Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ক্যামব্রিজ স্পাই রিং: ব্রিটেনে সোভিয়েত গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক | পর্ব – ১

ঔপনিবেশিক যুগে ব্রিটেনের কাছ থেকে সর্বপ্রথম স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশ কোনটি ছিল জানেন? আমেরিকা। আজকের দিনে আমেরিকা প্রায় সবদিক থেকে ব্রিটেনের চেয়ে এগিয়ে গিয়েছে। কিন্তু ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, একসময় আমেরিকার তেরটি উপনিবেশে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিল ব্রিটিশরা। আমাদের ভারতবর্ষে একসময় যেমন ব্রিটিশরা শাসন করত, আমেরিকাতেও ব্রিটিশরা নিজস্ব শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করেছিল। কিন্তু অন্যান্য উপনিবেশের মতো আমেরিকা ব্রিটিশদের শোষণমূলক শাসন মেনে নিতে রাজি ছিল না। সেকারণে একসময় জর্জ ওয়াশিংটনের নেতৃত্বে তেরটি মার্কিন উপনিবেশই স্বাধীনতা ঘোষণা করে। তবে ব্রিটিশরা এত সহজে সমৃদ্ধ উপনিবেশ ছেড়ে যেতে রাজি ছিল না। আমেরিকার স্বাধীনতাপন্থী বাহিনী ও ব্রিটিশদের মধ্যে সামরিক সংঘাত বেধে গেলে সেনাপতি জর্জ ওয়াশিংটনের নেতৃত্বে আমেরিকা সেই শাসন থেকে মুক্তি লাভ করে। তৎকালীন বিশ্বে সবচেয়ে শক্তিশালী নৌবাহিনীর অধিকারী ব্রিটিশদের হারানো মোটেও সহজ কাজ ছিল না। কিন্তু স্বাধীনতার স্বপ্নে উন্মুখ মার্কিনিরা ব্রিটিশদের হাত থেকে নিজেদের মুক্ত করতে সক্ষম হয়।

িতওতওতেগ
আমেরিকা ছিল ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত পৃথিবীর প্রথম উপনিবেশ; image source: britannica.com

আমেরিকার ইতিহাসে স্বাধীনতা সংগ্রামের অংশ পড়লে মনে হতে পারে- ব্রিটিশরা বোধহয় আমেরিকার চিরশত্রু। কিন্তু বাস্তবে এমন ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সমস্ত বিবাদ ভুলে মিত্রপক্ষের প্রধান দুই দেশ হিসেবে চিরশত্রু ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স যখন কাইজারের জার্মানির বিপক্ষে কোণঠাসা হচ্ছিল, তখনই বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার অংশগ্রহণ পাশার দান উল্টে দেয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ আমেরিকার জন্য রীতিমতো আশীর্বাদ বয়ে এনেছিল। যুদ্ধের আগে আমেরিকা ছিল মোটামুটি রুগ্ন অর্থনীতির এক দেশ। ব্রিটেনের কাছে লাখ লাখ ডলার ঋণ ছিল তাদের। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বিবদমান পক্ষগুলোর কাছে অস্ত্র বিক্রির মাধ্যমে প্রচুর অর্থ সংগ্রহ করতে সক্ষম হয় আমেরিকা। যুদ্ধ শেষে দেখা যায়- ব্রিটেনই আমেরিকার কাছে লাখ লাখ ডলার ঋণ করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও ব্রিটেন, ফ্রান্স ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সমন্বয়ে গঠিত মিত্রপক্ষে আমেরিকা স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করে। এবার যুদ্ধ হয় আরও বড় আকারে, তাদের অস্ত্র ব্যবসার মুনাফা আকাশ ছুঁয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট দেশগুলোর বিপক্ষে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী দেশগুলোর যে স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়, সেখানেও ব্রিটেন ও আমেরিকা দুই বিশ্বস্ত মিত্রের মতো লড়েছে।

তবে আমেরিকা ও ব্রিটেনের সম্পর্ক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কয়েক বছর পরে বেশ খারাপ অবস্থায় নেমে এসেছিল। এর পেছনে ছিল এমন এক স্পর্শকাতর ঘটনা, যেটি দু’দেশেরই জাতীয় নিরাপত্তা বেশ হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। ঘটনাটি সম্পর্কে একটু আগাম ধারণা নেয়া যাক। ধরুন, আপনি ‘ক’ দেশের একজন নাগরিক। আপনার দেশের সাথে ‘খ’ দেশের চমৎকার সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। হঠাৎ একদিন আপনি আবিষ্কার করলেন, ‘খ’ দেশের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তি, যারা আপনার রাষ্ট্রের অনেক গোপন খবর জানে, তারা সেই তথ্যগুলো ‘গ’ দেশের কাছে পাচার করছে। এর পাশাপাশি আরও জানতে পারলেন, আপনার মিত্র ‘খ’ দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিরা এক কিংবা দুই বছর নয়, দীর্ঘ বিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে অসংখ্য গোপন তথ্য পাচার করেছে, এবং ‘খ’ দেশের স্বনামধন্য গোয়েন্দা বাহিনী এই বিষয়ে এক চুল পরিমাণ তথ্যও জানে না। এরকম একটা পরিস্থিতিতে আপনার ‘ক’ দেশের সাথে ‘খ’ দেশের সম্পর্ক খারাপ হওয়াই স্বাভাবিক, তাই নয় কি? আমেরিকা ও ব্রিটেনের মধ্যে ঠিক এ ধরনের ঘটনাই ঘটেছিল।

বসহতপপত
দুটি বিশ্বযুদ্ধেই আমেরিকা ও ব্রিটেন একই জোটে ছিল; image source: history.com

ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই? ব্রিটেনের যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পৃথিবীজুড়ে বিখ্যাত, সেগুলোর তালিকা করলে ক্যামব্রিজ উপরের দিকেই থাকবে। এই বিশ্ববিদ্যালয়েই গত শতকের ত্রিশের দশকে কয়েকজন ব্যক্তি, যারা প্রায় একইসাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেছিলেন, তাদেরকে সোভিয়েত ইউনিয়ন তথ্য পাচারের কাজে নিয়োগ দিয়েছিল। আরেকটু পরিষ্কার করে বললে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্রিটেনের এমন কয়েকজন ব্যক্তিকে খুঁজছিল, যাদেরকে ব্রিটেনের গোপন তথ্য সংগ্রহের কাজে চমৎকারভাবে ব্যবহার করা যাবে। এখানে লক্ষ্যণীয়, সোভিয়েত স্কাউটরা সরাসরি স্পর্শকাতর পেশার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের নিয়োগ না দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করেছিল। কারণ, স্পর্শকাতর পেশার (সেনাবাহিনীর উঁচু পর্যায়, গোয়েন্দা সংস্থা) ব্যক্তিদের যদি নিয়োগ দেয়া হয়, তাহলে তাদের পরিচয় ফাঁস হওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা থাকে। এর পাশাপাশি এটাও লক্ষ্যণীয় যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পেশায় যাওয়ার যে সম্ভাবনা থাকে, সেটির পূর্ণ ফায়দা উসুল করতে চেয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন।

হডজতজততপ
ক্যামব্রিজ স্পাই রিংয়ের সবাই একসময়ে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন; image source: theguardian.com

ইতিহাসের দিকে আরেকটু যাওয়া যাক। তাহলে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী কেন সোভিয়েত ইউনিয়নের গুপ্তচরবৃত্তির প্রস্তাবে সাড়া দিল, সেই বিষয় সম্পর্কে আরেকটু পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে। ১৯১৭ সালে অক্টোবর বিপ্লবের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে এটি ছিল এক বিশাল তাৎপর্যময় ঘটনা। শত শত বছর ধরে কমিউনিজম ছিল ইউটোপিয়ার জগতে, সেখান থেকে প্রথমবারের মতো বাস্তবে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার ঘটনা বিশ্বজুড়ে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে। অক্টোবর বিপ্লবের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমৃদ্ধি এবং পশ্চিমা বিশ্বের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের চোখে চোখ রেখে চলার ঘটনা পৃথিবীর অসংখ্য তরুণ-তরুণীকে কমিউনিজমের প্রতি আকৃষ্ট করে। এছাড়া বৈজ্ঞানিক গবেষণায় পশ্চিমা বিশ্বের থেকে অনেক দিক দিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন, যেটি যুক্তিবাদী তরুণদের কমিউনিজমের প্রতি আরও বেশি উদ্বুদ্ধ করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘোষণা দিয়েছিল- কমিউনিস্ট বিপ্লব ছড়িয়ে দেয়া হবে পুরো বিশ্বে। পুঁজিবাদের পাঁড় সমর্থক ইউরোপের দেশগুলোতেও কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

হডপগেলগ
ক্যামব্রিজ স্পাই রিংয়ের সদস্যরা কমিউনিজমের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন, যেটি সোভিয়েত গোয়েন্দাদের সুবিধা এনে দিয়েছিল;
image source: history.com

ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের যে পাঁচ শিক্ষার্থী সোভিয়েত ইউনিয়নের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির প্রস্তাবে রাজি হন, তারা প্রায় সবাই কমিউনিস্ট মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ ছিলেন। যেহেতু সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল কমিউনিজমের অভিভাবক, স্বাভাবিকভাবে কমিউনিজমে উদ্বুদ্ধ এই শিক্ষার্থীদের সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি আলাদা দুর্বলতা ছিল। এজন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের গোয়েন্দা স্কাউট যখন অসংখ্য ব্রিটিশ নাগরিকের মধ্যে বাছাই করে এই পাঁচজনকে গুপ্তচরবৃত্তির প্রস্তাব দেয়, তখন তারা সেই প্রস্তাব নাকচ করে দিতে পারেনি। এটি অনেকটা আমেরিকার বিখ্যাত ম্যানহাটন প্রজেক্টের মতো। নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটন প্রজেক্টে যে পারমাণবিক বিজ্ঞানীরা ছিলেন, তারা বৈশ্বিক রাজনীতির ভারসাম্যের জন্য চেয়েছিলেন আমেরিকার পাশাপাশি সোভিয়েত ইউনিয়নও পারমাণবিক বোমার অধিকারী হোক। তাই সোভিয়েত ইউনিয়নের দুধর্ষ গোয়েন্দারা যখন তাদের কাছে পারমাণবিক বোমা তৈরির সূত্র হস্তান্তর করার আহ্বান জানায়, তখন স্বেচ্ছায় তারা সেই প্রস্তাবে রাজি হন। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই পাঁচ শিক্ষার্থী ভেবেছিলেন, যদি তারা তথ্য পাচারে সহায়তা করেন, তাহলে হয়তো তাদের পছন্দের মতাদর্শের দেশটির উপকার হতে পারে।

পাঁচজনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল তারা যখন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ডিগ্রির শিক্ষার্থী, ঠিক তখন। সোভিয়েত ইউনিয়নের গোয়েন্দারা বুঝতে পেরেছিলেন- এই পাঁচজন বেশ সম্ভাবনাময়, এবং ভবিষ্যতে তাদের রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে যাওয়ার বেশ বড় সম্ভাবনা রয়েছে। হয়তো এমনও হয়েছিল যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের গোয়েন্দারা তাদের ক্যারিয়ার গড়তে বেশ সহায়তা করেছিল, যে সম্পর্কে জনসমক্ষে কোনো তথ্য আসেনি। যা-ই হোক, তারা পাঁচজন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর কে কোন পেশায় গিয়েছিলেন, সেগুলো দেখে নেয়া যাক।

১) কিম ফিলবি: ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআই-সিক্স (MI-6) এ দীর্ঘদিন উচ্চপদস্থ পদে আসীন ছিলেন। ।এর মধ্যে একপর্যায়ে তিনি সোভিয়েত কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্ট এবং আমেরিকার ওয়াশিংটন ডিসিতে এমআই-সিক্স এর ‘লিয়াজোঁ অফিসার’ হিসেবেও কাজ করেছিলেন।

২) ডোনাল্ড ম্যাকলিন: ব্রিটেনের পররাষ্ট্র বিভাগে পারমাণবিক ও সামরিক বিষয়াবলি নিয়ে কাজ করতেন।

৩) গাই বার্গেস: ব্রিটেনের গোয়েন্দা সংস্থা এমআই-সিক্সে কিছুদিন চাকরি করার পর পররাষ্ট্র বিভাগে যোগ দেন। প্রথমদিকে তার কর্মক্ষেত্র ছিল লন্ডনে, এরপর তাকে ওয়াশিংটনের ব্রিটিশ দূতাবাসে পাঠানো হয়।

৪) অ্যান্থনি ব্লান্ট: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পুরোটা সময় এমআই-ফাইভে কাজ করেছেন। তার কাজ ছিল দুর্বোধ্য জার্মান এনিগমা কোডগুলোকে ডিকোড করা এবং ব্রিটেনে অবস্থানরত জার্মান গোয়েন্দাদের প্রতিরোধ করা।

৫) জন কেয়ার্নক্রস: অ্যান্থনি ব্লান্টের মতো তিনিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পুরোটা সময় ব্লেচলি পার্কে জার্মান কোডব্রেকিংয়ের কাজ করেছেন।

Related Articles