Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

প্রাচীন মিশরীয় ধর্মে নিষিদ্ধ জিনিসসমূহ

পৃথিবীর বহু ধর্মেই সেই ধর্মের অনুসারীদের জন্য নিষিদ্ধ এবং গ্রহণযোগ্য জিনিসের তালিকা বিদ্যমান। যেসব জিনিসকে ওই ধর্মের অনুসারে অকল্যাণকর মনে করা হয়েছে, তা স্থান করে নিয়েছে নিষিদ্ধের তালিকায়। প্রাচীন মিশরীয় সমাজে ধর্মীয়ভাবে বিভিন্ন জিনিস নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু এসব সরঞ্জাম সমাজের সকল শ্রেণির জন্য সবসময় নিষিদ্ধ ছিল, এমনটা ভাবা অসংগত। সময়ভেদে, শ্রেণিভেদে, অঞ্চলভেদে বিভিন্ন জিনিসের গায়ে নিষিদ্ধকরণের পরোয়ানা জারি থাকত। উদাহরণ টেনে বলা যেতে পারে মাছের কথা। খাদ্য হিসেবে মাছ পৃথিবীর প্রায় দেশ ও ধর্মে প্রচলিত রয়েছে। কিন্তু ধর্মীয়ভাবে পরিশুদ্ধ থাকার সময় প্রাচীন মিশরে মাছ খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। তেমনটা প্রযোজ্য ছিল শারীরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও। মন্দিরে প্রবেশ করার পূর্বের কয়েকদিন কোনোপ্রকার শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হওয়া ছিল ধর্মীয় রীতির পরিপন্থী।

প্রাচীন মিশর; Image Source : Ubisoft

নিষিদ্ধ খাবারসমূহ

মাছ

কায়রো পঞ্জিকা অনুসারে, প্রাচীন মিশরে খাবার হিসেবে সবচেয়ে বেশিবার নিষিদ্ধ করা হয়েছে মাছকে। ধর্মীয়ভাবে বিশুদ্ধ থাকার সময় মাছ খাওয়া নিষেধ ছিল। মাছ বেশিরভাগ সময় অপরিচ্ছন্ন অবস্থায় থাকে, মাছ আহারের পর মুখ থেকে গন্ধ আসে- এই ধারণা থেকেই পবিত্রতা বজায় রাখার খাতিরে মাছ খাওয়ার উপর নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নিষেধাজ্ঞা আসে। মিশরীয় দেব-দেবী এবং কিছু পৌরাণিক কিংবদন্তিতে মাছের কথা উঠে এসেছে। মন্দিরে খোদাই করা বিভিন্ন হায়ারোগ্লিফিক্স ইঙ্গিত দেয়, মাছ নিষিদ্ধ খাদ্যের তালিকায় ছিল। সেই তালিকায় মোট ছয় প্রকার নিষিদ্ধ মাছের নাম পাওয়া যায়।

ওসাইরিসের পুরাণে বর্ণিত আছে, দেবতা সেথ ওসাইরিসের জননাঙ্গ কেটে তা নীল নদে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। ওই অঙ্গ লেপিডোটাস, অক্সিরিনচাস, এবং ফ্র‍্যাগাস মাছ মিলে খেয়ে ফেলেছিল। তাই প্রাচীন মিশরীয়রা এই তিন ধরনের মাছ আহার থেকে বিরত থাকত। তবে, ফাইয়ুম অঞ্চলের মানুষ এই নিষেধাজ্ঞার ধার ধারেনি। তাদের পাত্রে অক্সিরিনচাস মাছ ছিল জনপ্রিয় একটি খাদ্য উপাদান। ইতিহাসবিদ হেরোডোটাসের মতে, মাছ ছিল প্রাচীন মিশরীয় ফারাও এবং পুরোহিতদের জন্য নিষিদ্ধ একটি খাদ্য। কারণ, এটি দেবতা সেথের সাথে সম্পৃক্ত ছিল।

লেপিডোটাস মাছের জীবাশ্ম; Image Source : Holzmaden.

মাছ খাওয়া থেকে বিরত থাকার আরেকটি কারণ হতে পারে এর বাসস্থান। মাছ পাওয়া যেত সমুদ্রে, আর মিশরীয় পুরাণ মতে সমুদ্র হচ্ছে বিশৃঙ্খলার জন্মস্থান। স্টেলায় লিপিবদ্ধ করা আছে, ব-দ্বীপের অধিকাংশ রাজপুত্র খতনা না করা এবং তারা মাছ খেতেন বলে, তাদের প্রাসাদে অনেকেই প্রবেশ করতেন না। এই কর্মকাণ্ড ছিল প্রাসাদের জন্য ভীষণ অপমানজনক। এই স্টেলা বর্তমানে কায়রো জাদুঘরে লিপিবদ্ধ আছে। তবে, প্রাচীন মিশরে খাদ্য হিসেবে মাছের জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। মিশর গড়ে উঠেছিল নীল নদের অববাহিকায়। এই নীল নদে তো মাছের প্রাচুর্য ছিলই, সাথে ডেল্টা সাগর এবং নলখাগড়ার সাগর থেকে প্রচুর মাছ আহরণ করা হতো। বাজারে তখন মাংসের চড়া দাম থাকায়, মাংস ছিল দরিদ্রদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাই, তারা ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার মাছ দিয়ে প্রাণীজ আমিষের চাহিদা মেটাত। শৈল্পিক ও সাহিত্য নথি থেকে জানা গেছে, রাজস্ব এবং অর্থ প্রদানের মাধ্যম হিসেবে মাছ ছিল বেশ জনপ্রিয়। দেইর-এল-মদিনাতে প্রাপ্ত এক নথি অনুসারে জানা যায়, রাজ সমাধিকর্মী এবং অন্যান্য কর্মকর্তাদের খাদ্য সরবরাহের জন্য জেলেদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। প্রত্নতত্ত্ববিদেরা মন্দিরের মূল খাদ্য গুদামেও বহু মাছের কাঁটার সন্ধান পেয়েছেন, যা আপাতদৃষ্টিতে প্রমাণ করে পবিত্র স্থানেও মাছ খাওয়া যেত।

মিশরীয় সমাধির দেওয়ালে অঙ্কিত মাছের ছবি; Image Source : World History Encyclopedia.

শূকর

গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডোটাসের বর্ণনা থেকে সর্বপ্রথম জানা যায়, প্রাচীন মিশরে শূকর নিষিদ্ধ ছিল। শূকর নিষিদ্ধ হওয়ার প্রধান কয়েকটি কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, এটি ছিল অপবিত্র, নাপাক, এবং দেবতা সেথের সাথে সম্পৃক্ত। তার ভাষ্যমতে, ভুলবশত কেউ শূকরকে স্পর্শ করলে, পবিত্রতা অর্জনের জন্য তাকে নীল নদে স্নান করতে হতো। তিনি আরও যোগ করেন, শূকর পালকেরা সমাজ থেকে আলাদাভাবে বসবাস করত। তাদেরকে নিম্ন বংশের বলে গণ্য করা হতো, এবং তারা শুধু অন্য শূকর পালকের মেয়ের সাথেই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারত।

মিশরীয় সমাধির দেওয়ালে খোদাই করা শূকরের ছবি; Image Source : World History Encyclopedia.

তবে প্যাপিরাস বলছে অন্য কথা। কোনো কোনো মন্দিরের খাদ্য উৎসর্গের তালিকায় শূকরের মাংসের উল্লেখ পাওয়া যায়। শূকরের মাংস বেশি ভক্ষণ করতে দেখা গেছে সাধারণত দরিদ্র পল্লীতেই। তবে এর পরিমাণ ছিল গরু, খাসি বা ভেড়ার মাংসের চেয়ে কম। মধ্যবর্তী সাম্রাজ্যে অন্যান্য গবাদিপশু পালনের সাথে শূকর পালনেরও প্রমাণ পাওয়া গেছে। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা প্রমাণ করেছেন, প্রাচীন সাম্রাজ্যে এটি ছিল আমিষ জাতীয় খাদ্যের অন্যতম উৎস।

মিশরীয় সমাধির দেওয়ালে অঙ্কিত শূকরের ছবি; Image Source : World History Encyclopedia.

প্রাচীন মিশরীয় বৈদ্যরা শূকরের দাঁত, চোখ, রক্ত, চর্বি, নাড়িভুঁড়ি বিভিন্ন চিকিৎসার কাজে ব্যবহার করতেন। শূকর আকৃতির রঙিন পাথরের ছোট ছোট তাবিজ ও কবচ সৌভাগ্য-বর্ধক হিসেবে ব্যবহার করা হতো। শ্রমিকদের গ্রাম দেইর-এল-মদিনার কসাইখানাতে শূকরের হাড় এবং এর পাশেই শূকরের খামারের সন্ধান মিলেছে। উনিশতম রাজবংশের ফেরাউন দ্বিতীয় রামেসিসের সময়ে লিখিত হ্যারিস প্যাপিরাসে মন্দিরে উৎসর্গীকৃত একটা খাদ্য তালিকা পাওয়া গেছে, যেখানে শূকরের মাংসের উল্লেখ নেই। অষ্টাদশ শতাব্দীর পূর্বে চিকিৎসা সম্বন্ধীয় কোনো প্যাপিরাসে শূকরের উল্লেখ পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয়, শূকর সম্বন্ধে প্রাচীন মিশরে এমন কাহিনি প্রচলিত ছিল যে, জবাই করার সাথে সাথে এটি না খাওয়া হলে পেটের পীড়া হবার সম্ভাবনা থাকে। এজন্যই সম্ভবত শূকর খাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা চলে এসেছে।

দেইর-এল-মদিনা; Image Source : World History Encyclopedia.

কামোদ্দীপক খাবার

কামোত্তেজনার সাথে জড়িত কিছু খাবার প্রাচীন মিশরে কোনো কোনো সময় নিষিদ্ধ ছিল। প্লুটার্কের ভাষ্য থেকে জানা যায়, প্রাচীন মিশরে হয়তো লবণ নিষিদ্ধ ছিল। কারণ, একে তখন কামোদ্দীপক খাবার হিসেবে গণ্য করা হতো। প্লুটার্কের সাথে প্লিনি সুর মিলিয়ে বলেছেন, হেলিওপলিসের মন্দিরে পুরোহিতদের জন্য অ্যালকোহল নিষিদ্ধ ছিল। তার ধারণা হয়তো পুরোপুরি সঠিক নয়। সম্ভবত মন্দিরের পুরোহিতদের পরিমিত অ্যালকোহল পান এবং মন্দিরের পবিত্র জায়গায় অ্যালকোহল পানে নিষেধাজ্ঞা আনার জন্য বলা হয়েছিল। প্রাচীন লেখকদের বর্ণনাতেও সন্ধান মেলে, ফেরাউনদের জন্য দৈনিক অ্যালকোহল পানের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সীমা বেধে দেওয়া ছিল।

সিরীয় একজন বণিককে বিয়ার দিয়ে আপ্যায়ন করাচ্ছেন মিশরীয়রা। নতুন সাম্রাজ্য, ১৮ তম রাজবংশ,
চতুর্থ আমেনহোতেপের সময়; Image Source : Neues Museum, Berlin

অন্যান্য খাবার

মটরশুঁটি প্রাচীন মিশরের অন্যতম প্রধান খাদ্য হলেও, হেরোডোটাস এবং অন্যান্য ঐতিহাসিকদের মতে, পুরোহিতরা মটরশুঁটি খাওয়া থেকে নিজেদের বিরত রাখতেন। তাদের কাছে মটরশুঁটি এবং লেন্টিল খাবার নিষিদ্ধ ছিল এই কারণে যে, সবাই যদি সব ধরনের খাবার খায়, তাহলে মিশরে খাদ্য সংকট দেখা দেবে। কিছু নিষিদ্ধ খাবার ছিল, যেগুলো খেয়ে সমাধিতে যাওয়া যেত না। ধারণানুযায়ী, সেসব নিষিদ্ধ খাবার খেয়ে সমাধিতে প্রবেশ করা মৃতের প্রতি অশ্রদ্ধা জ্ঞাপনের শামিল। যেমন, পিঁয়াজ খেয়ে সমাধিতে প্রবেশ করা যেত না। গ্রেকো-রোমান যুগে এসনার এক মন্দিরে লেখা ছিল, কিছু খাবার (কিছু বিশেষ ধরণের মাছ, শূকরের মাংস, মটরশুঁটি, লবণ, পিঁয়াজ) মন্দিরে প্রবেশ পূর্বে এবং ধর্মীয় উৎসবের চারদিন আগ থেকে বন্ধ করা উচিত।

ঐতিহাসিক প্লিনি; Image Source :Wikimedia Commons.

ঋতুচক্রে নিষিদ্ধ

প্রাচীন মিশরীয়রা মনে করতেন, ঋতুস্রাবের সময় নারীদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তা অমঙ্গল ডেকে আনতে পারে। বিশ্বাস করা হতো, এসময় নারীরা নাপাক এবং অপবিত্র থাকেন। ঋতুস্রাবের মাধ্যমে নারী পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে, এমনটা ভেবে ধর্মীয় ও পবিত্র স্থানে তাদের যাতায়াত নিষিদ্ধ ছিল। তাদেরকে গ্রাম থেকে দূরে কিংবা বাড়ির পেছনে নির্দিষ্ট এক জায়গায় রাখা হতো। ঋতুমতী নারীর স্বামী বা পিতাও অপবিত্র হয়ে যেতেন বলে তখনকার মানুষের ধারণা ছিল। সেসময় ওই স্বামী বা পিতাকে কাজ থেকে ছুটি নিয়ে বাড়িতে থাকতে হতো। দেইর-এল-মদিনাতে প্রাপ্ত এক ‘অনুপস্থিতি তালিকা’ থেকে এই বিষয়ে ধারণা পাওয়া যায়। তখন কিছু শ্রমিককে এই কারণে কাজ থেকে ছুটি দেওয়া হতো। সমাধি, মন্দির, ও প্রাসাদের মতো আনুষ্ঠানিক ভবনে প্রবেশ করতে হলে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হতো।

হেরোডোটাসের ভাষ্যমতে,

পবিত্রতা নিয়ে সজাগ দৃষ্টি ছিল মিশরীয়দের। সদ্য যৌনমিলনের পর পরিশুদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত পুরোহিতদের সমাধি, মন্দির, বা প্রাসাদে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল।

ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পুরোহিতকে কঠোর পবিত্রতা মানতে হতো। যেমন, নখ কাটা, শরীরের সকল স্থানের কেশ কর্তন, ন্যাট্রন দিয়ে হাত ধৌতকরণ, লিনেনের বস্ত্র পরিধান, নিষিদ্ধ খাবার বর্জন ইত্যাদি। তাদের জন্য খতনা করা ছিল অত্যাবশ্যকীয়। তারা পশমের কাপড় পরতে পারত না।

হোরাস বধ করছেন সেথকে। টলেমি সাম্রাজ্য, হোরাসের মন্দির; Image Source : Flickr.

মিশরীয় উপকথায় ইপাগোমেনাল দিনগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মোট পাঁচটি দিন ইপাগোমেনালের দিন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অতিরিক্ত এই পাঁচ দিন দেবতা থোথ সৃষ্টি করেছিলেন দেবতা রা-র অভিশাপ এড়িয়ে ওসাইরিসকে জন্ম দেওয়ার জন্য। এই পাঁচ দিনে যথাক্রমে ওসাইরিস, আইসিস, হোরাস দ্য এল্ডার, সেথ, এবং নেপথিস জন্মগ্রহণ করেন। জনশ্রুতি অনুসারে, এই পাঁচ দিন তারা মারাত্মক সংকটাপন্ন সময়ের মধ্য দিয়ে পার করেছেন। তাই, এই পাঁচ দিনে নতুনভাবে কোনো কাজ আরম্ভ করা বা কাজ চালিয়ে যাওয়াও নিষিদ্ধ ছিল। মিশরের সৌর পঞ্জিকা ছিল ৩৬০ দিনের। বাড়তি এই পাঁচদিন পরবর্তীতে মিশরের সৌর পঞ্জিকায় যুক্ত হয়।

Related Articles