একনায়কতন্ত্র বা স্বৈরশাসন– যেটাই বলা হোক না কেন, শুনলেই প্রথমে কপালে একটা ভাঁজ পড়ে যায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী থেকে সাধারণ মানুষ, সকলেই এই একনায়কতন্ত্র সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করে থাকেন। এক দেশ, এক জাতি, এক নেতা- এই আদর্শকে পুঁজি করে কোনো দেশের শাসনব্যবস্থা যখন একজনের উপর ন্যস্ত থাকে, তখন তাকে একনায়কতন্ত্র বলা হয়।
একনায়কতন্ত্রে জনগণের ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন হয় বলে এই শাসন ব্যবস্থার প্রতি মানুষের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি অস্বাভাবিক কিছু নয়। শুধু তা-ই নয়, একনায়কতন্ত্রের কারণে সংগঠিত হয়েছে গণহত্যা! ইতিহাস ঘেঁটে দেখলে এমন অনেক নজির পাওয়া যায়, যেখানে একনায়ক বা স্বৈরশাসকের একচ্ছত্র আধিপত্য এবং সিদ্ধান্তের কারণে প্রাণহানি হয়েছে কোটি কোটি মানুষের। প্রিয় পাঠক, আজ এমন কিছু গণহত্যার কাহিনী শোনাবো, যেগুলোর পেছনে হাত রয়েছে স্বৈরশাসন বা একনায়কতন্ত্রের।
১০. উত্তর কোরিয়ার মানবতাবিরোধী আচরণ ও গণহত্যা (১৯৪৮- চলমান)
পৃথিবীর সবচাইতে মানবতা বিরোধী ও স্বাধীনতা দমনাত্মক সরকার হচ্ছে উত্তর কোরিয়ার সরকার। বিশ্ব মানবাধিকার রেকর্ডের সবচাইতে সর্বনিম্ন সূচক নিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনে উত্তর কোরিয়ার অবস্থান শীর্ষে। এই দেশে শুধুমাত্র রাজনৈতিক মতবিরোধের জের ধরে ২ লক্ষেরও বেশি মানুষকে এখন পর্যন্ত কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে প্রেরণ করা হয়েছে। এর পাশাপাশি রাজনৈতিক মতবিরোধের কারণে দাসত্ব, কারাবরণ, গণহত্যা, নির্যাতনের শিকার হচ্ছে আরো লক্ষ লক্ষ মানুষ। আনুমানিক হিসাব মতে, ১৯৪৭ থেকে এখন পর্যন্ত উত্তর কোরিয়ায় একনায়কতন্ত্রের ফাঁদে গণহত্যার শিকার হয়েছেন প্রায় ৭-৩৫ লক্ষ মানুষ।
৯. ইয়ং তুর্কির অটোম্যান হলোকাস্ট (১৯১৩- ১৯২২)
১৯০৮ সালে তুরস্কে নতুন সরকার গঠন করা হলে একদল সংস্কারপন্থী লোক নিজেদেরকে ইয়ং তুর্কি বলে অভিহিত করে এবং সুলতান আব্দুল হামিদকে উৎখাত করে। এরপর তারা একটি আধুনিক সাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিল। নতুন এবং আধুনিকতার আড়ালে ইয়ং তুর্কিদের দ্বারা সংগঠিত অটোম্যান হলোকাস্ট মূলত কয়েকটি আলাদা আলাদা গণহত্যার সম্মিলিত রূপ। এগুলো হলো আর্মেনিয়ান গণহত্যা (মৃতের সংখ্যা ৮-১৫ লক্ষ), অ্যাসিরিয়ান গণহত্যা (মৃতের সংখ্যা ১.৫ লক্ষ – ৩ লক্ষ), গ্রিক গণহত্যা (মৃতের সংখ্যা ২ লক্ষ ৭৯ হাজার-৭ লক্ষ ৫০ হাজার), এবং মাউন্ট লেবাননের চরম দুর্ভিক্ষ (মৃতের সংখ্যা প্রায় ২ লক্ষ)। সব মিলিয়ে আনুমানিক প্রায় ১৫-২৫ লক্ষ মানুষ ইয়ং তুর্কিদের অটোম্যান হলোকাস্টের বলি হয়েছিলেন।
৮. খেমার রুজের কম্বোডিয়ান গণহত্যা (১৯৭৫-১৯৭৯)
কম্বোডিয়ার খেমার রুজ সরকারের শাসনামলে সরকার প্রধান পোল পটের অধীনে এই গণহত্যা পরিচালিত হয়েছিল। মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল আনুমানিক ১৫ থেকে ৩০ লক্ষে। কম্বোডিয়ার গৃহযুদ্ধে খেমার রুজের বিজয় এবং সরকার গঠনের মাধ্যমে কমিউনিস্ট পার্টি অফ কম্বোডিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মার্ক্সবাদী নেতা পোল পট স্ট্যালিনিজম এবং মাওবাদী আদর্শের ভিত্তিতে সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন করতে চেয়েছিল। জোরপূর্বক শহুরে জনগণকে গ্রামে পাঠাবার বিনিময়ে কম্বোডিয়াকে এর মূল্য দিতে হয়েছিল চরমভাবে। কম্বোডিয়ার মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে। ক্ষুধা, নির্যাতন, দুর্ভিক্ষ, অপুষ্টির কারণে তারা মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়। ১৯৭৯ সালে, ভিয়েতনামের বহিরাক্রমণের ফলে কম্বোডিয়ায় চার বছর ধরে চলতে থাকা এই নৈরাজ্যের অবসান ঘটে। ২০০৯ সাল পর্যন্ত হিসাব অনুসারে কম্বোডিয়ার এই গণহত্যার প্রমাণস্বরূপ ২৩ হাজার ৭৪৫টি গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। নিহতের সংখ্যা কমপক্ষে ২০ লক্ষ।
৭. মাদাগাস্কারে রানী প্রথম রানাভালোনার নৃশংসতা (১৮২৯-১৮৪২)
মাদাগাস্কারের রানী প্রথম রানাভালোনাকে বলা হতো ম্যাড কুইন। তার রানী হয়ে ওঠার ঘটনা যেমন নির্মম, তেমনই নির্মম ছিল তার রাজ্য পরিচালনার নিয়মনীতি। রাজ্য পরিচালনার জন্য একরোখা, বর্বর নীতি অনুসরণ করতেন। তার কথার অবাধ্য হওয়া দূরে থাক, তার সমালোচনা করার কথা কেউ মনে মনে ভাবলেও, পেতে হতো চরম শাস্তি। তিনি মাদাগাস্কারের রানী হবার পর স্বনির্ভর রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেন। বৈদেশিক সমস্ত বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং দেশের জনগণকে দিয়ে বিনা পারিশ্রমিকে দিন রাত খাটাতেন।
জনগণকে পাশবিকভাবে খাটানোর জন্য ফ্যানমপোয়ানা প্রথা প্রচলন করেছিলেন তিনি। এই প্রথা অনুসারে, কেউ যদি রানাভালোনার রাজ্যে খাজনা বা ট্যাক্স দিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তাকে টাক্সের বদলে অতিরিক্ত শ্রম দিয়ে সেই খাজনা পরিশোধ করতে হতো। কোনো শ্রমিক ছোটখাট ভুল করলেও তাকে পেতে হতো চরম শাস্তি। ফলে খাদ্যাভাব, দুর্ভিক্ষ, নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা যায় লাখ লাখ শ্রমিক।
রানাভালোনা তার সাম্রাজ্য আরো বিস্তৃত করার জন্য তার পূর্বসূরি রাজা প্রথম রাদামার যুদ্ধনীতি জারি রেখেছিলেন। তার সিধান্তের বিরোধিতা করলেই শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। সামরিক বাহিনীর সহায়তায় তিনি এসব শাস্তি নিশ্চিত করতেন। ফ্যানমপোয়ানা প্রথা, সামরিক নির্যাতন, অনৈতিক বিচার ব্যবস্থার ফাঁদে পড়ে ১৮৩৩ থেকে ১৮৩৯, এই ছয় বছরে মাদাগাস্কারের জনসংখ্যা ৫০ লক্ষ থেকে ২৫ লক্ষতে নেমে এসেছিল। অন্যদিকে মাদাগাস্কারের অংশ ইমরিনা রাজ্যেও রানাভালোনার নৃশংসতার কারণে আরো প্রায় ৬ লক্ষ প্রাণহানি ঘটেছিল। কেউ কেউ রানী প্রথম রানাভালোনাকে ইতিহাসের সবচাইতে বর্বর রানী হিসেবে মনে করেন।
৬. কঙ্গো ফ্রি স্টেট এবং কসাই রাজা লিওপোল্ডের হত্যাযজ্ঞ (১৮৮৫-১৯০৮)
বর্তমানে কঙ্গো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হলেও, কঙ্গো ফ্রি স্টেট তাদের ইতিহাসের একটি কালো অধ্যায়। ১৮৮৫ সালে কঙ্গোর লিজ নেয়ার জন্য বার্লিন কনফারেন্সে আবেদন করেন বেলজিয়ামের রাজা লিওপোল্ড। কঙ্গোর উন্নতির কথা বলে, তিনি তার নিজের দেশের চাইতে ৭৬ গুণ বড় কঙ্গোতে নিজের সাম্রাজ্য বিস্তার করেন। তবে তার সাম্রাজ্য বিস্তারের ধরন ছিল পৈশাচিক এবং বর্বর। তিনি নিজস্ব পাবলিক ফোর্স গঠন করে প্রাকৃতিক সম্পদের দেশ কঙ্গোর উপরে শোষণ চালাতে থাকেন। বার্লিন কনফারেন্সের নিয়ম ভেঙে তিনি সেখানে বিদেশি বিনিয়োগ বন্ধ করেন। স্থানীয় শ্রমিকদের দিয়ে জোরপূর্বক রাবার চাষ করাতে শুরু করেন। কঙ্গো থেকে আইভরি রপ্তানি করে নিজের দেশের উন্নতি ঘটাতে থাকেন। তার নির্দেশে গ্রামের পর গ্রাম রাবার শ্রমিকদের উপর নির্যাতন চালিয়ে গেছেন তার পাবলিক ফোর্স। বর্বর পাবলিক ফোর্সের মাধ্যমে কোনো শ্রমিকের ভুল দেখলেই তার অঙ্গচ্ছেদ করা হতো। বাবা-মায়ের সামনে সন্তানের মুণ্ডুপাত করা হতো। পান থেকে চুন খসলে শ্রমিককে বরণ করতে হতো মৃত্যু! তার এই শোষণের শিকার হয়ে কঙ্গোতে প্রাণ গেছে প্রায় ১ কোটি শ্রমিকের! কঙ্গোর প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা ধ্বংস হয়েছে কঙ্গোর কসাই নামে পরিচিত রাজা লিওপোল্ডের গণহত্যায়!
৫. হিরোহিতোর জাপানী যুদ্ধাপরাধ সংশ্লিষ্ট হলোকাস্ট (১৮৯৫-১৯৪৫)
দ্বিতীয় সাইনো-জাপানিজ সংঘাত এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে জাপানিজ সাম্রাজ্যবাদের বিস্তার ঘটেছিল। এই সময়কালের মধ্যে এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বেশ কিছু জাপানি যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছিল। ইতিহাসবিদরা এই যুদ্ধাপরাধকে এশিয়ান হলোকাস্ট নামে অভিহিত করে থাকেন। উনিশ শতকের শেষ দিকে জাপানিজ সাম্রাজ্যের কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তা কর্তৃক গণহত্যা এবং যুদ্ধাপরাধ সংগঠিত হলেও, জাপানী সাম্রাজ্যের প্রভাবে সবচাইতে বেশি গণহত্যার প্রমাণ পাওয়া যায় রাজা হিরোহিতোর রাজত্বকালের প্রথম দিকে, শোওয়া যুগে। ১৯৪৫ সালে জাপানি সাম্রাজ্যের আত্মসমর্পণের আগপর্যন্ত এই যুদ্ধাপরাধ চলমান ছিল। কোনো কোনো ইতিহাসবিদ সাম্রাজ্যবাদী রাজা হিরোহিতোর সামরিক বাহিনী, নৌবাহিনী এবং জাপানের কিছু সাম্রাজ্যবাদী পরিবারকে লক্ষ লক্ষ মানব হত্যার জন্য দায়ী করেন। জাপানী যুদ্ধাপরাধের দরুন, আনুমানিক ৩০ লক্ষ থেকে ১ কোটি ৪০ লক্ষ বেসামরিক নাগরিক এবং বন্দীকে যুদ্ধের জের ধরে হত্যা করা হয়েছিল।
৪. চীনের জাতীয়তাবাদী সরকার কর্তৃক গণহত্যা (১৯২৮-১৯৪৬)
একনায়কতন্ত্রের জের ধরে ইতিহাসের সবচাইতে বড় গণহত্যার একটি নজির স্থাপনের জন্য চীনের জাতীয়তাবাদী সরকারকে দায়ী করা হয়ে থাকে। বিখ্যাত রাজনীতিবিদ এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রুডলফ রুমেলের হিসেব মতে, প্রায় ৬০ লক্ষ থেকে ১ কোটি ৮৫ লক্ষ গণহত্যার পেছনে চীনের এই জাতীয়তাবাদী সরকার প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। তিনি এই গণহত্যার কিছু কারণ অনুসন্ধান করেছিলেন। প্রায় ১০ লক্ষ চীনা নাগরিককে অনাহারী করে রাখা হয়েছিল এবং হত্যা করা হয়েছিল চীনা কম্যুনিজম উৎখাতের লক্ষ্যে।
চীনা কম্যুনিস্ট এবং সাধারণ চাষীরা রাজনৈতিক নিগ্রহের শিকার হয়েছিলেন ব্যাপকভাবে। চীনা জাতীয়তাবাদী সরকারের ক্ষমতাবান সরকারী কর্মকর্তারা নিজের লাভের জন্য, গরীব চাষিদের উৎপাদিত খাদ্যশস্য বাজেয়াপ্ত করে বিক্রি করে দিত। এই কারণে চীনে প্রায় ১৭ লক্ষ ৫০ হাজার থেকে ২০ লক্ষ মানুষ ক্ষুধার্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিল। চীনা জাতীয়তাবাদী দল নির্বিচারে এবং জোরপূর্বক সাধারণ জনগণকে সামরিক বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করেছিল। এই কর্মযজ্ঞ চলাকালে প্রায় ৪২ লক্ষ চীনা নাগরিক যুদ্ধে যাওয়ার আগেই ক্ষুধা এবং অসুখে মারা গিয়েছিল। জাপানের উন্নতির ধারা ঠেকানোর জন্য চীনা জাতীয়তাবাদী দল উদ্দেশ্যমূলক বন্যা পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। বন্যার পানিতে ভেসে গিয়েছিল প্রায় ৪ লক্ষ ৪০ হাজার থেকে ৮ লক্ষ ৯৩ হাজার বেসামরিক চীনা নগরিকের জীবন!
৩. হিটলারের অধীনে জার্মানির নাৎসি হলোকাস্ট (১৯৩৯-১৯৪৫)
একনায়কতন্ত্রের প্রভাবে পৃথিবীতে যত গণহত্যা সংগঠিত হয়েছে, তার মধ্যে সবচাইতে আলোচিত গণহত্যার নাম নাৎসি হলোকাস্ট। নাৎসি হলোকাস্টের প্রধান শিকার ছিল কয়েক ধরনের জনগোষ্ঠী। মূলত ইহুদি, পোলিশ, সমকামী, শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী, জিপসি, সার্বিয়ান জনগোষ্ঠী, ফ্রিম্যাসন, ইস্ট স্লেভস, জেহোভান সাক্ষী এবং যুদ্ধবন্দীরাই ছিল এই নাৎসি হত্যাযজ্ঞের প্রধান শিকার।
এই হলোকাস্টে ইহুদিদেরকে একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে গণহত্যা করা হয়। জার্মানির নাৎসি পার্টির সর্বোচ্চ নির্দেশে, এসএস বাহিনীর সমন্বয়ে, জার্মানির প্রতিটি আমলাতান্ত্রিক সামরিক বাহিনী এই ইহুদি গণহত্যার সাথে যুক্ত ছিল। জার্মান দখলদারিত্বের অধীনে থাকা ইউরোপ, নাৎসি জার্মানি এবং জার্মান মিত্রবাহিনী কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত সব অঞ্চলে এই হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছিল। ইহুদিদের বাইরে পোল্যান্ডের পোল গোষ্ঠী, ইউক্রেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের বেসামরিক জনগণ, সোভিয়েত যুদ্ধবন্দী, স্ল্যাভিয়ান জনগোষ্ঠী, সমকামী এবং প্রতিবন্ধীরাও এই গণহত্যায় প্রাণ হারিয়েছিলেন। ইহিহাসের এই জঘন্যতম মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার জন্য জার্মান নাৎসি বাহিনী কর্তৃক প্রায় ৪২,৫০০ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প ব্যবহৃত হয়েছিল। এই বিপুল পরিমাণ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের অন্ধকারে নাৎসি হলোকাস্টে জীবন দিয়েছে ১ কোটি ৭০ লক্ষ মানুষ!
২. স্ট্যালিনের মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং গণহত্যা (১৯২২-১৯৫৩)
জোসেফ স্ট্যালিনের স্বৈরাচারের জের ধরে কত মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে তা জানলে গা শিউরে উঠবে। এই স্বৈরশাসক তার শাসনামলে দুর্ভিক্ষ লাগিয়ে, শ্রমশিবিরে নির্যাতন চালিয়ে, স্ট্যালিনবিরোধী এবং সমালোচকদের নির্বাসনে পাঠিয়ে, বিতাড়িত করে এবং এনকেভিডি বাহিনীর সাহায্যে লাখ লাখ মানুষ হত্যা করেছিলেন। ইউএসএসআর পতনের পর পোস্ট আর্কাইভের হিসেব মতে প্রায় ৪০ লক্ষ থেকে ১ কোটি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে স্ট্যালিনের স্বৈরশাসন।
এই হিসেব শুধুমাত্র দুর্ভিক্ষ বহির্ভূত মৃত্যুর জন্য প্রযোজ্য। অর্থাৎ গুলি করে হত্যা, বা নির্বাসনে পাঠিয়ে হত্যা করা হয়েছিল তাদের। ধারণা করা হয়, গুলাগ শ্রমশিবিরেই হত্যা করা হয়েছিল ৫০ লক্ষ শ্রমিককে। স্ট্যালিনের স্বৈরশাসনের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে, লেখক রবার্ট কনকোয়েস্ট তার দ্য গ্রেট টেরর বইতে লিখেছেন, স্ট্যালিনের শাসনামলে গণহত্যার পরিমাণ ছিল প্রায় তিন কোটি। পরবর্তীতে এই হিসেবে একটু কমবেশি হয়েছে। স্ট্যালিন নিজেও ভুয়া আদমশুমারির মাধ্যমে তার গণহত্যা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তবে বেশিরভাগ ইতিহাসবিদই মনে করেন, স্ট্যালিনের সময়ে গণহত্যার মোট পরিমাণ কমপক্ষে দেড় থেকে দুই কোটি!
১. মাও সে তুং এবং চীনের দুর্ভিক্ষ (১৯৪৬-১৯৭৬)
চীনা গৃহযুদ্ধে, জাতীয়তাবাদী সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে চায়না কম্যুনিস্ট পার্টির জয়ের নেতৃত্ব দেয়া মাও সে তুংয়ের সুখ্যাতি থাকলেও, তার বিরুদ্ধে ব্যাপক গণহত্যার অভিযোগও রয়েছে। মাও সমালোচকরা বলেন, মাও তুংয়ের একনায়কত্বকালে গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ডের মতো বর্বর অর্থনৈতিক নীতির সাক্ষী হয়েছে চীন। এই গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ডের কবলে পড়ে প্রাণ হারিয়েছে লাখো মানুষ। এছাড়াও শ্রমশিবিরে দাসের মতো লোক খাটানো, রাজনৈতিক মতবিরোধ, সাংস্কৃতিক বিপ্লব এবং মাওবাদীদের অতি বৈপ্লবিক স্বপ্নের বলি হয়েছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড নীতির কারণে মানুষের জীবনযাত্রার মান কমে যাবার সাথে সাথে কমে যেতে থাকে গ্রামীণ চাষীদের আয়। অতিমাত্রায় শিল্প বিপ্লবের স্বপ্নে বিভোর থাকায় মাও দেখতেই পারেননি, তার নীতিই বুমেরাং হয়ে ধ্বংস করছে দেশের অর্থনীতিকে। চেয়ারম্যান মাওয়ের এই একরোখা নীতির কারণে চীনে দেখা দেয় মহাদুর্ভিক্ষ। মারা যায় আনুমানিক ৪ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষ। ভূমিসংস্কার নীতির কারণে মৃত্যুবরণ করে আনুমানিক আরো ৮ লক্ষ মানুষ।
পাঠক, পুরো লেখায় কোটি কোটি হত্যার কথা পড়ে হয়তো শিউরে উঠেছেন। আরো শিহোরিত হবার মতো ব্যাপার হচ্ছে; বিভিন্ন সময়ের, বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন একনায়ক বা স্বৈরশাসক হচ্ছেন এই মৃত্যু মিছিলের মূল পরিকল্পনাকারী! কখনো কখনো তারা সজ্ঞানে ঘটিয়েছেন এসব হত্যাকাণ্ড। আবার কখনো ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে, ন্যাক্কারজনক ঘটনার জন্ম দিয়ে ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম লিখিয়েছেন। স্বৈরশাসক হিসেবে তারা যে দেশের জন্য ভাল কিছুই করেননি এমনটাও নয়। ইতিহাস সবই মনে রাখে। কিন্তু যে নজিরবিহীন নৃশংসতার জন্ম তারা দিয়েছেন, তার কাছে সবকিছু ছাপিয়ে যায়, তুচ্ছ হয়ে যায়।