কিছুদিন আগে তিনি বলেছিলেন,
আর দুটো স্ক্রিপ্টের কাজ বাকি। তারপরই সিনেমা থেকে অবসরে যাব।
সিনেমাকে ‘যুদ্ধক্ষেত্র’র মতো দেখা ফরাসি-সুইস চলচ্চিত্র নির্মাতা জঁ-লুক গদার যে চিরতরেই অবসরে চলে গেলেন। এমন এক নশ্বর অবসরে, যেখানে অগণিত ভক্তরা তাকে খুঁজে ফিরবেন নক্ষত্রের সারিতে। অজস্র সীমাবদ্ধতা, বাধা-বিপত্তির রকমফেরেও কোনো এক তরুণ স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা একটা ভালো শট নেওয়ার পর স্মরণ করছেন তাকে, হয়তোবা সেটাও দেখতে পাবেন। তারপর হয়তো গ্রিফিথ, কিয়ারোস্তামিদের নিয়ে সেই পরিচিত স্বগোতক্তি বলে বেড়াবেন,
কখনো কখনো বাস্তবতাও ভীষণ জটিল হয়ে পড়ে, গল্প সে জটিলতাকে তুলে আনে।
গদারের এখন অফুরন্ত অবসর।
৩ ডিসেম্বর, ১৯৩০ এ জন্মগ্রহণ করেন। পড়া শুরু করেছিলেন গণিত নিয়ে। সিনেমার নেশা তাকে নিয়ে যায় গণিত থেকে বহুদূরে। পাবলিক পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হয়ে গণিতে যাত্রা ছাড়েন। এথনোলজি নিয়ে পড়া শুরু করেন। মাত্র উনিশ বছর বয়সেই যাত্রা শুরু করেন ফিল্ম ক্রিটিক হিসেবে। যেভাবে এগিয়ে গিয়েছিলেন ফ্রঁসোয়া ত্রুফো, এরিক রোমের, ক্লদ শেব্রলরা। সেখান থেকে বয়স ত্রিশের ঘরে গেলে সিনেমা বানালেন, নাম ‘ব্রেথলেস’। ষাটের দশকের নিউ ওয়েভ ধারণাকে সবচেয়ে পরিপূর্ণ আর পরিপাটি রুপ দিল যে সিনেমা।
‘ব্রেথলেস’ এ কী ছিল? একজন কেয়ারলেস চোর প্রেমিক, যে কিনা চুরিকৃত গাড়িচাপা দিয়ে এক পুলিশকে হত্যা করে। তারপর পালিয়ে প্যারিসে তার প্রেমিকার কাছে হাজির হয়। সাংবাদিক প্রেমিকা ইতালি পালিয়ে যাওয়ার জন্য টাকা জোগাড়ের সময়ে জানতে পারে, তার প্রেমিক খুব দ্রুতই পুলিশের হাতে পড়তে যাচ্ছে। প্রেমিকা এবার প্রশ্ন করতে থাকে তাদের সম্পর্ক, তাতে মধ্যকার বিশ্বস্ততা সবকিছু নিয়েই। শেষে এই সিনেমা এগোয় এক করুণ বিশ্বাসঘাতকতার দিকে। এমন গল্প হয়তো সেকালেও নতুন ছিল না। তবুও এই সিনেমা নিউ ওয়েভের সবচেয়ে বড় প্রতিনিধি। একটি ছবিতে সংলাপগুলো অগোছালো, অনেকে কথা বলছে তবে শোনাই যাচ্ছে না, চরিত্রগুলো দেখে বোঝার উপায় নেই তারা ঠিক কী করতে চাইছে, যেন ইচ্ছে করেই ভুল এডিট করা হয়েছে। দর্শক বিভ্রান্ত হোক- তাই যেন চেয়েছিলেন গদার। বলেছিলেন, জীবন নিয়ে কনফিউশনে থাকেন তিনি।
গদারের ‘ব্রেথলেস’ সিনেমা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তোলে। বাস্তবে আপনি কি সত্যিই একটি জনাকীর্ণ ক্যাফেতে বসা সব মানুষের আলাপ শুনতে পান? আপনি কি অনুভব করেন, হঠাৎ পথে দুর্ঘটনা হলে তার পর আহতদের কী হয়? হলিউড যে গল্প বলাকে ‘বাস্তব কিংবা তার কাছাকাছি’ বলে তখনও চালিয়ে যাচ্ছিল, গদার সেই ষাটের দশকে এসে দেখিয়ে দেন, সে ধরনের ‘রিয়েলিটি’র অস্তিত্বই নেই। গদারের প্রয়াণে নিউইয়র্ক টাইমসের শোকবার্তা থেকেই দেখি,
“Breathless” is an artistic hybrid that seemed to capture the discontinuities and conflicts of modern life, half in the artificial public world created by the media and half in the deepest recesses of consciousness. In Mr. Godard’s later, more radical phase, he came to suggest that there was no real distinction between the two realms.
ফিল্ম ক্রিটিক তিনি একাই ছিলেন না। আরও অনেকেই ছিলেন। কিন্তু গদার এসে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। তিনি ও তার সমসাময়িক ফিল্ম ক্রিটিকদের প্রভাবশালী ম্যাগাজিন ‘কাইয়ে দ্যু সিনেমা’ই প্রথম থিওরি দাঁড় করায় যে, একজন পরিচালক একইসাথে ওই সিনেমার লেখকও হতে পারেন; যেভাবে একজন লেখক উপন্যাস লিখতে পারেন। নিউ ওয়েভ ডিরেক্টর তিনি একাই ছিলেন না। কিন্তু প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে কেবল একটা সেটকে কেন্দ্র করে হ্যান্ডহেল্ড ক্যামেরার ব্যবহার, ন্যাচারাল লাইটিং, প্রকৃত দৃশ্যকে ধারণ করা, স্টুডিওর বাইরে এসে সেট নির্মাণ, ল্যাপেলে ন্যাচারাল সাউন্ড নেওয়া- এসবকিছু যেন সিনেমার হলিউডি গ্রামারকে একত্রে ‘নাই’ করে দিয়েছিল। তাতেই তিনি নিউ ওয়েভের প্রধান পথিকৃতের আসনে বসে যান। ব্যাকরণশৈলী আয়ত্ত্ব করে ভাষায় পারদর্শী হয়ে উঠার রেওয়াজের বাইরে এসে গদার যেন বলে বসলেন, মুখের ভাষাটাই সিনেমা। তৎকালীন বিখ্যাত ফিল্ম ক্রিটিক রজার ইবার্ট ২০০৩ সালে ব্রেথলেস-এর রিভিউ লিখতে গিয়ে শিরোনাম দেন, ‘Modern Movies Begin Here’। তিনি দাবিও করেন, ১৯৪২ সালের ‘সিটিজেন কেইন’-এর পর আর কোনো অভিষেক সিনেমা এতটা প্রভাবশালী হিসেবে হাজির হয়নি।
সিনেমার ভেতর তিনি জীবনকে খুঁজেছেন। সেই খোঁজার ভেতরে গিয়ে তিনি সবসময়ই দেখতে পেয়েছেন, জীবন বেশ বড়। কিন্তু সিনেমা তার চেয়েও বড়। ভয় পেতেন সিনেমার মৃত্যু ঘটতে যাচ্ছে চিন্তা করে। তাই নিত্যনতুন শৈলী আর এক্সপেরিমেন্ট দিয়ে সিনেমাকে জীবন্ত করে রাখার একটা লড়াই চালিয়ে গেছেন সত্তর বছর ধরে। গদারের কাছে সিনেমার চেয়ে বড় কিছু ছিল না জীবনে। এক তৃষ্ণার্থ চাতকের মতনই কখনো চিত্রনাট্যকার, কখনো পরিচালক, কখনো সমালোচক হিসেবে ছুটে বেড়িয়েছেন সিনেমা নামক কাঁটাতারবিহীন এক নিজের রাজ্যে। যেখানে হলিউডি প্রভাব চলতো না, যেখানে ফ্রেঞ্চ স্টিল ক্যামেরার স্টাইল বিশেষ বিবেচনা পেত না, যেখানে বাজেটের ছড়াছড়ি কিংবা এস্টাবলিশমেন্টের ছায়া নেই। কেবল মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়ে বেড়ানো, মানুষের জীবনকে দেখতে থাকা উপর থেকে।
দেখাতে চেয়েছেন সিনেমার চোখে নিজের জীবনের গল্পও। মার্ক টোয়েনের বই চুরির কথা আমরা শুনেছি। সিনেমা দেখতে, সিনেমা বানাতে, সিনেমা বানানো নিজের বন্ধুদের সাহায্য করতে জঁ-লুক গদার টাকা চুরিও করেছেন। তাকে সিনেমা থেকে সরাতে যখন পরিবার ভরণপোষণ বন্ধ করে দেয়, তখন মায়ের কাছ থেকে চুরি করা শুরু করেন। একটা চাকরিতে ঢুকতে বাধ্য হন, সেখান থেকেও টাকা চুরি করেন সিনেমা বানাবেন বলে। সুইস টেলিভিশনের অফিস থেকে সেই চুরির পর জেলেও যান। নিজেই আবার ছায়া হিসেবে সেই গল্প বলেছেন। বলা হয়ে থাকে ‘ব্যান্ড অব আউটসাইডারস’ সিনেমায় তার স্ত্রী আনা কারিনাকে তার মায়ের মতনই এক চরিত্রে অভিনয় করান গদার। প্রত্যেকটি সিনেমায়ই করেছেন সাধ্যমতো এক্সপেরিমেন্ট। সিনেমার একাডেমিক জগতে ঘটিয়েছেন একের পর এক নতুন সংযোজন।
এ উইম্যান ইজ আ উইম্যান-এ (১৯৬১) এমন দুটো আলাদা জনরাকে একত্র করেছেন, যা এর আগে কল্পনাও করা যায়নি। সেই সিনেমারই একটা নতুন গতি দিয়েছেন ভিভ্রে স্যা ভি-তে (১৯৬২)। খদ্দের টিকিয়ে রাখতে একজন যৌনকর্মীকে নানান রকম রূপান্তরের ভেতর দিয়ে যাওয়ার মেটাফোর দিয়ে তিনি আঙুল তাক করেছিলেন শিল্প বিপ্লবের পরের পুঁজিবাদের দিকে। নাগরিক জীবনের টানাপোড়েন সেই সময়ে আর কেউ এত গভীরভাবে উত্থিত করে তুলতে পারেননি। উইকেন্ড (১৯৬৭) সিনেমায় উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের দম্পতির গল্প দিয়ে একেকটি স্যাটায়ার, সিম্প্যাথি ফর দ্যা ডেভিল (১৯৬৮) সিনেমার মধ্য দিয়ে স্যাটায়ারিক সেই গদারের পলিটিক্যাল স্টোরিটেলিংয়ের দিকে ঝুঁকে পড়া, এরপর হেইল মেরি (১৯৮৫), কিংবা গুডবাই টু ল্যাংগুয়েজ (২০১৪) অবধি তার সিনেমা নিয়ে এক বীরের যাত্রা অব্যাহত ছিল। সিনেমা বানানোর জন্য তার সবচেয়ে সহজ গাইডলাইন ছিল,
সিনেমা বানানোর জন্য দরকার কেবল একটি মেয়ে আর একটা বন্দুক।
সিনেমাকে এর চেয়ে সহজবোধ্য আর করা যায় কি!
জঁ-লুক গদারের সিনেমার এই রোমাঞ্চকর ভ্রমণের আড়ালে লুকিয়ে যায় তার লেখকসত্ত্বার অস্তিত্ব। গদার অন গদার (তার নিজেকে নিয়ে সমালোচনা), হিস্টরি দ্য সিনেমা (সিনেমার ইতিহাস নিয়ে), ফিউচার অব ফিল্ম (সাক্ষাৎকার), লেটার টু জেন এই বইগুলোর প্রত্যেকটিই আলাদা করে আলোচনার দাবি রাখে। গদার সবসময়ই নিজেকে ‘এক্সপেরিমেন্ট’ এর অংশ হিসেবে ভাবতে চাইতেন। কিন্তু একটা সময়ে এসে, তার প্রভাবশালীর পোশাক পরে থাকাটাকে কিছুটা ‘সেল্ফ অবসেশন’ বলে মনে করতেন অনেক সমালোচকই। ইংমার বার্গম্যান দাবি করতেন, গদার আসলে সিনেমা বানাতেনই সমালোচকদের খুশি করার জন্য৷ তার সিনেমায় দর্শকমন অনুপস্থিত থাকত এবং সমালোচকদের সন্তুষ্ট করার ‘সেল্ফ অবসেশনে’ বাকি জীবন পার করছিলেন তিনি। একথা অস্বীকার করা যায় না, তিনি সবসময়ই একটা ‘অভিজাত’ অবস্থান থেকেই সিনেমা বানানোর এবং বোঝার চেষ্টা করতেন। সেটা করতে গিয়ে বারবারই তিনি দর্শককে উপেক্ষা করে এসেছেন। দর্শককে উপেক্ষা করলে যে ভালো সিনেমা বানানো যায় না, তেমনটা নয় অবশ্য।
তবুও, সমালোচনা কিংবা আলোচনা বাদ দিয়ে, কেবল একটা প্রবল অস্থিরতার ভেতর দিয়ে জীবনের প্রতিটি অধ্যায় কাটানো গদারের জীবনই যেন একটা একাডেমিক গবেষণার বিষয় হতে পারে। ক্রিটিক হিসেবে নিজেকে তৈরি করা একটা মানু্ষ সিনেমা বানানোতে নেমে পড়ছেন, সেই সিনেমাকে আবার প্রতিদিন নতুন নতুন রঙে রাঙিয়ে যাচ্ছেন, জীবনে রাজনীতির প্রভাব যে সেলুলয়েডে দেখানো যায় সেটা প্রমাণ করে যাচ্ছেন, সেক্সুয়াল রিয়েলিটির মধ্য দিয়ে কালচার আর আরবান ইকোনমিকে দেখানোর অদ্ভুত সাহস করছেন, সিনেমা বানানোর যাবতীয় উপাত্তকে একপাশে রেখে অল্প ক’জন ক্রু মেম্বার নিয়ে ক্যামেরা হাতে রাস্তায় নেমে পড়ছেন, একদিকে বলছেন সিনেমার চেয়ে বড় ফ্রড আর কিছু নেই, অপরদিকে ”আই মেইক ফিল্ম টু মেইক মাই টাইম পাস” বুলি আওড়াচ্ছেন; এলাম, দেখলাম, জয় করলাম ধাঁচে ঘোষণা দিয়ে অবসরে যাচ্ছেন সিনেমা থেকে, এমনকি মৃত্যুর সিদ্ধান্তটাও নিচ্ছেন নিজে নিজে, ‘অ্যাসিস্টেড সুইসাইড’ করছেন বেঁচে থাকা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে দেখে- এত এত অস্থিরতা নিয়ে একটা মানুষ জীবন পার করে দিলেন, এ তো এক বিস্ময়!
জীবন নিয়ে গদারের অনুভূতি ছিল একদমই শিশুর মতো। সাবলীল আর সহজ ভঙ্গিমায় জীবনের দৌড়ঝাঁপ নিয়ে কথা বলে গেছেন আজীবন। সেসব শুনে যে কারোরই মনে হবে, এ যেন আপনার উক্তি। এ যেন নিজের মনের কথা, পরিচিত কথা, যা ব্যক্ত না করলেও জীবন চলে যায়। জঁ-লুক গদার তো সেই ব্যক্ত করতে না পারার ট্যাবু ভেঙে যেতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছিলেন। গদার সেই যে সিনেমায় মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের গল্প বলা আরম্ভ করেছিলেন, সেই ন্যারেটিভ থেকেই আজকের রোমান্টিকতা, আজকের অন্য পৃথিবীর সিনেমা বোঝার মেথড, অন্য কারো শিল্পচর্চাকে গুরুত্ব দেওয়ার সংস্কৃতি চালু হয়েছে। সিনেমায় মার্কসবাদের কথা বলা যায় তারই কারণে। সিনেমায় জায়নিজমের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো যায় তারই মাধ্যমে। সিনেমায় অন্যের অধিকারের দাবি তোলা যায় তার শেখানো পথেই। গদার তো চেয়েছিলেন সিনেমায় যেকোনো ধাঁচের গল্প বলতে পারার স্বাচ্ছন্দ্য। ২০২২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করা এই মায়েস্ত্রোর কাজের সেই ধারাকে যদি কখনো কেউ ভুল প্রমাণ করতে এগিয়ে এসে কোনো বাধার সম্মুখীন না হয়, তবেই গদারের এক্সপেরিমেন্টগুলো সফল, তবেই নিউ ওয়েভের হাওয়া বইতে থাকবে। গদার তো বলেছিলেন,
জীবন কেবল সিনেমার একটা অংশ। সিনেমা অনেকগুলো টুকরোর সমষ্টি।
গদারের উক্তির মতো বড় হয়ে উঠুক সিনেমা আমাদের সবার কাছে।