এই জীবনে ভালোবাসার স্বাদ যারা আস্বাদন করেছেন তারা হয়তো জানেন, ভালোবাসার আসক্তি কখনো কখনো মাদকাসক্তিকেও হার মানায়। ভালোবাসার মধ্যে যে মাদকতা রয়েছে তার সামনে হিরোইন, কোকেইনের মতো শক্তিশালী ড্রাগও যেন তুচ্ছ।
ভালোবাসার ফাঁদে পড়লে নাকি মানুষ বিচিত্র সব কাজকর্ম করা শুরু করে। কবিতা-উপন্যাসে দেখা যায়- প্রেয়সীর জন্য মানুষ সারা পৃথিবী তন্ন তন্ন করে খুঁজে আনে ১০৮টি নীল পদ্ম, উৎসর্গ করে দেয় নিজের জীবন, দাঁড়িয়ে যায় পরিবারের বিরুদ্ধে। বাস্তবেও এরকম ঘটনা প্রায়শই শুনতে পাওয়া যায়। আপনারো হয়তো প্রিয় মানুষটির জন্য টুকটাক পাগলামো করার অভ্যাস আছে। বিশেষ কোনো একটি দিনে অপ্রত্যাশিত উপহার দেয়া, অসাধারণ কোনো জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যাওয়া, দীর্ঘদিন পর কিছু না বলেই হুটহাট হাজির হয়ে যাওয়ার মতো কত কিছুই না আমরা করি প্রিয়জনের মুখে হাসি ফোটাবার জন্য।
কিন্তু আজ আমরা এমন কিছু প্রেমিকের গল্প শুনতে যাচ্ছি যারা ভালোবাসার সংজ্ঞাকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন। তাদের কর্মকান্ড কোনোভাবেই স্বাভাবিকের কাতারে পড়ে না।
প্রেমিকাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়ার জন্য এক রাশান প্রেমিকের কান্ড
“সে কি আমাকে আমার মৃত্যুর পরেও ভালোবাসবে?”
প্রতিটি প্রেমিকের মনেই এই প্রশ্ন অন্তত একবার হলেও উঁকি দিয়ে গিয়েছে। কিন্তু এর উত্তর জানবার সাধ বা সাধ্য হয়েছে ক’জনের? বেঁচে থাকতে তো এর সঠিক উত্তর পাওয়া মুশকিল, আর মৃত্যুর পরও দুনিয়াতে ফিরে এসে নিজের জন্য হাহাকার রত প্রেমিকাকে দেখার সাধও পূরণ হবার নয়। তাহলে কি কোনো প্রেমিকের পক্ষে এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর পাওয়া সম্ভব নয়?
আপনার-আমার কাছে অসম্ভব মনে হলেও রাশিয়ার এক প্রেমিক ছিল এ ব্যাপারে নাছোড়বান্দা। প্রেমিকাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়ার জন্য এবং প্রেমিকা তাকে কতটুকু ভালোবাসে তা জানার জন্য রাশিয়ান নাগরিক অ্যালেক্সেই বিকোভ নিজেই নিজের মৃত্যুর মিথ্যা নাটক সাজিয়েছিল!
মৃত্যুর নাটক ঠিকঠাকভাবে ঘটানোর জন্য ৩০ বছর বয়সী অ্যালেক্সেই প্রস্তুতির কোনো কমতি রাখেনি। এই কাজের জন্য সে পেশাদার ফিল্ম ডিরেক্টর, স্টান্ট ম্যান, মেকআপ আর্টিস্ট থেকে শুরু করে স্ক্রিপ্ট রাইটার পর্যন্ত ভাড়া করেছিল!
ঘটনার দিন অ্যালেক্সেইয়ের সাথে তার প্রেমিকা ইরিনার ডেটে যাবার কথা ছিল। নির্ধারিত সময়ে ইরিনা সেই স্থানে গিয়ে দেখতে পায় অ্যালেক্সেইয়ের টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, বরং চারদিকে অসংখ্য মানুষ জড় হয়েছে, অনেকগুলো ভাঙাচোড়া গাড়ি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ শোনা যাচ্ছে। হতচকিত ইরিনা ব্যাপারটা কী দেখার জন্য আরেকটু সামনে যেতেই চিৎকার করে কান্না শুরু করে। কারন সে দেখতে পায়, ভাঙাচোড়া একটি গাড়ির সামনে রক্তাক্ত অ্যালেক্সেইয়ের নিথর দেহ পড়ে রয়েছে।
ইরিনার দুঃস্বপ্নকে আরও বাড়িয়ে দেয়ার জন্যই হয়তো আকজন প্যারামেডিক ডাক্তার তাকে অ্যালেক্সেইয়ের মৃত্যুর সংবাদটি দেয়। সবমিলিয়ে হতবিহবল ইরিনা যখন কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে, ঠিক তখনই তাকে অবাক করে দিয়ে অ্যালেক্সেই মৃত্যুশয্যা থেকে উঠে বসে। এক হাতে ফুলের তোড়া এবং অপর হাতে হলুদ রঙের একটি বেলুন নিয়ে সে হাঁটু গেড়ে ইরিনাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়!
পরবর্তীতে অ্যালেক্সেই বলেছিল, ”আমি তাকে বোঝাতে চেয়েছিলাম আমকে ছাড়া তার জীবন কতটা শূন্য এবং মূল্যহীন হতে পারে!হ্যাঁ, আমার মৃত্যুর পরও সে আমাকে ভালোবাসবে। তবে আমি তাকে কথা দিয়েছি এই ধরনের পাগলামি আর করব না।”
সার্জারি করে নিজেরদের চেহারা একই রকম করে নিলেন এক ব্রিটিশ দম্পতি
আমাদের চারপাশে প্রায়শই দেখা যায়, অনেকে তাদের পরিবার, বাড়ি-গাড়ি, বিলাসবহুল জীবন সব কিছু ত্যাগ করে ভালোবাসার মানুষটির হাত ধরে রাস্তায় নেমে আসে। অনেকে আবার প্রিয়জনকে না পেয়ে আত্মহত্যা পর্যন্ত করে বসে। আসলে এসব কর্মকান্ড প্রিয় মানুষটির প্রতি ভালোবাসার তীব্রতাকেই প্রকাশ করে।
কিন্তু ব্রিটিশ দম্পতি পি-অরিজ এবং জ্যাকুলিন ব্রেয়ারের পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা যেন একটু বেশিই তীব্র ছিল। তা না হলে কি তারা নিজেদের চেহারা একই রকম করে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন!
পি-অরিজ বলেন,
প্রথম দেখাতেই আমরা একে অপরের প্রেমে পড়ে যাই। প্রেম গভীর হওয়ার সাথে সাথে আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে, আমরা দুজন আসলে একই ব্যক্তি। একই আত্মা। শুধু আমাদের শরীর দুটিই আলাদা। একসময় ভাবলাম, যদি আমাদের শরীরও একই রকম হতো তাহলে ব্যাপারটা মন্দ হতো না।
যে-ই ভাবা সেই কাজ। নিজেদের দশম বিবাহবার্ষিকী থেকে তারা নিজেদের দেহ পরিবর্তনের কাজে নেমে পড়েন। ২০০৩ সালের ভালোবাসা দিবসে তারা প্রথমবারের মতো সার্জনের ছুরির নিচে বসেন। সে সময় দুজনই নিজেদের ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান্ট করিয়েছিলেন। একে একে তারা নিজেদের চোখ, নাক, গাল, ঠোঁট ইত্যাদি সার্জারির মাধ্যমে একই রকম করে নেন। তারা একই ধরনের পোশাক পরা শুরু করেন। কথা-বার্তা, আচার-আচরণেও বিস্তর মিল লক্ষ্য করা যায় তাদের মধ্যে।
সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। এরই মধ্যে ২০০৭ সালে পাকস্থলির ক্যান্সারে মৃত্যু হয় জ্যাকুলিন ব্রেয়ারের। একা হয়ে পড়েন পি-অরিজ। কষ্ট হয়তো হয়। কিন্ত সান্ত্বনা একটাই, জ্যাকুলিন এখনও বেঁচে আছে তার শরীরের মধ্য দিয়ে।
প্রেমিকার সুদৃষ্টি পাবার আশায় বন্ধুকে দিয়ে নিজের শরীরে গুলি করালো এক যুবক
প্রেম-ভালোবাসা হয়তো অনেকের বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ করে দেয়। অন্তত ২০ বছর বয়সী জর্ডান কার্ডেলার কর্মকান্ড দেখলে যে কারও সেটা মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক।
এই প্রেমিক পুরুষ বান্ধবীর সাথে তার ভেঙে যাওয়া সম্পর্ক জোড়া লাগানোর জন্য এক অদ্ভুত পরিকল্পনা করে। তার একজন বন্ধুকে জর্ডান নিজের হাতে গুলি করার জন্য রাজি করিয়ে ফেলে। জর্ডানের আশা ছিল যে, তার রক্তাক্ত অবস্থা দেখে বান্ধবীর মনে তার প্রতি সহানুভূতি জন্মাবে এবং সে আবার তার কাছে ফিরে আসবে!
পরিকল্পনা অনুযায়ী একটি শুভ দিন দেখে জর্ডান ও তার বন্ধু মাইকেল বেরিয়ে পড়ে। তারা দুজনে একটি ফাঁকা মাঠে পৌঁছালে জর্ডান মাইকেলকে পিস্তল দিয়ে তার হাতে পরপর তিনটি গুলি করতে বলে। বেচারা মাইকেলের আর কী করার! বন্ধুর অনুরোধ রাখতে জর্ডানের হাত লক্ষ্য করে গুলি চালায় সে। গুলির আঘাতে দূরে ছিটকে পড়ে জর্ডান। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোতে থাকে।
এতক্ষণে যেন হুশ ফেরে মাইকেলের। সে জর্ডানকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যায়। ডাক্তারের সহায়তায় ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে জর্ডান। তবে তার পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। তার বান্ধবী তো ফিরে আসেইনি, এমনকি একবারের জন্যও তাকে দেখতে হাসপাতালে যায়নি। তার উপর উটকো ঝামেলা হিসেবে জুটে যায় একদল পুলিশ। আপনি আগ্নেয়াস্ত্রের ভুলভাল ব্যবহার করবেন আর পুলিশ চুপচাপ বসে থাকবে তা কি হয়?
একজন ভাড়াটে খুনীর কান্ড
আপনার স্বামী যদি আপনাকে ধোঁকা দেয় এবং অন্য কোনো মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে আপনার সামনে হয়তো দুটি রাস্তা খোলা থাকবে। এক. ডিভোর্স দিয়ে তার থেকে মুক্তি পাওয়া, দুই. তার সাথে সম্পর্ক চালিয়ে যাওয়া এবং সব সমস্যা মিটমাট করে ফেলা। কিন্তু ব্রাজিলের সিমোয়েস নামের এক মহিলা অন্য একটি রাস্তা বের করে ফেললেন। তিনি ঠিক করলেন, যে মেয়ের জন্য তার সংসারে অশান্তি, তাকে দুনিয়া থেকেই বিদায় করে দেবেন!
স্বামীর প্রেমিকা লুপিতাকে খুন করার জন্য তিনি ৩৫০ ইউরোর বিনিময়ে কার্লোস রিকার্ডো নামের একজন ভাড়াটে খুনীকে ঠিক করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৪ জুন কার্লোস তার মিশনে বের হন। কিন্তু বিধিবামই বলতে হয়। কারন লুপিতাকে দেখামাত্র কার্লোসের মন পরিবর্তন হয়ে যায়। লুপিতা যে তার শৈশবের বান্ধবী! তাকে কীভাবে সে খুন করতে পারে? বরং লুপিতাকে দেখামাত্র তার প্রেমে পড়ে যায় কার্লোস।
কিন্তু সিমোয়েসের কাছ থেকেও তো টাকা নিয়েছে সে। তাহলে এখন কী উপায়? উপায় একটা বের হলো। কার্লোস ঠিক করলো, লুপিতার মিথ্যা মৃত্যুর নাটক সাজাবে সে। পরিকল্পনা অনুযায়ী লুপিতার হাত-মুখ বেধে তার সারা গায়ে টমেটো ক্যাচাপ মাখিয়ে দেয় কার্লোস। এরপর বগলের মধ্যে একটি বড়সড় ছুরি রেখে সেই অবস্থার একটি ছবি তুলে ফেলে সে। সেই ছবিকে লুপিতার মৃত্যুর প্রমাণস্বরুপ সিমোয়েসের কাছে নিয়ে যায় কার্লোস।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, কোনো ধরনের সন্দেহ ছাড়াই শুধুমাত্র টমেটো ক্যাচাপ মাখানো ছবি দেখে লুপিতার মৃত্যুর ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে যায় সিমোয়েস। কার্লোসকে ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় করে সে।
কিন্তু এই ঘটনার কিছুদিন পর স্থানীয় মার্কেটে কার্লোসের সাথে লুপিতাকে চুম্বনরত অবস্থায় আবিষ্কার করে সিমোয়েস। রাগে অগ্নিশর্মা সিমোয়েস সোজা চলে যায় পুলিশ স্টেশনে। কার্লোসের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ আনে সে। পুলিশ ধরে আনে কার্লোসকে। তার মুখে পুরো ঘটনা শুনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায় পুলিশ। তিনজনকেই গ্রেফতার করে তারা। কার্লোস ও লুপিতাকে মিথ্যা মৃত্যুর নাটক সাজাবার অপরাধে এবং সিমোয়েসকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে জেলে ঢোকানো হয়।
এই ঘটনা সেই সময় ব্রাজিলিয়ান সংবাদপত্রগুলোতে আলোড়নের সৃষ্টি করে এবং ক্যাচাপ মাখানো লুপিতার ছবি অনেক সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় জায়গা করে নেয়।
পরস্পরকে ভালোবেসে পঞ্চাশ বছর গুহায় বসবাস করেছিলেন এক দম্পতি
আজ থেকে প্রায় ষাট বছর আগে চীনের লিউ গোজিয়াং ছিলেন ১৯ বছরের একজন কিশোর। সেই বয়সে তিনি প্রেমে পড়েন তার থেকে দশ বছরের বড় এবং চার বাচ্চার মা ঝু ঝাওকিং নামক একজন বিধবার। ওই সময় চীনে একজন বিধবার সাথে প্রেমের শাস্তি ছিল একটি বড়সড় কুগারের (বিড়াল জাতীয় বড়সড় হিংস্র প্রাণী) সাথে লড়াই করা।
কুগারের সাথে লড়াই এবং চারপাশের মানুষজনের সমালোচনা থেকে বাঁচতে তারা পাশের একটি পাহাড়ে আশ্রয় নেন এবং সেখানেই কাটিয়ে দেন জীবনের পরবর্তী পঞ্চাশটি বছর!
লিউ এবং ঝু পাহাড়ে তাদের জীবন শুরু করেন একটি পরিত্যক্ত কুঁড়েঘরে। খাবারের জন্য তারা পাহাড়ি নদীতে মাছ ধরতেন, বন্য শাক-সবজি, ওয়ালনাট, খেজুর ইত্যাদি সংগ্রহ করতেন। নিজেদের কুঁড়েঘরের পেছনে তারা চাষ করতেন আলু এবং ভুট্টা। অবশ্য ফসলের একটি অংশ বরাদ্দ থাকতো ক্ষুধার্ত বানরদের জন্য।
লোকালয়ে যেতে যেন ঝু’র কষ্ট না হয় সেজন্য লিউ পাহাড় কেটে ৬,০০০টি সিড়ি তৈরি করেন! পাহাড়ের মধ্যেই ঝু তাদের চারটি সন্তানের জন্ম দেন কোনো ধরনের চিকিৎসা সাহায্য ছাড়াই। ঝু’র প্রথম ঘরের চার সন্তানের মধ্যে এক মেয়ে মারা যায়। ফলে লিউয়ের চারজন এবং প্রথম ঘরের তিনজনসহ মোট সাত সন্তান নিয়ে লিউ-ঝু দম্পতির ছিল সুখের সংসার।
তাদের প্রত্যেক সন্তানই পাহাড়ের নিচে স্থানীয় স্কুলে পড়ালেখা করত। পরবর্তীতে সন্তানদের প্রত্যেকেই পাহাড় ছেড়ে লোকালয়ে বসবাস করা শুরু করে। কিন্তু লিউ এবং ঝু ছিল অনড়। মাঝে মাঝে মধু এবং ফলমূল বিক্রি করতে লোকালয়ে গেলেও তারা তাদের পাহাড়ি জীবন বিসর্জনে রাজি ছিলেন না।
২০০৭ সালে ৭২ বছর বয়সে ভালোবাসার মায়া কাটিয়ে পরপাড়ে পাড়ি জমান লিউ। এর চার বছর পর ২০১২ সালের ৩০ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন ঝু। সমাপ্তি হয় তাদের মধুর ভালোবাসার। বর্মানে পাহাড়ের ওপর তাদের নির্মিত বাড়ির পেছনে প্রকৃতির সান্নিধ্যে শুয়ে আছেন এই প্রেমিক যুগল।