কাশ্মীর; আমাদের মনোযোগ কেড়ে নিতে এই একটি শব্দই যথেষ্ট। নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি খ্যাত এই অঞ্চলের তুষারঢাকা পাহাড়, কলকল করে বয়ে চলা নদী, চোখধাঁধানো নীল হ্রদ, শুকনো ফলাহার, সুবিশাল আপেল বাগান, স্থানীয় মানুষের হাতে তৈরি বিভিন্ন লোকজ ঐতিহ্য ধারণ করা পণ্য কিংবা রাজনৈতিক সংঘাত– আলোচনায় থাকার জন্য কাশ্মীরের উপাদান রয়েছে অনেক।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সিল্ক রুটের জন্য বহু আগে থেকেই এই অঞ্চলের নাম পৃথিবীর সবখানে ছড়িয়ে পড়লেও গত সত্তর বছর ধরে কাশ্মীর মূলত আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে বার বার শিরোনাম হয়েছে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, আন্দোলন থামাতে নির্মমতা প্রদর্শন, এবং চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই দেশ ভারত ও পাকিস্তানের সংঘাতের মূল কেন্দ্র হিসেবে। তবে এসব কখনোই কাশ্মীরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কিংবা সমৃদ্ধ সংস্কৃতিকে ছাপিয়ে যেতে পারেনি।
কাশ্মীর অবস্থিত ভারতের উত্তর দিকে, পৃথিবীবিখ্যাত হিমালয় পর্বতমালার পাদদেশে। কাশ্মীরকে বলা হয় ‘প্যারাডাইজ অন দ্য আর্থ’ (Paradise On The Earth) বা ভূস্বর্গ। একজন কবি কাশ্মীর সম্পর্কে একদা বলেছিলেন,
যদি পৃথিবীতে থাকে কোনো স্বর্গ,
তবে এটিই সেই স্বর্গ, এটিই সেই স্বর্গ, এটিই সেই স্বর্গ।
এই উপত্যকার চমৎকার সব পাহাড়, নীল হ্রদ কিংবা অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদান বহু আগে থেকেই এক অমোঘ আকর্ষণে টেনে নিয়ে গিয়েছে। বর্তমানে প্রযুক্তির কল্যাণে যাতায়াতব্যবস্থা ও যোগাযোগ আরও সহজ হওয়ায় কাশ্মীরে আগের চেয়ে অনেক বেশি পর্যটকের আগমন ঘটছে। তবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, স্থানীয় লোকজশিল্প কিংবা সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ছাড়াও আরেকটি বিষয় পর্যটকদের আকর্ষণের মূলে পরিণত হয়েছে– ওয়াজওয়ান। এটি একটি খাবারের নাম, যেটি কাশ্মীরের মৌলিকত্বকে খুবই চমৎকারভাবে ধারণ করতে সমর্থ হয়েছে।
কাশ্মীরী ভাষায় ‘ওয়াজওয়ান’ শব্দটির নিজস্ব অর্থ রয়েছে। ‘ওয়াজা’ বলতে বোঝানো হয় বিশেষ দক্ষতাসম্পন্ন রাঁধুনি। আর ‘ওয়ান’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘দোকান’। অনেকে বলেন, ‘ওয়ান’ বলতে আসলে ‘দোকান’ বোঝানো হয় না, বরং সেই স্থানকে বোঝানো হয় যেখানে এই খাবার প্রস্তুত করা হয়। ওয়াজওয়ান বলতে সেই খাবারকে বোঝানো হয়, যে খাবারটি বিশেষ দক্ষতাসম্পন্ন রাঁধুনির তত্ত্বাবধানে তৈরি করা হয় এবং বিশেষ জায়গায় পাওয়া যায়।
ওয়াজওয়ান হচ্ছে অনেকগুলো বিশেষ খাবারের সমন্বয়ে তৈরি হওয়া একটি ‘মাল্টি-কোর্স মিল’, যাতে চৌদ্দ থেকে ছত্রিশ পদের খাবার থেকে। এটি সাধারণত কোনো উপলক্ষে রান্না করা হয়। সাধারণত কোনো উৎসব, বিয়ের অনুষ্ঠান কিংবা পার্টি থাকলে এই খাবার বিশেষভাবে রান্না করা হয়। এছাড়া অনেক সময় বাইরের দেশ থেকে রাজনীতিবিদরা আসলে এই খাবার পরিবেশন করা হয়। স্নায়ুযুদ্ধের সময় সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ কাশ্মীর ভ্রমণে আসলে তার সামনে এই খাবার পরিবেশন করা হয়েছিল। কাশ্মীরের ঐতিহ্যকে ধারণ করা সবচেয়ে মৌলিক খাবার হচ্ছে এই ওয়াজওয়ান।
এই খাবারের ইতিহাস বেশ পুরনো। মনে করা হয়, ভারতবর্ষে এই খাবারের প্রচলন মোঙ্গলদের দ্বারা। মোঙ্গল সামরিক বীর তৈমুর যখন ভারতবর্ষে আসেন, তখন সাথে করে সমরখন্দের অনেক দক্ষ রাঁধুনি নিয়ে আসেন। তারাই মূলত এই খাবারের প্রচলন করেন বলে ইতিহাসবিদরা মন্তব্য করেন। আবার অনেকে বলে থাকেন, প্রাচীন সিল্ক রুটের কারণে মধ্য এশিয়ার অনেক ব্যবসায়ী ও অভিবাসীর কল্যাণে ভারতবর্ষে এই খাবারের আগমন ঘটে। এছাড়াও তৃতীয় আরেকদল মানুষ বলে থাকেন, এই খাবারের শিকড় হচ্ছে পারস্যে, এবং মূলত প্রাচীন শাসক, মধ্যপ্রাচ্যের ইসলাম ধর্ম প্রচারক ও সুফি সাধকদের মাধ্যমে ভারতবর্ষে এই খাবারের আগমন ঘটে। তবে ওয়াজওয়ান তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান ও রন্ধনপ্রণালী বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই খাবারে আফগান, পারস্য ও মধ্য এশিয়া– সব জায়গারই ছোঁয়া রয়েছে। এই খাবারের উৎপত্তি নিয়ে যত রকমের মতামতই থাকুক না কেন, বর্তমানে এটি কাশ্মীরের নিজস্ব খাবার হিসেবেই সব জায়গায় সমাদৃত হচ্ছে।
ওয়াজওয়ান তৈরির প্রধান উপকরণ হচ্ছে সদ্য জবাই করা ভেড়া কিংবা খাসির মাংস। বলা হয়, ওয়াজওয়ানের দুর্দান্ত স্বাদের পেছনে মূল কারণ হচ্ছে- এটি রান্নার ক্ষেত্রে একেবারে টাটকা মাংস ব্যবহার করা হয়। প্রাণীর দেহের একেক অংশের মাংস একেক পদের খাবার রান্নার জন্য আলাদা করে রাখা হয়। যেমন- পাঁজরের অংশ দিয়ে রান্না করা হয় ‘তাবাক মাজ’, পায়ের অংশবিশেষ দিয়ে রান্না করা হয় ‘দায়েন ফোল’, দেহের ভেতরের অংশগুলো রাখা হয় ‘মিথি’ রান্নার জন্য, ঘাড়ের অংশ দিয়ে রান্না করা হয় ‘রোগান জোশ’ এবং একেবারে সাধারণ মাংস ব্যবহার করা হয় রিশতা, গুস্তাভা এবং কাবাব বানানোর জন্য। এছাড়া একেক পদের খাবারের জন্য আলাদা আলাদা মশলা ও অন্যান্য উপাদান ব্যবহার করা হয়। এসব মশলার কারণে একেক খাবার একেক বর্ণ ও স্বাদের হয়ে থাকে।
সবধরনের মাংস দেহের অবস্থানের উপর ভিত্তি করে আলাদা করা হয়ে গেলে এবার ওয়াজারা তাদের কাজ শুরু করে দেন। ‘ওয়াজা’ সম্পর্কে আমরা আগেই জেনেছি যে, তারা হলেন বিশেষ দক্ষতাসম্পন্ন রাঁধুনি। পুরো কাশ্মীরে ওয়াজাদের বাইরে সাধারণত ওয়াজওয়ান রান্না করা হয় না। ওয়াজারা একেকজন হচ্ছেন শিল্পী, যারা নিখুঁতভাবে এই খাবার রান্নায় নিজেদের নিয়োজিত করেন। তারা মূলত পারিবারিকভাবেই এই রান্নার শিক্ষা পান। খোঁজ নিলে হয়তো দেখা যাবে- তাদের পরিবার শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই খাবার তৈরির কাজে নিয়োজিত আছে।
নিকেলের আস্তরণ দেয়া পাতিলে করে বিভিন্ন খাবার রান্না করা হয়। সাধারণত কোনো স্থায়ী রান্নাঘরে ওয়াজওয়ান রান্না করা হয় না। আমাদের দেশে বিয়ের অনুষ্ঠানে যেমন মাটি খুঁড়ে অস্থায়ী চুলায় রান্না করা হয়, ওয়াজওয়ানের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি ঠিক সেরকমই। তবে ওয়াজারা রান্নার মূল দায়িত্বে থাকলেও সামগ্রিকভাবে সবকিছু ঠিকমতো হচ্ছে কী না, সেটির তত্ত্বাবধানে থাকেন আরেকজন ব্যক্তি। তাকে বলা হয় ‘ভাস্তা ওয়াজা’ (ওয়াজাদের প্রধান)। তিনি রান্নার সময় বিভিন্ন নির্দেশনা প্রদান করেন।
ওয়াজওয়ানের বেশিরভাগ পদের রান্নার রং হয় লাল। এই রান্নায় যেসব মশলা ব্যবহার করা হয় তার মধ্যে রয়েছে শুকনো মোরগঝুঁটি গাছের পাতা, সবুজ ও কালো এলাচ, শুকনো মেথি, শুকনো আদা বাটা, টাটকা রসুন বাটা, দারুচিনি, মৌরি বীজ, তেঁতুল, কাশ্মিরি লাল মরিচ, লবঙ্গ, গোল মরিচ, পুদিনা পাতা, ধনে পাতা ইত্যাদি৷ এছাড়াও ওয়াজওয়ানের আরেকটি প্রধান উপাদান হচ্ছে জাফরান৷ এই খাবারের বেশিরভাগ পদই ধীরে ধীরে আগুনের তাপে রান্না করা হয়৷ মিথি মাজ, তাবাক মাজ, শিক কাবাব, রিশতা, রোগান জোশ, আব গোশত, মিরচি কোর্মা, গুশতাভ ইয়াখনি ইত্যাদি হচ্ছে এই ওয়াজওয়ানের মূল পদ।
ঐতিহ্যগতভাবে ওয়াজওয়ান খাওয়া হয় কার্পেটের উপর বসে, এবং শুধু হাত ব্যবহার করেই। সাধারণত অতিথিরা কার্পেটের উপর বসে গেলে ‘তাশত তি নায়ের’ নামের একটি বাসনে হালকা গরম পানিতে তাদের হাত ধুয়ে নেয়া হয়। এরপর তারা চারজন করে একসাথে বসে যান এবং ‘ত্রামি’ নামক খাবারের প্লেটে তাদের খাবার পরিবেশন করা হয়। খাবার মুখে নেয়ার আগে তারা দলগতভাবে প্রার্থনা করেন। খাবারের শেষ দিকে মিষ্টান্নও পরিবেশন করা হয়ে থাকে।
ওয়াজওয়ান কাশ্মিরের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাইরের মানুষ তো বটেই, পুরো ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের অসংখ্য মানুষ প্রতিবছর কাশ্মিরে বেড়াতে যান এই ঐতিহ্যবাহী খাবারের স্বাদ গ্রহণের উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে। দিনের পর দিন এই খাবারের চাহিদা বেড়েই চলেছে, সামনের দিনগুলোতে আরও বাড়বে। কাশ্মীরের সমৃদ্ধ সংস্কৃতিকে ধারণ করার ক্ষেত্রে এর চেয়ে ভালো কোনো খাবার আর নেই।