ইতিহাসে মঙ্গোলিয়া স্বাতন্ত্র্য পরিচয় গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছে বেশ কিছু বিষয়ের উপর ভিত্তি করে। পৃথিবীকাঁপানো চেঙ্গিস খান ও তার বংশধরেরা ছিলেন এই দেশেরই অধিবাসী। পুরো বিশ্বে চেঙ্গিস খান একজন ‘রক্তপিপাসু’ ও ‘নির্মম’ শাসক হিসেবে পরিচিত হলেও মঙ্গোলিয়ানদের কাছে তিনি ‘জাতির পিতা’ ও মঙ্গোলিয়ার প্রতিষ্ঠাতা। এছাড়া জনসংখ্যার ঘনত্বের উপর ভিত্তি করে মঙ্গোলিয়া বিশ্বের সব দেশের মধ্যে একেবার তলানিতে অবস্থান করছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মঙ্গোলিয়ায় প্রতি বর্গ কিলোমিটারে মাত্র দুজন বাস করে! দেশটির ভৌগলিক অবস্থানও বেশ আগ্রহোদ্দীপক। দুই পারমাণবিক পরাশক্তি চীন ও রাশিয়ায় প্রায় মাঝখানে এই দেশের অবস্থান, কিন্তু আধুনিক ইতিহাসে সেভাবে কখনোই কোনো পরাশক্তির সাথে সংঘাতে জড়ায়নি মঙ্গোলিয়া। সাংস্কৃতিকভাবে ‘নাদাম উৎসব’ হচ্ছে দেশটির সবচেয়ে বৃহৎ ও ঐতিহ্যবাহী উৎসব।
নাদাম উৎসবের রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। প্রাচীনকালে মঙ্গোল রাজা ও সামরিক নেতারা সারাবছর ধরে সৈন্য ও ঘোড়াগুলোকে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিতেন। সৈন্যদের মনোবল বাড়াতে ও প্রশিক্ষণের একঘেয়েমি কাটাতে এই দিনে তারা সেনাদের মাঝে তিনটি খেলার প্রতিযোগিতা আয়োজন করতেন- কুস্তি, তীর নিক্ষেপ এবং ঘোড়দৌড়।
১২০৬ সালে মঙ্গোল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা চেঙ্গিস খান ক্ষমতা হাতে নেয়ার পর এই উৎসব চলমান রাখেন। তার সময়েও প্রাচীনকালে এই উৎসবের যেসব রীতি ছিল, সেগুলো অপরিবর্তিত রাখা হয়। ২০০৬ সালে খুব জাঁকজমকপূর্ণভাবে নাদাম উৎসবের আটশো বছর পূর্তির অনুষ্ঠান পালন করা হয়। ইতিহাসে নাদাম শুরুর বছর হিসেবে ১২০৬ সালকে গণনা করা হলেও মূলত এই উৎসব ভিন্ন নামে চেঙ্গিস খানের আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। ২০১০ সালে ইউনেস্কোর ‘সাংস্কৃতিক হেরিটেজ’ এর তালিকায় এই উৎসবকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৩৯ সালে এই উৎসব কিছুটা ধর্মীয় আঙ্গিকে পালন করা হয়। পাঁচ বছর বয়সী জানাবাজারকে আধ্যাত্মিক নেতা ঘোষণা দেয়া হয়।
সাধারণত প্রতি বছর জুলাই মাসের এগারো ও বারো তারিখে নাদাম উৎসব চলতে থাকে। তবে কিছু জায়গায় ভিন্ন সময়েও উৎসবটি পালিত হয়ে থাকে। রাজধানী উলানবাটারের জাতীয় স্টেডিয়ামে বর্ণিল উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, প্যারেড এবং জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়ে থাকে। মঙ্গোলিয়ানরা টিকিট কেটে আসন গ্রহণের মাধ্যমে এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। দেশের অন্যান্য স্থানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা প্যারেড অনুষ্ঠিত না হলেও তিনটি খেলার প্রতিটিই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। আপনি যদি পর্যটক হিসেবে রাজধানী উলানবাটোরের মূল অনুষ্ঠান উপভোগ করতে ব্যর্থও হোন, সেক্ষেত্রে স্থানীয় খেলাগুলো অনায়াসে উপভোগ করতে পারবেন। স্থানীয় পর্যায়ের উৎসবের খেলাগুলো আরও কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ মেলে। এছাড়া এগুলো হয়ে ওঠে স্থানীয় মানুষের বাৎসরিক মিলনমেলা। মঙ্গোলিয়ায় একুশটি রাজ্য এবং তিনশো ত্রিশটি ‘সৌম’ রয়েছে (সৌম বলতে বোঝানো হয় ছোট শহর)। সব রাজ্য এবং সৌমেই নাদাম উৎসব পালিত হয়ে থাকে।
যে তিনটি খেলা মঙ্গোলিয়ার নাদাম উৎসবের মূল আকর্ষণ, তার একটি হচ্ছে কুস্তি। কুস্তিগীররা আঞ্চলিক পর্যায়ে নিজেদের দক্ষতা প্রমাণ করে এরপর জাতীয় পর্যায়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার সুযোগ পান। তারা যে অঞ্চল থেকে উঠে আসেন, সেই অঞ্চলের মানুষ তাদেরকে প্রচুর সম্মান করে। যদি কেউ জাতীয় পর্যায়ের কুস্তিতে বিজয়ী হয়, তবে মঙ্গোলিয়ার মানুষ তাকে দেবতার মতো সম্মান করতে শুরু করে। এটা বলা হয়ে থাকে যে, চেঙ্গিস খান তার সেনাবাহিনীর শারীরিক ও মানসিক সামর্থ্য ঠিক রাখতে কুস্তি খেলার উপর জোর দিতেন। এই প্রতিযোগিতা শুধু পুরুষদের মাঝেই সীমাবদ্ধ, নারীরা এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারে না।
মঙ্গোলিয়ার কুস্তি খেলার নিয়ম খুবই সোজা। এখানে সময়ের কোনো ব্যাপার নেই। কুস্তি খেলার সময় আপনার পায়ের নিচের অংশ বাদে শরীরের কোনো অংশ মাটিতে স্পর্শ করলেই আপনি পরাজিত হয়েছেন বলে ধরে নেয়া হবে। জুলাই মাসের শুরুর দিকে সৌম বা ছোট শহরগুলোতে কুস্তি খেলা শুরু হয়। সৌম পর্যায়ে জয়লাভ করতে পারলে এরপর আপনাকে আইমাগ বা রাজ্য পর্যায়ে অংশগ্রহণ করার অনুমতি দেয়া হবে। এখানেও যদি আপনি জিতে যান, তবে আপনার পরবর্তী গন্তব্য হবে উলানবাটার। সেখানে আপনি প্রতিটি প্রদেশের চ্যাম্পিয়নদের মুখোমুখি হবেন। জাতীয় পর্যায়ের এই খেলাগুলো নাদাম উৎসবের প্রথম দিন, অর্থাৎ এগারো জুলাই উলানবাটারের জাতীয় স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়। আর পরের দিন তথা বারো জুলাই চূড়ান্ত খেলার মাধ্যমে মঙ্গোলিয়াী জাতীয় কুস্তি চ্যাম্পিয়ন নির্ধারণ করা হয়।
নাদাম উৎসবের আরেকটি উল্লেখযোগ্য খেলা হচ্ছে তির নিক্ষেপ। তির নিক্ষেপের তিন ধরনের প্রতিযোগিতার চল থাকলেও সবচেয়ে বেশি প্রচলিত হচ্ছে ‘খালখা খারভা’। এই ধরনের প্রতিযোগিতায় নারী প্রতিযোগীরা ষাট মিটার দূরের লক্ষ্যে বিশটি তির ছোড়ার সুযোগ পান, অপরদিকে পুরুষ প্রতিযোগীরা পঁচাত্তর মিটার দূরের লক্ষ্যে চল্লিশটি তির ছুড়তে পারেন। লক্ষ্যবস্তু হিসেবে চামড়ার একটি সিলিন্ডার আকৃতির বস্তু রাখা হয়। তির যতবার লক্ষ্যবস্তুকে স্পর্শ করবে, ততবার একটি করে পয়েন্ট পাবেন তির নিক্ষেপকারী। সাধারণত নির্ধারিত দূরত্বে দুই থেকে তিনটি লক্ষ্যবস্ত রাখা হয়। তবে শুধু লক্ষ্যবস্তুকে স্পর্শ করলেই হবে না, লক্ষ্যবস্তু যেন পূর্বের অবস্থান থেকে সরে যায়, সেটিও নিশ্চিত করতে হয়। মঙ্গোলীয় নারীরা এই প্রতিযোগিতায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন।
নাদাম উৎসবের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা হচ্ছে ঘোড়দৌড়। এই প্রতিযোগিতায় ঘোড়াগুলোকে কত দূরত্ব অতিক্রম করতে হবে, তা নির্ভর করে ঘোড়ার বয়সের উপর। দুই বছর বয়স্ক ঘোড়াদের দৌড়ের ব্যপ্তি হয় পনের কিলোমিটার। অপরদিকে যেসব ঘোড়ার বয়স ছয় বছরের বেশি, তাদেরকে দৌড়াতে হয় ত্রিশ কিলোমিটার। ঘোড়দৌড়ের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখ করার মতো বিষয় হচ্ছে, যেসব জকি ঘোড়ার পিঠে আরোহন করে, তারা সবাই শিশু। তাদের বয়স ৬-১২ বছর। ছেলে কিংবা মেয়ে– উভয় লিঙ্গেরই জকি দেখা যায়। প্রতিযোগিতায় বিজয়ী ঘোড়ার ঘামকে সুখের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রতিযোগিতা শেষ হওয়ার পর দর্শকরা বিজয়ী ঘোড়ার পায়ের নিচে চাদর বিছিয়ে দেন এবং নিজেদের বাড়িতে সেই চাদর ব্যবহার করেন।
নাদাম উৎসব মঙ্গোলীয়দের জাতীয় সংহতি ও ঐক্যের প্রতীক। এটি এমন একটি উৎসব, যেটি তাদেরকে তাদের গৌরবোজ্জ্বল অতীত স্মরণ করিয়ে দেয়। তবে এই উৎসবের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের উদযাপনে অংশগ্রহণ করার সুযোগ সবার মেলে না। কারণ রাজধানী উলানবাটারের জাতীয় স্টেডিয়ামেরর উৎসব উপভোগ করার জন্য প্রচুর মানুষ আগ্রহী থাকে। মঙ্গোলীয়রা এই উৎসব উদযাপনের জন্য প্রায় দুই সপ্তাহ ছুটি পেয়ে থাকেন৷ এই সময়ে সরকারি অফিসগুলো বন্ধ থাকে, ব্যাংকের মুল ফটকে তালা ঝুলতে থাকে, এমনকি রেস্টুরেন্ট কিংবা জাদুঘরও বন্ধ হয়ে যায়। অনেকে এই ছুটিতে বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে যান। মঙ্গোলিয়ায় সাধারণত যারা ভ্রমণ করতে যান, তারা এই নাদাম উৎসবের সময়ই পা রাখেন দেশটিতে। তবে এই সময়ে চাহিদা বেশি থাকার কারণে হোটেল ভাড়া, গাইডের ফি কিংবা যানবাহনের ভাড়া বেশি থাকে। মঙ্গোলিয়ার স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পরিচয় পেতে হলে নাদাম উৎসব উপভোগ করার বিকল্প নেই।