থাকলেও নিজেদের সামর্থ্যানুযায়ী কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে দুর্দান্ত বোলিং করে ভারতীয় পেসাররা। তাদের মাটিতে তাদের পেসারদের থেকেও ভারতীয় পেসারদের পারফরম্যান্স ছিল অধিকতর উজ্জ্বল। তুলনামূলক কম গতিতে বল করলেও ভারতীয় পেসাররাই বেশি ধারালো ছিল।
১.
২০১৮ সালে ভারত ১৪টি টেস্ট ম্যাচ খেলে। এই ১৪ টেস্টে ভারতীয় পেসাররা রেকর্ড গড়ে মোট ১৭৯ উইকেট শিকার করেন। মাত্র ২৩.৭০ বোলিং গড়ে এবং ৪৭.৫ স্ট্রাইক রেটে তারা এই উইকেট শিকার করেন। এর আগে ভারতীয় পেসাররা এক বছরে সবচেয়ে বেশি উইকেট শিকার করেছিলো ১৯৭৯ সালে। ঐ বছর ভারতের পেসাররা ১২৫ উইকেট শিকার করেছিলো। ২০১১ সালে শিকার করেছিলো ১১৯ উইকেট। এই দুই বছরেই পেসারদের বোলিং গড় ছিল ৩০-এর উপরে এবং স্ট্রাইক রেট ছিল ৬০-এর উপর।
ভারত ক্রিকেট ইতিহাসের কোনো বছরেই ভারতীয় পেসাররা ২০১৮ সালের মতো ছন্দে ছিলেন না। পেসাররা কমপক্ষে ৫০ উইকেট শিকার করেছেন, এমন কোনো বছরেই তাদের বোলিং গড় ২০১৮ সালের মতো ভালো ছিলোনা। এমনকি প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের উপর দাপট দেখানোর দিক থেকেও তারা এইবছর এগিয়ে ছিল। এমন দাপটের সাথে ভারতীয় পেসারদের আর কখনও বোলিং করতে দেখা যায়নি।
২০১৮ সালের ভারতের পেসাররা আটবার ইনিংসে পাঁচ উইকেট শিকার করেছে। এক পঞ্জিকাবর্ষে ভারতীয় পেসারদের সবচেয়ে বেশি পাঁচ উইকেট শিকার করার রেকর্ডও এটি। এর আগে ১৯৮১ সালে ভারতের পেসাররা ছয়বার ইনিংসে পাঁচ উইকেট শিকার করেছিলো। এই বছর জাসপ্রিত বুমরাহ তিনবার, মোহাম্মদ শামি দুইবার এবং ইশান্ত শর্মা, উমেশ যাদব ও হার্দিক পান্ডিয়া একবার করে ইনিংসে পাঁচ উইকেট শিকার করেছেন।
২.
২০১৮ সালে ভারতীয় পেসারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উইকেট শিকার করেছেন জাসপ্রিত বুমরাহ। তিনি নয় ম্যাচে ২১.০২ বোলিং গড়ে এবং ৪৭.৪ স্ট্রাইক রেটে ৪৮ উইকেট শিকার করেছেন। মোহাম্মদ শামিও খুব একটা পিছিয়ে নেই। তিনি ১২ ম্যাচে ২৬.৯৭ বোলিং গড়ে এবং ৪৯.০ স্ট্রাইক রেটে ৪৭ উইকেট শিকার করেছেন। এছাড়া ইশান্ত শর্মাও বল হাতেও দুর্দান্ত সময় কাটিয়েছেন। তিনি ১১ ম্যাচে ২১.৮০ বোলিং গড়ে এবং ৪৯.০ স্ট্রাইক রেটে ৪১ উইকেট শিকার করেছেন।
২০১৮ সালের আগে ভারতীয় পেসাররা এক পঞ্জিকাবর্ষে ৪০-এর বেশি উইকেট শিকার করেছিলো মাত্র সাতবার। এর মধ্যে কোনো বছরেই একসাথে দুইজন পেসার ৪০ উইকেট করে পাননি। শুধুমাত্র ২০১৮ সালেই ভারতের তিনজন পেসার এই মাইলফলক অতিক্রম করলেন। বুমরাহ, শামি এবং ইশান্ত জুটি ভারতীয় পেসারদের মোট ১৭৯ উইকেটের মধ্যে ৭৫% কিংবা ১৩৬ উইকেট শিকার করেছেন।
২০১৮ সালে ভারতের সেরা পেসার জাসপ্রিত বুমরাহ’র বছরের শুরুতেও টেস্ট দলে জায়গা নিশ্চিত ছিল না। সাদা বলের ক্রিকেটে দলের নিয়মিত সদস্য হলেও টেস্ট দলে তখনও ডাক পাননি। তবে সুযোগ পেয়েই জানান দেন, তিনি লাল বলেও রাজত্ব করতে এসেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে অভিষেক হওয়ার পর ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়া সিরিজেও দলে ছিলেন তিনি। এবং প্রতিটি সিরিজেই একবার করে ইনিংসে পাঁচ উইকেট শিকার করেছেন। বছর শেষে তিনিই টেস্ট ক্রিকেটে ভারতের হয়ে সর্বোচ্চ ৪৮ উইকেট শিকার করেছেন। ভারতের পক্ষে বোলার হিসাবে নিজের অভিষেক বছরে তার চেয়ে বেশি উইকেট আর কোনো বোলারই শিকার করতে পারেননি।
ইশান্ত শর্মা ভারতের হয়ে অনেক বছর ধরে টেস্ট ক্রিকেট খেলছেন। কিন্তু ২০১৮ সালের আগে কখনোই কোনো এক বছরে তার বোলিং গড় ৩০-এর নিচে ছিলোনা। ২০১৮ সালে তিনি ২১.৮০ বোলিং গড়ে ৪১ উইকেট শিকার করেছেন, যেখানে স্ট্রাইক রেট মাত্র ৪৯.০। স্ট্রাইক রেটের দিক দিয়েও এটি তার সেরা বছর ছিল। আরেক পেসার মোহাম্মদ শামি ২০১৮ সালে ৪৭ উইকেট শিকার করেছেন, যা একবছরে তার ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ উইকেট শিকারের রেকর্ড। বরাবরের মতোই দ্বিতীয় ইনিংসে দুর্দান্ত বোলিং করেছেন তিনি, যা ২০১৮ সালে আরও বেশি কার্যকরী হয়েছে।
৩.
ভারতের পেস আক্রমণকে আরও শক্তিশালী করে গড়ে তুলেছে তাদের ব্যাকআপ ক্রিকেটাররা। বেঞ্চে বসে থাকা পেসাররাও বর্তমানে ছন্দে রয়েছেন। বুমরাহ, শামি, ইশান্তদের বাহিরেও রয়েছেন ভুবনেশ্বর কুমার এবং উমেশ যাদব। ভুবেনেশ্বর কুমার ২০১৮ সালে দু’টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছিলেন। এই দুই টেস্টে তিনি দশ উইকেট শিকার করেছিলেন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে জোহানেসবার্গে ম্যাচ সেরার পুরস্কার জিতেছিলেন।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ভারত প্রথম সারির পেসারদের বিশ্রাম দিয়ে উমেশ যাদবকে একাদশে সুযোগ দিয়েছিলো। সুযোগ পেয়েই বাজিমাত করেছিলেন উমেশ যাদব। তিনি তৃতীয় ভারতীয় পেসার হিসাবে ঘরের মাঠে দশ উইকেট শিকারের কীর্তি গড়েছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে।
২০১৮ সালে ভারতীয় পেসাররা সাকুল্যে মোট ১৭৯ উইকেট শিকার করেছে, যা ২০১৮ সালে যেকোনো দলের পেসারদের পক্ষে সর্বোচ্চ। দ্বিতীয় স্থানে দক্ষিণ আফ্রিকার পেসাররা ১৪৭ উইকেট এবং ইংল্যান্ডের পেসাররা মোট ১৩২ উইকেট শিকার করেছে। স্ট্রাইক রেটের দিক দিয়েও ভারতীয় পেসাররা অনেকটা এগিয়ে রয়েছে। স্ট্রাইক রেটের দিক থেকে তাদের অবস্থান ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং দক্ষিণ আফ্রিকার পরই।
৪.
২০১৮ সালের শুরু থেকেই বলা হচ্ছিলো, ভারতের বর্তমান পেস অ্যাটাক সময়ের সেরা। যদিও ইংল্যান্ড সিরিজ থেকেই টেস্ট দলের নিয়মিত সদস্য ভুবনেশ্বর কুমারকে পায়নি ভারত, তারপরও তাদের পেস অ্যাটাক নিয়মিত সাফল্য পেয়েছে। শামি, বুমরাহ এবং ইশান্ত দুর্দান্ত নৈপুণ্য প্রদর্শন করে ভুবির শূন্যতা অনুভব করতে দেয়নি ভারতকে। বর্তমানে তো ভুবির একাদশে জায়গা করে নিতেই অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে।
ভারতীয় পেসাররা প্রায় প্রতি টেস্টেই প্রতিপক্ষের পেসারদের ভালো বল করছেন। এইবছর ১৪টি টেস্টের মধ্যে নয়টি টেস্টেই ভারতীয় পেসাররা প্রতিপক্ষের পেসারদের সমান কিংবা বেশি উইকেট শিকার করেছে। এর মধ্যে আটটি টেস্টে তাদের বোলিং গড় এবং স্ট্রাইক রেট প্রতিপক্ষের বোলারদের চেয়ে ভালো ছিল, এবং ভারত এর মধ্যে সাতটি টেস্টে জয়লাভ করেছে।
ভারতের বোলিং অ্যাটাকের আরও একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, প্রতিপক্ষকে দুইবার অলআউট করা, ঘরের মাঠে স্পিনাররা যে কাজটা খুব সহজেই করে। কিন্তু ২০১৮ সালে ভারত ১১টি টেস্ট খেলে ঘরের বাইরে যথাক্রমে দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার মাঠে। সেখানে স্পিনাররা খুব একটা বাড়তি সুবিধা পায় না, তাই যা করতে হতো পেসারদেরই।
পেসাররা হতাশ করেননি। তারা ১১টেস্টের মধ্যে নয় টেস্টে প্রতিপক্ষের ২০ উইকেট তুলে নিতে দলকে সাহায্য করেছিলেন, শতকরার হিসাবে যা ৮২%।
২০১৮ সালে ভারত মাত্র তিনটি টেস্ট ঘরের মাঠে খেলেছে। তাই এই বছরে দলের পক্ষে সিংহভাগ উইকেট তাদের দখলে গেছে। ভারতীয় বোলাররা ২০১৮ সালে ২৫৭ উইকেট শিকার করেছে, এর মধ্যে তাদের পেসাররা প্রায় ৭০% উইকেট শিকার করেছে। এক বছরে কমপক্ষে চারটি টেস্ট ম্যাচ খেলেছে এমন বছরে পেসাররা শতকরা এর চেয়ে বেশি উইকেট শিকার করেছে শুধুমাত্র ২০১৪ সালে। ঐ বছর মোট ১৪১ উইকেটের মধ্যে ৭৯%, তথা ১১২ উইকেট শিকার করেছিলো পেসাররা।
ইনিংসে পাঁচ উইকেটে শিকারের দিক থেকেও ২০১৮ সালে স্পিনারদের আকাশপাতাল ব্যবধানে এগিয়ে আছে পেসাররা। এ বছর ভারতীয় বোলাররা নয়বার ইনিংসে পাঁচ উইকেট শিকার করেছিলো, যার মধ্যে আটবার পেসাররা এবং মাত্র একবার স্পিনাররা পাঁচ উইকেট শিকার করেছে। একমাত্র স্পিনার হিসাবে পাঁচ উইকেট শিকার করেছেন চায়নাম্যান বোলার কুলদ্বীপ যাদব। তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে রাজকোটে ৫৭ রানের বিনিময়ে পাঁচ উইকেট শিকার করেছেন। বর্তমানে ভারতের পেস অ্যাটাক কিংবা স্পিন অ্যাটাক দু’টিই বিশ্বমানের, যার ফলে ঘরের মাঠের পাশাপাশি দেশের বাইরেও সফলতা ধরা দিচ্ছে তাদের হাতে। ভারতের যে এই মুহূর্তে ‘মধুচন্দ্রিমা’ চলছে, বলতে তাই আর তেমন ভাবতে হয় না!