৬৩৬ খ্রিস্টাব্দ। মুসলিম জাহানের খলিফা তখন হজরত উমর ফারুক (রা.)। মুসলিমরা ইতোমধ্যে আরব উপদ্বীপ থেকে বেরিয়ে তৎকালীন বিশ্বের দুই পরাশক্তি বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য ও সাসানীয় পারস্য সাম্রাজ্যকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। ইরাক ও সিরিয়ার বিস্তৃত অঞ্চল তখন আরবদের কব্জায়। এর মাত্র দুই বছর আগে আবু উবাইদা ইবনে জাররাহ, আমর ইবনুল আস, ইয়াজিদ ইবনে আবু সুফিয়ান, এবং শুরাহবিল ইবনে হাসানাহ (রা.) এই চারজনের নেতৃত্বে সিরিয়া অভিযান শুরু হয়েছিল। এরপর তৎকালীন খলিফা আবু বকর (রা.)-এর নির্দেশে মহাবীর খালিদ ইবনুল ওয়ালিদকে পার্সিয়ান ফ্রন্ট থেকে সিরিয়ান ফ্রন্টে স্থানান্তরিত করা হয়। এই পাঁচ জেনারেলের নেতৃত্বে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের অনেকগুলো শহর জয় করে মুসলিমরা।
আবু উবাইদা এবার খালিদকে নিয়ে সিরিয়ার আরো উত্তরের দিকে অভিযানে নামেন। একের পর এক শহর বিজয়ের মাধ্যমে ৬৩৬ সালের মার্চ নাগাদ এমেসা পর্যন্ত পৌঁছে যান তারা। এই অবস্থা দেখে বাইজান্টাইন সম্রাট হিরাক্লিয়াস বিচলিত হয়ে পড়েন। এমতাবস্থায় তিনি সর্বশক্তি দিয়ে মুসলিম বাহিনীকে প্রতিহত করার সিদ্ধান্ত নেন। সম্রাট হিরাক্লিয়াস তখন রাশান, স্লাভ, ফ্রাঙ্ক, গ্রিক, রোমান, জর্জিয়ান, আর্মেনিয়ান ও খ্রিস্টান আরবদের সমন্বয়ে প্রায় দুই লক্ষ্য সৈন্যের এক বাহিনী গঠন করেন। বহুজাতিক বাইজান্টাইন বাহিনীকে কয়েকটি কমান্ডে সাজানো হয়। দুঃসাহসী আর্মেনিয়ান বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন জেনারেল ভাহান। রাশান ও স্লাভদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন জেনারেল কানাতির। অল ইউরোপীয় বাহিনীর কমান্ডে ছিলেন জেনারেল গ্রেগরি ও জেনারেল দাইরজান। খ্রিস্টান আরবদের নেতৃত্বে ছিলেন প্রিন্স জাবালাহ। হিরাক্লিয়াস ভাহানকে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রধান সেনাপতি মনোনীত করেন।
তখন মুসলিম বাহিনী কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন ফ্রন্টে অভিযান চালাচ্ছে। ফিলিস্তিনে আমর ইবনুল আস, শুরাহবিল জর্ডানে, কাসেরিতে ইয়াজিদ, এবং এমেসার উত্তরে আবু উবাইদা ও খালিদ। একে অপরের থেকে দূরে থাকার এই সুযোগে হিরাক্লিয়াস মুসলিম বাহিনীকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার কথা ভাবেন। এ সময় সম্রাট হিরাক্লিয়াস আরো একটি মোক্ষম চাল চেলেছিলেন। তিনি জানতেন- মুসলিম বাহিনী একইসঙ্গে বাইজান্টাইন ও পার্সিয়ানদের বিরুদ্ধে লড়ছে।
বাইজান্টাইন সম্রাট হিরাক্লিয়াস এবার “আমার শত্রুর শত্রু, আমার বন্ধু” এই নীতিতে এগোলেন। তিনি তার কন্যা ম্যানিয়াকে পারস্যের সম্রাট তৃতীয় ইয়াজদিগার্দের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে বাইজান্টাইন-পার্সিয়ান বন্ধুত্ব স্থাপন করেন। সম্রাট হিরাক্লিয়াসের উদ্দেশ্য ছিল বাইজান্টাইনরা যখন সিরিয়ান ফ্রন্টে মুসলিম বাহিনীকে আক্রমণ করবে, তখন একইসঙ্গে ইয়াজদিগার্দের বাহিনীও পার্সিয়ান ফ্রন্টে মুসলিমদের উপর হামলা করবে। অর্থাৎ একইসঙ্গে দুই ফ্রন্টে যুদ্ধ করতে মুসলিম বাহিনীকে বাধ্য করা, যেন মুসলিমরা পার্সিয়ান ফ্রন্ট থেকে সিরিয়ান ফ্রন্টে সৈন্য সরিয়ে আনতে না পারে। এ সময় খলিফা উমর (রা.) অন্য এক চাল চালেন। তিনি ইয়াজদিগার্দের কাছে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়ে দূত প্রেরণ করেন। এভাবে তিনি পার্সিয়ানদের সাথে যুদ্ধের সম্ভাবনা দীর্ঘায়িত করতে থাকেন। উমরের কূটনৈতিক চালে শেষপর্যন্ত পার্সিয়ানরা মুসলিমদের সঙ্গে সময়মতো যুদ্ধে জড়াতে পারেনি।
সম্রাট হিরাক্লিয়াসের নির্দেশে বিশাল বাইজান্টাইন বাহিনী এন্টিয়ক থেকে বেরিয়ে মুসলিম বাহিনীর দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করল। কিন্তু সম্রাট হিরাক্লিয়াসের সব পরিকল্পনা আগেই গোয়েন্দাদের মাধ্যমে ও যুদ্ধবন্দিদের থেকে মুসলিমরা জেনে যায়। খালিদ বুঝতে পারেন- বাইজান্টাইনরা যদি মুসলিমদের বিচ্ছিন্ন করে দেয়, তবে কোনোভাবেই তাদের সঙ্গে পেরে ওঠা যাবে না।
মহাবীর খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ এবার এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি মুসলিম বাহিনীকে পিছু হটতে নির্দেশ দেন। খালিদের উদ্দেশ্য ছিল পিছু হটে বাইজান্টাইনদের পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়ে শক্তি সঞ্চয় করে পুনরায় হামলা করা। এতে সাময়িকভাবে পিছিয়ে গেলেও, দীর্ঘমেয়াদে লাভবান হওয়া যাবে। এখন পিছিয়ে না গেলে বিচ্ছিন্ন মুসলিম বাহিনী বাইজান্টাইনদের আক্রমণে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে। অর্থাৎ পিছিয়ে গিয়ে যদি লাভবান হওয়া যায়, তবে পিছিয়ে যাওয়াই ভালো। তাই মহাবীর খালিদ মুসলিম বাহিনীকে পিছিয়ে গোলান মালভূমির কাছাকাছি ইয়ারমুকের প্রান্তরে একত্রিত করেন।
ইয়ারমুক যুদ্ধক্ষেত্রটি গ্যালিলি সাগরের পূর্বে ও ইয়ারমুক নদীর উত্তরে বর্তমান সিরিয়া, জর্ডান ও ইসরায়েল সীমান্তের সংযোগস্থলে অবস্থিত। আনুমানিক ২৪,০০০-৪০,০০০ সৈন্য নিয়ে খালিদ ইয়ারমুকের প্রান্তরে হাজির হন। যদিও খলিফার নির্দেশে মুসলিম বাহিনীর সামগ্রিক কমান্ডের নেতৃত্বে ছিলেন আবু উবাইদা, কিন্তু মহাবীর খালিদের বীরত্ব, রণকৌশল ও নেতৃত্বগুণের ফলে আবু উবাইদা খালিদের হাতে যুদ্ধক্ষেত্রের সামগ্রিক কমান্ড তুলে দেন।
কিছুদিনের মধ্যেই প্রায় ১,৫০,০০০ সৈন্যের বহুজাতিক বাইজান্টাইন বাহিনী নিয়ে সেনাপতি ভাহান ইয়ারমুকের প্রান্তরে প্রবেশ করেন। প্রাথমিক মুসলিম সূত্রানুযায়ী, বাইজান্টাইন সৈন্যসংখ্যা ছিল প্রায় আড়াই লাখ। প্রাথমিক রোমান সূত্রানুযায়ী সেই সংখ্যা প্রায় ১,৪০,০০০ জন। কিন্তু আধুনিক হিসাব অনুযায়ী বাইজান্টাইনরা প্রায় ৮০,০০০ থেকে ১,২০,০০০ সৈন্য নিয়ে ইয়ারমুক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। সে যা-ই হোক, বাইজান্টাইনদের সৈন্যসংখ্যা মুসলিম বাহিনীর থেকে যে অনেক বেশি ছিল তাতে সকল সূত্রই একমত।
বাইজান্টাইন সেনাপতি ভাহান তার বিশাল বাহিনী নিয়ে ইয়ারমুকে পৌঁছে দেখলেন- তার প্রতিপক্ষ খালিদ মুসলিম বাহিনী নিয়ে রণক্ষেত্রের পূর্ব প্রান্তে ক্যাম্প করে অপেক্ষা করছেন। খালিদ যুদ্ধক্ষেত্রের সুবিধাজনক জায়গায় ক্যাম্প করেন। এর ফলে বাইজান্টাইনরা অপেক্ষাকৃত অসুবিধাজনক স্থান পশ্চিম প্রান্তে ক্যাম্প করতে বাধ্য হয়। এই অবস্থানের ফলে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বাইজান্টাইনদের চোখের সামনে সূর্য থাকত, যা তাদের জন্য বেশ অস্বস্তিকর ছিল। বিপরীতে মুসলিমরা প্রতিপক্ষকে স্পষ্ট দেখতে পেত। এছাড়া বাইজান্টাইনরা যেখানে ক্যাম্প করে, তার পেছনেই ছিল গভীর গিরিখাত। তাছাড়া মুসলিম বাহিনীর সবচেয়ে বড় সুবিধা ছিল রণক্ষেত্রের পূর্ব প্রান্তে ক্যাম্প করায় খলিফা উমর প্রতিদিন ছোট ছোট দলে রিইনফোর্সমেন্ট পাঠাতেন।
বাইজান্টাইনরা প্রথমে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতার প্রস্তাব দিলেন। এ উদ্দেশ্যে বাইজান্টাইন সেনাপতি গ্রেগরি আবু উবাইদার সঙ্গে বৈঠক করতে মুসলিম ক্যাম্পে এলেন। গ্রেগরি প্রস্তাব দিলেন মুসলিমরা যেন লেভান্ত ছেড়ে আরবে চলে যায়, এবং আর কখনো ফিরে না আসে। আবু উবাইদা স্বাভাবিকভাবেই এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন। এদিকে প্রতিদিনই মুসলিম ক্যাম্পে ঢাকঢোল পিটিয়ে খলিফা উমরের পাঠানো সৈন্যরা আসছিল। সকালে সূর্যের বিপরীতে অবস্থিত হওয়ায় প্রকৃত সৈন্যসংখ্যাও আন্দাজ করতে পারছিল না বাইজান্টাইনরা। এমতাবস্থায় বাইজান্টাইনরা ভাবতে থাকে- যুদ্ধ শুরু দীর্ঘায়িত হলে মুসলিম বাহিনী আরো শক্তিশালী হয়ে উঠবে, তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যুদ্ধ শুরু করা উচিত। এ সময় খালিদ ও ভাহান এক বৈঠকে বসেন। বৈঠকে তারা সমঝোতায় পৌঁছাতে না পেরে যুদ্ধ বেছে নেন।
৬৩৬ সালের ১৫ আগস্ট। মহাপরাক্রমশালী পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য বা বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য ও উদীয়মান মুসলিম সাম্রাজ্য ইয়ারমুকের রণক্ষেত্রে মুখোমুখি হয়। দুই বাহিনীর কয়েক লক্ষ সৈন্যের কুচকাওয়াজে ইয়ারমুকের প্রান্তর তখন কাঁপছে।
বাইজান্টাইনরা তাদের বাহিনীকে চার ভাগে বিভক্ত করে সাজায়। ডান, বাম, মধ্যডান ও মধ্যবাম এই চারটি উইংয়ের দায়িত্বে ছিলেন চারজন সেনাপতি। বাইজান্টাইন ডান উইংয়ের নেতৃত্বে ছিলেন জেনারেল গ্রেগরি, বাম উইংয়ের নেতৃত্বে ছিলেন জেনারেল কানাতির, মধ্যবামের নেতৃত্বে ছিলেন জেনারেল দাইরজান, এবং মধ্যডানের নেতৃত্বে ছিলেন জেনারেল ভাহান স্বয়ং।
খালিদও তার বাহিনীকে চার ভাগে বিভক্ত করে সাজালেন। মুসলিম বাহিনীর বাম পাশের দায়িত্ব দেওয়া হয় জেনারেল ইয়াজিদকে। মধ্য বামের দায়িত্বে ছিলেন জেনারেল আবু উবাইদা। মধ্য ডানের নেতৃত্বে ছিলেন শুরাহবিল এবং সর্বডানের নেতৃত্বে ছিলেন জেনারেল আমর ইবনুল আস। খালিদ তার অশ্বারোহী বাহিনীকেও চার ভাগে ভাগ করেন। এই চারটি অশ্বারোহী ইউনিটের একটি মুসলিম বাহিনীর সর্বডানের উইংয়ের পেছনে মোতায়েন করেন। সর্ববামের উইংয়ের জন্য একটি ইউনিট মোতায়েন করেন এবং সমগ্র মধ্যভাগের জন্য একটি ইউনিট মোতায়েন করেন। বাকি একটি অশ্বারোহী ইউনিটকে তিনি নিজের কাছে রিজার্ভ হিসেবে রেখে দেন।
১৫ আগস্ট তৎকালীন রীতি অনুযায়ী দুই বাহিনীর চ্যাম্পিয়নরা মল্লযুদ্ধে লিপ্ত হয়। সেখানে বেশ কয়েকটি মল্লযুদ্ধে মুসলিম বীরেরা বাইজান্টাইন চ্যাম্পিয়নদের কুপোকাত করে। এরপর ভাহান তার বাহিনীর একাংশকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেন। ভাহানের নির্দেশে বাইজান্টাইন বাহিনী প্রথমে মুসলিম বাহিনীকে আক্রমণ করে। যুদ্ধে মুসলিমরা প্রথমে রক্ষণাত্মক ভূমিকা নেয়। মুসলিমদের তীরের রেঞ্জে আসতেই মুসলিম তিরন্দাজ বাহিনী তির ছুড়তে শুরু করে। কিন্তু এটি বাইজান্টাইনদের খুব বেশি কাবু করতে পারেনি। এরপর দুই শিবিরের পদাতিক বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। দিনশেষে বাইজান্টাইন বাহিনী পশ্চাদপসরণ করে। প্রথম দিন মুসলিম বাহিনী খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।
ভাহান এবার নতুন পরিকল্পনা শুরু করেন। বাইজান্টাইনরা সিদ্ধান্ত নেয় পরদিন একদম ভোরে মুসলিমদের উপর আক্রমণ চালাবে। কারণ, তখন মুসলিমরা ফজরের নামাজরত থাকবে। এমন অপ্রস্তুত অবস্থায় মুসলিমদের আক্রমণ করে দুর্বল করে দেওয়ার কথা ভাবেন ভাহান। কিন্তু সেই আশার গুড়ে বালি। কেননা, প্রতিপক্ষ যে খালিদ! তিনি কি এমনি এমনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ জেনারেলদের মাঝে গণ্য হন! খালিদ আন্দাজ করতে পেরেছিলেন যে বাইজান্টাইনরা মুসলিমদের এই দুর্বলতার সুযোগ নিতে পারে। তাই তিনি আগে থেকেই প্রস্তুত হয়েছিলেন। বাইজান্টাইন বাহিনী মুসলিম বাহিনীর কাছে আসতেই তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়।
দ্বিতীয় দিনের যুদ্ধে বাইজান্টাইনদের কঠোর আক্রমণের প্রেক্ষিতে আরবরা দুর্বল হয়ে পড়ে। কয়েক ঘণ্টা পর একপর্যায়ে আরবদের ডান ও বাম উইং পিছু হটতে শুরু করে। আরবরা যখন পিছু হটে শিবিরের কাছে যায়, তখন মুসলিম নারীরা তাদের ধিক্কার জানাতে শুরু করেন। অনেক নারী পুরুষদের উপর পাথর ছুড়তে শুরু করে। মুসলিম নারীরা পুরুষদের পশ্চাদপসরণ না করে পুনরায় যুদ্ধে যেতে উদ্বুদ্ধ করে। নারীদের উৎসাহে মুসলিম বাহিনী পুনরায় যুদ্ধে ফিরে যায়। খালিদ কমান্ডারদের নির্দেশ দিলেন যেকোনো মূল্যে তাদের অবস্থান ধরে রাখার জন্য। কিছুক্ষণ পর খালিদের অশ্বারোহী বাহিনী ঝটিকা আক্রমণের মাধ্যমে বাইজান্টাইনদের দুর্বল করে দেয়।
যুদ্ধের তৃতীয় দিনে বাইজান্টাইনরা নতুন পরিকল্পনা হাতে নেয়। তারা মুসলিম বাহিনীর ডান অংশে শক্তিশালী আক্রমণ করে ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করে। বাইজান্টাইনদের কঠোর আক্রমণের মুখে এবারও মুসলিমরা পিছু হটতে শুরু করে। বাইজান্টাইনদের পরিকল্পনা বুঝতে পেরে খালিদ তার মোবাইল গার্ড নিয়ে আক্রমণ চালান। সময়মতো খালিদের আক্রমণের ফলে মুসলিমরা আবার ঘুরে দাঁড়ায়। শেষপর্যন্ত বাইজান্টাইনরা পিছু হটতে বাধ্য হয়।
যুদ্ধের চতুর্থ দিন ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই দিনে বাইজান্টাইনরা পূর্বে ক্ষতিগ্রস্ত মুসলিমদের ডানপার্শ্বে আবার আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। বাইজান্টাইনদের আক্রমণের মুখে আবার মুসলিমরা পিছিয়ে যায়। এবারও ত্রাণকর্তা হিসেবে হাজির হয় খালিদের মোবাইল গার্ড। খালিদ এবার মুসলিম বাহিনীর বাম অংশকে বাইজান্টাইনদের উপর আক্রমণ চালানোর নির্দেশ দেন। মুসলিম বাহিনী সম্মিলিতভাবে তিনটি আক্রমণ পরিচালনা করে। মুসলিমদের এই আক্রমণের ফলে বাইজান্টাইন বাহিনী অনেকটা পিছু হটতে বাধ্য হয়। কিছুক্ষণ পর বাইজান্টাইনদের অশ্বারোহী তিরন্দাজরা মুসলিমদের উপর তীব্র আক্রমণ শুরু করে। তিরের আঘাতে অনেক মুসলিম তাদের চোখ হারান। সেদিন আবু সুফিয়ানও তার এক চোখ হারান। অনেক মুসলিম চোখ হারানোর ফলে এই দিনটি ‘দ্য ডে অব লস্ট আইজ’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
যুদ্ধের চতুর্থ দিনে মহাবীর খালিদের বাল্যবন্ধু ইকরিমা ইবনে আবু জাহল মৃত্যুবরণ করেন। বাইজান্টাইনরাও এই দিন অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যখনই মুসলিম বাহিনী খারাপ অবস্থায় চলে গিয়েছে, তখনই খালিদ তার রিজার্ভ অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে আক্রমণ করে বাইজান্টাইনদের হটিয়ে দিয়ে মুসলিমদের রক্ষা করেছেন। খালিদের অশ্বারোহী বাহিনীর আক্রমণে বাইজান্টাইন বাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। দিন দিন বাইজান্টাইন বাহিনীর সেনাসংখ্যা কমতে শুরু করে। বাইজান্টাইনদের এই শোচনীয় অবস্থা দেখে যুদ্ধের পঞ্চম দিন সেনাপতি ভাহান মুসলিমদের কাছে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেন।
আবু উবাইদা এই শান্তি প্রস্তাবে রাজি হলেও খালিদ তা মানতে নারাজ ছিলেন। মহাবীর খালিদ বুঝতে পেরেছিলেন- বাইজান্টাইন বাহিনী এখন নিরাশ হয়ে পড়েছে। এই দুর্বলতার সুযোগে বাইজান্টাইনদের সমূলে ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিলেন তিনি, যেন পরবর্তীতে তারা আর সংগঠিত হতে না পারে। খালিদের মনে হয়েছিল- ভাহানের এই প্রস্তাব একটি অভিনয় ছাড়া কিছুই নয়। এখন বাইজান্টাইনদের সাথে যুদ্ধবিরতি করলে মুসলিমদের কোনো লাভ নেই, কিন্তু এখন তাদের ধ্বংস করে দিতে পারলে পরবর্তীতে বাইজান্টাইনরা আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। তাই যুদ্ধের ষষ্ঠ দিনে খালিদ সর্বাত্মক আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন।
সেদিন রাতে খালিদ তার অশ্বারোহী বাহিনীকে পাঠান বাইজান্টাইনদের পালানোর একমাত্র পথটি দখল করে নিতে। ২০ আগস্ট আবু উবাইদা ও গ্রেগরির মধ্যে দ্বন্দ্বযুদ্ধের মাধ্যমে যুদ্ধ শুরু হয়। আবু উবাইদার তরবারির আঘাতে গ্রেগরির শরীর থেকে মাথা আলাদা হয়ে যায়। এরপর মুসলিম বাহিনী বাইজান্টাইনদের উপর আক্রমণ শুরু করে। এই প্রথম মুসলিম বাহিনী আক্রমণাত্মক ভূমিকা নেয়। খালিদের অশ্বারোহী বাহিনীর তেজে বাইজান্টাইনরা দিশেহারা হয়ে পড়ে। ভাহান তার বাহিনীকে সংগঠিত করতে ব্যর্থ হন। মুসলিমরা একের পর এক বাইজান্টাইন উইং ভেঙে দিতে থাকে। একপর্যায়ে বাইজান্টাইন বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পশ্চাদপসরণ শুরু করে।
খালিদ বাইজান্টাইনদের পালানোর সকল পথ বন্ধ করে দেন। দিশেহারা বাইজান্টাইনদের উপর মুসলিমরা এবার আরো তীব্র আক্রমণ শুরু করে। এ সময় বাইজান্টাইনদের কেউ কেউ গভীর গিরিখাতে পড়ে যায়, কেউ বা নদীপথে পালানোর চেষ্টা করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করে। তবে অনেক সৈনিক পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। যুদ্ধে বাইজান্টাইন সেনাপতি ভাহান মৃত্যুবরণ করেন। যুদ্ধক্ষেত্রে প্রায় অর্ধেক বাইজান্টাইন সৈন্য নিহত হয়। অপরদিকে মুসলিমদের মাত্র কয়েক হাজার সৈন্য নিহত হয়। এরপর খালিদ তার বাহিনী নিয়ে পূর্বে ছেড়ে আসা শহরগুলো পুনরুদ্ধার করেন।
ইয়ারমুকের যুদ্ধ ছিল পৃথিবীর ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া এক যুদ্ধ। ছয় দিনের এই যুদ্ধের মাধ্যমে বৃহত্তর সিরিয়া বা লেভান্তে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের ইতি ঘটে। এটি ছিল বাইজান্টাইনদের পতনের প্রথম ধাপ। এই যুদ্ধে জয়ের মাধ্যমে মুসলিমরা পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। যুদ্ধে খালিদ বিন ওয়ালিদের রণনৈপুণ্য সমরবিশারদদের অবাক করে। খালিদ বিন ওয়ালিদ পৃথিবীর ইতিহাসের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ জেনারেলদের একজন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। প্রতিপক্ষের চেয়ে অনেক কম সৈন্য নিয়েও কীভাবে সফল নেতৃত্ব ও দৃঢ়তার মাধ্যমে যুদ্ধ জয় করা যায়- এটি তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এটি ছিল উদীয়মান মুসলিমদের হাতে পরাক্রমশালী বাইজান্টাইনদের এক লজ্জাজনক পরাজয়।