মাত্র ছ’মাস পূর্বেও আমাদের এই পৃথিবী ছিল ব্যস্ত ও প্রাণচঞ্চল। প্রতিদিনের সকাল শুরু হতো ব্যস্ততা দিয়ে। এমন জীবনে অভ্যস্ত আমরা তখন পর্যন্ত ভাবতেও পারিনি সামনের দিনগুলোতে কী হতে যাচ্ছে। কোভিড-১৯ এর আক্রমণে শতাব্দীর অন্যতম ভয়াবহ এ দুর্যোগে পুরো পৃথিবী জুড়ে কোটি কোটি মানুষ গৃহবন্দী জীবনযাপন করছে। এই ভাইরাসের আকস্মিক প্রকোপের কারণে দীর্ঘ সময় ধরে বন্ধ হয়ে আছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সীমিত আকারে চালু রয়েছে অন্য সকল কর্মক্ষেত্র।
লকডাউনের দীর্ঘ ও বন্দিদশায় সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশের মতো মধ্যম আয়ের দেশের বার্ষিক আয়ের অন্যতম বৃহৎ খাত হলো অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারের ব্যবসা। করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ পড়ে ছিল এ দেশের অধিকাংশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বর্তমানে ধীরে ধীরে আবার ব্যবসাক্ষেত্র চালু হলেও লকডাউনের বন্দিদশার কারণে ক্রেতাদের কেনাকাটা করতে আসার হার বেশ কমে গিয়েছে। যার ফলে নতুন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান চালু হওয়া তো দূরের কথা, বর্তমানের অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানই হুমকির মুখে পড়েছে।
বাজারের এ স্থবিরতা ও অচলাতনয়ের মাঝে অনলাইন বিজনেস হতে পারে উত্তরণের সময়োপযোগী একটি উপায়। বাংলাদেশের মানুষ ইতোপূর্বে অনলাইন বিজনেসের সাথে একদমই পরিচিত ছিল না তা কিন্তু নয়, তবে করোনাভাইরাসকালীন সময়ে অনলাইন বিজনেস যেভাবে ব্যবসায়ী ও ক্রেতা, উভয়পক্ষের কাছেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, তাতে বলা যায় যে বন্ধের মুখে পড়ে যাওয়া ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনরায় বাজারে ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি স্বল্প বিনিয়োগে নতুন নতুন উদ্বোক্তা তৈরি করার একটি অপার সম্ভাবনাময় দ্বার এই অনলাইন বিজনেস।
বাংলাদেশে অনলাইন বিজনেস শুরু হয়েছে খুব বেশিদিন হয়নি। এই শতাব্দীর প্রথম শতকে বাংলাদেশের মানুষ ইন্টারনেটের সাথে ব্যাপকহারে পরিচিত হয় এবং তার সহজলভ্যতাও বেড়ে যায়। বিগত দশ বছরে বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান তাদের অফিশিয়াল আউটলেটের পাশাপাশি অনলাইনে প্রোডাক্ট অর্ডার করা বা হোম ডেলিভারির মতো অনলাইন নির্ভর কার্যক্রম শুরু করেছে। এর পাশাপাশি বেশ কিছু স্বতন্ত্র অনলাইন ব্যবসাও গড়ে উঠেছে এ সময়ে। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে ক্ষুদ্র পর্যায়ের উদ্যোক্তাদের মাঝে বেশ জনপ্রিয় হচ্ছে অনলাইন বিজনেস।
অনলাইন বিজনেস শুরু করার পূর্বেই আপনার কিছু ধারণা পরিষ্কার থাকা প্রয়োজন। সর্বপ্রথম আপনার জানা থাকতে হবে আপনি অনলাইন বিজনেস কেনই বা করতে চান? লকডাউনে বাড়তি আয়ের উদ্দেশ্যে নাকি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনায়। কারণ আপনার লক্ষ্যের উপরে ভিত্তি করেই সাজাতে হবে সম্পুর্ণ পরিকল্পনা। পাশাপাশি, আপনি কতখানি বিনিয়োগ করতে সক্ষম তার উপরেও অনেক কিছুই নির্ভর করে। অনলাইন বিজনেসে মূলত অনেক সময় দিতে হয়। অনলাইনে নিজের বিজনেসের প্রচারণা, ক্রেতার অর্ডার নেওয়া, যথাসময়ে ডেলিভারি ইত্যাদি ঝক্কির কথা মাথায় রেখেই ব্যবসা শুরু করতে হবে। তাছাড়াও পরিকল্পনা তৈরির সময় ব্যবসার ব্যপ্তি, যোগান ইত্যাদি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে নেওয়া ভালো। সেক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বিনিয়োগ বা লোকবলসংক্রান্ত জটিলতায় সম্মুখীন হতে হবে না।
ব্যবসায় নামার পূর্বে অভিজ্ঞ কারোর সাথে যোগাযোগ করে নেওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মনে করুন, আপনি অলনলাইনে কসমেটিকসের ব্যবসা করা শুরু করলেন, কিন্তু এ ধরনের প্রোডাক্ট সম্পর্কে আপনার বিশেষ কোনো ধরনের ধারণা নেই। প্রোডাক্ট কোথা থেকে আনলে ভালো হবে, এই প্রোডাক্টের টার্গেট মার্কেট কোথায়, কীভাবে কাস্টমারদের কাছে এই প্রোডাক্টেগুলোর তথ্য পৌছানো সম্ভব, এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সম্পর্কে ধারণা না রাখলে বিনিয়োগসমেত পুরো ব্যবসাই লাটে উঠার ঝুঁকি থেকে যায়। তাছাড়াও বিভিন্ন ব্যবসায়িক জটিলতা, ম্যানেজমেন্ট, কমিউনিকেশন ইত্যাদি কীভাবে সহজে ও কার্যকরভাবে করা সম্ভব সে সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দেয়ার জন্যও একজন অভিজ্ঞ কাউকে প্রয়োজন। সুতরাং হুট করে ব্যবসায় নেমে পড়লেই হবে না, অনলাইন বিজনেসে অভিজ্ঞ এমন কারোর থেকে নিয়মিত নির্দেশনাও গ্রহণ করতে হবে।
নির্দেশনা অর্জনের পাশাপাশি কিছু কাগুজে দক্ষতা অর্জন ব্যবসা সম্পর্কে ধারণা পরিষ্কার রাখতে সহায়তা করে। অনলাইন বিজনেসে নামায় পুর্বে চাইলে অনলাইনে কিছু বিজনেস স্ট্র্যাটেজির ওপর কোর্স করে ফেলতে পারেন। বর্তমানে কোর্সেরা, ইউডেমিসহ বড় বড় সব অনলাইন কোর্স প্ল্যাটফর্মগুলিতে বিজনেস স্ট্রাকচার, বিজনেস মডেল ক্যানভাস, মানি ফ্লো, সাপ্লাই চেইনের মতো বেসিক কিছু বিজনেস কোর্স ফ্রি তে করা যাচ্ছে।
এবারে আসা যাক মূল পরিকল্পনায়। সর্বপ্রথম আপনাকে যা করতে হবে তা হলো পণ্য বা সেবা নির্বাচন করা। আপনি কী ধরনের পণ্য বা সেবা দিতে চাচ্ছেন, আপনার গ্রাহক কারা হবে, বাজারে আপনার পণ্য বা সেবার চাহিদা কতটুকু এসব বিষয় নির্দিষ্ট করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন মার্কেট এনালাইসিস। বর্তমানে কোন ধরনের পণ্যের চাহিদা কেমন, আর কারা কারা অনলাইনে একই ধরনের সেবা প্রদান করছে, প্রতিযোগীদের থেকে আপনি কোন কোন দিক থেকে বাড়তি সুবিধাজনক অবস্থায় থাকবেন ইত্যাদি যাবতীয় প্ল্যান সেরে ফেলে সে অনুযায়ী আপনার মার্কেটিং পলিসি নির্ধারণ করতে হবে। মার্কেটিং পলিসি ভেবে ফেলার পরে এবারে প্রয়োজন তার একটি লিখিত আকার। অনলাইনে যারা ব্যবসা করে তাদের সকলেই এ ধরনের লিখিত আকারে রাখেন এমনটি নয়, কিন্তু আপনি যদি অদূর ভবিষ্যতে আপনার ব্যবসাকে বড় করতে চান তবে সেক্ষেত্রে এ ধরনের পূর্ব পরিকল্পনা ও বিজনেস স্ট্রাটেজিগুলো লিখিত আকারে থাকলেই ভালো হয়। পাশাপাশি প্ল্যান করে ফেলার পরপরই চাইলে আপনার কোম্পানির নামে একটি ফেসবুক পেজ, কন্টাক্ট পেজ, ফেসবুক গ্রুপ, ইউটিউব চ্যানেল ইত্যাদি খুলে ফেলতে পারেন। তাহলে আপনি পুরোদমে ব্যবসা শুরু করার আগেই আপনার উদ্যোগটি সম্পর্কে আপনার আশেপাশের মানুষজন জানতে পারবে।
আপনি যদি মোটামুটি ভালো অংকের বিনিয়োগ নিয়ে বেশ বড় আকারে বিজনেস প্ল্যাটফর্ম খুলতে চান তবে সেক্ষেত্রে আপনার প্রতিষ্ঠানটিকে রেজিস্ট্রেশন করিয়ে নিতে হবে। সাধারণত ব্যক্তি পর্যায়ের এ ধরনের উদ্যোগের জন্যে রেজিস্ট্রেশন ফ্রি-তেই করা যায়। এবারে পূর্ণ উদ্দমে কাজে নামার পালা! যেহেতু অনলাইন বিজনেস, তাই শুধুমাত্র ফেসবুক কেন্দ্রিক প্রচার প্রচারণা না করে চেষ্টা করুন একটি ওয়েবসাইট খুলে ফেলার। এমন একটি ওয়েবসাইট তৈরি করুন যেন আপনার বিজনেসকে খুব সুন্দরভাবে ক্রেতার নিকট উপস্থাপন করা যায়। ওয়েবসাইট ডিজাইন, লোগো তৈরি, সিকিউরিটি চেক, আপডেট ও ব্যাক আপ ইত্যাদি কাজের জন্যে একজন হোস্ট রেখে দিতে পারলে ভালো হয়। এ ধরনের ওয়য়েবসাইট পরিচালনা করার জন্যে কিছুটা আর্থিক লগ্নির প্রয়োজন হলেও, প্রচারণা ও স্বচ্ছন্দভাবে অনলাইনে বিজনেস চালানোর ক্ষেত্রে এ ধরনের ওয়েবসাইট খুবই কার্যকরী।
ওয়েবসাইটটি তৈরি হয়ে যাবার পর আপনি আপনার পণ্যের বিবরণ, দাম, যোগাযোগের উপায় ইত্যাদি বিস্তারিত সহকারে আপনার ওয়েবসাইটে আপডেট দিতে পারবেন। প্রচার প্রচারণার জন্যে আগে থেকে খুলে রাখা ফেবসুক পেইজ বা গ্রুপকেও ব্যবহার করতে পারেন। পাশাপাশি নিয়মিত কন্টেন্ট আপলোড, ভিডিও তৈরি, ডিজিটাল ডিজাইন বা রিভিউয়ের মাধ্যমে আপনি অনলাইনে গ্রাহকদেরকে আকৃষ্ট করতে পারেন। বর্তমানে বিভিন্ন অনলাইন প্রতিযোগীতা, রিভিউ প্রতিযোগীতা বা বন্ধুদের যুক্ত করার প্রতিযোগীতার বিনিময়ে অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলিতে অনেক অনেক মানুষকে সংযুক্ত করা যাচ্ছে। মনে রাখতে হবে, প্রচারেই প্রসার। তাই শুরুর দিকে ক্রেতাদের সেবা প্রদানের পাশাপাশি আর অধিক ক্রেতাকে একই প্ল্যাটফর্মে সংযুক্ত করার চেষ্টাও চালিয়ে যেতে হবে।
তবে শুধু বিনিয়োগ ও পণ্য বিক্রির মধ্যেই অনলাইন বিজনেস সীমাবদ্ধ নয়। ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে এর পাশাপাশি আরো অনেক কিছুই মেনে চলতে হয়। গ্রাহকদের অর্ডার ঠিকঠাকভাবে গ্রহণ করা, সময়মতো পণ্য বা সেবা পৌঁছে দেওয়া, তাদের কোনো সমস্যা থাকলে তা সমাধান করে দেওয়া ইত্যাদি যাবতীয় দায়িত্বও অনলাইন বিজনেস করতে গেল মাথায় রাখতে হয়। অন্যথায় ক্রেতাদের বাজে রিভিউয়ের কারণে আপনার ব্যবসার ক্ষতি তো হবেই, উপরন্তু আইনি জটিলতার মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনাও থেকে যায়।
অন্য সকল ব্যবসার তুলনায় অনলাইন বিজনেসের বিশেষত্ব হচ্ছে, এ ধরনের ব্যবসা অত্যন্ত কম বিনিয়োগে ও বিশেষ পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই করতে পারা সম্ভব। আর যে কারণে কোয়ারেন্টিনের এই গৃহবন্দিদশায় বেশ বৃহৎ আকারেই বেড়ে উঠছে দেশের অনলাইন বিজনেস। ঘরে বসে অযথা সময় নষ্ট না করে তাই শুরু করতে পারেন অনলাইন বিজনেস। অভিজ্ঞতা অর্জনের পাশাপাশি বাড়তি আয়ের সুযোগ হলে মন্দ কী তাতে? বলা যায় না, আপনার এ ক্ষুদ্র উদ্যোগ থেকেই হয়তো আগামীতে গড়ে উঠবে দেশের সর্ববৃহৎ অনলাইন বিজনেস প্ল্যাটফর্ম।