দুই দলের যেকোনো ম্যাচেই একটা দল ফেভারিট থাকে, সেই ম্যাচেও ছিল। তবে ম্যাচ শুরুর আগে ফেভারিটের তকমা পাওয়া আর ম্যাচে জয় পাওয়া, একদমই ভিন্ন বিষয়। জয় পাবার জন্য নির্দিষ্ট দিনটাতে নির্দিষ্ট দলকে অবশ্যই ভালো খেলতে হবে। কাগজে-কলমে এগিয়ে থাকা দলটাই সবসময় জয় না-ও পেতে পারে। তবে এরপরও বিভিন্ন কারণে একটা দলকে মিডিয়া এগিয়ে রাখে। দলগত শক্তি, অতীত ইতিহাস, নির্দিষ্ট টুর্নামেন্টে পারফরম্যান্স ইত্যাদি বিষয়ের পাশাপাশি সর্বশেষ মুখোমুখি লড়াইটাও ফেভারিটের তকমা পাওয়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে। তবে দুই দলের মুখোমুখি সর্বশেষ লড়াইয়ে পাকিস্তান জয় পেলেও ম্যাচটাতে সবাই ফেভারিট হিসেবে নিউ জিল্যান্ডকে এগিয়ে রাখার পরও কেউ অবাক হচ্ছিল না। বরং অবাক না হওয়াটাই স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল।
ম্যাচের বিবরণটা জানার আগে তাই নিউ জিল্যান্ডকে ফেভারিট মনে করার কারণটা একটু জেনে নেওয়া যাক।
১.
সেই বিশ্বকাপে নিউ জিল্যান্ড ছিল দুর্দান্ত, একই সাথে বিস্ময়কর। বিস্ময়ের শুরুটা হয়েছিল আগের আসরের চ্যাম্পিয়ন স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়াকে প্রথম ম্যাচে হারানোর মাধ্যমেই। একে একে টুর্নামেন্টে একমাত্র দল হিসেবে নিজেদের প্রথম ৭টি ম্যাচেই জয় লাভ করে সেমিফাইনাল নিশ্চিত করেই পাকিস্তানের বিপক্ষে গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচটা খেলতে নামে তারা।
অন্যদিকে নিউ জিল্যান্ডের প্রতিপক্ষ পাকিস্তানের অবস্থা এর ঠিক উল্টো। নিজেদের প্রথম ম্যাচে উইন্ডিজের বিপক্ষে ২২০ রান করলেও সেটা হেসেখেলেই টপকে যায় উইন্ডিজ, এমনকি এই রানটা করতে কোনো উইকেটও হারাতে হয়নি তাদেরকে। প্রথম ৭ ম্যাচে জিম্বাবুয়ে এবং শ্রীলংকার মতো দুর্বল দল বাদে শক্তিশালী দল বলতে একমাত্র অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জয় পায় তারা। সবচেয়ে লজ্জাজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয় ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মাত্র ৭৪ রানে অলআউট হবার পর। বৃষ্টির জন্য ম্যাচটা পরিত্যক্ত হবার কারণে ১ পয়েন্ট পায় পাকিস্তান, মূলত সেই ১ পয়েন্টের কারণেই গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচ পর্যন্ত টুর্নামেন্টে টিকে থাকে তারা।
তবে এরপরও পরের পর্বে যাওয়ার জন্য শেষ ম্যাচে নিউ জিল্যান্ডকে হারানোর পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়া-ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচে উইন্ডিজের পরাজয় কামনা করতে হয়েছিল তাদেরকে। পাকিস্তানের প্রার্থনাটা পূরণ করার পেছনে মূল ভুমিকা পালন করেন অস্ট্রেলিয়ান ওপেনার ডেভিড বুন। নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে নিজেদের প্রথম ম্যাচে শতরানের একটা ইনিংস খেলেও পরাজিত দলে থাকা হয়েছে বটে, কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেঞ্চুরিটা বিফলে যায়নি। অন্যদিকে, সেমিফাইনাল নিশ্চিত করে ফেলায় কিছুটা নির্ভার হয়ে খেলতে থাকা নিউ জিল্যান্ড মাত্র ১৬৬ রানে অলআউট হয়ে গেলে কোণঠাসা পাকিস্তান সহজ জয় পেয়ে নকআউটের টিকেট পেয়ে যায়।
মূলত নির্ভার থাকার কারণেই নিউ জিল্যান্ডের হারটাকে কেউ বড় করে দেখেনি। আর এই কারণে ভাগ্যের কিছুটা সুবিধা পেয়ে সেমিফাইনালে আসা পাকিস্তানের বিপক্ষে নিউ জিল্যান্ডকে ফেভারিট ভাবতে কেউ দ্বিধাবোধ করেনি।
২.
ম্যাচটা শুরু হবার পর দেখা গেলো যে, বিশেষজ্ঞ কিংবা দর্শকদের ভাবনাটা মোটেও ভুল কিছু নয়। টস জিতে নিউ জিল্যান্ড ব্যাটিং নিলো। মার্ক গ্রেটব্যাচ তার স্বভাবসুলভ আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতেই খেলা শুরু করলেও খুব বেশি সময় টিকতে পারলেন না। দুইটি ছক্কার সাহায্যে ১৭ রান করেই প্যাভিলিয়নে ফিরতে হলো তাকে, দলীয় রান তখন ৩৫। চার রান পরই আরেক ওপেনার আউট হয়ে গেলে মাঠে নামেন অধিনায়ক মার্টিন ক্রো। সেই টুর্নামেন্টে মার্টিন ক্রো ছিলেন দুর্দান্ত ফর্মে। তখন পর্যন্ত ক্রো’র সংগ্রহ ১২১.৬৬ গড়ে ৩৬৫ রান।
পাকিস্তানের বিপক্ষেও সাবলীল ভাবে খেলতে থাকে দলের রানের চাকা বাড়াতে থাকলেন। যতক্ষণ ব্যাটিং করছিলেন, একটা মুহূর্তের জন্যেও মনে হয়নি, কোনো বোলার তাকে আউট করতে পারবেন। সেঞ্চুরিটাও হয়তো পেয়ে যেতেন, কিন্তু হ্যামস্ট্রিং ইনজুরিতে পড়ে যাওয়ায় রানার নিতে হলো তাকে। শেষ পর্যন্ত রানআউটই হয়েছেন। আউট হবার আগে খেলেছেন ৮৩ বলে ৯১ রানের একটা ঝকঝকে ইনিংস। সেঞ্চুরি না হলেও ক্রো’র অসাধারণ ইনিংসের সুবাদে ২৬২ রানের একটা জেতার মতো স্কোরই করেছিল নিউ জিল্যান্ড। সেই বিশ্বকাপে এর চাইতেও বেশি রান হয়েছিল আরো ৬টি ইনিংসে, তবে প্রতিটি রানই হয়েছিল সেই সময়ের ‘শিশু দল’ হিসেবে পরিচিত জিম্বাবুয়ে আর শ্রীলংকার বিপক্ষে। পাকিস্তানের মতো একটা বোলিং অ্যাটাকসমৃদ্ধ দলের বিপক্ষে ২৬২ রানের মতো স্কোর করাটা আসলেই অনেক বড় বিষয় সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে।
নিউ জিল্যান্ডকে ফেভারিটের তকমা দিয়ে বিশেষজ্ঞরা ভুল করেননি, প্রথম ইনিংস শেষ হবার পর সেটা নিঃসন্দেহেই বলা যায়।
৩.
পাকিস্তানের ইনিংসের শুরুটা সেই যুগের বিবেচনায় খুব একটা খারাপ ছিল না। ওপেনার আমির সোহেল দলীয় ৩০ রানের মাথায় ব্যক্তিগত ১৭ রান করে আউট হয়ে গেলেও অধিনায়ক ইমরান খানের সাথে ৫৪ রানের জুটি গড়ে তোলেন আরেক ওপেনার রমিজ রাজা। রমিজ রাজার ৫৫ বলে ৪৪ রানের ইনিংসে ৬টা চারের মার ছিল। জাভেদ মিঁয়াদাদ আর ইমরান খান ৫০ রানের জুটি গড়লেও কিছুটা ধীরগতিতে খেলছিলেন। ৪৪ রান করতে ইমরান খান বল খরচ করেছিলেন ৯৩টি, যা সেই ইনিংসে প্রয়োজনের প্রেক্ষাপটে যথেষ্ট ধীর। ইমরান আউট হবার পরপরই আউট হয়ে যান নতুন ব্যাটসম্যান সেলিম মালিক। মাঠে নামেন তরুণ ব্যাটসম্যান ইনজামাম-উল হক।
মাত্র ৭টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা নিয়ে বিশ্বকাপে আসা ইনজামাম-উল হকের ক্যারিয়ারের শুরুটা ছিল যথেষ্টই জমকালো। বিশ্বকাপের আগের ৭টি ইনিংসে করেছেন ৬৭.৬৭ গড়ে ৪০৬ রান, যার মাঝে ২টি শতক আর ২টি অর্ধশতকের ইনিংসও ছিল। অথচ সেই টুর্নামেন্টে খুবই বাজে ফর্মে ছিলেন। বিশ্বকাপের ৮টি ইনিংসে ১৫.৩৭ গড়ে করতে পেরেছিলেন মাত্র ১২৩ রান। ক্রিজে তখনও জাভেদ মিঁয়াদাদ থাকলেও পাকিস্তানের জয়ের ব্যাপারে সমর্থকরাও খুব বেশি আশাবাদী ছিলেন না। শেষ ১৫ ওভারে ১২৩ রান করাটা এই সময়ের প্রেক্ষাপটেও কঠিন, সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে মোটামুটি অসম্ভবই বলা চলে।
আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করতে অভ্যস্ত ইনজামাম-উল হক মাঠে নেমে পাল্টা আক্রমণ করা শুরু করলেন। আর তাতেই পরিস্থিতিটা ধীরে ধীরে পাকিস্তানের দিকে হেলতে শুরু করলো। মিঁয়াদাদের সাথে মাত্র ১০ ওভারে ৮৭ রানের খুবই প্রয়োজনীয় এবং সময়োপযোগী জুটি গড়ে তুললেন ইনজামাম, যেখানে তার অবদান ৬০ রান, সেটাও মাত্র ৩৭ বলে।
৪.
তার আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ে পুরো সিরিজে ইকোনমিক্যাল বোলিং করতে থাকা ‘ব্ল্যাক ক্যাপস’ বোলাররাও খেই হারিয়ে ফেলে। প্রথম ৮ ওভারে মাত্র ২৮ রান দেওয়া দীপক প্যাটেল শেষের ২ ওভারে দেন ২২ রান। ধারণা করা হয়, মার্টিন ক্রো’র ইনজুরির কারণে অধিনায়কত্বের দায়িত্ব পালন করা জন রাইট সতীর্থদের কাছ থেকে প্রয়োজনের সময় সেরাটা বের করে আনতে ব্যর্থ ছিলেন।
অথচ আগের রাতে জ্বরে ভোগার কারণে ম্যাচ খেলা নিয়েই অনিশ্চিত ছিলেন ইনজামাম। অধিনায়ক ইমরান খানকে সেটা জানানোর পর ইমরানের একটা কথাই ম্যাচটা খেলতে তাকে অনুপ্রাণিত করেছিল,
‘ইনজি, বিকল্প কিছু ভাববার সুযোগ নেই। কেবল ভাবো, কোন কাজটা করলে তুমি খেলতে পারবে।’
আগের ইনিংসগুলোতে ব্যর্থ থাকার পরও অধিনায়কের তার প্রতি আত্মবিশ্বাস তাকে বাড়তি প্রেরণা যোগায়। ৬০ রানের ইনিংস খেলার পথে ৭টি বাউন্ডারির পাশাপাশি একটা ওভার বাউন্ডারিও মারেন ইনজামাম উল হক। হয়তো ম্যাচটা শেষ করেই ফিরতেন, কিন্তু ক্রিস হ্যারিসের দুর্দান্ত ফিল্ডিংয়ে রানআউট হয়ে প্যাভিলিয়নে ফেরত আসতে হয় তাকে।
ইনজামাম আউট হবার পর নিউ জিল্যান্ড আবারও ম্যাচে ফেরত আসে। তখনও জিততে পাকিস্তানের প্রয়োজন ছিল ৩৬ রান। কিন্তু শেষ ওভারে মঈন খানের ছক্কায় সম্ভাবনার শেষ আশাটুকুও খুইয়ে ফেলে নিউ জিল্যান্ড। পুরো টুর্নামেন্টে বাজে খেলেও প্রয়োজনের সময় ঝলসে উঠে বাজি মেরে দেয় পাকিস্তান। মার্টিন ক্রো’কে পেছনে ফেলে ম্যান অফ দ্য ম্যাচের পুরস্কার পেয়ে যান ইনজামাম-উল হক।