বর্তমান বিশ্বে চীনের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ আমেরিকা– এই কথা নতুন করে বলার কিছু নেই বোধহয়। আবার উল্টোভাবে বললে, আমেরিকারও সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ চীন। অর্থনৈতিক, সামরিক কিংবা রাজনৈতিক– সব দিক থেকেই চীনের যে মহাকাব্যিক উত্থান, সেই উত্থান রুখে দিতে আমেরিকা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই আমেরিকা পরাশক্তি হিসেবে নিজেদের শক্ত অবস্থান পাকাপোক্ত করে আসছিল, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্বে একক দেশ হিসেবে আমেরিকার সাথে পাল্লা দেয়ার মতো কেউ ছিল না। এই শতকের শুরুর দিকে চীনের দুর্দান্ত অর্থনৈতিক উত্থানের পর দেশটির রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে যে পরিকল্পনাগুলো নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, সেগুলো আমেরিকাকে নতুন এক বাস্তবতার সামনে হাজির করেছে। চীন ইতোমধ্যে বৈশ্বিক পরাশক্তি হওয়ার দিকে অনেক পথ পাড়ি দিয়ে ফেলেছে, ওয়াশিংটনের নীতিনির্ধারকদের কপালে ভাঁজ বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ।
বৈশ্বিক পরিমন্ডলে আমেরিকার সমস্ত চোখরাঙানি এবং প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে চীনকে এগিয়ে যেতে তো হচ্ছেই, এর পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও একটি সমস্যা চীনের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চীনের পূর্বাঞ্চলের মোট আয়তনের একটি বড় অংশ মরুময় এলাকা। গোবি মরুভূমির এই অংশে চাষাবাদ অত্যন্ত কঠিন। পানির তীব্র সংকট রয়েছে। ফলে স্বাভাবিক জীবন ধারণও প্রায় অসম্ভবের কাছাকাছি। আরও উদ্বেগজনক পরিস্থিতি হচ্ছে, প্রতিবছর এই মরুভূমির পরিমাণ বাড়ছে। ফলে একসময় ক্রমশ এই অঞ্চলের পুরোটাই মরুভূমি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। একটি দেশের মোট আয়তনের একটি তূলনামূলক বড় অংশ যখন মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার কারণে চাষের অযোগ্য হয়ে পড়বে, তখন জাতীয় অর্থনীতিতে সেটির নেতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য। কারণ, এই ভূমিতে যেসব চাষাবাদ হতো, সেগুলো বন্ধ হয়ে যাবে, চাষাবাদের সাথে জড়িত মানুষেরা বেকারত্ব বরণ করে নেবে। পৃথিবীতে বর্তমানে জনসংখ্যা বাড়ছে, বাড়তি জনসংখ্যার জন্য প্রয়োজন হচ্ছে অতিরিক্ত খাদ্যশস্য। এরকম পরিস্থিতিতে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কমে গিয়ে খাদ্যশস্য উৎপাদনে যে ঘাটতি তৈরি করবে না, সে কথাও জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না।
চীনের পূর্বাঞ্চলের অধিবাসীরা একসময় যেসব জায়গায় পাহাড় কিংবা সবুজ মাঠ দেখতে পেতেন, সেসব জায়গায় বর্তমানে ধু ধু মরুভূমি। অসংখ্য অধিবাসী প্রাকৃতিক মরুকরণের ফলে বর্তমানে গ্রাম ছেড়ে শহরগুলোতে পাড়ি জমাচ্ছেন। চীনের পূর্বাঞ্চলে বসবাসরত মানুষদের অনেকে সবজি চাষের সাথে জড়িত। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ধুলিঝড়ের পরিমাণ এত বেড়ে গিয়েছে যে, চাইলেও সবজি চাষ করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ ধুলিঝড়ের প্রতিকূলতা সহ্য করে সবজি গাছগুলোর পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব নয়। কয়েক কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ধুলিঝড় যখন দ্রুতবেগে লোকালয়ের উপর দিয়ে বয়ে যায়, তখন বিভিন্ন শারীরিক সমস্যাও দেখা দেয়। সম্প্রতি বেশ কয়েকবার ধুলিঝড় এতে ভয়াবহতা লাভ করেছিল যে, বেশ কয়েকবার বেইজিংয়ের উপর দিয়েও ঝড় বয়ে গিয়েছে। ধুলিঝড়ের মৌসুমে চীনের হাসপাতালগুলোতে শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা নিয়ে শত শত মানুষের আগমন ঘটে। প্রাকৃতিক মরূকরণের ফলে ধুলিঝড়ের পরিমাণ আরও বেড়ে গিয়েছে।
গোবি মরুভূমির প্রসার রোধ করতে চীনা সরকারের যে প্রকল্প হাতে নিয়েছে, সেটি রীতিমতো বিস্ময়কর। ধারণা করা হয়, পৃথিবীর ইতিহাসে এত বড় পরিসরের কোনো প্রকল্প এর আগে কখনও নেয়া হয়নি। ‘দ্য থ্রি নর্থ শেল্টার ফরেস্ট প্রোগ্রাম’ নামের এই প্রকল্পের মেয়াদ মোট ৭২ বছর। ১৯৭৮ সালে শুরু হওয়া এই ‘সেফটি বেল্ট নির্মাণ’ প্রকল্প চলবে ২০৫০ সাল পর্যন্ত। প্রাচীনকালে চীনের রাজারা হাজার হাজার মাইল দৈর্ঘ্যের মহাপ্রাচীর (The Great Wall of China) তৈরি করেছিলেন। এই প্রশস্ত দেয়াল নির্মাণের মূল কারণ ছিল তাদের সাম্রাজ্যকে বাইরের শত্রুদের হাত থেকে নিরাপদ রাখা। বর্তমানের চীনা সরকার প্রায় একইরকমের একটি দেয়াল (দ্য গ্রেট গ্রিন ওয়াল) নির্মাণ করছে, যে দেয়াল তাদের মরুভূমির হাত থেকে রক্ষা করবে। এই প্রকল্প সফলভাবে বাস্তবায়ন করা সহজ কাজ নয়। তাই চীনা সরকার বেশ সময় নিয়ে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। প্রতিবছর গোবি মরুভূমি চীনের প্রায় ৩,৬০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা মরুভূমিতে পরিণত করে। চীনা সরকারের এই প্রকল্প এই বিশাল পরিমাণ অঞ্চলকে মরুকরণের হাত থেকে রক্ষা করবে।
এই প্রকল্পের মূল কাজ হচ্ছে প্রায় সাড়ে চার হাজার কিলোমিটার জায়গা জুড়ে গাছ রোপণ করা। এই প্রকল্পের অধীনে প্রায় দশ হাজার কোটি গাছের বীজ রোপণ করা হবে। ইতোমধ্যে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কোটি গাছের বীজ রোপণ করা হয়ে গিয়েছে। পুরো গোবি মরুভূমির মাত্র পাঁচ শতাংশ জায়গা জঙ্গলাকীর্ণ, সেটিকে পনের শতাংশে উন্নীত করা এই প্রকল্পের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। গোবি মরুভূমির পনের শতাংশের আয়তন পুরো পশ্চিম ইউরোপের সমান। অর্থাৎ এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে পুরো পশ্চিম ইউরোপের সমান বনভূমি লাভ করবে চীনা সরকার। এই প্রকল্পের অধীনে মরুভূমির প্রসার রোধ করতে প্রথমে ঘাস ও সাধারণ গাছ লাগানো হয়। এরপর লাগানো হয় বিভিন্ন ধরনের গুল্ম, যেগুলো শুষ্ক আবহাওয়ায় টিকে থাকতে সক্ষম। গাছের বীজ রোপণ করা হয় দুভাবে। যেসব জায়গায় যাতায়াত করা সাধারণ মানুষের জন্য কষ্টকর, সেসব জায়গায় বিমান থেকে বীজ ফেলে দেয়া হয়। এর পাশাপাশি যেসব জায়গায় জনবসতি আছে, সেসব জায়গায় মানুষকে গাছ লাগানোর জন্য অর্থ ও বীজ প্রদান করা হয়। এছাড়া বেশ ক’জন ধনী ব্যক্তি নিজ উদ্যোগেও বনায়ন কর্মসূচিতে অংশ নিতে এগিয়ে এসেছেন।
বেইজিংয়ের ইন্সটিটিউট অব জিওগ্রাফিক্যাল সায়েন্সেস এন্ড ন্যাচারাল রিসোর্স রিসার্চের গবেষক মিংহং তানের এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, এই প্রকল্পের সুফল পাওয়া যাচ্ছে এখনই। মিংহং তান এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “সবজি চাষাবাদের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আগের চেয়ে উন্নতি লাভ করেছে। এছাড়াও অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় ‘গ্রেট গ্রিন ওয়াল’ অঞ্চলে ধুলিঝড়ের মাত্রা কমে এসেছে।” তবে এই প্রকল্পের সমালোচনাও রয়েছে। অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, যে অঞ্চলে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, সেই অঞ্চলের কৃষকেরা নিজেদের জমির আয়তন বাড়ানোর স্বার্থে অনেক সময় গাছ কেটে ফেলেন, যা এই প্রকল্পের কার্যকারিতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলবে। এছাড়া অনেকে বলছেন, যে তিনটি প্রদেশে এই প্রকল্প পরিচালিত হচ্ছে, সেই অঞ্চলগুলোতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ইতোমধ্যেই অনেকটা নেমে গিয়েছে। সেখানেই এই ধরনের বৃহৎ পরিসরের বনায়ন প্রকল্পের ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আরও নিচে নেমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাছাড়া, মোট দশ হাজার কোটি গাছের বীজ রোপণের পর ঠিক কতগুলো শেষ পর্যন্ত টিকে থেকে প্রকল্প সফল করবে– এটাও একটা বড় প্রশ্ন। তারা দেখিয়েছেন, ১৯৪৯ সালে চীনের শুষ্ক অঞ্চলগুলোতে যে গাছের চারাগুলো রোপণ করা হয়েছিল, তার মাত্র ১৫ শতাংশ এখন টিকে আছে।
বর্তমানে সবচেয়ে বেশি আলোচিত বৈশ্বিক সমস্যাগুলোর একটি হচ্ছে ‘বৈশ্বিক উষ্ণতা’। অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণের ফলে পৃথিবীর উষ্ণতা বেড়েই চলেছে, যার নেতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে প্রকৃতিতে। বরফাবৃত অঞ্চলগুলোতে উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে বরফ গলছে, বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। মরুভূমির আয়তন দিন দিন বেড়েই চলেছে। প্রতি বছর বিশাল আয়তনের ভূমি প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কারণে মরুভূমির করাল গ্রাসের শিকার হচ্ছে। অন্যান্য দেশ বাদ দিলে শুধু চীনেই মরুকরণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে প্রায় চল্লিশ কোটি মানুষের। এই সময়ে তাই পরিবেশ রক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার। চীনের এই প্রকল্প শুধু চীনের বিশাল অঞ্চলকে মরুকরণের হাত থেকেই রক্ষা করবে না, পাশাপাশি অনেক মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করবে ও কাঠের যোগান নিশ্চিত করবে। পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এই প্রাকৃতিক প্রকল্প সফল হলে চীনের পরবর্তী কয়েক প্রজন্ম এর সুফল ভোগ করতে থাকবে।