“স্বাধীনতা তুমি শহীদ জননী জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলি”
জেমসের এই গান শুনে রক্তে আগুন ধরে যায়নি কিংবা কাঁদেনি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া একটু কঠিন। আবেগী বাঙালির জন্য আবেগপূর্ণ এই গান। এই গানে বাংলাদেশের অসংখ্য মহাপ্রাণ মানুষের কথা বলা হয়েছে। ওপরের লাইনটিতে বলা জাহানারা ইমামকে নিয়েই আজকের এই নিবেদন। জাহানারা ইমাম, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম আর তার লেখা ‘একাত্তরের দিনগুলি’ নিয়েই আজ আলোচনা। এই দিনলিপি যে কবে তাঁর দিনলিপি থেকে আমাদের দিনলিপি হয়ে উঠেছে, তা ঠিক করে বলা যায় না।
১৯২৯ সালে জন্ম নেয়া এই নারী। উচ্চশিক্ষিত এই নারী রংপুর, কলকাতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে শিক্ষাজীবন শেষ করে শিক্ষিকা হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।
স্বামী শরীফ ইমাম ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার। স্বামী, দুই ছেলে শফী ইমাম রুমী আর সাইফ ইমাম জামী, সাথে শ্বশুর এবং আরও কিছু আত্মীয়স্বজন নিয়ে তাঁর সংসার। এলিফ্যান্ট রোডের ছোট্ট বাসা, কনিকা। সবসময় নানা মানুষের কোলাহলে পূর্ণ থাকত।
১৯৭১ সালে নিজের বড় ছেলে রুমী ইমামকে হারান। আর এর কয়েক মাসের মধ্যে বিজয়ের অল্প কিছুদিন আগে হারান স্বামী শরীফ ইমামকে। বিজয়ের পরে রুমীর সব বন্ধুসহ সকল মুক্তিযোদ্ধা তাকে তাদের জননী হিসেবে মেনে নিয়েছিল। এক শহীদের জননী, হাজার শহীদের জননী, হাজার মুক্তিযোদ্ধার জননী হয়ে ওঠা তিনি আমাদের সবার শহীদ জননী।
বিজয়ের এক দশক পরে ১৯৮২ সালে, মুখের ক্যান্সারে আক্রান্ত হন তিনি। ১৯৯২ সাল থেকে ক্যান্সারের সাথে লড়াইয়ের পাশাপাশি লড়েছিলেন দেশের রাজাকারদের বিরুদ্ধে। গঠন করেছেন ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’। ১৯৯৪ সালে পরপারে পাড়ি জমান এই মহীয়সী নারী।
তার লেখা অনেকগুলো বইয়ের মধ্যে একটি ‘একাত্তরের দিনগুলি’। বাঙালি আর বাংলাদেশী কিন্তু এই বইয়ের কথা জানে না, সেরকম কাউকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এটি কোনো উপন্যাস বা গল্প নয়, এটি ১৯৭১ সালের দিনলিপি। উত্তাল মার্চ থেকে বিজয়ের ডিসেম্বর, প্রায় ১৯৭১ সালের পুরো ৯টি মাস খুব সুন্দরভাবে লিপিবদ্ধ করে গেছেন জাহানারা ইমাম। এ ন’মাসে অনেক উত্থান-পতন, কান্না, প্রিয় মানুষ হারানো- সবকিছু সাথে নিয়েই লিখে গেছেন তিনি।
মার্চ ১, ১৯৭১ সাল থেকে শুরু তার দিনলিপি। সেই সময়ের উত্তাল ঢাকা, উত্তাল বাংলাদেশের চিত্র আমরা দেখতে পারি। রুমী ক্রিকেট খেলা শেষ করে বন্ধুদের নিয়ে বাড়িয়ে হ্যামবার্গার খেতে আসবেন। বাজার থেকে ফিরেই জানতে পারেন, ‘জাতীয় পরিষদের অধিবেশন’ স্থগিত করা হয়েছে। চারদিকে শোরগোল।
মার্চ এর ২ তারিখ, বাংলার আকাশে ওড়ে স্বাধীন বাংলার প্রথম পতাকা। লাল-সবুজের পতাকা, মাঝখানে তৎকালীন পূর্ব বাংলার মানচিত্র আঁকা হলুদ রঙে।
রুমী ছিলেন বেশ অদ্ভুত ধরনের। তার সাথে কথায় কেউ পারত না। কখনও বাংলা, কখনও ইংরেজি কবিতা কিংবা উপন্যাসের যুক্তি দিয়ে মা-বাবাকে কথায় হারিয়ে দিতেন, কখনো বা হৃদয়-গলানো হাসি। বেঁচে থাকলে উদ্দাম এই তরুণ হয়তো বিশ্বজয় করতে পারতেন। অত্যন্ত মেধাবী ছেলে ছিলেন রুমি। মাত্র আইএসসি পাশ করে ১৯৭১ সালে তখনকার দিনের ‘ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ’ (বুয়েট) এ ভর্তি হলেন, শুধু ক্লাস শুরুর অপেক্ষা। আমেরিকার শিকাগো শহরের নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতছানি তাকে ভোলাতে পারেনি, তাকে টেনেছিল দেশমাতৃকার ডাক।
মা অন্তঃপ্রাণ ছেলে রুমী। একদিন তার যুদ্ধে যাবার সুযোগ এসে গেল। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে রুমী হয়তো পারতেন বিদেশে গিয়ে নিজের জন্য কিছু করতে। আর দশজন বাঙালি যুবকের মতো সদ্য তারুণ্যে পা রাখা রুমী ইমামের মনে নাড়া দিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ডাকে যুদ্ধে যাবার আহ্বান । বঙ্গবন্ধুর সেই ৭ মার্চের ভাষণ,
“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”
যারা দেশকে ভালোবাসে, এ ডাক উপেক্ষা করার ক্ষমতা ছিল না তাদের। রুমীও পারেননি সেই ডাককে অবহেলা করতে।
একদিকে যেমন মেধাবী, আত্মপ্রত্যয়ী আর অন্যদিকে রাজনীতি সচেতন, দেশপ্রেমিক ছেলে রুমী। মাকে বলেছিলেন, এই উত্তাল সময় এখন সব দলের উর্দ্ধে, তাকে যুদ্ধে যেতে হবে। রুমী পালিয়ে যেতে পারতেন, সুযোগ ছিল তার হাতে, কিন্তু মাকে না জানিয়ে কোনো কাজ তিনি করতেন না। তাই এলেন মায়ের কাছে অনুমতি নিতে। মায়ের মন বলে কথা, সে কি আর সহজে মানে নিজের নাড়ি ছেঁড়া ধনকে বিসর্জন দিতে? কিন্তু যুগে যুগে মায়েরা বুকে পাথর বেঁধে সন্তানকে বিভিন্ন বৃহত্তর স্বার্থে বিসর্জন করে এসেছেন।
১৯ এপ্রিল, ১৯৭১। সেই ভয়াল দিন। নাছোড়বান্দা মা জাহানারা ইমাম বলেছিল “দিলাম তোকে দেশের জন্য কোরবানী করে”।
দাদার কাছ থেকে ‘ইসকারশন’-এ যাবার কথা বলে রুমী বিদায় নিয়েছিলেন, কিন্তু বলে না যে, অন্ধ মানুষ, সাধারণ মানুষের চাইতেও প্রখর বুদ্ধির অধিকারী? বোধহয় তিনিও কিছুটা আঁচ করেছিলেন।
রুমী যুদ্ধে গিয়েছিলেন, নানা চড়াই-উৎরাই পার করে মেলাঘরে গিয়ে ট্রেনিং নিলেন; সাথে ছিলেন আজাদ, বাচ্চু, ইসরাক, বদি, জুয়েলসহ কত মানুষ। রুমী খালেদ মোশাররফের সেক্টর-২ এ ট্রেনিং শেষ করে যোগ দেন ক্র্যাক প্লাটুনে। ধানমন্ডিতে গেরিলা আক্রমণের পরে রুমী সবার কাছে প্রিয় হয়ে ওঠেন। বাবা-মাকে চমকে দিয়ে আগস্ট মাসের শেষদিকে তিনি নিজ বাড়িতে আসেন। ২৯ আগস্ট, আজাদ, জুয়েল, বদীসহ বেশ কয়েকজন গেরিলা যোদ্ধার পাক হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন রুমী। এরপরে তার কোনো খোঁজ কেউ পায়নি। তিনি কতদিন বেঁচে ছিলেন, তার লাশই বা কোথায়, কেউ জানে না আজও।
এদিকে রুমীর সাথে বাবা শরীফ ইমাম, ভাই জামি ইমামও পাক হানাদার বাহিনীর হাতে বন্দী হন।
জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রুমীকে ভাই ও বাবাসহ এক জায়গাতে নিয়ে আসে হানাদার বাহিনী। বিচক্ষণ রুমী সবাইকে শিখিয়ে দেন, তাদের যুদ্ধে জড়িত না থাকার কথা বলবার জন্য। গেরিলা আক্রমণের সব দায়ভার তিনি নিজের কাঁধে তুলে নেন। এরপরে আসে ভয়াল ৩০ আগস্ট। সেদিনের পর রুমীকে আর কোনোদিন দেখা যায়নি। অন্যদিকে পাক বাহিনীর অকথ্য অত্যাচারের পরও প্রচণ্ড শক্ত ছিলেন শরীফ ইমাম।
শারীরিক আর মানসিক এই অত্যাচারে ভেতরে ভেতরে বেশ ভেঙে পড়েন তিনি, কিন্তু নিজের স্ত্রী-বাবা-ছোট ছেলেকে কিছুই বুঝতে দেননি। আর তাই সেপ্টেম্বরের প্রথমদিকে যখন ইয়াহিয়া খান সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন, তখন শরীফ ইমাম ছেলের জন্য পাপীদের কাছে হাত পাততে চাননি। চাননি ছেলের প্রাণভিক্ষা। যুদ্ধের শেষদিকে এসে মারা যান শরীফ। বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসেও দেখে যেতে পারলেন না। বাবা আর ভাইকে হারিয়ে ভেঙে পড়েছিল ছোট্ট জামী।
এত তাণ্ডব, এত মনঃকষ্ট, সবকিছুকে সামলে নিয়ে এক হাতে নিজের শ্বশুর, মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য, নিজের মায়ের সেবা, নিজের সংসার সামলানো- সবটাই করে গেছেন জাহানারা ইমাম। কোথায় কোন খাবার লাগবে, কী ওষুধ লাগবে, কতটা ব্যান্ডেজ লাগবে, কীভাবে গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের টাকা পাঠানো যায়, কোন রাস্তার মাথায় গেরিলা বাহিনীকে পৌঁছে দিতে হবে- সবটাই ছিল তার মাথায়।
সাথে নিজের মাকে বাজার করে দিয়ে আসা, রান্না খাবার পৌঁছানো, অসুস্থ শ্বশুরের আলাদা যত্ন নেওয়া- কোনো কিছুতেই নিজেকে উজার করে দিতে ভোলেননি। নিজের ঘরে জমিয়ে রেখেছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রসদ। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর থেকে একাধিকবার নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন। নিজের অনেক আত্মীয়স্বজনকেও আশ্রয় দিতে একটুও ভয় পাননি তিনি।
১৬ ডিসেম্বর যখন সমগ্র দেশ বিজয়ের আনন্দে মেতেছে, ঠিক সেই সময়ে, স্বামীর কুলখানির জন্য রসদ ঘর খুলে দিয়েছিলেন। সেখান থেকেই সেদিনের রাত, পরদিন সকালের খাবার রসদ নিলেন। এই রসদ তিনি রেখেছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যের জন্য।
যে পতাকা ২৫ মার্চ তুলেছিলেন, কিন্তু হানাদার বাহিনীর ভয়ে নামিয়ে ফেলেছিলেন- সেই পতাকা ৯ মাস বাদে ১৭ ডিসেম্বর আকাশে উড়িয়েছিলেন। একদিকে বিজয়ের আনন্দ, অন্যদিকে শুনছিলেন আল-বদর বাহিনীর হাতে হত দেশের সেরা বুদ্ধিজীবীদের কথা। একদিকে ভাবছেন রুমীর কথা, অন্যদিকে স্বামী। আবার শোকে কাতর জামীর জন্য তিনি অস্থির। বাবার মৃত্যুর পর থেকে স্তব্ধ সে। পাঁচদিন তার মুখে কথা নেই, মাঝে মধ্যে উন্মাদের মতো করছে।
সমগ্র বাংলাদেশ একইসাথে বিজয়ের আনন্দে ভাসছে, অন্যদিকে বুকে স্বজন হারানোর তীব্র যন্ত্রণা। এ এক অদ্ভুত অনুভূতি। হাসি-কান্নার মিলনে বুকের মধ্যে যে একটা চাপা ব্যথা হয়, যা না যায় সহ্য করা- না যায় বোঝানো। ১৯৭১ সাল থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত সমস্ত কষ্ট একাই বহন করেছেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। মুক্তিযুদ্ধে তার অবদানের জন্য তাকে শহীদ জননী বলা হয়, শুধু কি তা-ই? নিজের আত্মার ধনকে যে মা বিসর্জন দিতে পারে, যে মা নিজের জীবনের ঝুঁকি নিতে পারে, যে মা হাজার শহীদ মায়ের প্রতিচ্ছবি- তাকে তো শহীদ জননী বলতেই হয়।
জাহানারা ইমামের মতো আর এক মা ছিলেন, শহীদ আজাদের মা সাফিয়া বেগম। শহীদ আজাদও একই সময়ে হারিয়ে গিয়েছিলেন প্রায়। শহীদ আজাদের মায়ের সাথে বেশ সখ্য ছিল জাহানারা ইমামের। সাফিয়া বেগমকে নিয়ে লেখা আনিসুল হক এর ‘মা’ বইটিতে জানতে পারা যায়, যেদিন আজাদের মায়ের দাফন হয়, অসুস্থতা নিয়েও তিনি গিয়েছিলেন সেই দাফনের কাজে, গাড়িতে বসেছিলেন। সেদিন অঝোরে বৃষ্টি নেমেছিল, বোধহয় শহীদেরা এসেছিল তাদের এক মাকে শেষ বিদায় দিতে। অন্যরকম এক গন্ধে ভরেছিল সেদিন চারপাশ। সেদিনের সেই বৃষ্টিতে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম হয়তো শেষবারের মতোই ছেলের স্পর্শ খুঁজেছিলেন।
নানা উত্থান-পতন এসেছিল তার জীবনে, নিজের জীবনের সেই ভয়ঙ্কর কালো দিনগুলো তবুও লিপিবদ্ধ করে গেছেন আমাদের জন্য। তার বই যতবার পড়ি, ততবার মনে হয়- নতুন করে দেখছি সবকিছু। পাক বাহিনীর অত্যাচারের কথা পড়ে আর একবার ঘৃণায় মনে পড়ে পাকিস্তানিদের।
আর মাত্র এক বছর পর ৫০ বছর হবে আমাদের দেশের, রুমী-আজাদের মতো শহীদেরা যেন সেদিন স্বর্গ থেকে দেখে আমাদের সোনার বাংলাদেশ। ভালো থাকুক রুমী-আজাদেরা, আর তাদের মহিয়সী মায়েরা। ভালো থাকুক বাংলাদেশ।
বইটি অনলাইনে কিনতে চাইলে ক্লিক করতে পারেন নিচের লিংকে-