জন্ম এবং মৃত্যুর পাশাপাশি মানবসমাজে যে শব্দটি অসম্ভব গুরুত্ব পেয়েছে সেটি হলো বিয়ে। আর বিয়ের মতন একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে মানুষের চিন্তা-ভাবনা থাকবে না তা হয় না। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতাকে ঘিরে থাকে অনেক প্রথা, নানাবিধ অনুষ্ঠান। দেশভেদে এই আনুষ্ঠানিকতায় থাকে ভিন্নতা। তবে ভিন্ন হলেও এটা সত্য যে, নিজের বিয়েতে মানুষ তার জীবনের সেরা পোশাকটি পরতে চায়। হতে চায় অসম্ভব সুন্দর। কোন পোশাকটি সুন্দর সেটা নিয়ে কিন্তু কম কাটাছেঁড়া হয়নি। প্রতিনিয়ত মানুষের পছন্দ আর ভালোলাগা পরিবর্তিত হয়েছে। সেইসাথে পরিবর্তন এসেছে বিয়ের পোশাকেও। পোশাকের রঙ হিসেবে কেউ বেছে নিয়েছে সাদাকে, কেউ আবার লাল রঙয়েই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছে। বিশেষ করে পশ্চিমা সমাজে বিয়ের সময় সাদা পোশাক পরিধান করাটা যেন অলিখিত এক নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেন? বিয়ের পোশাকের রঙ সাদা হওয়ার অর্থ কী? আর লাল, সেটাই বা কেন?
প্রশ্নের উত্তরটা খুব সহজ। বেশিরভাগ মানুষই ভেবে এসেছেন- বিয়ের পোশাকে সাদা রঙ থাকার অর্থ হলো কনের সতীত্ব এবং শুদ্ধতা। তবে পোশাকের ইতিহাস বলতে গিয়ে ইদানিং অনেকে ভাবছেন, শুদ্ধতা বা পবিত্রতা নয়, বিয়েতে নারীর পরনে সাদা রঙ ব্যবহারের কারণ আভিজাত্য। লন্ডনের ‘ভিক্টোরিয়া এন্ড অ্যালবার্ট’ জাদুঘরের তত্ত্বাবধায়ক এডুইনা রেমানের মতে, পবিত্রতার ব্যাপারটি এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। পুরোটাই টাকার ব্যাপার।
১৮ এবং ১৯ শতকে যে নারীরা প্রচুর সম্পদের অধিকারী কিংবা ধনী পরিবারের সদস্য হতেন, তারাই সাদা পোশাকে বিয়ে করতে পারতেন। তখন কাপড় পরিষ্কারের প্রক্রিয়া এখনকার মতো সহজ ছিল না। প্রচুর কষ্ট করে, টাকার বিনিময়ে কাপড় পরিষ্কার করতে হতো। সাদা পোশাক পরিষ্কার করাটা ছিল একেবারেই অসম্ভব একটি কাজ। তাই আপনি সাদা পোশাক বিয়েতে পরার জন্য কিনছেন, এর মানে আপনি জানেন যে, পোশাকটি অনেক দামী, এটি পরা যাবে না খুব বেশি এবং আপনি পোশাকটি অনেকটা তুলে রাখার জন্যই কিনেছেন। এমনটা কেবল ধনীদের ক্ষেত্রেই সম্ভব। তাই বিয়েতে সাদা রঙয়ের পোশাক পরা আর সম্পদের অধিকারী হওয়াটা অনেকটা একই ছিল সেসময়।
সাদা কিংবা লাল রঙয়ের এই ব্যবহার ঠিক কবে থেকে শুরু হল? সাদা রঙয়ের ব্যবহার শুরু হওয়ার সময়কালটা লেখার শুরুতেই জানিয়েছি। তবু হিসেব করে বলতে গেলে, ২০০ বছর আগে শুরু হয়েছিল বিয়েতে এই সাদা পোশাক পরার চল। তবে ১৭৬ বছর পূর্বে, লাল রংকেও কিন্তু পশ্চিমে বিয়ের পোশাকের রঙ হিসেবে ব্যবহার করা হতো। গোলাপের লাল রঙ এবং যে কারণে আমরা এখনো লাল রঙকে বিয়ের পোশাকে প্রাধান্য দিয়ে থাকি সেই উৎসবমুখর ব্যাপারটিও ছিল একটা সময় পোশাকে লাল রঙ রাখার কারণ। বিশেষ করে, ভারতীয় সংস্কৃতিকে মাথায় রাখলে দেখা যায় যে, এটি ভালোবাসা আর আনন্দের রঙ। সেই সাথে মঙ্গল, যার হাতে বিয়ের সমস্ত দায়িত্ব, সেই গ্রহটির কথা মাথায় রেখেও লাল রঙকে বিয়ের পোশাকের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়।
এছাড়া লাল রঙে আরো অনেক বেশি আনন্দিত দেখা যায় মানুষকে। যতটাই মন খারাপ থাকুক আপনার, লাল রঙ মন খারাপ একটু হলেও দূর করতে সাহায্য করে। ফলে ভারতে লাল রঙকে বিয়ের পোশাকের রঙ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে বছরের পর বছর এবং সেই ধারাকে আপন করে নিয়েছি আমরা এবং আরো অনেকে। সেটা নিয়ে অবাক হওয়ার কিছু নেই। সেই সময় কারো মৃত্যুর শোক পোশাক করার রঙ হিসেবে ব্যবহার করা হত সাদা রঙকে। স্কটের মেরি কুইন প্রথম সাদা পোশাক ব্যবহার করেন নিজের বিয়েতে। তাকে নিয়ে প্রচুর সমালোচনা হয়। তবে সেসব কিছুই শোনেননি মেরি। তবে বিয়ের কয়েক বছর পরেই মারা যায় তার স্বামী। ফলে দোষ চলে যায় সাদা পোশাকের উপরে।
বিয়েতে সাদা পোশাক পরিধানের এই চল শুরু হয় রানী ভিক্টোরিয়া এবং রাজপুত্র অ্যালবার্টের সময় থেকে। ১৮৪০ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি বিয়ে করেন এই জুটি এবং নিজের বিয়েতে সাদা রঙয়ের পোশাক পরেন রানী। এর কিছুদিন পরই নারীদের কাছে বেশ পরিচিত ম্যাগাজিন, তৎকালীন গোডি’স লেডি বুকে জানানো হয় যে, সাদা রঙ বিয়ের পোশাকে ব্যবহার করার জন্য মানানসই একটি রঙ। নিষ্পাপ আর পবিত্র রঙ সাদা। একদিকে সাদা রঙয়ের পোশাক আকর্ষণীয়। সেই সাথে, পোশাক নির্মাতারাও পছন্দ করেন বিয়ের ক্ষেত্রে সাদা রঙ ব্যবহার করতে। নতুন কোনো সম্পর্কে যাওয়ার আগে, নিজেদের পুরনো সম্পর্ককেই আবার নতুন এক আঙ্গিক দিতে সাদা রঙ ভালোবাসা, পবিত্রতা ও এক স্নিগ্ধ অনুভূতি প্রকাশ করে বলে মনে করে মানুষ।
তবে তার মানে এই নয় যে, সাদা রঙ ছাড়া অন্য কোনো রঙয়ের পোশাক নিজের বিয়েতে পরেন না কেউ। সব মিলিয়ে এরপরই সবার, বিশেষ করে পশ্চিমাদের কাছে বিয়ের পোশাক হিসেবে সাদা রঙ হয়ে পড়ে সবচাইতে কাঙ্ক্ষিত রঙ। এটা সত্য যে, পশ্চিমাদের ক্ষেত্রে সাদা এবং আমাদের ক্ষেত্রে লাল (যেটা কিনা আপনি উৎসবের রঙ হিসেবেই চালিয়ে দিতে পারবেন), অনেকটা বাঁধাধরা ব্যাপার হয়ে পড়েছে। বিয়েতে লাল এবং সাদা রঙ পরা হবে এটাই যেন আগে থেকে ঠিক করা। লাল রঙয়ের কথাটা পশ্চিমাদের বেলায় অবশ্য বলার অবকাশ নেই। কারণ আমাদের দেশে লাল রঙয়ের শাড়ি কিংবা পোশাক পরিধানের চল থাকলেও বেশিরভাগ দেশে, বিশেষ করে পশ্চিমে এই চল নেই তেমন। অবশ্য বাংলাদেশেও যে লাল রঙয়ের সেই শাড়িকে পেছনে ফেলে নানা রকম রঙ ব্যবহার করা হচ্ছে বিয়ের পোশাকে।
পশ্চিমেও তেমনি নিজেদের প্রথাকে পেছনে রেখে বিয়েতে সাদার পাশাপাশি গোলাপি, লাল এবং কালো রঙয়ের গাউনও পরেছেন অনেকে। এটাকে অনেকটা বিদ্রোহী একটা মনোভাবের সাথে তুলনা করা হয়। স্রোতের বিপরীতে গিয়ে কিছু করাটা তো বিদ্রোহী ও অন্যরকম হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করে দেওয়াই। তাই না? এডুইনার মতে, এমনটা নতুন কিছু নয়। যুগে যুগে ফ্যাশন সচেতন অনেকেই সাদার পাশাপাশি অন্য রঙকে বিয়ের পোশাকের রঙ হিসেবে বেছে নিয়েছে। নানা সময়ের ছাপও এসে বিয়ের পোশাকে লেগেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পর্দার কাপড় কেটে, ধার নিয়ে কিংবা সৈনিকের পোশাকেই বিয়ে করার উদাহরণ আছে। সেগুলো এখন হয়তো পাকাপাকিভাবে তার ছাপ রাখেনি বিয়ের পোশাকের উপরে, তবে সময় পোশাককে কতটা প্রভাবিত করতে পারে তা বুঝিয়েছে।
যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বিয়ের পোশাকে ভিন্নতা আসে। নারীরা কাজের সাথে যুক্ত হয় একটু বেশি করে। ফলে পোশাকের দৈর্ঘ্য একটু কমিয়ে আনা হয়। চলাফেরায় কোনো জড়তা রাখতে চাননি সেসময় নারীরা। উপভোগ করতে চেয়েছেন নিজের বিয়ের দিনটিকে আর পোশাককেও সেভাবেই তৈরি করে নিয়েছেন। আপনি বিয়েতে কেমন পোশাক পরবেন সেটা মূলত নির্ভর করে আপনার অবস্থান, উদ্দেশ্য, স্বাচ্ছন্দ্য- ইত্যাদির উপর। ষাটের দশকে অনেকে নতুন ধাঁচের বিয়ের পোশাক তৈরি করেছেন নিজেদের জন্য। সেটাও নিজেদের ফ্যাশন আর স্বাচ্ছন্দ্যকে মাথায় রেখেই। তবে পোশাক যেমনই হোক, সাদা রঙ টিকেছিল সবসময়ই। যেমনটা আমাদের জন্য বিয়ে মানেই স্থায়ী হয়ে আছে লাল রঙ।
ফিচার ইমেজ: Wedding Dresses and Fashion Ideas