এমন একজন রাজনৈতিক কৌশলবিদের কথা কল্পনা করুন, যিনি রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল, অর্থনৈতিকভাবে বিধ্বস্ত এবং সামরিকভাবে বিপর্যস্ত একটি রাষ্ট্রে স্থিতিশীলতা স্থাপন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন; যিনি একজন প্রায় অচেনা ব্যক্তিকে একটি রাষ্ট্রের একচ্ছত্র ক্ষমতা লাভে সহায়তা করেছেন; যিনি একদিকে রাষ্ট্রটির মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে সহায়তা করেন, আবার অন্যদিকে যারা এই সংগঠনগুলোর বিরোধী তাদেরকেও সমর্থন করেন; যিনি একইসঙ্গে রাষ্ট্রটির ডানপন্থী, বামপন্থী এবং মধ্যপন্থীদের নিয়ন্ত্রণ করেন! এরকম সুচতুর রাজনৈতিক কৌশলবিদ পৃথিবীতে খুব বেশি নেই। এরকমই একজন রাজনীতিবিদ হচ্ছেন ভ্লাদিস্লাভ সুরকভ, রুশ রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চের পর্দার অন্তরালে থাকা পাপেট মাস্টার, যিনি প্রায় ২০ বছর ধরে রুশ রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন।
ভ্লাদিস্লাভ সুরকভের পূর্ণ নাম ভ্লাদিস্লাভ ইউরেভিচ সুরকভ (Владислав Юрьевич Сурков)। রুশ সরকারি তথ্যমতে, সুরকভ ১৯৬৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের রুশ যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্রের (বর্তমান রুশ ফেডারেশনের) লিপেতস্ক প্রদেশের সলনৎসেভোয় জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু বেসরকারি সূত্রমতে, সুরকভের জন্ম ১৯৬২ সালে তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের রুশ যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত চেচেন–ইঙ্গুশ স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্রের শালি শহরে, যেটি বর্তমান রুশ ফেডারেশনের চেচেন প্রজাতন্ত্রের অংশ।
সুরকভের বাবা আন্দারবেক (ইউরি) দানিলবেকভিচ দুদায়েভ ছিলেন জাতিগতভাবে চেচেন এবং ধর্মগতভাবে মুসলিম। অন্যদিকে, সুরকভের মা জিনাইদা আন্তোনোভনা সুরকোভা ছিলেন জাতিগতভাবে রুশ এবং ধর্মগতভাবে ইহুদি। সুরকভের প্রকৃত নাম ছিল আসলামবেক আন্দারবেকোভিচ দুদায়েভ (Асламбек Андарбекович Дудаев)। ধারণা করা হয়, চেচনিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা জওহর দুদায়েভের সঙ্গে সুরকভের আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে।
সুরকভের বাবা-মা দুজনেই ছিলেন স্কুলশিক্ষক। সুরকভের জীবনের প্রথম ৫ বছর অতিবাহিত হয় চেচনিয়ার দুবা-ইয়ুর্ত এবং গ্রোজনি শহরে। এরপর সুরকভের বাবা লেনিনগ্রাদে (বর্তমান সেন্ট পিটার্সবার্গ) চলে যান এবং সেখানকার সামরিক স্কুলে ভর্তি হন। পরবর্তীতে তিনি সোভিয়েত সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ‘গ্রু’–তে যোগদান করেন। তিনি আর কখনো সুরকভদের কাছে ফিরে আসেননি। ১৯৬৯ সালে সুরকভের মা সুরকভকে নিয়ে রাশিয়ার লিপেতস্ক প্রদেশে চলে যান। সেখানে সুরকভ তার পিতৃদত্ত নাম পরিত্যাগ করে মায়ের পদবী গ্রহণ করেন এবং তাঁকে অর্থোডক্স খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করা হয়।
ছাত্রজীবনে সুরকভ ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমান কিন্তু পড়াশোনায় অমনোযোগী। ১৯৮২–৮৩ সালে তিনি মস্কোর জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন, কিন্তু স্নাতক হওয়ার আগেই সোভিয়েত সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। সরকারি তথ্যমতে, ১৯৮৩–৮৫ সালে সুরকভ হাঙ্গেরিতে মোতায়েনকৃত একটি সোভিয়েত আর্টিলারি রেজিমেন্টে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। কিন্তু অন্যান্য সূত্রের মতে, এসময় তিনি সোভিয়েত সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ‘গ্রু’–এর সদস্য ছিলেন।
এরপর তিনি মস্কো রাষ্ট্রীয় শিল্প ও সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং থিয়েটার বিষয়ে পড়াশোনা করেন। কিন্তু তিন বছরের মাথায় স্নাতক সমাপ্ত না করেই তিনি পড়াশোনা ছেড়ে দেন এবং ব্যবসা–বাণিজ্যের জগতে প্রবেশ করেন। তবে স্নাতক অর্জন না করলেও থিয়েটার সম্পর্কে অর্জিত জ্ঞান তিনি পরবর্তীতে দক্ষতার সঙ্গে কাজে লাগিয়েছেন রুশ রাজনৈতিক অঙ্গনে। ১৯৯০–এর দশকের শেষদিকে সুরকভ মস্কো আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৮০–এর দশকের শেষদিকে তিনি রুশ ধনকুবের মিখাইল খোদোর্কোভস্কির বিজ্ঞাপন বিভাগের প্রধান নিযুক্ত হন। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সালের এপ্রিল পর্যন্ত তিনি খোদোর্কোভস্কির মালিকানাধীন ‘ব্যাঙ্ক মেনাতেপ’–এর বিজ্ঞাপন ও জনসংযোগ বিভাগে কাজ করেন। ১৯৯৬ সালের মার্চ থেকে ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি খোদোর্কোভস্কির মালিকানাধীন তেল কোম্পানি ‘রোসপ্রোম’–এ কাজ করেন। খোদোর্কোভস্কির সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, এবং পরবর্তীতে রুশ নেতা ভ্লাদিমির পুতিন যখন খোদোর্কোভস্কিকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করেন এবং তার কোম্পানিগুলোকে বাজেয়াপ্ত করে নেন, তখন সুরকভ পুতিনের একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী হওয়া সত্ত্বেও খোদোর্কোভস্কির পরিবারকে সহায়তা করেছিলেন।
১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে খোদোর্কোভস্কির সঙ্গে মতানৈক্যের কারণে সুরকভ খোদোর্কোভস্কির কাজ থেকে অব্যাহতি নেন এবং মিখাইল ফ্রিদমানের মালিকানাধীন আলফা ব্যাংকে যোগদান করেন। ১৯৯৮-১৯ সালে তিনি আরেক ধনকুবের বোরিস বেরেজোভস্কির মালিকানাধীন রুশ টিভি চ্যানেল ‘ওআরটি’–এর জনসংযোগ বিভাগের পরিচালক ছিলেন। বেরেজোভস্কি পরবর্তীতে পুতিনের চরম শত্রুতে পরিণত হন এবং তার বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যও ধ্বংস হয়।
১৯৯৯ সালের ৩ আগস্ট তিনি রুশ রাষ্ট্রপতি বোরিস ইয়েলৎসিনের প্রশাসনের উপপ্রধান নিযুক্ত হন এবং ক্রেমলিনের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করতে থাকেন। ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর ইয়েলৎসিন আকস্মিকভাবে পদত্যাগ করেন এবং প্রধানমন্ত্রী ভ্লাদিমির পুতিনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। এই ক্ষমতা হস্তান্তরে সুরকভ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
পুতিন ক্ষমতা লাভের পর রুশ ধনকুবেরদের একটি অংশের সঙ্গে তার বিরোধ দেখা দেয় এবং পুতিন এই দুর্নীতিবাজ ধনকুবেরদের ধ্বংস করতে তৎপর হয়ে ওঠেন। সুরকভ এই প্রক্রিয়ায় পুতিনকে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করেন। ২০০০ সালের আগস্টে সুরকভের তত্ত্বাবধানে রুশ সরকারি কোম্পানি ‘গাজপ্রম’ রুশ ধনকুবের ভ্লাদিমির গুসিনস্কির মালিকানাধীন কোম্পানি ‘মিদিয়া–মোস্ত’কে কিনে নেয়, যার ফলে সরকারবিরোধী টিভি চ্যানেল ‘এনটিভি’ রুশ সরকারের হস্তগত হয়।
২০০২ সালে রুশ জনসাধারণের একাংশ সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা ‘চেকা’র (পরবর্তীতে কেজিবি) প্রতিষ্ঠাতা ফেলিক্স জেরজিনস্কির মূর্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি জানায়। এই মূর্তিটি সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের প্রাক্কালে ভেঙে ফেলা হয় এবং এই ঘটনাটিকে রাশিয়ায় কমিউনিজমের পতনের আন্যতম প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ২০০২ সালের সেপ্টেম্বরে সুরকভ মূর্তিটি পুনঃস্থাপনের দাবি প্রত্যাখ্যান করেন এবং এর মাধ্যমে সোভিয়েত রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি ক্রেমলিনের অনীহাকে প্রকাশ করেন।
২০০৩ সালের রাষ্ট্রীয় দুমা (রুশ আইনসভার নিম্নকক্ষ) নির্বাচনে পুতিনের ‘ঐক্যবদ্ধ রাশিয়া’ (Единая Россия, ‘ইয়েদিনায়া রোসিয়া’) দল জয়লাভ করলে সুরকভ ঘোষণা করেন যে, একটি ‘নতুন রাশিয়া’র সৃষ্টি হতে চলেছে। ২০০৪ সালের মার্চে তিনি রুশ রাষ্ট্রপতির সহকারী নিযুক্ত হন। একই বছরের সেপ্টেম্বরে তিনি রুশ কোম্পানি ‘ত্রান্সনেফৎপ্রোদুক্ত’–এর পরিচালকমণ্ডলীর সভাপতি নির্বাচিত হন, কিন্তু ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে রুশ প্রধানমন্ত্রী মিখাইল ফ্রাদকভের নির্দেশে পদত্যাগ করেন।
২০০৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি সুরকভ ‘ঐক্যবদ্ধ রাশিয়া’ দলের একটি সমাবেশে ‘সার্বভৌম গণতন্ত্র’ (суверенная демократия, ‘সুভেরেন্নায়া দেমোক্রাতিয়া’) নামক একটি রাজনৈতিক ধারণা সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন। তার মতে, ‘সার্বভৌম গণতন্ত্র’ হচ্ছে – ‘এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে সকল নাগরিক, সামাজিক দল ও জাতির বৈষয়িক উন্নতি, স্বাধীনতা ও ন্যায়ের জন্য সকল রাজনৈতিক ক্ষমতা, কর্তৃত্ব এবং সিদ্ধান্ত রুশ জনসাধারণের দ্বারা গৃহীত হয়’। পশ্চিমা বিশ্বে প্রচলিত ‘উদারনৈতিক গণতন্ত্রে’র (liberal democracy) বিপরীতে সুরকভের প্রবর্তিত ‘সার্বভৌম গণতন্ত্র’ রাশিয়ার রাজনৈতিক আদর্শ হয়ে ওঠে। এই ব্যবস্থায় রাশিয়ায় পশ্চিমা গণতন্ত্রের মতো বহুদলীয় ব্যবস্থা, নির্বাচন পদ্ধতি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতি বজায় থাকে, কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বের নেতৃত্ব রাশিয়া অস্বীকার করে এবং রাশিয়ার অভ্যন্তরে পশ্চিমাপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
‘সার্বভৌম গণতন্ত্র’ ব্যবস্থাটিকে একটি উদাহরণের মাধ্যমে স্পষ্ট করে নেয়া যায়। ‘রুশ ফেডারেশনের কমিউনিস্ট দলে’র মহাসচিব গেনাদি জুগানভ এবং ‘ভবিষ্যতের রাশিয়া’ দলের নেতা আলেক্সেই নাভালনি উভয়েই রুশ রাষ্ট্রপতি পুতিনের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী। জুগানভ পশ্চিমাবিরোধী, এজন্য তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন এবং মোটামুটি স্বাধীনভাবে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন; কিন্তু নাভালনি পশ্চিমাপন্থী, তাই তাকে নির্বাচনে অংশ নিতে বাধা দেয়া হয় এবং মুক্তভাবে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে দেয়া হয় না।
২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে সুরকভ ‘সার্বভৌমত্ব প্রতিযোগিতার রাজনৈতিক প্রতিশব্দ’ এবং জুনে ‘আমাদের গণতন্ত্রের রুশ সংস্করণের নাম সার্বভৌম গণতন্ত্র’ শিরোনামে দুটি ভাষণ দেন। এর মাধ্যমে তিনি তার ‘সার্বভৌম গণতন্ত্র’ ধারণাটির বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন। ২০০৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সুরকভ লমোনসভ মস্কো রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত একটি সেমিনারে রুজভেল্টের ‘নিউ ডিল’ (New Deal) এর সঙ্গে পুতিনের ‘নতুন রাশিয়া’র তুলনা করেন এবং নিউ ডিল যেভাবে ১৯৩০–এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অর্থনৈতিক মন্দা থেকে বের করে নিয়ে এসেছিল, তেমনি পুতিন রাশিয়াকে ১৯৯০–এর দশকের অর্থনৈতিক দুর্যোগ থেকে বের করে নিয়ে এসেছেন বলে মন্তব্য করেন।
বস্তুত ২০০০ সাল থেকে পুতিন যে রুশ রাষ্ট্রপতির পদে অধিষ্ঠিত আছেন, এর পেছনে সুরকভের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। সুরকভ রুশ বিরোধী দলগুলোকে নিষ্ক্রিয় করার জন্য বিশেষ ধরনের কৌশল অবলম্বন করেন। ২০০৩ সালের আগস্টে রাশিয়ার ৩০টি উগ্র ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী দল একত্রিত হয়ে ‘মাতৃভূমি’ (Родина, ‘রোদিনা’) নামে একটি ঐক্যজোট গঠন করে। ২০০৫ সালের এপ্রিলে ‘নাশি’ (Наши) নামে একটি জাতীয়তাবাদী ও পুতিনপন্থী যুব সংগঠন গঠিত হয়। ২০০৬ সালের অক্টোবরে ‘ন্যায়বান রাশিয়া’ (Справедливая Россия, ‘স্প্রাভেদনিভায়া রোসিয়া’) নামক বামপন্থী দলগুলোর একটি ঐক্যজোট গঠিত হয়। এই সবগুলো দলই সুরকভের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা লাভ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সুরকভ কেন এই বিচিত্র মতাদর্শের দলগুলোকে সমর্থন দিয়েছেন? উত্তর সহজ – এই দলগুলো একদিকে পশ্চিমাবিরোধী, অন্যদিকে এগুলো জনসমর্থন লাভ করলে পুতিনের মূল বিরোধী দলগুলো জনসমর্থন হারাবে। এর ফলে রুশ রাজনীতিতে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তা হলো – জনসাধারণ আর প্রকৃত বিরোধী দল ও কৃত্রিম বিরোধী দলের মধ্যে পার্থক্য করতে পারছে না, ফলে তারা সরকারের বিরোধিতা করার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। সুরকভ তার এই রাজনৈতিক ভূমিকার জন্য পশ্চিমা গণমাধ্যমে পরিচিতি লাভ করেছেন ভ্লাদিমির পুতিনের ‘ধূসর কার্ডিনাল’ হিসেবে।
২০০৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সুরকভের জন্মভূমি চেচনিয়ায় রমজান কাদিরভ রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত হন। কাদিরভের নির্বাচনে সুরকভের বড় ভূমিকা ছিল, এজন্য কাদিরভ সুরকভের ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে পরিণত হন। তখন থেকে কাদিরভ তেলসমৃদ্ধ চেচনিয়ার একচ্ছত্র শাসক। কাদিরভ রাশিয়ার একমাত্র আঞ্চলিক নেতা, যার একটি নিজস্ব সেনাবাহিনী রয়েছে। প্রায় ৩০,০০০ সৈন্যবিশিষ্ট এই সেনাবাহিনীটি আনুষ্ঠানিকভাবে রুশ জাতীয় রক্ষীবাহিনীর অংশ, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বাহিনীটির নিয়ন্ত্রণ চেচেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে, এবং বাহিনীটির সদস্যদের ব্যক্তিগত আনুগত্য কাদিরভের প্রতি। এজন্য বাহিনীটিকে অনানুষ্ঠানিকভাবে ‘কাদিরভোৎসি’ বলা হয়। সুরকভ নিজেও যেহেতু জাতিগতভাবে চেচেন, তাই ক্রেমলিনে তিনি ছিলেন কাদিরভের সবচেয়ে সক্রিয় সমর্থক।
২০০৮ সালে দিমিত্রি মেদভেদেভ রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন এবং ২০১২ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন। এসময় পুতিন ছিলেন রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী। এই সময়টিকে পশ্চিমারা ‘ট্যানডেমোক্রেসি’ (tandemocracy) নামকরণ করে, কারণ তাদের বিশ্বাস এই সময়েও পুতিনই ছিলেন রাশিয়ার মূল শাসক, আর মেদভেদেভ ছিলেন নামেমাত্র রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এতটা সরল নয় এবং পুতিনের বিস্তর ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তিনি রাশিয়ার একচ্ছত্র শাসক নন, বরং তিনি রুশ অভিজাত শ্রেণীর শীর্ষস্থানীয় নেতা এবং ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এই অভিজাতদের সমর্থনের ওপরে অনেকাংশেই নির্ভরশীল।
২০০৮ সালের ১৫ মে মেদভেদেভ সুরকভকে রাষ্ট্রপতির প্রশাসনের প্রথম উপপ্রধান নিযুক্ত করেন এবং ২০১১ সালের ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত সুরকভ এই পদে বহাল থাকেন। মেদভেদেভ রুশ রাজনীতির অধিকতর গণতন্ত্রায়নের প্রচেষ্টা করেন। সুরকভ এই প্রক্রিয়াকে সমর্থন করেন, কিন্তু মেদভেদেভকে এই বলে সতর্ক করেন যে, এর ফলে রাশিয়ার ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
২০১১ সালের ২৮ ডিসেম্বর সুরকভকে রাশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিষয়ক উপপ্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। এসময় মস্কোর মোঝায়স্কি জেলায় স্থাপিত ‘স্কোলকোভো’ (Сколково) উদ্ভাবন কেন্দ্রটির উন্নয়নের সঙ্গে সুরকভ জড়িত ছিলেন। এটি রাশিয়ার ‘সিলিকন ভ্যালি’ নামে পরিচিত। ২০১২ সালের ২১ মে পর্যন্ত সুরকভ এই দায়িত্ব পালন করেন।
[এই নিবন্ধটির অবশিষ্ট অংশ পরবর্তী পর্বে দেয়া হবে]