ভরত গেল নির্বাসনে থাকা রামের কাছে। উদ্দেশ্য, ভাইকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে ফিরিয়ে আনা, রাজ্য শাসনে উদ্বুদ্ধ করা। কিন্তু অনেক চেষ্টা-চরিত্র করেও কোনো লাভ হলো না। রাম মহা একগুঁয়ে। ভাইয়ের কোনো অনুরোধ-উপরোধই সে রাখবে না। উপায়ান্তর না দেখে এক অভিনব কৌশল বের করলো ভরত। অনশনে বসবে সে। এমনকি উপবাসব্রত শুরুর ঘোষণাও দিয়ে দিল। সারথি সুমন্ত্রকে বলল কিছু পবিত্র কুশা ঘাস নিয়ে আসতে। কিন্তু সুমন্ত্র তখন রামের মুখের দিকে চেয়ে থাকতে ব্যস্ত। তাই ভরত নিজেই গেল কুশা ঘাসের সন্ধানে। রামের সামনে সেই ঘাস বিছিয়ে, তার উপর শুয়ে পড়লো সে। তবে খুব বেশিক্ষণ উপবাসব্রত জারি রাখা সম্ভব হলো না তার পক্ষে। কারণ রাম তার ভাইকে অতি সহজেই বশ মানিয়ে ফেলল এ কাজ থেকে বিরত থাকতে।
-সর্গ ১০৩, অযোধ্যা কাণ্ড, রামায়ণ
তবে ভরতকে যত সহজে বশ মানানো গিয়েছিল, অনেক বিপ্লবী বা আন্দোলনকারীকেই কিন্তু এত সহজে বশ মানানো যায় না। তারা অনশনের ঘোষণা দেয়, আর সত্যি সত্যিই নিজেদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত কোনো খাবার (তরল ব্যতীত) মুখে দেয় না। এমনকি দাবি আদায় না হলে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নিতেও তারা দ্বিধাবোধ করে না।
না পাঠক, মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নেয়াটা কেবল কথার কথা হিসেবে বলা না। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত কেউ যদি অনশন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও তাদের সিদ্ধান্তে অটল থাকে, তাহলে অনশনকারীর মৃত্যুই ভবিতব্য। তাই তো একে বলা হয় আমরণ অনশন।
ক্যালিফোর্নিয়া ডিপার্টমেন্ট অফ রিহ্যাবিলিটেশন্স এন্ড কারেকশন্স থেকে প্রকাশিত এক নীতিমালা অনুযায়ী, কেউ যদি অনশন করে অর্থাৎ খাদ্য গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়, তাহলে প্রথম প্রথম তার হুট করে তীব্র ক্ষুধাবোধ হবে, প্রচণ্ড কষ্টও অনুভূত হবে। কিন্তু এরকম অনুভূতি তৃতীয় দিনের পর আর থাকবে না। তার শরীরে গ্লুকোজের মাত্রার আকস্মিক পতন হতে শুরু করবে। চতুর্থ থেকে ত্রয়োদশ দিনের মধ্যে, তার শরীর শক্তির উৎস হিসেবে ফ্যাটি অ্যাসিড ভাঙতে শুরু করবে, এবং শরীরের ফ্যাটি টিস্যু ও পেশি ক্রমাগত হ্রাস পেতে থাকবে।
দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে চৌত্রিশতম দিন পর্যন্ত অনশনকারী নিস্তেজ বোধ করবে, মাথা একেবারেই হালকা লাগবে, মাঝেমধ্যেই মাথা ঝিমঝিম করবে, ঠাণ্ডা অনুভব করবে, বিচার-বিবেচনাবোধ লোপ পেতে থাকবে।
পঁয়ত্রিশতম দিন থেকে বিয়াল্লিশতম দিন একজন অনশনকারীর জন্য সবচেয়ে ভয়ংকর সময়। এ সময় মাথা ঝিমঝিম করার মাত্রা আরো বেড়ে যাবে, থেকে থেকে সে জ্ঞান হারাতে থাকবে, পেটে কিছু না থাকা সত্ত্বেও ক্রমাগত বমি হতে থাকবে, এবং এমনকি পানি পান করতেও প্রচণ্ড কষ্ট হবে।
টানা সপ্তম সপ্তাহ পার হওয়ার পর অনশনকারীর সবকিছুই তালগোল পাকিয়ে যেতে শুরু করবে, সে দৃষ্টিশক্তি বা শ্রবণশক্তি অথবা দুই-ই হারিয়ে ফেলবে, এবং তার আভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ শুরু হবে। তবে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি খুব কম অনশনকারীকেই হতে হবে, কেননা পঁয়তাল্লিশতম দিন পার হওয়ার পর যেকোনো সময়ই সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে।
তার মানে বুঝতেই পারছেন, জেনে-বুঝে কেউ যখন অনশনে বসে, তখন সে নিছকই কারো ‘দৃষ্টি আকর্ষণ’ করতে চায় না, বরং স্বেচ্ছায় নিজেকে তীব্র শারীরিক যন্ত্রণার মধ্যে ঠেলে দেয়, মৃত্যু যার অন্তিম পরিণতি।
তারপরও মানুষ অনশনে কেন বসে? ঠিক কোন পরিস্থিতিতে সে এমন চরম সিদ্ধান্ত নেয়? ঐতিহাসিকভাবে, তারাই মূলত অনশনে বসে, যাদের সামনে প্রতিবাদের আর কোনো রাস্তাই খোলা নেই। এখন তাহলে প্রশ্ন হলো, কাদের সামনে আর কোনো রাস্তা খোলা নেই? মূলত জেলবন্দীদের। যেহেতু তারা জেলের চার দেয়ালের মাঝে বন্দি, তাই প্রতিবাদ হিসেবে তাদের পক্ষে সর্বোচ্চ এটুকুই করা সম্ভব।
অবশ্য যারা জেলবন্দী নয়, তাদের জন্যও কিন্তু অনশনে বসাই সবচেয়ে চরম সিদ্ধান্ত। এবং সাম্প্রতিক অতীতে জেলবন্দী নয় এমন মানুষদের মধ্যেও অনশনে বসার প্রবণতা আশ্চর্যজনকভাবে বেড়ে গেছে। এর একটি প্রধান কারণ এ-ই হতে পারে যে, আপাতদৃষ্টিতে যেটিকে স্বাধীন সমাজব্যবস্থা বলে মনে হয়, সেটিও হয়তো অনেকের কাছেই জেলখানার সমতুল্য হয়ে গেছে। তাই দাবি আদায়ের অন্য আর সব চেষ্টাই যখন ব্যর্থ হয়ে যায়, তখন তারা অনশনে বসাকেই শেষ উপায় হিসেবে ধরে নেয়।
এখানে একটি কথা মনে রাখতে হবে, অনশনে বসা আর আত্মহত্যা কিন্তু কখনোই এক নয়। অনশনের পরিণতি মৃত্যু ঠিকই, কিন্তু যারা অনশনে বসে তারা মৃত্যুর আকাঙ্ক্ষা থেকে অনশনে বসে না। বরং শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাদের আশা থাকে, তাদের অনশন ও মৃত্যুপথযাত্রী অবস্থা দেখে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের টনক নড়বে, ফলে তাদের দাবি-দাওয়া মেনে নেয়া হবে। পাশাপাশি তাদের মধ্যে এমন আশাও থাকে যে তাদেরকে অনশন করতে দেখে হয়তো সমাজের অন্য অনেক মানুষও অভিন্ন দাবি আদায়ের আন্দোলনে সামিল হবে, ফলে তুমুল জনমত গড়ে উঠবে, এবং এভাবেই কর্তৃপক্ষের উপর চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে দাবি আদায়ের পথ প্রশস্ত হবে।
সেই প্রাক-খ্রিস্টীয় সময়কার আয়ারল্যান্ডেও প্রচলিত ছিল অনশনে বসার রীতি। সেখানে এমন অনশন পরিচিত ছিল Troscadh কিংবা Cealachan নামে। তৎকালীন নাগরিক নীতিতেও এর উল্লেখ ছিল, এবং এই অনশন নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম মেনে পরিচালিত হতো। মূলত ন্যায়বিচারের আশায় মানুষ অনশনে বসতো, এবং তা-ও অপরাধী বা অভিযুক্ত ব্যক্তির বাড়ির দোরগোড়ায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই অনশন হতো কেবল এক রাতের ব্যাপার। অনশনকারী তার অভিযোগ রয়েছে কিংবা সে টাকা পায় এমন ব্যক্তির বাড়ির দোরগোড়ায় পুরো এক রাত না খেয়ে বসে থাকত, এবং এভাবেই সমাজে সকলের সামনে ঐ ব্যক্তিকে অপমান বা হেনস্তা করা সম্ভব হতো। এমনকি আয়ারল্যান্ডের বিখ্যাত সন্ত প্যাট্রিকও একবার অনশনে বসেছিলেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। কিন্তু তখনকার দিনে অনশনের কারণে কারো মৃত্যু হয়েছে বলে শোনা যায়নি।
দাবি আদায়ের চরম পন্থা হিসেবে যে অনশনকে এখন আমরা বুঝে থাকি, সাম্প্রতিক অতীতে তার প্রথম নিদর্শনের দেখা মিলেছিল ১৮৮০’র দশকে। সাইবেরিয়ান গুলাগে তারা যে মানবেতর দিন কাটাচ্ছিলেন, এর প্রতিবাদস্বরূপ অনশনে বসেছিলেন রাশিয়ার রাজবন্দীরা। তবে এক্ষেত্রে তারা জনসাধারণের সমর্থনের আশা করেননি, এবং সে সুযোগও তাদের সামনে ছিল না। তারা এ কাজ করেছিলেন সরাসরি জেল কর্তৃপক্ষকে লক্ষ্য করে, যাতে করে তাদের সাথে আরো সহানুভূতিশীল আচরণ করা হয়।
অনশনকে রাজনৈতিক দাবি আদায় বা উদ্দেশ্য হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের পালে জোর হাওয়া লাগে বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে, যখন (১৯০৯-১৪) সাফরাজেটরা তাদের প্রতিবাদের প্রধান উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন খাদ্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকাকে। পরবর্তীতে তাদের এই কৌশল কাজেও লেগেছিল। এছাড়াও সাম্প্রতিক অতীতের আরেকটি সমগ্র বিশ্বকে নাড়িয়ে দেয়া অনশনের সাথে জড়িয়ে আছে নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের রিপাবলিকান রাজবন্দিদের নাম। ১৯৮০-৮১ সালে মেজ কারাগারে ঐতিহাসিক অনশন করেছিলেন তারা।
বিংশ শতাব্দীর অনশনকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত নামটি অবশ্যই ভারতের মহাত্মা গান্ধীর। অহিংস আন্দোলন দর্শনের অংশ হিসেবে মোট ১৭ বার অনশনে বসেছিলেন তিনি। তিনবার তিনি টানা ২১ দিন করে অনশন করেছিলেন। ২০১১ সালে তারই অনুসারী আন্না হাজারে দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে নয়া দিল্লির যন্তর মন্তরে অনশনে বসে বিশ্বব্যাপী আলোচনার সৃষ্টি করেছিলেন।
১৯৫২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে জেলে বসে মহিউদ্দিন আহমদকে সাথে নিয়ে অনশন শুরু করেছিলেন বাংলাদেশের জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানও। তার এ অনশন ১৩ দিন কার্যকর ছিল।
এছাড়াও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দাবিতে অনশন করে পৃথিবীর ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন মেক্সিকোর সিজার শ্যাভেজ (৩৬ দিন), ফ্রান্সের সোলাঙ্গে ফারনেক্স (৪০ দিন), আয়ারল্যান্ডের ববি স্যান্ডস (৬৬ দিন), ভারতের ভগৎ সিং (১১৬ দিন) প্রমুখ। তবে অনশন ইতিহাসের সবচেয়ে বিস্ময়জাগানিয়া মানুষটি হলেন মণিপুরের লৌহমানবী খ্যাত ইরম শর্মিলা চানু। ২০০০ সাল ২ নভেম্বর থেকে মণিপুরে সৈন্য বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৫৮ বাতিলের দাবিতে ১৬ বছর অনশন করেন তিনি। অবশেষে ২০১৬ সালের ৯ আগস্ট অনশন ভাঙেন তিনি। পুরোটা সময় নাকে নল ঢুকিয়ে খাবার প্রদানের মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল তাকে।
অনশনকে বিবেচনা করা হয় প্রতিবাদ বা ন্যায়বিচার লাভের একটি কার্যকরী উপায় হিসেবে। কেননা, যদিও এর মাধ্যমে অনশনকারী কেবল নিজেরই ক্ষতি করে এবং তাতে অন্য কারো বিশেষ ক্ষতি হয় না, তারপরও সভ্য, দায়িত্বশীল সমাজে কেউ অনশন করলে সমাজের বাকিরাও সে দায় এড়িয়ে যেতে পারে না, ফলে তারা সর্বাত্মক চেষ্টা করে অনশনকারীর দাবি আদায়ে সমর্থন জানাতে, কিংবা অনশনকারীকে অনশন ভাঙতে বাধ্য করার মাধ্যমে তার প্রাণ বাঁচাতে। অনশন ভাঙানোর জন্য ফোর্স ফিডিং শেষ পথ। তবে এর জন্য বিচারক বা সরকারের অনুমোদন দরকার হয়।
আয়ারল্যান্ড রিপাবলিকান আর্মির সাবেক অনশনকারী টমি ম্যাকিয়ারনির ভাষ্যমতে,
“মৃত্যু কখনো আমাদের লক্ষ্য ছিল না। কিন্তু আমরা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত ছিলাম। যেসব মানুষ এটি (অনশন) করে, তারা কোনো একটি গভীর দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে এটি করে। এটি কখনোই কোনো ছেলেখেলা নয়।”
বাস্তবিক তা-ই। অনশন কোনো ছেলেখেলা নয়। মৃত্যুর সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখেও যারা অনশন শুরু করে, তারা যে অসীম সাহসী, সে ব্যাপারে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। তাই অনশনকে ‘পাবলিসিটি স্টান্ট’ হিসেবে আখ্যা দেয়া নিতান্তই বালখিল্যতা। বরং সাম্প্রতিক অতীতে অনশনের প্রবণতা কেন এত বেড়ে গেল, সে বিষয়ে চিন্তা করা একান্ত প্রয়োজন। এখনই ভেবে দেখা প্রয়োজন, আমাদের সমাজব্যবস্থা কি এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে যে, কিছুদিন পরপরই নতুন কোনো না কোনো ইস্যুতে প্রতিবাদকারীদের উপায়ান্তর না দেখে অনশনে বসতে হচ্ছে?
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/