ব্যাচেলরদের খাবার হিসেবে জনপ্রিয় ডিমের কদর না করলেই নয়। যেকোনো সময় ঝটপট তৈরি করা যায় ডিমের পদগুলো। আর খেতেও খারাপ নয়। সাথে শরীরকে কম খরচে যথাযথ প্রোটিনটাও দেওয়া সম্ভব হয় ডিমের মাধ্যমে। কিন্তু, আমরা যতটা ভাবছি, ডিম কি আমাদের শরীরের জন্য ততটাই ভালো? ব্যাপারটা একটু চিন্তার। অনেকেই ডিমকে হৃদপিণ্ডের নানারকম সমস্যার কারণ বলে মনে করেন। কিন্তু ডিম কি আসলেই ক্ষতিকর? আমাদের কি ডিম খাওয়া একেবারেই উচিত না? ডিম নিয়ে এমন সব বিবাদ মিটিয়ে নিতে এই লেখাটি পড়ে নিন।
ইউনিভার্সিটি অব কানেক্টিকাটের নিউট্রিশনাল সায়েন্সের সহযোগী অধ্যাপক ক্রিস্টোফার ব্লেজোর মতে, ডিমের মধ্যে একটি মানবদেহকে পরিপুষ্ট করে তোলার সমস্ত সামর্থ রয়েছে। তাই পুষ্টির দিক দিয়ে একে অনেক বেশি স্বয়ংসম্পূর্ণ বলাই যায়। শুধু তা-ই নয়। অন্যান্য খাবারের সাথে ডিম গ্রহণ করলে তাতে করে আমাদের শরীর স্বাভাবিকের চেয়ে ভিটামিন গ্রহণ করতেও পারে বেশি পরিমাণে। এই যেমন- এক বাটি সালাদে আপনি একটি ডিম রাখলে তাতে করে সালাদের অন্যান্য উপাদানের ভিটামিন আপনি বেশি পাবেন। তবে ডিমের ইতিবাচক দিকই সবসময় সবার সামনে আসেনি।
নেতিবাচক দিক, এই যেমন- অনেক বেশি কোলেস্টেরল থাকার কারণে ডিম অনেক সমালোচিতও। একটি ডিমের সাদা অংশেই প্রায় ১৮৫ মিলিগ্রাম কোলেস্টেরল থাকে। আমাদের শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য সর্বোচ্চ ৩০০ মিলিগ্রাম কোলেস্টেরল প্রতিদিন গ্রহণ করা উচিত। একটি ডিমেই এর অর্ধেক পরিমাণ থাকে। তাহলে ডিম আমাদের শরীরের ক্ষতি করছে, নাকি সুফল বয়ে নিয়ে আসছে? প্রশ্নটা থেকেই যায়।
কোলেস্টেরল কী?
কোলেস্টেরল শব্দটা শুনলেই আমরা সবাই নেতিবাচক কিছু ভেবে নিই। আসলে কিন্তু কোলেস্টেরল জন্মগতভাবেই আমাদের শরীরে থাকে। এটি মূলত আমাদের যকৃত এবং অন্ত্রনালীতে উৎপন্ন হয়ে থাকে। শরীরের প্রতিটি কোষেই কিছু পরিমাণে এই হলুদ রঙয়ের কোলেস্টেরল পাওয়া যায়। সাধারণত ‘নেতিবাচক’ বলে মনে করা এই উপাদানটি আমাদের সেল মেমব্রেনে ব্লক তৈরি করে। এছাড়া শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন ডি, অস্ট্রোজেন ও টেস্টস্টেরন হরমোনের উৎপাদনে ভূমিকা তো রয়েছেই। সাধারণত, আমাদের শরীরে দরকারি কোলেস্টেরল উৎপন্ন হলেও প্রাণীজ খাবার থেকেও কোলেস্টেরল গ্রহণ করে শরীর।
কোলেস্টেরল আমাদের শরীরে লিপোপ্রোটিন মলিকিউলের মাধ্যমে স্থানান্তরিত হয়। প্রতিটি ব্যক্তির শরীরে এই লিপোপ্রোটিনের গঠন ভিন্ন ভিন্ন হয়। আর সেই অনুসারে কোলেস্টেরল গ্রহণ করার ক্ষমতা, এর কারণে তৈরি হওয়া হৃদপিণ্ডের সমস্যাগুলোও ভিন্ন হয়ে থাকে। লো-ডেনসিটি লিপোপ্রোটিন কোলেস্টেরল আমাদের শরীরের জন্য ক্ষতিকর। এটি যকৃত থেকে কোলেস্টেরল সরাসরি রক্তনালী ও শিরায় বহন করে। যেটি কি না পরবর্তীতে রক্তনালীতে বাঁধা সৃষ্টি করে এবং হৃদপিণ্ডের নানাবিধ অসুখের জন্ম দেয়। তবে গবেষকেরা এখনো পর্যন্ত সরাসরি কোলেস্টেরলকে কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজের জন্য একমাত্র দায়ী বলে মানতে রাজি নন। এর পেছনে স্যাচুরেটেড ফ্যাটের ভূমিকাও রয়েছে বলে মনে করেন তারা। বাস্তবিকভাবেই, আমরা কতটা ফ্যাট গ্রহণ করছি তার উপরে আমাদের সুস্থতা অনেক বেশি নির্ভর করে। সরাসরি কোলেস্টেরল গ্রহণ না করলেও ট্রান্স ফ্যাট গ্রহণের মাধ্যমে আমাদের শরীরে এলডিএলের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ট্রান্স ফ্যাট প্রাণীদেহে স্বাভাবিকভাবে উৎপন্ন হলেও, অনেকসময় এটি কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়। বিশেষ করে, বিভিন্ন ধরনের নাশতা, ভাজাপোড়া খাবারে এই ট্রান্স ফ্যাটের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে। আপনার খুব পছন্দের পেস্ট্রি, কেক এবং ডোনাট- সেগুলোতেই এই ফ্যাট অনেক বেশি পরিমাণে পাবেন আপনি।
এক্ষেত্রে ডিমের ব্যাপারটা একেবারেই উল্টো। চিংড়ির পাশাপাশি ডিমই একমাত্র খাবার যেটিতে স্যাচুরেটেড ফ্যাটের পরিমাণ একেবারেই কম। আর এই স্যাচুরেটেড ফ্যাট যেহেতু রক্তে বাঁধা সৃষ্টি করে, তাই এক্ষেত্রে অসুস্থতার চিন্তাটাও অনেক কম থাকে। মোটকথা, গবেষকদের মতে, ডিমে কোলেস্টেরলের পরিমাণ অনেক বেশি থাকলেও রক্তনালীতে বাঁধা এবং হৃদপিণ্ডের সমস্যা তৈরি করতে পারে যে স্যাচুরেটেড ফ্যাট সেটি কম থাকায় এটি শরীরে নেতিবাচক কোনো প্রভাব রাখে না।
এছাড়া কোলেস্টেরল এবং ডিমের এই বিষয়ে আলোচনা অনেকটা কমে আসার পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে কাজ করেছে আমাদের শারীরিক প্রক্রিয়া। খাবারের মাধ্যমে আমরা যে কোলেস্টেরল পাই সেটিকে পুরোপুরি ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করার ক্ষমতা প্রাকৃতিকভাবেই আমাদের শরীরে আছে। তাই এটি আমাদের জন্য খুব একটা ক্ষতিকারক হবে, এমন সম্ভাবনা একেবারেই কম বলা যায়। ২০১৫ সালে মোট ৪০টি স্টাডি পরীক্ষা করেন জনসন ও তার গবেষক দল। সেখানে কোলেস্টেরল ও হৃদপিণ্ডের অসুখের মধ্যে সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পাননি তারা। শরীরে অরিতিক্ত কোলেস্টেরল দিলে শরীর সেটাকে গ্রহণ করে নিজে কম কোলেস্টেরল উৎপন্ন করে বলে জানান তারা। শিরায় কোলেস্টেরল অক্সিডাইজড হলে সেক্ষেত্রে এটি আমাদের শরীরের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। ডিমের ক্ষেত্রে যে কোলেস্টেরল উৎপন্ন হয় সেটি অক্সিডাইজডও হয় না। কিছু ক্ষেত্রে এই কোলেস্টেরল আমাদের শরীরের জন্য ইতিবাচকভাবেও কাজ করে।
এই যেমন, হাই ডেনসিটি লিপোপ্রোটিন কোলেস্টেরল যকৃতে প্রবেশ করে ভেঙে যায় এবং শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। এভাবে এটি হৃদপিণ্ডের ও রক্তনালীর নানারকম সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে। যে কোলেস্টেরল রক্তপ্রবাহের মধ্যে বাঁধা সৃষ্টি করে সেটিই মূলত ক্ষতিকর। এলডিএল এবং এইচডিএলের ভারসাম্য বজায় থাকছে কি না সেটার উপরেই মূলত এই পুরো ব্যাপারটি নির্ভর করে। যেখানে আমাদের বেশিরভাগই বাইরে থেকে গ্রহণ করা কোলেস্টেরলকে স্বাভাবিকভাবে হজম করতে পারে, কিছু মানবদেহ তা পারে না। গ্রহণ করা কোলেস্টেরলের ১০-১৫% রক্তে জমা হতে শুরু করে।
তবে একদিকে যেমন ডিমকে ক্ষতির কারণ নয় বলে জানিয়েছেন অনেকে, তেমনই অন্যদিকে ডিম আমাদের শরীরের জন্য কতটা ক্ষতিকর তা নিয়েও গবেষণা চলেছে। সম্প্রতি, ৩০ হাজার প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে টানা ১৭ বছর ধরে পর্যবেক্ষন করে জানানো হয়েছে যে, যেসব ব্যক্তি প্রতিদিন অর্ধেক ডিম খেয়েছেন তাদের হৃদপিণ্ডের সমস্যা ও মৃত্যুহার বেশি দেখা গিয়েছে। প্রতি ৩০০ মিলিগ্রাম কোলেস্টেরলের জন্য একজন মানুষের কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজের পরিমাণ ১৭% করে বেড়ে গিয়েছে এই গবেষণায়। যার মধ্যে প্রতিদিন অর্ধেক ডিম খাওয়া একজন মানুষের হৃদপিণ্ডের অসুখকে ৬% এবং মৃত্যুহারকে ৬% বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে এই গবেষণায় প্রশ্ন হিসেবে একজন মানুষকে সে দিনে কী খেয়েছে এটাই শুধু করা হয়েছে। যেটি গবেষণাটিকে অসম্পূর্ণ করেছে বলে মনে করেন বাকিরা।। কারণ, একজন মানুষের জন্য খাবার ছাড়া অন্যান্য কারণেও হৃদপিণ্ডের অসুখ ও মৃত্যুহার বাড়ার মতো ব্যাপার ঘটতে পারে। আর সেই ব্যাপারটি এই গবেষণায় মোটেই দেখা হয়নি।
একইসাথে গবেষণাটি ২০১৮ সালে চীনে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের উপরে করা একটি গবেষণাকেও ভুল বলে দাবী করে। যেখানে এটা বলা হয়েছিল যে, ডিম একজন মানুষের হৃদপিণ্ডের অসুখের কারণে হওয়া মৃত্যুকে ১৮% কমিয়ে দেয়। এছাড়া স্ট্রোকের মাধ্যমে মৃত্যুর ঝুঁকিও এক্ষেত্রে ২৮% কমে আসে।
ডিম খাওয়া কি তাহলে স্বাস্থ্যের জন্য ভালো, না খারাপ?
যে প্রশ্ন দিয়ে শুরু হয়েছিল এই লেখাটি সরাসরি সেটার উত্তরেই চলে যাওয়া যাক তাহলে। ডিম খাওয়া আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো না খারাপ এ নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে, গবেষণা আছে। যুক্তির সাথে সাথে আছে সেটা খণ্ডনের পাল্টা যুক্তিও। ডিম হয়তো কোলেস্টেরলের মাধ্যমে আমাদের শরীরে কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলে না। তবে ডিমে কোলাইন নামক একটি উপাদান রয়েছে যেটি মানুষের যকৃতে প্রবেশ করে টিএমএও নামক অণু তৈরি করে এবং হৃদপিণ্ডকে অসুস্থ করে ফেলে। পরীক্ষায় দেখা যায়, ডিম খাওয়ার ১২ ঘণ্টা পর একজন মানুষের শরীরে এই অণুর পরিমাণ বেড়ে যায়। তবে এই একই উপাদান আলঝেইমার্সকে প্রতিহতও করে। এছাড়া এর পাল্টা উত্তরও খুব একটা কম নেই। ডিমে থাকা লুটেইন আমাদের চোখকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
মোটকথা, ডিম আমাদের জন্য কতটা ক্ষতিকর বা উপকারী, তা নিয়ে এখনো অনেক পরীক্ষার প্রয়োজন আছে। বিজ্ঞানীরা এ ব্যাপারে তাদের গবেষণা চালিয়েও যাচ্ছেন। ফলাফল জানার আগপর্যন্ত সকালের নাশতায় ডিম পোজ বা ভাতের সাথে ডিমের তরকারি নাহয় চলুক বরাবরের মতোই!