চারদিকে নির্বাচনী আমেজ। স্কুল কলেজ সব বন্ধ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলছে সেমিস্টার ব্রেক। অলস সময় কাটাচ্ছি বাসায়। বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করলাম কী করা যায়। সে বলল, চল ঘুরে আসি বিরিশিরি থেকে। খুব ভোরে মোটরসাইকেলে চড়ে রওনা হবো দুজন। সারাদিন ঘুরে সন্ধ্যায় ঢাকার দিকে রওনা দিবো। রাতেই ঢাকায় পৌঁছে যাবো। পরিকল্পনাটা ভালো লাগায় রাজি হয়ে গেলাম।
ঢাকা থেকে বিরিশিরির দুরত্ব প্রায় ১৭০ কিলোমিটার। বিরিশিরি সীমান্তবর্তী একটি অঞ্চল। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়ী ঝর্ণা থেকে এখানে পানি নেমে আসে যা প্রবাহিত হয় সোমেশ্বরী নদীতে। বিরিশিরিতে মূলত ঘোরাঘুরির জন্য কয়েকটি উল্লেখযোগ্য স্থান রয়েছে। যেমন চিনামাটির পাহাড়, কমলা বাগান, নীল সবুজ জলের লেক, বিজয়পুর বিজিবি ক্যাম্পের সামনে নৌ ভ্রমণ, বিজয়পুর জিরো পয়েন্ট, সোমেশ্বরী নদী, আদিবাসী সাংস্কৃতিক একাডেমি এবং রানীখং চার্চ।
বিরিশিরিতে কয়েকভাবেই যাওয়া যায়। বাসেও যেতে পারেন আবার ট্রেনেও যেতে পারেন। ট্রেন আপনাকে নামিয়ে দেবে নেত্রকোণা। তাছাড়া ট্রেনে যেতে চাইলে রাতের ট্রেনে রওনা হওয়া উচিত। ঢাকার কমলাপুর থেকে রাত সাড়ে ১১টায় হাওড় এক্সপ্রেস ছেড়ে যায় নেত্রকোণার উদ্দেশ্যে। ট্রেন আপনাকে সকালে নেত্রকোণায় নামিয়ে দেবে। সেখান থেকে যেতে হবে বিরিশিরি।
শহর তখনো জেগে ওঠেনি পুরোপুরি। জনশূন্য রাস্তাঘাট। শীতের সকালে কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে পড়লাম পথে। বন্ধু সানি ততক্ষণে মোটরসাইকেল নিয়ে চলে এসেছে। হেলমেট আর গ্লাভস পরে আল্লাহর নামে রওনা হলাম দুই বন্ধু। সকাল হওয়ায় ঢাকার রাস্তাঘাট তখনও ব্যস্ত হয়ে ওঠেনি। ফাঁকা রাস্তায় ছুটে চলছি আমরা। পথিমধ্যে পেট্রোল পাম্প থেকে গ্যাস নিয়ে নিলাম যথেষ্ট পরিমাণে। পরিবর্তন করে নিলাম মোবিলও। রাস্তা ফাঁকা থাকলেও আমরা ধীরে সুস্থেই এগোচ্ছিলাম। কেননা সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি।
তাছাড়া আজকাল সড়ক দুর্ঘটনাও ঘটছে অনেক। গাজীপুর পেরিয়ে ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশেই এক খাবার হোটেলে সকালের নাস্তা করার জন্য থামলাম। নাস্তা করে বের হওয়া মাত্রই চোখ আটকে গেল হোটেলের অপর পাশে ঘন গজারি বনের দিকে। বনের মধ্য হতে হাইওয়ের পাশে বেরিয়ে এসেছে বানরের দল। ছোট বড় নানান সাইজের নানান রকম বানর। ওদের খুব কাছাকাছি গেলেও ওরা ছিলো বেশ নির্বিকার।
তখনও কুয়াশার কারণে রোদের দেখা পাইনি। বাইকের পেছনে বসে থাকায় বেশ ঠান্ডা অনুভূত হচ্ছিল। পথিমধ্যে আমরা দেখতে পেলাম জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট। হাইওয়ে থেকে কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় ৩ কিলোমিটার দুরত্বে অবস্থিত। গ্রামের মধ্য দিয়ে পিচঢালা পথ ধরে এগোলেই দেখতে পাওয়া যায় বিশাল বিশাল বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ। ৫৭ একর জায়গা নিয়ে ২০০৬ সালে এ বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে।
পুরো বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে আমরা আবার রওনা হলাম। পথ দেখাচ্ছে গুগল ম্যাপস। ভ্রমণের জন্য এই গুগল ম্যাপ ছাড়া এক প্রকার অচল আমরা। পথিমধ্যেই পেয়ে গেলাম বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। ১,২৬১ একরের সুবিশাল এই ক্যাম্পাস যেন সবুজের সমারোহ। সুন্দর সাজানো গোছানো চারদিক।
কয়েকটি রাস্তার দু’পাশে ঘন আমগাছ। এই ক্যাম্পাসে ‘৭১ এর শহীদদের স্মরণে নির্মিত হয়েছে শহীদ মিনার। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরেই রয়েছে একটি কৃষি জাদুঘর। এই ক্যাম্পাসটি গড়ে উঠেছে ব্রহ্মপুত্র নদীর তীর ঘেঁষে।
কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় পুরোটা ঘুরে আমরা এবার রওনা হলাম নেত্রকোণার দিকে। কেননা আমাদের মূল গন্তব্য নেত্রকোণা জেলার বিরিশিরি। সেখান থেকে সুসং দুর্গাপুর হয়ে বিজয়পুর। নেত্রকোণা যাবার রাস্তা কোথাও কোথাও মসৃণ পিচঢালা আবার কোথাও খানাখন্দে ভরপুর। নেত্রকোণায় পৌঁছানোর পর দেখলাম বিরিশিরির রাস্তায় কাজ চলছে। তাই আমরা নদীর পাশ দিয়ে ছোট গ্রাম্য রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলাম। দু’পাশে শীতকালীন সবজির ক্ষেত।
দূর থেকে দেখলে মনে হয় সবুজ চাদর বিছিয়ে রেখেছে কেউ। সম্ভবত এজন্যই দেশটাকে ‘সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা’ বলা হয়। দুপুর নাগাদ আমরা পৌঁছে গেলাম বিরিশিরি বাজারে। দুপুরের খাবারটা সেরে নিলাম সেখানেই। খাবারের মান অনুযায়ী দামটা বেশ সাধ্যের মধ্যেই মনে হলো। অতঃপর স্থানীয়দের দেখানো পথ ধরে এগিয়ে চললাম নদী পারাপারের জন্য খেয়া ঘাটের দিকে। সোমেশ্বরী নদীর পাড় ঘেঁষে মাটির রাস্তায় খুব একটা মন্দ লাগছিলো না। পথিমধ্যেই রাস্তার পাশে অযত্নে অবহেলায় পড়ে থাকতে দেখলাম ‘৭১ এর শহীদদের বধ্যভূমি।
সোমেশ্বরী নদী পারাপার হওয়ার একমাত্র মাধ্যম হলো নৌকা। এখানকার মানুষজন তাদের মোটরসাইকেল, গরু ছাগল এবং বিভিন্ন পণ্যদ্রব্য পারাপার করে থাকেন এই নৌকার মাধ্যমে। সোমেশ্বরী নদী থেকে মেশিনের সাহায্যে পাথর উত্তোলনের কারণে সারাক্ষণই মেশিনগুলোর ঠ্যাট ঠ্যাট শব্দ কানে বাজবে।
আমরা বেশ কিছুক্ষণ সময় সোমেশ্বরী নদীর বুকে জেগে ওঠা বালুচরে হাঁটাহাঁটি করলাম। আবার কখনো মেঘালয় থেকে নেমে আসা সোমেশ্বরীর বুক দিয়ে প্রবাহিত হওয়া শীতল পানিতে পা চুবিয়ে সময় কাটালাম। সোমেশ্বরী নদীর পারে দাঁড়িয়ে সামনে তাকালে মনে পড়ে যাবে সুনামগঞ্জের জাদুকাটা নদীর কথা। শীতকালে এই দুটো নদী দেখতে প্রায় একই রকম লাগে। জনপ্রতি ৫ টাকা ভাড়া দিয়ে নদী পার হলাম।
নদী পার হয়ে রাস্তায় উঠে আসলেই ঘোরাঘুরির জন্য অনেক অটো পাওয়া যায়। সব জায়গায় ঘোরার জন্য রিজার্ভ অটো ৬০০/৭০০ টাকা নিতে পারে। এছাড়া চাইলে দ্রুত সময়ে ভ্রমণের জন্য বাইকও ভাড়া নিতে পারবেন। আমাদের বাইক থাকায় অটোর প্রয়োজন হয়নি। সব জায়গা বাইকে ঘুরলেও পর্যটন স্থানগুলোতে যাওয়ার জন্য পথিমধ্যে সাহায্য নিয়েছি স্থানীয় মানুষের।
প্রথমেই আমরা বাইক নিয়ে চলে গিয়েছিলাম রানীখং চার্চ এ। এ গির্জাটি তৈরি করা হয়েছে সোমেশ্বরী নদীর কূল ঘেঁষে ঘন গাছপালা বেষ্টিত টিলার উপরে। গির্জার উপর থেকে ভারতের পাহাড়গুলোকে বেশ দেখা যায়। দেখা যায়, বহুদূর বিস্তৃত সোমেশ্বরী নদীও।
গির্জা থেকে বেরিয়ে চলে গেলাম বিজয়পুর বিজিবি ক্যাম্প। বিজিবি ক্যাম্পের সামনে বাইক পার্কিং সুবিধা রয়েছে। বিজিবি ক্যাম্পের ডান দিকে চলে গেলেই পাওয়া যায় নদী। এখান থেকে নদীতে ঘুরাঘুরির জন্য ঘন্টা হিসেবে ছোট সাইজের ইঞ্জিন চালিত নৌকা পাওয়া যায়। যা দিয়ে ঘুরে বেড়ানো যায় সোমেশ্বরী নদীর স্বচ্ছ জলে। নদীর অপরপাশে ভারত সীমান্ত পর্যন্তও যাওয়া যায়। কিন্তু হাতে সময় কম থাকায় আমরা নৌকা ভাড়া করিনি। সেখান থেকে ফিরে এসে বিজয়পুর জিরো পয়েন্ট যাওয়ার জন্য অটোতে চেপে বসলাম।
এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন, তা হলো বিজয়পুর বিজিবি ক্যাম্প থেকে বিজয়পুর জিরো পয়েন্ট ২/৩ কিলোমিটার রাস্তা হলেও সেখানে যেতে হলে অটো ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক। পায়ে হেঁটে কিংবা বাইক নিয়ে বিজিবি জিরো পয়েন্টে যেতে দেয় না। তাই অটোই একমাত্র ভরসা। জিরো পয়েন্টে যাওয়ার ক্ষেত্রে একটি মজার ব্যাপার লক্ষ করা যায়। জিরো পয়েন্টের রাস্তার দু’পাশেই ভারত এবং কিছুটা দূরে গিয়ে ৩ দিক থেকেই ভারত বেষ্টিত আমরা।
জিরো পয়েন্ট থেকে আমরা বাইক নিয়ে চলে গেলাম চিনামাটির পাহাড় দেখতে। তবে পথিমধ্যে গুগল ম্যাপস অনুসরণ করে মেঠোপথ ধরে চলে গেলাম বহুদূরে অচেনা এক গ্রামের মাঝে। মানুষজন খুব একটা নেই বললেই চলে। ছোট ছোট ঘরবাড়ির পেছনে দূরে বিশাল বিশাল সব পাহাড়েরা দাঁড়িয়ে আছে মূর্তির মতো। এক প্রাইমারি স্কুলের মাঠে পেয়ে গেলাম একজন মহিলা ঝালমুড়ি বিক্রেতাকে। ক্ষুধাও লেগেছিল বেশ। বেশ ভালো মুড়ি মাখাতে পারেন তিনি। বহুদিন বাদে এত মজাদার ঝালমুড়ি খেলাম।
চিনামাটির পাহাড় এবং নীল স্বচ্ছ জলের লেক মূলত একই জায়গায়। চিনামাটির পাহাড় থেকে মাটি কেটে নিয়ে যাওয়ায় নানান জায়গায় বিশাল বিশাল গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। আর সেখনেই পানি জমে সৃষ্টি হয়েছে স্বচ্ছ জলের লেক। মূলত সেখানে লেক দুটি। একটি বেশ বড়। আর সেটাতে অনেক পর্যটকই লম্ফঝম্ফ মেরে গোসল সেরে নেন।
বিদায় নেয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছিলো সূর্যি মামার। সেই পশ্চিমে অস্ত যাবেন তিনি খানিকক্ষণ পর। আমাদেরও ফিরতে হবে। আর সেজন্যই সারাদিনের ঘোরাঘুরি শেষে দারুণ সব স্মৃতি মস্তিষ্কে জমা করে দুই বন্ধু রওনা হলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে। রাত ১১ঃ৪৫ এ আমরা পৌঁছে গেলাম ঢাকায়।