না ছিল রেকর্ডের ঝনঝনানি, না ছিল চোখে মায়াঞ্জন বুলিয়ে যাবার বাড়াবাড়ি। উল্টো এক ইনিংসেই চার সুযোগ ছিল জানলে তাকে ভালোর স্বীকৃতি দিতেও দ্বিধায় ভুগতে হয় বিস্তর। স্রেফ মাঠের ক্রিকেট দিয়ে বাসিল ডি’অলিভিয়েরার শতকটিকে যে আর দশটা ইনিংস থেকে পৃথক করবো, তার কোনো উপায় ত্রিকালজ্ঞ রাখেননি।
তবে অন্য এক উপায় ঈশ্বর রেখেছেন, ক্রিকেটকে তিনি কেবল মাঠের খেলার গণ্ডিতেই আটকে রাখেননি। সেখানে তিনি রাজনীতি-কূটনীতি দিয়েছেন, জাত্যাভিমান দিয়েছেন, দিয়েছেন কুসংস্কার, রাজায়-রাজায় লড়াই, মস্ত কালো ছায়ারূপে তাতে জাত-পাত ভেদাভেদও মিশিয়েছেন। মাঠের এগারোজনের বদলে ডি’অলিভিয়েরার লড়াইয়ের কাহিনীটাও তিনি অন্যত্রই লিখেছিলেন।
আজ সে গল্পই বলব।
***
গল্পের মুখবন্ধটা বিধাতা লিখতে শুরু করেছিলেন ১৯৩১ সালের ৪ অক্টোবরে। সেদিনই দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনে এক ‘ইন্দো-পর্তুগিজ’ ঘরে তিনি পাঠিয়েছিলেন বাসিল ডি’অলিভিয়েরা নামের এক নবজাতককে। আর সবকিছু উপেক্ষা করে ইন্দো-পর্তুগিজ শব্দে আলাদা জোর দেবার কারণ, সংকর এই জাতের রংটা ঠিক শ্বেত হয় না, এবং বাসিল ডি’অলিভিয়েরার ক্ষেত্রেও কোনো ব্যতিক্রম ঘটেনি। স্রষ্টার কাছে গায়ের রঙ এবং জাতের বিশেষ বাছবিচার না থাকলেও এই ধরাধামে তার গুরুত্ব বরাবরই ছিল, বিশেষত দক্ষিণ আফ্রিকায় তা একটু বেশি মাত্রাতেই ছিল।
জন্ম থেকেই ডি’অলিভিয়েরা তাই দেখেছিলেন, দেশটিতে সুযোগ-সুবিধা-প্রতিপত্তি সবকিছুই নির্ধারিত হচ্ছে গায়ের রঙে। পাল্লায় বেশি পড়লে কোনো গোল ছিল না, তবে সাদায়-কালোয় মেশানো গায়ের রঙটা ডি’অলিভিয়েরাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল বিপরীত প্রান্তে। শুরুর দিনগুলোতে বঞ্চনার শিকার হতেন চুপিসারে, বয়সটা আঠারো পেরোতে না পেরোতেই সে অবহেলা প্রতিষ্ঠা পেয়ে গিয়েছিল কাগজে-কলমে। সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গদের আজ্ঞাবহ আফ্রিকান ন্যাশনাল পার্টি ক্ষমতায় এসেই ১৯৪৮ সালে পাশ করেছিল ‘অ্যাপার্থাইড অ্যাক্ট’; যার সরল বাংলা: সাদা আর কালো পাশাপাশি ঠিক মিশ খায় না, দক্ষিণ আফ্রিকায় সাদা এবং কালো জাতের মানুষেরাও তাই একত্রে মিশতে পারবে না।
যে ক্রীড়াঙ্গন বরাবরই ছড়িয়ে এসেছিল সাম্যের বার্তা, দক্ষিণ আফ্রিকা তাদের পৃথকীকরণ আইনের প্রয়োগ করেছিল সেখানেও। ক্রিকেট দলও তৈরি হয়েছিল দু’টি, শ্বেতাঙ্গদের নিয়ে গড়া হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা সাদা দল, জাতীয় দল হিসেবে পরিচিতি পেত এরাই। আর বাদবাকি সব জাতদের নিয়ে তৈরি হয়েছিল আরেক দল, আমাদের গল্পের নায়ক বাসিল ডি’অলিভিয়েরার ঠাঁই মিলেছিল এ দলেই। সমস্ত যোগ্যতা থাকবার পরও বাসিল ডি’অলিভিয়েরার সর্বোচ্চ পদোন্নতি ঘটেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা কৃষ্ণাঙ্গ দলের অধিনায়ক হিসেবে, জন্মভূমির হয়ে টেস্ট খেলবার সাধ তার পূরণ হয়নি কোনোদিনই।
উপায়ান্তর না দেখে ডি’অলিভিয়েরা হয়েছিলেন দেশান্তরি। জন আরলট ক্রিকেট-ইতিহাসে এমনিতেই স্মরণীয় হয়ে আছেন দুঁদে ভাষ্যকার আর সাহিত্যিক হয়ে, চাইলে তাকে শ্রদ্ধা করা যেতে পারে ডি’অলিভিয়েরার কারণেও। ইংল্যান্ডে ডি’অলিভিয়েরা প্রথম যে মিডলটন ক্লাবে সুযোগ পেয়েছিলেন, তার মধ্যস্থতা হয়েছিল আরলটের সুবাদেই।
দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বাকি খেলাগুলো মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল ততদিনে। ১৯৬১ সালে ফিফা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল তাদের ওপর, আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি সে ধারা অনুসরণ করেছিল ১৯৬৪তে। মাওরি খেলোয়াড়দের দক্ষিণ আফ্রিকা প্রবেশের অনুমতি না দেয়ায় বছরদুয়েক পর রাগবির সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল নিউ জিল্যান্ডও। দক্ষিণ আফ্রিকার এই ভীষণ অন্যায়কে তোষণ করে চলছিল কেবল ক্রিকেটই। অস্ট্রেলিয়া, নিউ জিল্যান্ড আর ইংল্যান্ড – দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে ক্রিকেটীয় সম্পর্ক চালু রেখেছিল এরা বরাবরই। এমনকি এমসিসি (তখনকার ইংল্যান্ড ক্রিকেটের সর্বময় কর্তা ছিল এই মেরিলিবন ক্রিকেট ক্লাবই) বিশ্বাস করতো, দক্ষিণ আফ্রিকাকে একঘরে করে নয়, বরং দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারের নেয়া বর্ণবাদী আইনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে সহাবস্থানে থেকেই। ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ভারত, পাকিস্তান যদিও টেস্ট খেলতে শুরু করে দিয়েছিল ততদিনে, দক্ষিণ আফ্রিকা এদের সঙ্গে খেলবার আগে অপেক্ষা করেছে ১৯৯১ পর্যন্ত। কারণ, বিধাতা তাদের গায়ের রঙটা সাদাটে করেননি।
হয়তো এমনি করেই কেটে যেত বাদবাকি বছরগুলো, পৃথিবীতে নিয়ত ঘটে চলা আরও অসংখ্য-অজস্র ঘটনার স্রোতে বয়ে যেত এই অনাচারটিও। তবে এমনি করেই কাটল না, গোল বাঁধানোর জন্যে পৃথিবীতে বাসিল ডি’অলিভিয়েরা এসেছিলেন।
পাঁচ বছর বিলেতে কাটিয়ে ডি’অলিভিয়েরা ১৯৬৫ সনে পেয়েছিলেন ব্রিটেনের নাগরিকত্ব, উস্টারশায়ারের হয়ে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করে ইংল্যান্ড জাতীয় দলে সুযোগ মিলেছিল পরের বছরই। ততদিনে বয়সটা ছাড়িয়ে গিয়েছিল ৩৪-এর ঘর, স্যার গ্যারি সোবার্স যে বয়সে গিয়েছিলেন অবসরে। খেলোয়াড়ি জীবনের খুব একটা বাকি নেই বুঝতে পেরেই কি না সায়াহ্নবেলায় ডি’অলিভিয়েরা মাঠে নিংড়ে দিয়েছিলেন সামর্থ্যর পুরোটা। ক্যারিয়ারের প্রথম নয় টেস্ট শেষে তার ব্যাটিং গড় ছিল ঠিক ঠিক বায়ান্ন, সঙ্গে ৪১.৯২ গড়ে ১২ উইকেট তো ছিলই।
দুঃসহ অতীতকে যখন তিনি অনেকটাই চাপা দিয়েছেন ক্রিকেটীয় পারফরম্যান্সে, বিধাতার খুব সম্ভবত তখনই স্মরণ হয়েছিল, বহুদিন বাসিলের সাথে রঙ্গ করা হচ্ছে না।
***
ইংল্যান্ড দলের দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যাবার কথা ছিল ১৯৬৮ সালের শেষার্ধে। কিন্তু ইংল্যান্ডের হয়ে ডি’অলিভিয়েরার স্বর্ণালি সময় দেখে দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন তোড়জোড় শুরু করেছিল সফরের দুই বছর আগে থেকেই। ১৯৬৭ সালের ২৬ জানুয়ারি দক্ষিণ আফ্রিকার তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী পিটার লে রুঁ সর্বপ্রথম জানিয়েছিলেন, ডি’অলিভিয়েরাকে কোনোমতেই দক্ষিণ আফ্রিকা সাদা দলের বিপক্ষে খেলতে দেয়া হবে না। তার মন্তব্যের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিকটি হচ্ছে, মন্তব্যটি তিনি করেছিলেন এমসিসি সচিব বিল গ্রিফিথের সঙ্গে বৈঠক করে বেরিয়েই।
লে রুঁর এমন মন্তব্য ক্রিকেটকে ঠেলে দিয়েছিল বডিলাইনের মতোই গভীর এক সংকটে। ইংল্যান্ড থেকে পাল্টা প্রতিক্রিয়া এসেছিল খুব সহসাই। জানুয়ারির ৩০ তারিখে, দুই শতাধিক ব্রিটিশ সাংসদের দাবির মুখে এমসিসি কর্তারা বিবৃতি দিতে বাধ্য হয়েছিলেন এই বলে যে,
‘আসন্ন দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের দল নির্বাচনে ক্রিকেটীয় যোগ্যতাই হবে একমাত্র বিচার্য।’
এর দিনদশেক পরে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক ডগলাস-হোম নিজে গিয়ে সাক্ষাৎ করেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকান প্রধানমন্ত্রী জন ভোরস্টারের সঙ্গে। সেখানে তাদের ভেতরে কী আলাপ হয়েছিল, তা জানা যায়নি। তবে দেশে ফিরে এসে এমসিসি কমিটিতে তিনি প্রশ্ন রেখেছিলেন, ‘বাসিলকে দলে রাখা হবে কি?’ সেখানে ৫-৪ ব্যবধানে জয় হয়েছিল ‘হ্যাঁ’ ভোটের। পরবর্তীতে সে বছরেরই ১১ এপ্রিল ভোরস্টার যখন জানিয়েছিলেন, মিশ্র গাত্রবর্ণের ক্রিকেটারদের (পড়ুন ডি’অলিভিয়েরার) সঙ্গে খেলতে আপত্তি নেই তার দেশের ক্রিকেট দলের। তখন ধরে নেয়া হয়েছিল, বাসিল ডি’অলিভিয়েরা কাণ্ডের সমাপ্তি ঘটেছে শেকড়েই।
***
কিন্তু এমনি করে গোড়াতেই ফুরিয়ে গেলে তা আর গল্প হয় কী করে!
আগেই বলা হয়েছে, ডি’অলিভিয়েরার বিপক্ষে খেলতে কোনো আপত্তি নেই তার দেশের, ভোরস্টার অন্তত এমনটিই বলেছিলেন। তবে আপত্তি বরাবরই ছিল, এবং সবচেয়ে গুরুতর আপত্তিটা খোদ তার সরকারস্থ মন্ত্রীদের থেকেই এসেছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার এই আপত্তির খবর পৌঁছে গিয়েছিল এমসিসি কর্তাদের কানেও, তাই ১৯৬৮ সালের প্রথম সপ্তাহেই সাকা (সাউথ আফ্রিকা ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন) অফিসে তার পাঠিয়ে এমসিসি আশ্বস্ত হতে চেয়েছিল, এমসিসির নির্বাচিত দলে দক্ষিণ আফ্রিকা কোনোরূপ হস্তক্ষেপের চেষ্টা করবে না।
দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট কর্তারা ফিরতি তার পাঠিয়েছিলেন এর আট সপ্তাহ পরে। তাতে লেখা হয়েছিল,
“Never presume to interfere with the manner in which you chose your sides”.
যদিও পরবর্তীকালের ঘটনাপরম্পরায় পরিস্থিতি এমন মোড় নিয়েছিল, এই তারবার্তার অস্তিত্ব অস্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল এমসিসি।
দুই দেশের ক্রিকেট বোর্ডের দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা মুখোমুখি হচ্ছিলেন তারবার্তা প্রেরণের বাইরেও। এমসিসির প্রাক্তন সভাপতি অ্যান্ডি কোবহ্যামের সঙ্গে মার্চের চার তারিখ সাক্ষাৎ করেছিলেন সাকা সচিব আর্থার কয়। ডি’অলিভিয়েরাকে দক্ষিণ আফ্রিকা নিয়ে এলে তা ‘বিপর্যয়’ বয়ে আনবে, এ নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছিলেন দুজনই।
এর দু’দিন পর নিজেদের মধ্যে আলোচনায় কয় আর ভোরস্টার ঠিক করেছিলেন, ঘুষ দিয়ে হলেও সফর থেকে দূরে রাখবেন ডি’অলিভিয়েরাকে। ভোরস্টারের পাঠানো তার যে স্রেফ লোক দেখানো, তার আরেকপ্রস্থ প্রমাণ পাওয়া যায় এদিনই। ছয় মার্চই গোপন বার্তায় এমসিসিতে যোগাযোগ করে তিনি জানিয়েছিলেন, ডি’অলিভিয়েরাকে স্কোয়াডে রাখা হলে সে বছর আর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলছে না তার দেশ।
***
এই গুরুতর বিপত্তির যে মূল কারণ, সেই বাসিল ডি’অলিভিয়েরা নিজে কী ভাবছিলেন, তা অবশ্য জানা যায়নি কোনোকালেই। মাঝে একবার দক্ষিণ আফ্রিকায় কোচিং করাতে গেলেও মুখ খোলেননি এ নাটক নিয়ে। তবে মাঠের বাইরের এ সমস্ত অধ্যায় নিশ্চয়ই আন্দোলিত করে থাকবে তার মনকে, যার প্রভাব পড়েছিল ব্যাট হাতেও। ১৯৬৭ পর্যন্ত যার গড় ছিল ৫২, সেই ডি’অলিভিয়েরার ব্যাটেই পরের বছরে ভাটার টান। বছরের গোড়াতে উইন্ডিজ সফরে গিয়ে রান করেছিলেন মাত্র ২২.৮৩ গড়ে। বল হাতে দুর্দান্ত কিছু করে পুষিয়ে দিয়েছেন ঘাটতি, তবে অমন মেলোড্রামাটিক কিছুও দেখা যায়নি ক্যারিবিয়ানে। বছরের মধ্যভাগের অ্যাশেজ দলে ডি’অলিভিয়েরার টিকে থাকাকে তাই যতটা না পারফরম্যান্স দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়, তার চাইতে পারিপার্শ্বিক প্রভাব খুঁজলেই ব্যাখ্যা করতে সহজ হয়। জ্যাক চিথামের মতে,
‘অবস্থা তখন এমনই, পড়তি ফর্ম সত্ত্বেও কোনো নির্বাচক কমিটিই তাকে বাদ রেখে অ্যাশেজ দল গড়বার সাহস করতো না।’
১১ জুন সমাপ্ত হওয়া ১৯৬৮ অ্যাশেজের প্রথম টেস্টে ইংল্যান্ড হেরেছিল ১৫৯ রানে। দ্বিতীয় টেস্টের দলে পরিবর্তন আসা তাই অবশ্যম্ভাবীই ছিল। তবে পরিবর্তনটা যে ডি’অলিভিয়েরাকে দিয়েই শুরু কিংবা শেষ হবে, এমন ভাবনাটা একটু কষ্টকল্পনাই ছিল। একে তো ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে রান করেছিলেন ৮৭, উপরন্তু ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রানকর্তার সঙ্গে তার ব্যবধান ছিল ৩৮ রানের। টিম কম্বিনেশন বলুন, আর নতুন ভাবনাই বলুন, দ্বিতীয় টেস্টের একাদশ থেকে ডি’অলিভিয়েরার বাদ পড়াটা কঠিনই ছিল।
সেই কঠিন কাজটাই কলিন কাউড্রে করেছিলেন বেশ সহজে। টেস্ট শুরুর তিনদিন আগেই ‘টাইমস’ পত্রিকা আঁচ করতে পেরেছিল, ডি’অলিভিয়েরা একাদশে থাকছেন না। টেস্ট শুরুর পর নিশ্চিত হয়েছিল যার সত্যতা; ডি’অলিভিয়েরার জায়গায় অতিরিক্ত বোলার হিসেবে এসেছিলেন কলিন মিলবার্ন।
দলে এই পরিবর্তন নিয়ে আলোচনার ঝড় ওঠাটা অবধারিতই ছিল, বিভিন্নজন দাঁড় করাতে চেষ্টা করেছিলেন ‘ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব’। প্রথম টেস্টের অমন দুর্দান্ত ইনিংসের পরও ডি’অলিভিয়েরাকে বাদ দেয়াতে এমসিসির মাঠের বাইরের রাজনীতির ভূমিকা ছিল বিস্তর, এমন গুঞ্জন মেলেছিল ডালপালা। সমালোচকেরা পালে জোর হাওয়া পেয়েছিলেন মিলবার্নের কারণেই। যে অতিরিক্ত বোলার খেলাবার অজুহাতে দ্বাদশ খেলোয়াড় হয়েছিলেন ডি’অলিভিয়েরা, সেই মিলবার্ন দ্বিতীয় টেস্টে হাত ঘোরাননি একটিবারও।
এরই মাঝে ডালপালা মেলেছিল নতুন গুঞ্জন। প্রথমে চার্লি গ্রিফিথ, পরে কাউড্রের ডানহাত সাংবাদিক আর্নেস্ট উইলিয়াম সোয়ান্টন নাকি ডি’অলিভিয়েরাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে প্রস্তাব দিয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকা সফর থেকে নিজের নাম কেটে দেবার। বলা বাহুল্য, ডি’অলিভিয়েরা এই প্রস্তাবনায় ইতিবাচক সাড়া দেননি একটিবারও। এমনকি লর্ডসে দ্বিতীয় টেস্ট চলাকালীন উইলফ্রেড আইজ্যাক বলে এক সাকা কর্মকর্তা দেখা করে গিয়েছিলেন বাসিল ডি’অলিভিয়েরার সঙ্গে। দক্ষিণ আফ্রিকায় ডি’অলিভিয়েরা সফর করলে তাকে আতিথ্য দেবেন আইজ্যাক, দু’জনের কথা হয়েছিল এমনটাই। কিন্তু দেশে ফিরে আইজ্যাক মোড় ঘুরেছিলেন ১৮০°, ‘ডি’অলিভিয়েরা সফর করবে না’, সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন তিনি।
কলিন মিলবার্ন ইনজুরিতে পড়েছিলেন তৃতীয় টেস্টের আগে, স্বাভাবিক নিয়মে প্রত্যাশা ছিল ডি’অলিভিয়েরার প্রত্যাবর্তনের। কিন্তু সময়টাই যে ছিল অস্বাভাবিক, ডি’অলিভিয়েরাও তাই ডাক পাননি তৃতীয় টেস্টের দলে। যে জন আরলট তাকে খুঁজে দিয়েছিলেন কুলীন ক্রিকেটের রাস্তা, তার কলমেই বেরিয়েছিল সবচাইতে সোচ্চার প্রতিবাদ,
“এমসিসি যদি ভেবে থাকে, কোনোরূপ যৌক্তিক ব্যাখ্যা ব্যতিরেকেই ওকে (ডি’অলিভিয়েরাকে) দলের বাইরে রাখবে, আর আমজনতাও বিনা প্রতিবাদে তা মেনে নেবে, তবে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছে।”
তবে আরলটের এই সমালোচনা এমসিসিকে টলাতে পারেনি তাৎক্ষণিক, উল্টো কাউন্টিতে ফিরে গিয়ে ডি’অলিভিয়েরা চোখে দেখতে শুরু করেছিলেন সর্ষে ফুল। সেবারের জুনের শুরু থেকে মধ্য আগস্ট পর্যন্ত খেলা কাউন্টির ম্যাচগুলোতে তার রান ছিল সাকুল্যে ২০৫, ১২.৮১ গড়ের কথা উহ্য রাখলেই বোধ করি ভালো হতো।
জুলাই মাসেই এমসিসি ঘোষণা করেছিল আসন্ন দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের প্রাথমিক দল। ৩০ জনের সেই তালিকায় জায়গা মেলেনি ডি’অলিভিয়েরার, অজুহাত হিসেবে রানখরা তো ছিলই। এরই মাঝে দক্ষিণ আফ্রিকার এক তামাক কারখানার মালিক টিয়েনি উস্থুইজেন ডি’অলিভিয়েরার কাছে পাঠিয়েছিলেন এক লোভনীয় প্রস্তাব। বাৎসরিক বেতন হবে ৪০০০ পাউন্ড, বিনিময়ে খেলা ছেড়ে দিয়ে ক্রিকেট শেখাতে হবে দক্ষিণ আফ্রিকায়। প্রথমবার এমন প্রস্তাবনা এসেছিল ১০ আগস্ট, দ্বিতীয়বার এসেছিল এর দশদিন পরে। দু’বারই ডি’অলিভিয়েরা দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের চূড়ান্ত দল ঘোষণা পর্যন্ত সময় নিতে চেয়েছিলেন। জাত-পাত নিয়ে লড়াইয়ের শেষটা তিনি সেবারই দেখতে চেয়েছিলেন।
কে জানে, বিধাতার সঙ্গে তার যোগাযোগটা ততদিনে হয়ে গিয়েছিল কি না! যোগাযোগ যদি না-ই হবে, তবে বুক বেঁধেছিলেন কোন আশাতে!
***
১৯৬৮ অ্যাশেজের পঞ্চম টেস্ট বসেছিল ওভালে। প্রথম টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার জয়ের পরে বাকি তিন টেস্ট হয়েছিল ড্র, এর আগেরবারের অ্যাশেজ জেতায় ক্যাঙারুর দেশে ছাইদানি যাওয়া নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল শেষ টেস্টের আগেই। ইংল্যান্ডের জন্যে এক সান্ত্বনার জয় নিশ্চিত করা ছাড়া ওভাল টেস্টের আর কোনো উদ্দেশ্য ছিল না।
তা নিশ্চিত হয়েছিলও, ইংল্যান্ড পেয়েছিল ম্যাচ শেষ হবার মিনিট কয়েক আগে এক নাটকীয় জয়৷ কলিন কাউড্রের ডাকে দর্শকদের মাঠের পানি অপসারণে নেমে যাওয়া, ডেরেক আন্ডারউডের সাত উইকেট, সব মিলিয়ে ওভালে সেবার জম্পেশ এক টেস্টই হয়েছিল। এবং সেই ওভাল টেস্টে ডি’অলিভিয়েরার অংশগ্রহণ নাটক বাড়িয়েছিল আরও।
এমনিতে ডি’অলিভিয়েরার সে টেস্টে খেলবার কথা ছিল না, এমনকি মূল একাদশের একজন খেলবেন না জানবার পরে তিনি তৃতীয় বিকল্পও ছিলেন না। উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান রজার প্রিডু যখন রহস্যময় চোটে আক্রান্ত হয়ে ছিটকে গিয়েছিলেন টেস্ট থেকে, তখন ইংল্যান্ড বিকল্প খুঁজতে চেয়েছিল টম কার্টরাইট কিংবা ব্যারি নাইটে। সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কার্টরাইট ডি’অলিভিয়েরাকে সুযোগ দেবার নিমিত্তে নাম তুলে নিয়েছিলেন দল থেকে, নাইটকেও পাওয়া গিয়েছিল খেলবার অনুপযুক্ত অবস্থায়, তাই একরকম বাধ্য হয়েই এমসিসির নির্বাচকদের আস্থা খুঁজতে হয়েছিল পড়তি ফর্মের ডি’অলিভিয়েরাতে।
ওভাল টেস্টে টসে জিতে ব্যাটিং নিয়েছিলেন ইংল্যান্ড অধিনায়ক কাউড্রে, নিখাদ ব্যাটিং উইকেটে তা-ই নেবার কথা ছিল। উইকেটের সুবিধা কাজে লাগিয়ে থ্রি লায়ন্সরা চার উইকেট হারিয়ে পৌঁছে গিয়েছিল ২৩৮ রানে, ডি’অলিভিয়েরা উইকেটে এসেছিলেন এমন অবস্থাতেই। প্রথম দিনের খেলা শেষের আগে যে সময়টুকু পেয়েছিলেন, তাতে তুলেছিলেন ২৪। তবে ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম অক্ষয় করে রাখবার কর্মটুকু সম্পাদন করেছিলেন দ্বিতীয় দিনে।
“ও (ডি’অলিভিয়ের) ইংল্যান্ডের হয়ে খেলা শুরু করবার পর সমস্যা দেখা দেবার সম্ভাবনা সর্বদাই ছিল, তবে তা অনিবার্য হয়ে দেখা দেয়নি ওই শেষ ইনিংসের আগে।”
এমসিসির নির্বাচক কমিটির চেয়ারম্যান ডগ ইনসোল যে শেষ ইনিংসের ইঙ্গিত করেছেন, তা ডি’অলিভিয়েরা খেলেছিলেন এই ওভাল টেস্টেই। ৩২৫ বল স্থায়ী ১৫৮ রানের ইনিংসটি তো শুধুই আরেকটি ইনিংস নয়, ডি’অলিভিয়েরার প্রতিপক্ষ শুধু অস্ট্রেলিয়ান বোলাররাই ছিলেন না। প্রতিটি রান তিনি যেন করছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার ভয়ংকর বর্ণবাদী আইনের বিরুদ্ধে, দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের বিরুদ্ধে, এমনকি এমসিসিরও বিপক্ষে।
এই রান করবার কাজটি যে সুচারুরূপে সম্পাদিত হয়েছিল, তার জন্যে অস্ট্রেলিয়ার ব্যারি জার্মান নিশ্চয়ই বাড়তি এক ধন্যবাদ পেয়েছিলেন ডি’অলিভিয়েরার কাছ থেকে। উইকেটের পেছনে তিনি বিশ্বস্ত ছিলেন বরাবরই, অস্ট্রেলিয়ার সর্বকাল সেরা উইকেটরক্ষক তিনিই কি না, সেটাও তর্কযোগ্য। সেদিন যেন কী হয়েছিল তার, ডি’অলিভিয়েরা জীবন পেয়েছিলেন তার হাতে। সোয়ান্টন যে মিসকে বলেছিলেন ‘The most fateful drop in cricket history’।
ডি’অলিভিয়েরার রান তখন ৩১। এই ক্যাচ মিস না হলে তো এরপরে আরও তিনবার ডি’অলিভিয়েরার ক্যাচ মিস হয় না, ডি’অলিভিয়েরার নামের পাশে আরও ১২৭ যোগ হয় না, ম্যাচের অন্তিমলগ্নে ডি’অলিভিয়েরার পাওয়া এক উইকেট কোনো প্রভাব ফেলে না। প্রথম টেস্টের পরে ডি’অলিভিয়েরাকে দল থেকে বাদ দিয়ে যে চিত্রনাট্য সাজিয়ে এনেছিলেন এমসিসি কর্তারা, তাতেও নতুন মোড় আসে না।
২১ চারের ওই শতক ক্রিকেটের মাহাত্ম্য ছাপিয়ে গিয়েছিল দিবালোকের মতো এত স্পষ্টরূপেই যে, শতকে পৌঁছানোর পর সে ম্যাচের আম্পায়ার চার্লি ইলিয়ট ডি’অলিভিয়েরাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন,
“Oh Christ, you’ve put the cat amongst the pigeons now.”
***
ওভাল টেস্ট যেদিন শেষ হয়েছিল, সেই ২৭ আগস্টের রাতেই দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের দল নির্বাচনী সভায় বসেছিলেন এমসিসির নির্বাচকেরা। ছয় ঘণ্টা স্থায়ী সে মিটিং শেষ হয়েছিল পরদিন রাত দুটোয়। অত্যন্ত গোপনীয় সে সভায় নির্বাচকদের বাইরেও উপস্থিত ছিলেন কমপক্ষে আরও পাঁচ এমসিসি সদস্য। ডি’অলিভিয়েরা পরবর্তীতে জানিয়েছিলেন, খেলা শেষে বৈঠকে ঢুকবার পূর্বে কাউড্রে তাকে আশ্বস্ত করেছিলেন এই বলে,
“আমি তোমাকে (ডি’অলিভিয়েরাকে) দক্ষিণ আফ্রিকায় চাই। যদি ভেতরে কেউ আমাকে জিজ্ঞাসা করে, দক্ষিণ আফ্রিকায় তোমাকে নিয়ে কোনো সমস্যা হলে আমি তা মোকাবিলা করতে প্রস্তুত কি না, আমি ‘হ্যা’-সূচক জবাবই দেব।”
অথচ, ভেতরে ঘটেছিল সম্পূর্ণ বিপরীত ঘটনা। সেদিন বিকেলেই ম্যাচের মোড় ঘোরানো বোলিং করলেও দক্ষিণ আফ্রিকার পিচে ডি’অলিভিয়েরা কার্যকর হবেন না, এই যুক্তি দিয়েছিলেন কাউড্রে। উপস্থিত সদস্যদের ভেতরে এক ডন কেনইয়নই ভোট দিয়েছিলেন ডি’অলিভিয়েরার পক্ষে, গণতান্ত্রিক এমসিসি স্বভাবতই তাই ২৮ আগস্ট ঘোষিত ১৬ জনের স্কোয়াডে ডি’অলিভিয়েরাকে ঠাঁই দেয়নি।
তবে ঘোষিত এ স্কোয়াড যে আদ্যোপান্ত পারফরম্যান্স আর যোগ্যতার ভিত্তিতে নির্বাচন করা হয়েছিল, এমন দাবি খুব সম্ভবত সেদিন বৈঠকে উপস্থিত মানুষগুলোর কেউই করতে পারবেন না। যে টিয়েনি উস্থুইজেন ডি’অলিভিয়েরাকে চাকরির প্রস্তাব করেছিলেন, ওভালে ডি’অলিভিয়েরার শতকের পরে হন্তদন্ত হয়ে তিনি যোগাযোগ করতে চেয়েছিলেন লর্ডসে। এমসিসিতে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হয়ে তিনি টেলিফোন করেছিলেন সারে সচিব জিওফ্রি হাওয়ার্ডকে।
‘(এমসিসি)নির্বাচকদের জানিয়ে দিন, আজকের সেঞ্চুরিয়ানকে দলে নেয়া হলে (দক্ষিণ আফ্রিকা) সফর হচ্ছে না।’
উস্থুইজেনের কথার সারমর্ম ছিল এমনই। নতুন কিছু অবশ্যই না, এমন হুমকি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে প্রতিনিয়তই ভেসে আসছিল এমসিসির জানালায়।
এ খবর জানাজানি হবার পর প্রতিক্রিয়া হয়েছিল দু’রকম। স্যার ল্যারি কন্সট্যান্টাইন এই সিলেকশনকে বলেছিলেন ‘হাইলি সাসপিশাস’, দক্ষিণ আফ্রিকায় এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আয়োজিত হয়েছিল র্যালিযাত্রা (এবং অবশ্যম্ভাবীভাবে এই র্যালিতে বাধ সেধেছিল আফ্রিকান ন্যাশনাল পার্টি)। গার্ডিয়ানের মতো পত্রিকাগুলো লিখেছিল, ‘anyone who would swallow that would believe the moon was a current bun.’
বিপরীতে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারিমহলে এ খবর বয়ে এনেছিল স্বস্তির তাজা বাতাস, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রধানমন্ত্রী স্বপ্রণোদিত হয়ে আর্থার কয়কে টেলিফোন করে জানিয়েছিলেন কৃতজ্ঞতা। এ খবর উস্টারশায়ার কাউন্টি দলের কাছে পৌঁছেছিল রেডিও ধারাভাষ্যকার ব্রায়ান জনসনের মাধ্যমে, ডি’অলিভিয়েরা তখন মাত্রই আরও একটি সেঞ্চুরি করে ফিরেছিলেন সাজঘরে।
***
এরই মাঝে সেপ্টেম্বরের ৯ তারিখে ঘটনায় নতুন মোড় এনে দিয়েছিল ‘নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড’। তারা জানিয়েছিল, বাসিল ডি’অলিভিয়েরা দক্ষিণ আফ্রিকায় যাবেন তাদের হয়ে সিরিজ কাভার করতে। দক্ষিণ আফ্রিকা প্রতিবাদ জানিয়েছিল এরও, নিজেদের পৃথকীকরণ আইনের প্রতি একে তারা দেখেছিল স্পষ্ট আঘাত রূপে। যতই সাংবাদিক পরিচয়ে আসুন না কেন, দক্ষিণ আফ্রিকায় তাকে মেনে চলতে হবে কালোদের জন্যে নির্ধারিত আইনই, এমনকি মাঠের ভেতরেও মানতে হবে ‘গ্রুপ এরিয়া অ্যাক্ট’, জানিয়ে দিয়েছিল তা-ও। সব দেখেশুনে ডি’অলিভিয়েরাকে যখন প্রশ্ন করা হয়েছিল, এত কায়দা-কানুন মেনে চলতে পারবেন সে দেশে গিয়ে, মুচকি হেসে তিনি জবাব করেছিলেন, তার জন্ম আর বেড়ে ওঠা ওই দেশেই।
১২ সেপ্টেম্বর এমসিসির কাছে বেনামি এক চিঠি এসে শঙ্কা বাড়িয়েছিল আরও। ডি’অলিভিয়েরাবিহীন বিমান বোমা মেরে উড়িয়ে দেবার হুমকি ছিল তাতে। এর চারদিন বাদে টম কার্টরাইট নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন স্কোয়াড থেকে, অন্য কোনো পছন্দসই বিকল্প না থাকায় ডি’অলিভিয়েরার সুযোগ মিলেছিল আবারও। সেবারের ইংলিশ গ্রীষ্মের দ্বিতীয়ভাগের পুরোটা জুড়েই বয়ে চলেছিলেন কাঁধের চোট, কার্টরাইটের সিদ্ধান্ত তাই যৌক্তিকই ছিল। তবে চতুর্দিকে নানামুখী তর্কবিতর্কের ওই সময়ে এমন সরল সিদ্ধান্ত বিশ্বাস করতে কারই বা দায় পড়েছিল!
পরদিনই দেয়া বক্তব্যে ভোরস্টার এমসিসির নেয়া এই সিদ্ধান্তের বিপরীতে ক্ষোভ জানিয়েছিলেন স্পষ্ট। এমসিসির নবনির্বাচিত দলটি এমসিসির বাছাই করা নয়, বরং এটি পাঠানো হচ্ছে পৃথকীকরণ আইনবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে, ভোরস্টারের কথার সার ছিল এমনই। এতদিন পর্যন্ত নিজেদের অবস্থান বেশ দুর্বল হলেও এবারে বেশ শক্ত জবাব পাঠিয়েছিল এমসিসি। সেদিনই পাঠানো পাল্টা বিবৃতিতে এমসিসি জানিয়ে দিয়েছিল, যদি এমসিসির দল দক্ষিণ আফ্রিকার পছন্দ না হয়, তবে সফর বাতিল করতেও আপত্তি নেই তাদের।
গল্পের বাকি অংশটুকু অতি সংক্ষিপ্ত। দক্ষিণ আফ্রিকান সংবাদমাধ্যমগুলোও এ পরিস্থিতিতে এসে সতর্ক করবার চেষ্টা করেছিল সরকারকে। কেননা, সেবার ইংল্যান্ড সফর বাতিল করলে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াজগৎ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা দূরে সরে যেত প্রায় পুরোপুরি। তবে এত সব সতর্কবার্তাও দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারকে টলাতে পারেনি তাদের বর্ণবাদী অবস্থান থেকে। এমনকি ভারত আর পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড স্ব-স্ব দেশে সিরিজ আয়োজনের প্রস্তাব দিলেও ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিল সে প্রস্তাব। বরং সেপ্টেম্বরের ২৩ তারিখে ভোরস্টারের কণ্ঠে আরও একবার উচ্চারিত হয়েছিল নিজেদের সিদ্ধান্তে অকাট্য থাকবার বার্তা। সিরিজ বাতিলের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ২৪ সেপ্টেম্বর এলেও তার আগেরদিনই বোঝা গিয়েছিল, এ সফর আর হচ্ছে না।
বাসিল ডি’অলিভিয়েরার মাঠের বাইরের লড়াইটিও শেষ হয়েছিল এমনই করে। এরপর যে চার বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছিলেন, সেখানে মুখোমুখি হতে হয়নি তেমন কোনো বৈষম্যের। সেই যে তার কারণে ইংল্যান্ডের দক্ষিণ আফ্রিকা সফর বাতিল হয়েছিল, এরপর ইংল্যান্ড আর দক্ষিণ আফ্রিকামুখো হয়নি পরের ২৭ বছরেও। যদিও ১৯৭০ সালে ইংল্যান্ডে দক্ষিণ আফ্রিকাকে আতিথ্য দেবার সর্বোচ্চ চেষ্টাই এমসিসি করেছিল।
ওই চেষ্টা কেন সফল হয়নি, উল্টো দক্ষিণ আফ্রিকা হয়েছিল ক্রিকেট থেকে নির্বাসিত, সে গল্প অন্য একদিনের জন্যেই তোলা রইলো।