শৈশবে স্কুলের পাঠ্যবই বা বাবা-মা-বড়দের কাছে শুনতাম ‘দেশ’-এর কথা। “আমাদের দেশ কত সুন্দর” বা “ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে” ইত্যাদি নানা ভালো লাগার গান-ছড়া-কবিতা শুনতাম। টেলিভিশনের পর্দাতেও লক্ষ্য করতাম জাতীয় সংহতির উদ্দেশ্যে নানা অনুষ্ঠান হচ্ছে। “ঐক্যই আমাদের শক্তি” বা “মিলে সুর মেরা তুমহারা” ধরনের নানা কার্যক্রম দেখতাম। সেগুলোর গূঢ় তাৎপর্য তখন সে বয়সে বুঝতাম না, শুধু দেখেই আনন্দ পেতাম। পরিণত বয়সে বুঝতে পারলাম, জাতীয় জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত এই সমস্ত কথা-অনুষ্ঠান-গান-ছড়া। দেশের প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যে বন্ধন দৃঢ় করতেই ছিল এই সমস্ত কিছুর প্রচার। আর পরিবার-পরিজনের কাছ থেকেও পেতাম এক মহা মূল্যবান মূল্যবোধ। যে মূল্যবোধ শেখাত দেশের কথা, দেশকে ভালোবাসার কথা। তাতে কোনো শর্ত ছিল না, দেশমাতৃকার প্রতি ভালোবাসার নামে কোনো পক্ষপাতিত্ব ছিল না। এমনকি, দেশকে ভালোবাসতে হলে সবার আগে গোমাতাকে ভালোবাসতে হবে বা সর্বক্ষণ সেনাবাহিনীর স্তুতি গেয়ে যেতে হবে, এমন মাথার দিব্যিও কেউ দেয়নি।
নেহেরুর ভারত- সুখ হয়তো কম ছিল, কিন্তু স্বস্তি ছিল
এটাই ছিল জওহরলাল নেহেরুর ভারত। টানা সতেরো বছর দেশের প্রধানমন্ত্রী থাকা নেহেরুর কাশ্মীর নীতিতে কী গাফিলতি ছিল বা চীনের কাছে প্রবল ধাক্কা খাওয়ার জন্যে তিনি নিজেই দায়ী ছিলেন কিনা- এই তর্ক-বিতর্কগুলো আজ প্রবল আকার ধারণ করলেও নেহেরুর প্রকাণ্ড নেতৃত্ব, যা ভারতকে স্বাধীনতার পরবর্তী সেই সংগ্রামের দিনগুলোতে এগিয়ে চলার পাথেয় জুগিয়েছিল, দেশের ধারণাকে পরিপূর্ণতা দান করেছিল, তা কোনোভাবেই অস্বীকার করা চলে না। যে সময়ে ভারত স্বাধীনতা অর্জন করেছিল, সেসময়ে অনেক ‘তৃতীয় বিশ্বের দেশ’ও স্বাধীন হয়েছিল এবং তাদের মধ্যে অনেকের নেতৃত্বের রাশ প্রবাদপ্রতিম দেশনেতাদের হাতে থাকলেও তারা যুগের সঙ্গে সঙ্গে স্বৈরাচারকে উৎসাহ দেন এবং হয়ে ওঠেন নিজেদের সদ্যস্বাধীনতাপ্রাপ্ত রাষ্ট্রের একমেবাদ্বিতীয়ম অধিপতি।
নেহেরু ছিলেন একমাত্র ব্যতিক্রম যিনি সে পথে যাননি এবং পাশাপাশি, ভারতে গণতন্ত্র যাতে বিপদগ্রস্ত না হয়ে পড়ে, তার জন্য সেনাবাহিনীকেও রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করেন। এ এক বিরাট অবদান রাখেন নেহেরু এই নতুন দেশটির প্রতি। পাশাপাশি উচ্চশিক্ষার জন্যে, শিল্পোন্নয়নের জন্যে গড়ে তোলেন নানাবিধ প্রতিষ্ঠান, কারখানা, বাঁধ আরও কত কী। লক্ষ্য ছিল একটাই, দেশটি যেন নিজের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারে। এবং তার সমর্থনে যা যা প্রয়োজনীয়, তার সবই নেহেরু বাস্তবায়ন করেছিলেন। ‘নেশন বিল্ডিং’ বা দেশ গঠন বলে একটি কথাও শুনতাম শৈশবে-ছাত্র জীবনে। এই লেখার প্রথম দিকে উল্লিখিত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উদ্যোগের প্রধান লক্ষ্য যে ছিল সেই অতি প্রয়োজনীয় ‘নেশন বিল্ডিং’, তাও বুঝলাম পরে। একটি আদর্শ ‘নেহ্রুভিয়ান ইন্ডিয়া’তে বড় হয়েছিলাম বলে গর্ব ছিল- ধর্মনিরপেক্ষতার গর্ব, গণতন্ত্রের গর্ব, সেনা অভ্যুত্থান না হওয়ার গর্ব এবং সব মিলিয়ে এক অনন্য ভারতের নাগরিক হওয়ার গর্ব।
সেই উদার ভারত আজ কই? সুখ এসেছে, কিন্তু স্বস্তি?
২০১৮ সালে এসে দেখলাম সেই গর্ব অনেকটাই ধুলিসাৎ। না, ভারতের সনাতন ধর্ম বা সংস্কৃতি- যা আত্মীয়তার কথা বলে, তা নষ্ট হওয়ার নয় সহজে। কিন্তু, যেটা প্রচণ্ড ভাবাচ্ছে সেটা হলো, বিশ্বের দরবারে আজ ভারতের ভাবমূর্তির এক নিদারুণ সঙ্কট চলছে এবং তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার আশু উপায় দেখা যাচ্ছে না। নেহেরুর আমলে যদি হিতকরী রাষ্ট্রের সঙ্গে ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদের মেলবন্ধনে এক মধ্যপন্থী রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রচলন থেকে থাকে, আজ তবে উত্তর-উদারবাদী যুগের সঙ্গে সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের মেলবন্ধনে তৈরি হয়েছে এক বিপজ্জনক ডানপন্থী রাজনৈতিক ব্যবস্থা, যা তিলে তিলে গ্রাস করছে ভারতের সনাতন ভাবমূর্তিকে; বিশ্বের সামনে দেশের এতদিনের অর্জিত সুনামকে ধ্বংস করছে।
একথা শুনে অনেকেই হয়তো বলবেন যে, কংগ্রেসি আমলে ভারতের ভালো কিছু হয়নি। দুর্নীতি, দারিদ্র্য, দুর্বল নেতৃত্ব- ইত্যাদিতে দেশ ক্রমেই পিছিয়ে পড়েছে। এখনকার গেরুয়া শাসনে সত্যিকারের প্রগতি হচ্ছে দেশের।
এই যুক্তির প্রতি পাল্টা যুক্তি, দেশের প্রগতি যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে বিভাজনের রাজনীতি খেলার প্রয়োজন কেন পড়ছে? কেন অহোরাত্র উন্নয়নের বড় বড় দাবি করে যেতে হচ্ছে? কেন কোটি কোটি টাকার মূর্তি তৈরি করে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাবাবেগকে সান্ত্বনা দিতে হচ্ছে? তবে কি দেশের আসল প্রগতি হচ্ছে না বলে মানুষকে ভুলিয়ে রাখার এই সমস্ত পন্থার অবলম্বন করতে হচ্ছে?
যদি হয়ে থাকে, তবে তা অত্যন্ত দুঃখজনক। নেহেরুকে আজকের নেতৃত্ব যতই তার কাশ্মীর বা চীন নিয়ে গালিগালাজ করুক না কেন, এ কথা ভুলে চলবে না যে স্বাধীনতার পরপরই সেই কঠিন প্রতিকূলতার মধ্যেও নেহেরু পিছিয়ে পড়া ভারতকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন; সেখানে গণতন্ত্রকে পোক্ত করেছিলেন। আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় একটি গরিব দেশের নেতা হয়েও তিনি নির্জোট আন্দোলনের মতো একটি সাড়াজাগানো বিদেশনীতিকে অবলম্বন করে অনেকের সমর্থন আদায় করে নিয়েছিলেন। আজকে ভারতের অবস্থান নানা কারণে সেই সময়ের থেকে অনেক শক্তপোক্ত। আজকের নেতৃত্বকে সেই সংগ্রাম করতে হয়নি আর সেদিনের সেই নেতৃত্ব আজকের মতো বিভাজনের নীতি নেননি দেশের সার্বিক উত্থানের কথা ভেবেই।
ভারতের মতো বহুমাত্রিক দেশের শাসনকার্য সফলভাবে করতে হলে নেহেরুর মতো নেতৃত্বের প্রয়োজন সর্বাগ্রে। এখানে পক্ষপাতদুষ্ট, একগুঁয়ে এবং একপেশে শাসন কখনোই চলতে পারে না। ভারত শাসনের মূল মন্ত্র নির্বাচন জেতা নয়- দেশের এবং জাতির আত্মার কথা শুনতে পারা, বুঝতে পারা। কিন্তু নেহেরু-পরবর্তী ভারতের নেতৃত্ব যেভাবে সেই শাসনযন্ত্রকে জাত-ধর্ম-সংরক্ষণ ইত্যাদির জাঁতাকলে পিষ্ট করেছেন, তাতে দিনদিন আরও বিপদগ্রস্ত হয়েছে ভারতের সাধারণ জনজীবন। মেধার বদলে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে পৃষ্ঠপোষকতার সংস্কৃতি, যা কখনোই একটি জাতির সার্বিক ভালো করতে পারে না। একথা বললে ভুল হবে যে, আজকের এই অবক্ষয় গত কয়েক বছরেই হয়েছে। নেহেরুর মৃত্যুর পরবর্তী দশকগুলোতেই এই অবক্ষয়ের সূত্রপাত এবং তা দিন দিন আরও ডালপালা ছড়িয়ে আজ এক মহীরুহে পরিণত।
আজ ভারতের যা কিছু ভালো, তা সম্ভব হয়েছে তার সহজাত ক্ষমতা এবং নেহরুবাদি প্রেক্ষিতের সামঞ্জস্যের কারণে। যেহেতু ভারতের প্রধান সম্পদ তার শক্তিশালী এবং উচ্চাকাঙ্খী বিশাল মধ্যবিত্ত শ্রেণী, মেধা, ইংরেজি শিক্ষায় পারদর্শী আস্ত কয়েকটি প্রজন্ম, একটি উদার অথচ আধা-সুরক্ষিত বাজার অর্থনীতি যার অন্তর্গত রয়েছে এক বিরাট বাজার- তাই সে অনেক দিক থেকেই নিজের পথ নিজে করে নিতে পারছে। কিন্তু দেশের যে সমস্ত ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্য প্রয়োজন উন্নয়নের কারণে- যেমন মৌলিক স্বাস্থ্য ও শিক্ষা, কৃষি, কর্মসংস্থান ইত্যাদি- সেখানে দেখা যাচ্ছে বড়সড় ফাঁক।
এই সমস্ত ফাঁকগুলোকেই ভরাট করা আজকের নেতৃত্বে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। নেহেরু তার সময়কার নিরিখে যা করার করে গিয়েছেন- শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বাঁধ, ভারী শিল্প, বিজ্ঞান-ভিত্তিক জ্ঞানচর্চা ইত্যাদি নানা দেশ গড়ার পদক্ষেপ তো বটেই, তিনি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে একটি গণতান্ত্রিক দেশ গড়ার কাজেও মন দিয়েছিলেন যা এতদিন ভরসা জুগিয়েছে এই সত্তরোর্ধ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে। আজকের নেতৃত্ব সেরকমই যুগোপযোগী কর্মসূচি নিয়ে দেশের হিতে কিছু করার কথা ভাবছে কি? শাসনকার্য একটি ধারাবাহিক কাজ, সেখানে দলীয় বিভাজন অবান্তর এবং বিপজ্জনক। আজকে আমরা ঠিক সেই নেতিবাচক ঘটনাটাই ঘটতে দেখছি; দেশ ও রাষ্ট্রের সর্বময় উন্নতির জন্যে ঠিক কে কী ভাবছে তা ঠাহর করা বেশ দুরূহ আজকে। বরং আজ অনেক বেশি স্পষ্ট দেখছি মানুষে মানুষে বিভাজন তৈরির প্রবণতা।
আশা করছি, এই রাত্তির শেষ হতে বেশি বাকি নেই।