১৯৫৩ সালের নভেম্বর মাসের এক ভোর। শীতের এই সময়ে নিউ ইয়র্কের রাস্তায় মানুষজন তো দূরে থাক, কাক-পক্ষীর দেখা পাওয়াও বিরল ঘটনা। কুয়াশার চাদরে আবৃত সেভেন্থ এভিনিউয়ের রাস্তায় থমথমে গুমোট পরিবেশ বিরাজ করছে, অস্বস্তিকর কিছু ঘটার সম্ভাবনা আগাম নির্দেশনা দিচ্ছে যেন।
সেভেন্থ এভিনিউতেই রাস্তার পাশে একটি বড় হোটেল অবস্থিত। ‘স্ট্যাটলার হোটেল’ হিসেবে সবাই এক নামে চেনে। পর্যটক কিংবা নিউ ইয়র্কে বিভিন্ন কাজে আসা ব্যক্তিদের আগমনে এই বহুতল হোটেলের কক্ষগুলো রাত থেকেই ভরে ওঠে। সারাদিন হোটেলের লবি বিভিন্ন কিসিমের মানুষের পদচারণায় মুখর থাকে।
স্ট্যাটলার হোটেলের দ্বাররক্ষক জিমি নভেম্বরের হিমশীতল ভোরের এই গুমোট সময়ে ঝিমোচ্ছেন। সারারাত জেগে থাকার পর এই সময়টিতে শরীর একেবারে অবসাদে নেতিয়ে পড়ে, দু’চোখ ভেঙে ঘুম আসতে চায়। ইচ্ছে হয় কোনোমতে শরীরটা এলিয়ে দিয়ে ঘুমের জগতে হারিয়ে যেতে। কিন্তু পেশাগত দায়িত্বের খাতিরে একেবারে ঘুমানোর জো নেই।
সেভেন্থ এভিনিউয়ের শান্ত, নিস্তব্ধ পরিবেশের ইতি টেনে হঠাৎ জানালার কাচ ভাঙার আওয়াজ শুনতে পাওয়া গেল। হোটেলের দ্বাররক্ষক জিমির কাছে এই ভোরবেলায় জানালা ভাঙার আওয়াজ কিছুটা খাপছাড়া ব্যাপার মনে হলো। কিন্তু আসল ঘটনা তখনও বাকি।
জানালার কাচ ভাঙার শব্দ শোনার একটু পরেই বেশ খানিকটা উপর থেকে একজন মানুষের দেহ পড়লো সেভেন্থ এভিনিউয়ের স্ট্যাটলার হোটেলের সামনের রাস্তায়। হতচকিত হয়ে জিমি ছুটে এসে পরখ করে দেখলেন লাশটিকে, এত উপর থেকে পড়ার পরও প্রাণ অবশিষ্ট আছে কি না। ততক্ষণে উপর থেকে লাফ দেয়া অজ্ঞাত ব্যক্তির প্রাণবায়ু বেরিয়ে গিয়েছে।
জিমি হোটেলের লবির দিকে থাকা ম্যানেজারের দিকে ছুটলেন। নাইট ম্যানেজারকে দেখামাত্র চেঁচিয়ে উঠলেন, “একজন হোটেলের উপর থেকে লাফ দিয়েছে!” নাইট ম্যানেজার দৌড়ে এসে লাফ দেয়া ব্যক্তির মৃতদেহের কাছে দাঁড়িয়ে চেক করলেন পরিচয় খুঁজে পাওয়ার মতো কিছু আছে কি না। কিছু না পেয়ে ম্যানেজার এবার উপরের দিকে তাকালেন। ১০১৮এ রুমের জানালা খোলা। সম্ভবত সেখান থেকেই মৃত ব্যক্তি কিছুক্ষণ আগে লাফ দিয়েছেন।
রেজিস্ট্রেশন খাতা চেক করলেন নাইট ম্যানেজার। রুমটি দুজন ব্যক্তি ভাড়া নিয়েছিলেন। একজন ফ্রাঙ্ক ওলসন, আরেকজন রবার্ট ল্যাশবুক। পুলিশ এসে বন্দুক তাক করে ঘরে ঢুকলো। রুমের জানালা খোলা। রুমে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। পুলিশ কাউকে না পেয়ে এবার রুমের সাথে সংযুক্ত টয়লেটের দরজা ভেঙে ঢুকে পড়লো। টয়লেটের কমোডে বসে রবার্ট ল্যাশব্রুক হাতে মাথা রেখে বেঘোরে ঘুমাচ্ছেন।
পুলিশ অফিসারেরা জানতেন না, যে ব্যক্তি হোটেল রুমের জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে মারা গিয়েছেন তিনি আমেরিকা সরকারের সবচেয়ে গোপনীয় গোয়েন্দা প্রজেক্টগুলোতে কাজ করছিলেন। ফ্র্যাঙ্ক ওলসন সিআইএ-র অত্যাধুনিক বায়োলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার নিয়ে গবেষণা করা খুব অল্প সংখ্যক বিজ্ঞানীর একজন।
পরদিন ওলসনের একজন সহকর্মী তার পরিবারকে মৃত্যুসংবাদ দেয়ার জন্য মেরিল্যান্ডের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। সংবাদটি শোনার পর স্বাভাবিকভাবেই তার পরিবার শোকাহত হয়ে পড়ে। কিন্তু যেহেতু তারা ওলসনের মারা যাওয়ার ঘটনা স্বচক্ষে দেখেনি, তাই তাদের পক্ষে সেই সহকর্মীর কথা বিশ্বাস না করে উপায় ছিল না। এমনকি লাফ দেয়ার ফলে ওলসনের লাশের চেহারা দেখতে ভয়াবহ রকমের খারাপ হওয়ার কথা বলে সরকারের পক্ষ থেকে তার পরিবারকে লাশ দেখা থেকেও বিরত রাখা হয়।
মার্কিন সরকারের বিবৃতিতে ফ্রাঙ্ক ওলসনকে দেখানো হয় একজন ক্লান্ত, অবসাদগ্রস্ত বিজ্ঞানী হিসেবে, যিনি তার কর্মক্ষেত্রে কাজ করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। তাই নিজেকে এসব থেকে চিরতরে মুক্তি দিতে তিনি আত্মহননের পথ বেছে নেন। অতি জটিল বিষয় নিয়ে প্রতিনিয়ত গবেষণা করতে থাকা একজন মানুষকে ক্লান্তি ও অবসাদ গ্রাস করতেই পারে। কিন্তু তার আত্মহননের ঘটনা যে আসলে মানুষের চোখে ধুলো দেয়ার জন্য একটি বানানো গল্প, তা পরবর্তী বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রমাণিত হয়ে যায়।
ফ্রাঙ্ক ওলসন সম্পর্কে একটু জানা যাক। তাহলে পরিষ্কার হবে সিআইএ কেন তাকে নিয়ে এত চিন্তিত ছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্রাঙ্ক ওলসনকে আমেরিকা সরকার নিয়োগ দেয় একজন দক্ষ ব্যাক্টেরিয়া-বিজ্ঞানী হিসেবে। জীবাণু অস্ত্র নিয়ে গবেষণার জন্য ওলসনকে ফোর্ট ডেট্রিক নামে জীবাণু গবেষণাগারে পাঠানো হয়। আরও অনেকজন প্রতিভাবান বিজ্ঞানীকে আমেরিকা সরকার নিয়োগ দিয়েছিলো, যাদেরকে ওলসন সহকর্মী হিসেবে পান। তারা প্রাথমিকভাবে অ্যারোসল প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছিলেন। শত্রুর উপর কীভাবে জীবাণু স্প্রে করে সমূলে ধ্বংস করে দেয়া যায় কিংবা শত্রুপক্ষ যদি কখনও জীবাণু আক্রমণ করে তবে কীভাবে তা প্রতিরোধ করা যায়– এসবের মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে তারা গবেষণা করছিলেন।
১৯৪৪ সালে তাকে সরকারি চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। কিন্তু চুক্তিবদ্ধ বেসামরিক গবেষক হিসেবে থেকে যান।
সিআইএ-র গবেষণা ও উন্নয়ন ইউনিটের একজন অন্যতম প্রধান কর্মকর্তা হিসেবে ওলসন সিআইএ-র অনেক গোপন তথ্য জানতেন। ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় সিআইএ-র গোপন অপারেশনের মাধ্যমে ধরে আনা বন্দীদের জিজ্ঞাসাবাদের নামে যেরকম অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে কিংবা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করে মেরে ফেলা হতো, তা তিনি সশরীরে উপস্থিত থেকে দেখেছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকার নেতৃত্বে পুঁজিবাদী বিশ্ব ও সোভিয়েত ইউনিয়নের নের্তৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের দ্বন্দ্ব যে স্নায়ুযুদ্ধে গড়ায়, তাতে আমেরিকা কিংবা সোভিয়েত ইউনিয়ন– দুই দেশেরই সামরিক গবেষণা নতুন মাত্রা লাভ করে। প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করতে দুই দেশই ভয়ংকর গণবিধ্বংসী অস্ত্রের আবিষ্কারের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে। আমেরিকা জীবাণু অস্ত্র কিংবা মানুষের মন নিয়ন্ত্রণের জন্য অত্যন্ত গোপনে বিভিন্ন প্রজেক্ট হাতে নেয়। এরই ফলশ্রুতিতে অপারেশন হার্নেস, প্রজেক্ট এমকে আল্ট্রার মতো উচ্চাভিলাষী প্রকল্পের গোড়াপত্তন করে আমেরিকা।
আমেরিকার ভয় ছিল, পারমাণবিক বোমার মতো হয়তো এসব পরিকল্পনাও গোপনে হাতিয়ে নিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। আর এসব কাজে সেসব ব্যক্তিদেরই কাজে লাগানো হবে, যারা আমেরিকার সেই উচ্চতর প্রকল্প কিংবা অপারেশনের সাথে যুক্ত। তাই ফ্রাঙ্ক ওলসনের মতো বিজ্ঞানীদের নিয়ে সিআইএ-কে সবসময় সতর্ক থাকতে হতো।
ওলসনের মৃত্যুর কিছুদিন আগেই কয়েক দিনব্যাপী বিজ্ঞানীদের নিয়ে একটি গেট-টুগেদারের আয়োজন করা হয়। এর অতিথিরা ছিলেন সিআইএ ও মার্কিন সেনাবাহিনীর তুখোড় বিজ্ঞানী, যাদের মধ্যে ফ্রাঙ্ক ওলসনও ছিলেন। গেট-টুগেদার চলাকালে একদিন ডিনারের সময় তরল পানীয়ের সাথে এলএসডি (LSD) মিশ্রিত করে বেশ কয়েকজন অতিথিকে পান করানো হয়। ফ্রাঙ্ক ওলসনকেও পান করানো হয়। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এলএসডি মিশ্রিত পানীয় খাওয়ার আগে কাউকেই বলা হয়নি যে পানীয়তে এলএসডি মিশ্রিত আছে!
এলএসডি মিশ্রিত পানীয় পান করার পর থেকেই অদ্ভুত আচরণ করা শুরু করেন ফ্রাঙ্ক ওলসনসহ আরও বেশ কয়েকজন। যে উদ্দেশ্য নিয়ে গেট-টুগেদারের আয়োজন করা হয় তা ভেস্তে যায়। ওলসন বাস্তব ও কল্পনার মধ্যে পার্থক্য করতে পারছিলেন না। সেখান থেকে বেরিয়ে তার কর্মক্ষেত্রে ফিরে গিয়ে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলতে থাকেন। তিনি তার বিভাগীয় প্রধানের সাথে চাকরিতে ইস্তফা দেয়ার বিষয়েও আলাপ করেন।
যেহেতু ফ্রাঙ্ক ওলসন সিআইএ-র অনেক স্পর্শকাতর বিষয় জানতেন তাই সিআইএ আরও অনেক বিজ্ঞানীর মতো তার উপরও অনেক কঠোর নজরদারি চালাতো যেন সোভিয়েত গোয়েন্দারা কোনোভাবেই তার মাধ্যমে কিছু হাতিয়ে নিতে না পারে। স্নায়ুযুদ্ধের সেই উত্তেজনাকর মুহুর্তে ফ্রাঙ্ক ওলসনের চাকরি ইস্তফা দেয়ার খবর সিআইএ-র চিন্তা আরও বাড়িয়ে দেয়। সে থেকেই সম্ভবত সিআইএ তাকে চিরতরে সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে।
ওলসনের পরিবার তার মৃত্যুর বাইশ বছর পর জানতে পারে যে ফ্রাঙ্ক ওলসনকে তার অজান্তেই এলএসডি প্রয়োগ করা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড আমেরিকার ভেতরে সিআইএ-র অবৈধ কার্যাবলি খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেন। সেই নির্দেশানুযায়ী রকফেলার রিপোর্ট তৈরি করা হয়। এই রিপোর্টে দুটি অনুচ্ছেদে ওলসনকে এলএসডি প্রয়োগে মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে। রকফেলার রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার দশ দিনের মাথায় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড ওলসনের পরিবারকে ওভাল অফিসে আমন্ত্রণ জানিয়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করেন। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সকল দাবিদাওয়া উঠিয়ে নেয়ার জন্য ক্ষতিপূরণও দেয়া হয় তার পরিবারকে।
ঘটনা এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু আমেরিকার সরকারের পক্ষ থেকে ওলসনের মৃত্যুর ব্যাপারে যে বিবৃতি এতদিন প্রচারিত ছিল, তাতে ফ্রাঙ্ক ওলসনের বড় ছেলে এরিক ওলসন কোনোভাবেই সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না। তার সবসময়ই মনে হতো, কোথাও কোনো একটা ঘাপলা আছে। সব সন্দেহ দূর করার জন্য একজন বিদেশি ফরেনসিক প্যাথোলজিস্টকে দিয়ে কবর থেকে ফ্রাঙ্ক ওলসনের লাশ উঠিয়ে আবার পরীক্ষা করান। সেই পরীক্ষার রিপোর্টে দেখা যায়, ফ্রাঙ্ক ওলসনের মুখে কোনো জোরাল ক্ষত ছিল না। অথচ মুখ ভয়াবহ রকমের বিকৃত হয়ে গিয়েছে বলে ওলসনের পরিবারের কাউকে লাশ দেখতে দেয়া হয়নি! এছাড়া রিপোর্টে আরও বলা হয়, ওলসনের করোটির পেছনে বড় আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এর মানে হলো, ওলসনকে মৃত্যুর আগে ভারি কিছু দিয়ে মাথার পেছনে জোরে আঘাত করা হয়!
ফ্রাঙ্ক ওলসনের মৃত্যু আমাদের সেই রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার অন্ধকার দিকটি উন্মোচিত করে দেয়, যে সংস্থার কুখ্যাতি সম্পর্কে পৃথিবীর তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশ ভালোভাবেই অবগত আছে। সিআইএ আমেরিকার বিশ্বব্যাপী কর্তৃত্ব বজায় রাখতে অনবদ্য ভূমিকা পালন করছে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই। ‘জাতীয় স্বার্থে’ ফ্রাঙ্ক ওলসনের মৃত্যু আমাদের ও বিশ্বের অপরাপর দেশের গণমানুষের সামনে সামনে সিআইএ-র অসংখ্য ভয়ংকর দিকের একটিকে উন্মোচিত করে দেয়, যা নৈতিকতার মানদন্ডে কোনোভাবেই কোনো মানুষের পক্ষে সমর্থন করা সম্ভব নয়।