রহস্যময় পৃথিবীতে রহস্যের যেন কোনো শেষ নেই। বিজ্ঞানী এবং গবেষকরা নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে অনেক রহস্যের সমাধান করেছেন। কিন্তু এখনো অনেক রহস্যের সমাধান করা বাকি রয়ে গেছে। পৃথিবীতে এমন কিছু স্থাপত্য রয়েছে যার রহস্য আজও অজানা। কে তৈরি করেছিল, কি আছে তাতে, কিভাবে তৈরি করা হয়েছিল, কখন তৈরি করা হয়েছিল, কেনই বা তৈরি করা হয়েছিল এগুলো- এসব প্রশ্নের উত্তর রহস্যের আবডালে ঢাকা রয়েছে আজ অবধি।
রহস্যের সাথে কৌতুহলের এক সমানুপাতিক সম্পর্ক রয়েছে। আর মানুষ মাত্রই জানার আগ্রহকে উপেক্ষা করা মুশকিল। তাই সময় নষ্ট না করে চলুন জেনে নেই বিশ্বের রহস্যময় পাঁচটি স্থাপত্য সম্পর্কে।
কাস্তা টম্ব, গ্রীস
গ্রীসের এই সমাধিকে ঘিরে থাকা রহস্যের উত্তর আজও মানুষ খুঁজে বেড়াচ্ছে। এই সুন্দর সমাধিতে কাকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল-আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের স্ত্রী রোক্সান, তার ছেলে বা মা কিংবা স্বয়ং আলেকজান্ডারই এই সমাধিতে শায়িত আছেন কিনা সেই রহস্যের উত্তর আজও অজানা রয়ে গেছে। কাস্তা পাহাড়ে এ সমাধিটি অবস্থিত এবং এর চারপাশে প্রায় ৫০০ মিটার লম্বা প্রাচীর রয়েছে, যা মার্বেল পাথর এবং চুনাপাথর দিয়ে তৈরি।
প্রাচীর এবং সমাধির গায়ে অসাধারণ কিছু কারুকার্য রয়েছে যা আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের সময়কার স্থপতি ডীনোক্রেটিসের কাজের সাথে মিলে যায়। প্রাচীর থেকে প্রায় তের ধাপ সিঁড়ি নিচে রয়েছে প্রবেশদ্বার।
তোরণদ্বারেই রয়েছে মাথা এবং ডানাবিহীন স্ফিঙ্কস (এক ধরণের পৌরাণিক জীব যার মাথা মানুষের ন্যায় এবং শরীর সিংহের ন্যায়)। সমাধির একেবারে চূড়ায় রয়েছে এক প্রকান্ড সিংহের প্রস্তর মূর্তি, যাকে বলা হয় ‘লায়ন অফ এম্ফিপোলিস’। সিংহটির উচ্চতা ৫.৩ মিটার এবং এর পাদদেশের প্রস্তরখন্ডসহ মোট উচ্চতা ১৫.৮৪ মিটার।
প্রবেশদ্বারের স্ফিঙ্কসের কারুকাজ এবং এম্ফিপোলিসের সিংহের কারুকাজ প্রায় একই রকম। ধারণা করা হয়ে থাকে একই ব্যক্তির শিল্পকর্ম এটি। কাস্তা টম্বটি এখনো জনসাধারণের প্রবেশের জন্য খুলে দেয়া হয়নি, সিল করে রাখা হয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা মনে করেন এখানে অনেক মূল্যবান ঐতিহাসিক তথ্য লুকিয়ে রয়েছে। সমাধিটিতে খনন কাজ চলছে রহস্য উদঘাটনের জন্য। এর তৃতীয় কক্ষ পর্যন্ত কেবলমাত্র খননকার্য সম্পন্ন হয়েছে, হয়ত পুরোটা খনন শেষ হলে রহস্যের একটা কিনারা হবে।
পুমা পুনকু, বলিভিয়া
বলিভিয়ায় অবস্থিত পুমা পুনকু পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন রহস্যময় জায়গা। ধ্বংসাবশেষের মাঝে খুঁজে পাওয়া অবকাঠামো এবং এতে সুস্পষ্ট ও জটিল কারুকাজগুলোই পুমা পুনকুকে ঘিরে এক রহস্য তৈরি করেছে। কে এই অবকাঠামো তৈরি করেছিল? অবকাঠামোটি কিভাবে তৈরি হয়েছিল? কেন এই অবকাঠামোটি তৈরি করা হয়েছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর এখন পর্যন্ত অজানা। এর গঠন, আকার এবং অবস্থান বেশ ভিন্ন ধরনের।
অবকাঠামোর পাথরগুলোর গায়ে যে জটিল খোদাইগুলো করা হয়েছে, তা দেখে মনে হয় এ কাজের জন্য হয় মেশিন অথবা লেজার রশ্মি ব্যবহার করা হয়েছে। মনে প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি প্রাচীন সভ্যতার মানুষেরা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করত? অবকাঠামোটির পাথরগুলো খুব নিখুঁত কোণে কাটা হয়েছে।
প্রত্নতত্ত্ববিদগণ ধারণা করে থাকেন, পুমা পুনকুর এই বিশাল পাথরখন্ডগুলো আনা হয়েছিল প্রায় ৬০ মাইল দূর থেকে। কিন্তু পুমা পুনকু ১২,৮০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত, যার অর্থ হচ্ছে এ জায়গাটি ‘ন্যাচারাল ট্রি লাইন’ এর উপরে অবস্থিত, যেখানে কোনো গাছ জন্মাত না। তাহলে সেখানে গাছ কেটে কোনো বাহন বা অন্য কিছু বানানো সম্ভব ছিল না, যার সাহায্যে এই বিশাল প্রস্তরখন্ডগুলো দূর থেকে টেনে আনা যাবে এখানে। প্রশ্ন হচ্ছে- তাহলে কিভাবে এই বিশাল পাথরগুলোকে এখানে বয়ে আনা হয়েছিল? এখানেই পৃথিবীর সব থেকে বড় মেগালিথিক পাথর খুঁজে পাওয়া যায়। এখানে এমন পাথরও রয়েছে যার ওজন প্রায় ১০০ টন।
মাসুদা নো ইওয়াফুন, জাপান
জাপানের পাহাড়ে ঘেরা একটি গ্রাম আসুকা। বৌদ্ধ মন্দির, মঠ এবং ভাস্কর্যশিল্পের জন্য এ এলাকাটি বিশেষভাবে পরিচিত। কিন্তু এখানেই এমন কিছু কীর্তিস্তম্ভ রয়েছে যা গঠনগত বা ভাবানুসারে কোনো বৌদ্ধমন্দিরের গঠনের সাথে যায় না। এমনকি এই স্তম্ভগুলো কে তৈরি করেছে বা কখন তৈরি হয়েছে কেউ বলতে পারে না। এই কীর্তিস্তম্ভগুলো যুগের পর যুগ ধরে রহস্যের আধার হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে। এখানকার স্তম্ভগুলোর মাঝে সর্বাপেক্ষা বড় স্তম্ভটি ‘মাসুদা নো ইওয়াফুন‘ নামে পরিচিত।
মাসুদা নো ইওয়াফুন এর অর্থ হচ্ছে ‘রক শিপ অফ মাসুদা’। অকাডেরা স্টেশনের কাছে একটি পাহাড়ের পাদদেশে এটি অবস্থিত। এর উচ্চতা ১৫ ফুট। নিখাদ গ্রানাইটের তৈরি এ স্তম্ভটিতে দুটি চারকোনা গর্ত রয়েছে, যার শেষপ্রান্ত মাটির সাথে সংযুক্ত।
গোসেক সার্কেল, জার্মানি
গোসেক সার্কেল অবস্থিত জার্মানিতে। ১৯৯১ সালের আগেও মানুষ এই রহস্যঘেরা জায়গায়টি সম্পর্কে জানত না। ১৯৯১ সালে গোসেক শহরে একটি এরিয়াল জরিপের সময় অদ্ভুত বৃত্তাকার এ বলয়টি সবার দৃষ্টিগোচর হয়। ধারণা করা হয়, এখানে প্রায় ৪৯০০ খ্রিষ্টাব্দ আগে ইউরোপের প্রথম সভ্যতা গড়ে উঠেছিল যা প্রাচীন মিশরীয় পিরামিডেরও আগেকার কথা। ২০০২ সালে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা গোসেক সার্কেলে খননকাজ শুরু করেছিলেন। সেখান থেকে তারা আবিস্কার করেন যে, এখানকার প্রাচীন স্থাপনাগুলো অতীতে আবার কখনো সংস্করণ করা হয়েছিল!
সার্কেলটি ৭৫ মিটার চওড়া, অনেকগুলো সমান্তরাল খাঁজবিশিষ্ট। এতে দুটি পলিভিয়ার রিং এবং কিছু প্রবেশদ্বার রয়েছে যা সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত বরাবর বিদ্যমান। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করে থাকেন এখানে হয়ত কোনো ব্যক্তি সোলার বা লুনার ক্যালেন্ডার তৈরি করছিলেন। অনেকে আবার এ জায়গাকে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ‘সোলার অবজার্ভেটরি’ হিসেবেও গণ্য করে থাকেন।
জর্জিয়া গাইডস্টোন, আমেরিকা
জর্জিয়া গাইডস্টোন একটি ২০ ফুট লম্বা পাথরের স্তম্ভ। অনেকে একে ‘আমেরিকান স্টোনহেঞ্জ’ ও বলে থাকেন। প্রস্তরখন্ডগুলোর ঠিক মাঝখানে একটি পাতলা আয়তাকার ফলক রয়েছে, এর চারপাশে রয়েছে বড় চার খন্ড প্রস্তরফলক এবং উপরে আরেক টুকরো প্রস্তরফলক। জর্জিয়া গাইডস্টোনের নেপথ্যে যে নামটি সর্বাগ্রে আসে তিনি হলেন আর. সি. ক্রিশ্চিয়ান। ১৯৮৯ সালের জুন মাসের এক শুক্রবারে তার আবির্ভাব ঘটে এবং তিনি আলবার্টন গ্রানাইট ফিনিশিং কোম্পানীকে অনুরোধ করেন একটি প্রস্তরস্তম্ভ নির্মাণ করার জন্য যা একাধারে কম্পাস, ক্যালেন্ডার এবং ঘড়ি হিসেবে কাজ করবে। সেই সাথে ক্রিশ্চিয়ান এটাও অনুরোধ করেন যে, স্তম্ভটি প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দূর্যোগেও যেন টিকে থাকে। কোম্পানীর মালিক লোকটিকে পাগল ভেবে তাকে তাড়িয়ে দিতে চাইলেন। তখন লোকটি আবারো জানান তিনি আমেরিকার একটি গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত এবং স্তম্ভটি নির্মাণ বাবদ সকল খরচ তারা বহন করবে। এরপর ক্রিশ্চিয়ান নির্মাতাদের একটি মডেল দিয়ে নির্মাণ করার কিছু নিয়মও বলে দিলেন। গাইডস্টোনে ১০টি মূলনীতি খোদাই করা ছিল ‘প্রিন্সিপাল অফ হিউম্যানিটি’ শিরোনামে।