বি.দ্র.: আর্টিকেলে 'ব্ল্যাক প্যান্থার: ওয়াকান্ডা ফরেভার' মুভির স্পয়লার রয়েছে!
‘ব্ল্যাক প্যান্থার: ওয়াকান্ডা ফরেভার‘ মুভির শুরু একটি কালো স্ক্রিন দিয়ে। কালো স্ক্রিনের ব্যাকগ্রাউন্ডে আমরা শুনতে পাই প্রিন্সেস শুরি ওয়াকান্ডার দেবতা বাস্টের কাছে প্রার্থনা করছে। প্রার্থনায় শুরি বাস্টের কাছে আকুতি করছে যাতে তার ভাইকে বাঁচানোর প্রচেষ্টা সফল হয়। সিনেমার এক ফ্রেম দৃশ্য দেখার আগেই শুরির এই প্রার্থনা শুনে দর্শকদের হৃদয় ভারী হতে বাধ্য। কারণ আমরা জানি, শুরির ভাই, কিং টি’চালার পরিণতি। আমরা জানি, শুরির হাজারো প্রার্থনা, বৈজ্ঞানিক বা প্রযুক্তিগত দক্ষতা শেষ পর্যায়ে কাজে আসবে না। চ্যাডউইক বোজম্যানের হৃদয়বিদারক মৃত্যুর ছায়াই যেন ফুটিয়ে তোলে এই কালো স্ক্রিন। মুভির প্রথম দৃশ্যে আমরা দেখি টি’চালাকে এক প্রাণঘাতী রোগের হাত থেকে বাঁচানোর উপায় বের করতে শুরির আপ্রাণ চেষ্টা। তবে সকল চেষ্টা ব্যর্থ হয় যখন কুইন রামোন্ডা শুরিকে জানায়- টি’চালা আর নেই।
এই খবর শোনার সাথে সাথে স্ক্রিনে আসে সকল এমসিইউ মুভির শুরুতে দেখানো ‘Marvel Studios‘ লোগো। তবে এবার আর এমসিইউ-র প্রচলিত ফ্যানফেয়ার মিউজিকের সাথে বিভিন্ন মুভির সিন নেই লোগোতে, আছে সম্পূর্ণ নিঃশব্দে চ্যাডউইন বোজম্যানের টি’চালার একেকটি সিন। চ্যাডউইকের প্রতি মর্মস্পর্শী এই ট্রিবিউটে যথাযথভাবেই থিয়েটারে থাকা দর্শকেরা নিঃশব্দে সম্মানের সাথে স্মরণ করেন ওপারে চলে যাওয়া এই মহাতারকাকে।
বিশ্বজুড়ে থিয়েটার রক্ষণাবেক্ষণকারীদের কাছ থেকে জানা গেছে, সকল থিয়েটারই ‘Marvel Studios’ লোগো দেখানোর সময় পিনপতন নীরবতা ছিল। ঠিক এই মুহুর্তের গাম্ভীর্যই চ্যাডউইকের ট্রিবিউটে এবং মুভির নিজস্ব গল্পে ২ ঘন্টা ৪০ মিনিট ধরে রেখেছেন মুভির পরিচালক এবং কো-রাইটার রায়্যান কুগলার। এই মুভির গল্প, অভিনয়, রোমাঞ্চ, মিউজিক, ভিজ্যুয়াল, ডিরেকশন ইত্যাদি নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে এবং সামনেও হবে। এই লেখায় আমি মুভির গল্প এবং চরিত্রগুলোর অন্তর্নিহিত কিছু থিম নিয়ে কথা বলতে যাচ্ছি। স্বজনবিয়োগের শোক কীভাবে মানুষকে প্রভাবিত করে এবং সেই শোক ধারণ করে রায়্যান কুগলার কীভাবে একটি ক্যাথার্টিক সিনেমা তৈরি করেছেন, এই বিষয় নিয়ে একটু বিস্তারিত আলোকপাত করব।
‘ওয়াকান্ডা ফরেভার’-এর উপজীব্য ছিল রাজাহীন, মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত ওয়াকান্ডার ক্ষতচিহ্ন মানবিক উপায়ে অনুসন্ধান করা এবং এর ভেতর দিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার রাস্তা চিহ্নিত করা। টি’চালার মৃত্যুর প্রভাব প্রধানত দেখানো হয়েছে এঞ্জেলা ব্যাসেটের কুইন রামোন্ডা, লেটিশিয়া রাইটের শুরি ও লুপিতা নিয়োঙ্গোর নাকিয়ার মধ্য দিয়ে। টি’চালার অতি কাছের এই তিন নারীর শোক প্রকাশ পেয়েছে তিন রূপে। টি’চালার মা কুইন রামোন্ডা সন্তানের পরলোকগমন মেনে নিয়েছেন সবার আগে। প্রথমত, এই সন্তানের শোক কাটাতে না পারলে তিনি আরেক সন্তান, শুরিকে সাপোর্ট দিতে পারবেন না। তার উপর টি’চালা না থাকাতে ওয়াকান্ডার সিংহাসন রামোন্ডার কাছেই এসেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাশীল রাজ্য শাসনের গুরুভার যেন রামোন্ডাকে বাধ্য করেছে মানসিক ভারসাম্য খুঁজে পেতে।
এরপরে আসে টি’চালার ছোট বোন, শুরি। শুরির মধ্যে আমরা দেখতে পাই অনেকটা বিপরীত প্রতিক্রিয়া। মেডিসিন, টেকনোলজির সকল জ্ঞান প্রয়োগ করার পাশাপাশি বিজ্ঞানের কঠিন অনুসারী হয়েও ভাইয়ের জীবনের জন্য দেবতার কাছে প্রার্থনা করেছিল শুরি। সেই প্রার্থনার কোনো ফল না পেয়ে একদমই স্কেপটিক এবং বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে ওয়াকান্ডার প্রিন্সেস।
তারপর আমরা দেখতে পারি টি’চালার জীবনের ভালোবাসা, নাকিয়াকে। পৃথিবীর সবার কাছ থেকে গোপন রাখলেও মুভির মিড-ক্রেডিট সিনে আমরা জানতে পারি নাকিয়া জানত টি’চালার ব্যধির কথা। নাকিয়াই মানসিকভাবে সবচেয়ে বেশি প্রস্তুত ছিল টি’চালার মৃত্যু মেনে নিতে। অভিনেত্রী লুপিতা নিয়োঙ্গো বলেছেন, এই দিকটি ফুটিয়ে তোলা তার জন্য বেশ কষ্টকর এবং একইসাথে উপকারী ছিল, কারণ তিনি নিজে মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না বাস্তবে চ্যাডউইকের মৃত্যুর জন্য। নাকিয়ার স্বাস্থ্যকর মানসিক অবস্থার অভিনয় কষ্টসাধ্য হলেও নিয়োঙ্গোর নিজের শোক কাটাতে তা অনেকটা থেরাপির মতো কাজ করেছে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। মিড-ক্রেডিটে আমরা পরিচিত হই টি’চালার ছেলে, প্রিন্স টি’চালার সাথে। এটা ছিল রায়্যান কুগলারের কাছ থেকে অতি বুদ্ধিমান একটি চয়েস, এখন চ্যাডউইককে রিকাস্ট না করেও আরেক টি’চালাকে পাব ভবিষ্যতে।
টি’চালার কাছের মানুষদের মানসিক বিষাদের পাশাপাশি তার মৃত্যু প্রভাবিত করেছে মুভির গল্পের বাহ্যিক কিছু উপাদানও, যেমনটা আমরা দেখতে পাই ‘মার্ভেল স্টুডিওস’ লোগোর পর প্রথম দৃশ্যে। ইউনাইটেড ন্যাশন্সের এক সেশনে ফ্র্যান্স ওয়াকান্ডার ভাইব্রেনিয়ামের দখল নেয়ার কৌশল চালালে কুইন রামোন্ডা তাদের মনে করিয়ে দেন ওয়াকান্ডার পরাক্রম। এই দৃশ্যে এঞ্জেলা ব্যাসেটের ডায়লগের মাধ্যমে মুভির মূলভাব অনেকটাই ফুটে ওঠে। বিশ্বের পরাশক্তিগুলো ওয়াকান্ডাকে অরক্ষিত গণ্য করছে ব্ল্যাক প্যান্থারের অনুপস্থিতিতে। কিন্তু রামোন্ডা তাদের (এবং একইসাথে দর্শকদের) মনে করিয়ে দেন- ব্ল্যাক প্যান্থার না থাকলেও ওয়াকান্ডা পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর এবং সমৃদ্ধ জাতি। ফ্র্যাঞ্চাইজির দ্বিতীয় মুভির নামে ‘ওয়াকান্ডা ফরেভার’ সাবটাইটেল দিয়ে রায়্যান কুগলার এই বার্তাই দিয়েছেন। টি’চালা হয়তো চলে গিয়েছেন, কিন্তু ওয়াকান্ডার গল্প মাত্র শুরু।
এই কথার ভিত্তিতে এখন আসা যাক মুভির মূল গল্পে। ‘ব্ল্যাক প্যান্থার: ওয়াকান্ডা ফরেভার’-এ আমরা দেখতে পাই পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দুই রাজ্যকে যুদ্ধে যেতে। প্রথম ব্ল্যাক প্যান্থার মুভিতে আমরা জানতে পারি প্রাচীন সেই উল্কাপিণ্ডের কথা, যার কারণে ওয়াকান্ডা ভাইব্রেনিয়াম পায়। দ্বিতীয় মুভিতে আমরা জানি হাজার বছর আগে একইসাথে আরেকটি উল্কাপিণ্ড পতিত হয় সাগরের তলদেশে। ভাইব্রেনিয়াম যেভাবে ওয়াকান্ডানদের পরাক্রমশালী করে তুলেছে, তেমনই পরাক্রমশালী হয়ে গড়ে উঠেছে পানির নিচের এই সভ্যতা, টালোকান রাজ্য। এই দুই মহাশক্তির সংঘর্ষকে রায়্যান কুগলার অতি প্রাসঙ্গিক এবং কৌতূহলোদ্দীপক সূত্রে গেথেছেন।
ওয়াকান্ডার যেমন রয়েছে ব্ল্যাক প্যান্থার, টালোকানের সেই রক্ষাকর্তার নাম ‘নামোর’, বা তাদের ভাষায় ‘কু’কুলকান’। নামোর এবং টালোকানকে কমিকবুকের পাতা থেকে ভিন্নরূপে চিত্রায়ন করা হয়েছে এই মুভিতে। নামোর এখানে ষোড়শ শতাব্দীতে মিউট্যান্ট হিসেবে জন্ম নেয়া মায়ান সভ্যতার একজন অতিমানবিক সত্তা যাকে তার অনুসারীরা ‘The Feather-Serpent God’ নামে ডাকে। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে নামোরের আদিবাসী গোষ্ঠীকে আশ্রয় নিতে হয় সাগরের তলায়, শরীরের গঠন পরিবর্তন করে পানি থেকে অক্সিজেন সংগ্রহ করা শুরু করে পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন মায়ান সভ্যতার এই গুচ্ছ সম্প্রদায়। নামোরের মায়ের মৃত্যুর পরে তার ইচ্ছা অনুযায়ী স্থলে নিয়ে আসা হয় তাকে সমাহিত করতে। কিন্তু সাগর থেকে মাটিতে পা দিয়ে নামোর প্রত্যক্ষ করে স্প্যানিশ কলোনাইজেশনের ভয়াবহ চিত্র। সহজাত মায়ান মানুষদের উপর ঔপনিবেশিক শক্তির চালানো বর্বরতা দেখে স্থলবাসীদের প্রতি তার মন হয়ে ওঠে কঠোর এবং ক্ষমাহীন। এরপর থেকেই নিজের মানুষকে রক্ষা করতে তিনি টালোকানকে সম্পূর্ণভাবে লুকিয়ে রাখেন পৃথিবীর নজর থেকে।
‘ওয়াকান্ডা ফরেভার’ মুভিতে তাই যখন কুইন রামোন্ডা এই গুপ্ত রাজ্যের খবর বিশ্বের কাছে ফাঁস করে দেবার হুমকি দেন, নামোর তীব্র প্রতাপে আক্রমণ করে ওয়াকান্ডাকে। এই যুদ্ধের চোখধাঁধানো ভিজ্যুয়াল, মন কেড়ে নেয়ার মতো সাউন্ডট্র্যাক আর রোমাঞ্চকর অ্যাকশনের পাশাপাশি অন্যতম আকর্ষণীয় দিক ছিল দুই পক্ষের কেন্দ্রীয় চরিত্র- নামোর আর শুরির অত্যন্ত ব্যক্তিগত এবং যৌক্তিক ডাইনামিক।
শুরি মুভির একপর্যায়ে রিরি উইলিয়ামসকে বাঁচাতে স্বেচ্ছায় নামোরের বন্দি হয়ে টালোকানে যায়। এখান থেকে আমরা দেখতে পাই শুরি ও নামোরের মধ্যে সম্ভবত মুভির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য। নামোর শুরিকে তার এবং তার রাজ্যের উৎপত্তির ঘটনা বলে, কলোনাইজেশনের হুমকি এই দুই নেতাকে একসূত্রে বাধার ভিত্তি গঠিত হয় এই দৃশ্যেই। ভাই হারানোর দুঃখে ক্রুদ্ধ শুরির আবেগে আগুন ধরিয়ে সেই রোষানলে দুজন মিলে পৃথিবী পুড়িয়ে দেয়াটা কয়েক সেকেন্ডের জন্য প্রকৃত এক সম্ভাবনা হয়ে উঠছিল। শুরির এই মানসিক পরিস্থিতি অত্যন্ত বাস্তবিক উপায়ে ফুটিয়ে তুলেছেন লেটিশা রাইট, একটি শক্তিশালী স্ক্রিপ্টের সাহায্যে। এই চলচ্চিত্রে শুরির গল্প এমসিইউ-তে সবচেয়ে চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলা কাহিনিগুলোর মাঝে অন্যতম।
তার গল্প শুরু হয় বিষণ্নতা এবং হাল ছেড়ে দেয়ার একদম নিচু স্থান থেকে, ভাইয়ের পরে মাকে হারিয়ে শিকার হয় আরো বড় মানসিক ধাক্কার। তবে মুভির কাহিনীর বিস্তারে সে খুঁজে বের করে এই যন্ত্রণা সহ্য করার উপায়, খুঁজে পায় তার হারানো আত্মবিশ্বাস, এবং সকল ব্যথা-বেদনাকে শক্তিতে রূপান্তর করে পরবর্তী ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’ হিসেবে নিজের দায়িত্ব এবং নিয়তিকে আলিঙ্গন করে নেয়। শুরির জার্নি সম্পূর্ণ দেখার পরে বাস্তবে চ্যাডউইকের বিয়োগান্তক দুঃখের কিছুটা হলেও প্রশমিত হওয়ার কথা দর্শকদের। রায়্যান কুগলার যেন নিজের শোক, দুঃখকে প্রবাহিত করেছেন এই মুভিতে শুরির আর্কের জন্য, যা পালাক্রমে অনেকটা থেরাপিউটিক অভিজ্ঞতা হিসেবে কাজ করেছে সারা বিশ্বের দর্শকের জন্যই।
ক্যান্সারের কাছে ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং ইতোমধ্যে কাজ শুরু করা মুভির লিডকে একসাথে হারান পরিচালক রায়্যান কুগলার, ২০২০ সালের আগস্ট মাসে। এই শোক নিয়েই তাকে ব্ল্যাক প্যান্থারের সিক্যুয়েলের জন্য সম্পূর্ণ ভিন্ন এক গতিপথ কল্পনা করতে হয়। সহ-লেখক জো রবার্ট কোলের সাথে রায়্যান কুগলার নতুন স্ক্রিপ্টের কাজ শুরু করেন টি’চালাবিহীন এক সিক্যুয়েলের। সমূহ সম্ভাবনা ছিল প্রথম মুভির আইকনিক, বিশ্ব সমাদৃত লিডকে ছাড়া পরবর্তী মুভি মুখ থুবড়ে পড়ার। কিন্তু কুগলার নিজের শৈল্পিক মূল্যবোধ এবং সৃজনশীলতার প্রমাণ দিয়ে আমাদের উপহার দিয়েছেন অতি চমৎকার একটি সিক্যুয়েল। মুভির শেষ দৃশ্যে শুরি যখন মায়ের উপদেশ মতো ফিউনারেলের সাদা পোশাক পুড়িয়ে টি’চালার প্রস্থানের সাথে বোঝাপড়ায় আসছে, তখন থিয়েটারে রিয়ান্নার ‘Lift Me Up’ গানের ছন্দে আড়াই ঘন্টার গভীর, আবেগপূর্ণ সিনেমা দেখার অসাধারণ এক আবহ বিরাজ করছিল।