মেহেরুন্নেসা মীরার জন্ম দেশের ইতিহাসের এক ক্রান্তিলগ্নে, ১৯৫২ এর ১০ই মার্চ; যখন সারাদেশ বিক্ষোভে উন্মাতাল ভাষার জন্য লড়াইয়ে নামা তরুণ ছাত্রদের মৃত্যুতে। সেজন্যই হয়তো মনে-প্রাণে ‘স্বাধীনতা ছাড়া কোনো উপায় নাই’ — এই আপ্তবাক্য ধারণে তার দরকার হয়নি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার। যে বিদ্রোহী পরিবেশে তার জন্ম, সেই জন্মই তাকে শিখিয়েছে লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা।
বাবা সামান্য কৃষক হওয়ায় মীরাদের সংসার ছিল চাকা ক্ষয়ে যাওয়া গরুর গাড়ির মতোই নড়বড়ে। তাই জীবিকা নির্বাহে ছেলেবেলাতেই নেমে পড়েন জীবনযুদ্ধে। তার ছিল অভিনয়ের আশ্চর্য প্রতিভা। ফলে বাগেরহাটের স্থানীয় যাত্রাদল তাকে দলে ভেড়াতে দুবার ভাবেনি। ছোটখাট ভূমিকা দিয়ে যাত্রায় তার যাত্রা শুরু হয়। অসাধারণ প্রতিভার বিচ্ছুরণে ক’দিনের ভেতরেই পেয়ে যান প্রধান চরিত্রে রূপদানের সুযোগ।
সময়টা তার ভালোই যাচ্ছিল। কিন্তু তা খুব বেশিদিন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে মফস্বলের সংস্কৃতিকেও গ্রাস করে বিদ্রোহের ছোঁয়া। সবাই-ই তখন একে একে শুরু করে সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ড। কেউ গানে, কেউ কবিতায়। তাই যাত্রাদলে অভিনয়ের পাট তার তখনই চুকে যায়। কিন্তু সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল ত্যাগ করেননি কখনোই। লেখাপড়া জানা বড় বড় বাবুরা যখন দেশের পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতেন, কান খাড়া হয়ে যেত মীরার।
লেখাপড়া না জানায় এই আলোচনায় তিনি নিজে খুব একটা পাত্তা পেতেন না। কিন্তু মানসিকভাবে মীরা ছিলেন অনেক সচ্ছল। অনেকেই যা বোঝেনি, তিনি তা ঠিকই বুঝেছেন। নিজেদের অবস্থার পরিবর্তনে চাই স্বাধীনতা আর সার্বভৌমত্ব, সেটা মীরা গভীরভাবে উপলব্ধি করেন।
এভাবেই কেটে যায় দেড় বছর। চলে আসে অগ্নিঝরা একাত্তর। মীরার মা তখন কাজ করতেন ওয়াপদা কলোনির এক কর্মকর্তার বাড়িতে। মায়ের চাকরির সুবাদে বাগেরহাটে অবস্থানরত পাক বাহিনী আর রাজাকারদের গতিবিধি ভালোই জেনে যান মীরা। বুঝতে পারেন, দেশের জন্য তারও আছে অনেক কিছু করার। তাই একাই গিয়ে উপস্থিত হন মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে।
মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের কাছে গিয়ে মীরা বলেন, “আমার মা কাজ করে ওয়াপদার এক স্যারের বাড়ি। আমি আপনাদের কাছে মিলিটারির খবর এনে দিতে পারি, যদি আপনারা আমায় দলে নেন।” মুক্তিবাহিনীর কেউই তার কথা বিশ্বাস করেননি। ভেবেছেন মীরা হলো রাজাকারদের পাঠানো গুপ্তচর।
তবে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার রফিকুল ইসলাম খান তখন ছিলেন নিরুপায়। কিছুতেই ভেবে পাচ্ছিলেন না, কিভাবে বাগেরহাট থেকে হানাদারদের হটানো যায়। তাই মীরাকে নিয়েই ঝুঁকিপূর্ণ বাজিটা খেললেন তিনি। বললেন, “আচ্ছা মীরা, আমি তোমায় বিশ্বাস করছি। আজ থেকে তুমি আমাদের দলের একজন।” এভাবেই বাগেরহাট মুক্তিবাহিনীর প্রথম মহিলা সদস্য হয়ে উঠলেন মীরা।
ওয়াপদা কলোনির কর্মকর্তা সে সময়ই হলেন বদলি। ভেস্তে যেতে বসল মীরার মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করার বাসনা। কিন্তু সৌভাগ্যবশত, মীরার মা কাজ পেয়ে গেলেন একেবারে হানাদারদের ক্যাম্পেই! মিলিটারির ক্যাম্প বসেছিল এসডিও’র বাসভবনে। মীরার মা ঢুকে পড়লেন একেবারে বাঘের গুহায়। ওদিকে মীরাও তখন কমান্ডার রফিকুল ইসলামের তত্ত্বাবধায়নে শুরু করেছিলেন সশস্ত্র ট্রেনিং। দু’সপ্তাহেই শিখে গেলেন রাইফেল চালানো। তারপর যোগ দিলেন গেরিলা বাহিনীতে।
কিন্তু তখন বাধল আরেক বিপত্তি। নিজেদের পরিকল্পনা যেন কোনোমতেই বাইরে পাচার না হয়, তাই হানাদাররা তাদের ক্যাম্পে কাজ করা সকলেরই বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ করল। তীরে এসে তরী ডুবতে বসল মীরার পরিকল্পনার। কিন্তু ততদিনে মীরা এক অদম্য যোদ্ধা। সাথে ছিল তার অভিনয়ের অসামান্য প্রতিভা। তাই মুক্তিবাহিনীর সকলের বাধা অগ্রাহ্য করে, ভিক্ষুক বেশে তিনি হাজির হন মিলিটারিদের ক্যাম্পে।
উর্দু জানা থাকায় সহজেই মীরা বের করে ফেলেন মিলিটারি ক্যাম্পের হাঁড়ির খবর। নিজের মায়ের সাথেও দেখা হয়। তার কাছ থেকে জানতে পারেন, রজব আলী খুব শীঘ্রই তার বাড়ি যাবে কিছু কাজে। বলে রাখা ভাল, রজব আলী ছিল বাগেরহাটের সবচেয়ে বড় রাজাকার। যুদ্ধে চলাকালীন সে মিলিটারির ক্যাম্পে থাকত। যার হাতে খুন হয়েছে বাগেরহাটের শতাধিক মানুষ।
প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে মীরা ফিরে আসেন মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে। সবাইকে জানান রজব আলীর বাড়ি যাওয়ার কথা। মুক্তিবাহিনীদের জন্য এ ছিল এক বিরাট সুযোগ। মীরার তথ্য অনুযায়ী তারা লুকিয়ে থাকেন রজব আলীর বাড়ির পাশে। রজব আলী বাড়ি আসতেই তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিবাহিনী। কথিত আছে, কাপুরুষ রজব আলী নাকি অবস্থা বেগতিক দেখে নিজের হাতের হীরার আংটি থেকে হীরা মুখে দিয়ে আত্মহত্যা করে। আবার এমনটাও অনেকে বলে যে আত্মহত্যা নয়, মুক্তিবাহিনীর সদস্যরাই হত্যা করেন রজব আলীকে। তবে মৃত্যুর ধরন নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে মীরার প্রত্যক্ষ কৃতিত্বে নিধন করা সম্ভব হয় বাগেরহাটের এক কুখ্যাত রাজাকারকে। এরপর মুক্তিবাহিনী রজব আলীর লাশ বাগেরহাট শহরবাসীকে দেখানোর জন্য শহরের প্রাণকেন্দ্রে ঝুলিয়ে রাখে।
পরবর্তীতে জানাজানি হয়ে যায় রজব আলীর মৃত্যুর পেছনে মীরার ভূমিকা। মীরার বাবার ওপর রাজাকাররা এসে চালায় অকথ্য নির্যাতন। তারপর থেকে যুদ্ধে মীরার কর্মপদ্ধতি বদলে যায়। তিনি বাগেরহাটের সাধনার মোড়ে বসতে থাকেন ভিক্ষুক সেজে। এ সময় তার কাজ ছিল শহরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সমন্বয় ও সংযোগ স্থাপন। ভিক্ষুকবেশে বসে থাকা অবস্থায় অনেক মুক্তিযোদ্ধা তার কাছে এসে বিভিন্ন খবর দিত, সেই খবর আবার মীরা অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিতেন।
এভাবেই গোটা একাত্তর জুড়ে দেশের স্বাধীনতা অর্জনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখে গেছেন মীরা।
জানতে ইচ্ছা হওয়া স্বাভাবিক, যুদ্ধ শেষে মীরার কী হয়। অন্য সব মেয়ের মতোই মীরাও চেয়েছিলেন সংসারী হতে। বিয়ে করেন এক দিনমজুরকে। এই দম্পতির কোলে আসে দুই সন্তান। কিন্তু ক’বছর পরই মীরার স্বামীর সম্পর্ক হয় নতুন এক মেয়ের সাথে। তাই সে ছেড়ে যায় মীরাকে। যাওয়ার আগে সে মীরার নামে দিয়ে গিয়েছিল ‘খারাপ মেয়ে’র অপবাদ। মুক্তিযুদ্ধের সময় যে নারী ছেলেদের সাথে ক্যাম্পে থেকেছে, সে নাকি ‘খারাপ মেয়ে’ই হবে!
যা-ই হোক, স্বামী ছেড়ে যাওয়ার পর মীরার ঘাড়ে বর্তায় দুই সন্তানের দায়িত্ব। হানাদারদের সাথে লড়াইয়ে জিতলেও দারিদ্র্যের সাথে লড়াইয়ে হার মানেন মীরা। তবু তার আশা ছিল, বঙ্গবন্ধু হয়ত তাদের জন্য কিছু করবেন। কিন্তু পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর সব আশা ছেড়ে দেন মীরা। ছেলেরা স্কুলে যাওয়ার বয়সী হলেও অর্থাভাবে স্কুলে পাঠাতে পারেননি তাদের।
এর বাড়ি, ওর বাড়ি কাজ করে এতদিন জীবিকা নির্বাহ করেছেন মীরা। শরীর দুর্বল হয়ে পড়ায় কয়দিন বাগেরহাটের বাজারে বসে সবজি বিক্রি করতে দেখা গেছে তাকে। বাসন মাজা আর সবজি কোটার কাজ করেছেন বাগেরহাট লঞ্চঘাটের এক দোকানে। আর বর্তমানে বাস করছেন বাগেরহাট শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ভৈরব নদীর পাড়ে জরাজীর্ণ কুটিরে, জীবন ও নদীর সাথে ক্রমাগত লড়াই করে।
মীরার সম্পর্কে এক অদ্ভুত স্মৃতিচারণা করেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির (বীরপ্রতীক), যিনি মুক্তিযুদ্ধে ৪ নম্বর সেক্টরের অধীনে দ্বিতীয় গোলন্দাজ বাহিনীকে সংগঠিত করেছিলেন। ২০১২ সালের দিকে তিনি বাগেরহাটের মোল্লারহাটে গিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের এক অনুষ্ঠানে। সেখানে তার সাথে দেখা করতে আসেন এক নারী, হাতে যার টুকরি আর পরনে ছেঁড়া শাড়ি। লেফটেন্যান্ট সাজ্জাদকে সেদিন তিনি খুবই কড়া গলায় বলেছিলেন,
“আমার নাম মেহেরুন্নেসা মীরা। মুক্তিযুদ্ধ করলাম আমি-আপনি। আমরা ছিলাম সহযোদ্ধা। আপনি হয়ে গেলেন বীরপুরুষ, আমি হয়ে গেলাম খারাপ মাইয়া, সমাজের বিচার ঠিক নেই। আমার সনদ নেই। সবাই বলে, তুই বস্তিতে থাকস সনদ দিয়া কী করবি?”
এই স্মৃতিচারণা গণমাধ্যমে প্রকাশ পাওয়ার পর অবশ্য মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট পেয়েছেন তিনি। এর পর থেকে ভাতাও পান। সাথে জুটেছে টুকটাক আরো কিছু সম্মাননা। তবে এ কথাও ভুলে গেলে চলবে না যে, দেশ স্বাধীন করার দীর্ঘ চার দশকেরও বেশি সময় ধরে তাকে সহ্য করে যেতে হয়েছে চরম অবহেলা-অনাদর। দেশের মানুষের কাছ থেকে এমন প্রতিদান পাবেন, এমনটি হয়তো মীরা কল্পনাও করেননি। যদি করতেন, তাহলে একাত্তরে তার ভূমিকা অন্যরকমও হতে পারত। নিঃস্বার্থভাবে তিনি, এবং তার মতো আরো অনেক মুক্তিযোদ্ধা, দেশকে স্বাধীন করতে যে অবদান রেখেছেন, তার প্রতি যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করতে না পারাটা আমাদেরই ব্যর্থতা।