তর্কের খাতিরে তর্ক চালিয়ে গেলে আর যা-ই হোক, বিতর্ক হয় না। আর সব কিছুর মতো বিতর্কেরও রয়েছে কিছু ব্যাকরণ। বিতর্কের ব্যাকরণ না জেনে বিতর্ক করলে তা দিনশেষে শুধু কিছু অগোছালো যুক্তি হিসেবে থেকে যাবে। তাই, বিতর্ক করতে হলে সবার আগে জানা প্রয়োজন বিতর্ক করার বিধিবদ্ধ কিছু নিয়মকানুন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টরি, সংসদীয় বিতর্ক, বারোয়ারী বিতর্ক, সনাতনী বিতর্কের মতো প্রচলিত কিছু ফরম্যাট রয়েছে। আজ আমরা জানবো বহুল প্রচলিত ও জনপ্রিয় বাংলা বিতর্ক ফরম্যাট সংসদীয় বিতর্কের ব্যকরণ।
সংসদীয় বিতর্কে মূলত জাতীয় সংসদের একটি প্রতিরূপ তুলে ধরা হয়। যেখানে একটি সরকারী দল, একটি বিরোধী দল ও একজন স্পিকার থেকে থাকেন। সরকারী দল ও বিরোধী দলে তিনজন করে বক্তা থেকে থাকেন। সরকারী দল সংসদে একটি প্রস্তাবনা উত্থাপন করেন, বিরোধী দল তার বিরোধিতা করেন। গঠনমূলক পর্বে পাঁচ মিনিট করে ছয় জন বক্তা মোট ত্রিশ মিনিট এবং যুক্তিখন্ডন পর্বে উভয়পক্ষের একজন বক্তা অতিরিক্ত তিন মিনিট করে সময় পেয়ে থাকেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবনা উত্থাপনের পর কৌশল নির্ধারণের জন্যে বিরোধীদল এক মিনিট সময় পেয়ে থাকে। মোট ৩৭ মিনিটের অধিবেশন শেষে স্পিকার ও বিচারকেরা তাদের মতামত প্রদান করেন এবং তাদের বিচারকার্যের ভিত্তিতে প্রস্তাবনাটি সংসদে গৃহীত হবে কি না তা নির্ধারিত হয়।
বিতর্কের এই পুরোটা সময় জুড়ে কিছু নির্দিষ্ট নিয়মতান্ত্রিক কাঠামো অনুসরণ করতে হয় সবাইকে। এই নিয়মগুলো সম্পর্কে আমরা আজ বিস্তারিত জানবো।
সঙ্গায়ন: সংসদীয় বিতর্কের অন্যতম প্রধান শর্ত হলো প্রস্তাবনার প্রপঞ্চগুলোর সঙ্গায়ন করা। একটি বিতর্কের বিষয় কোন আঙ্গিকে সংসদে আলোচিত হবে, প্রস্তাবনার কোন বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে তার সমস্তই সঙ্গায়নে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করতে হয়। বিতর্কের সঙ্গায়নের কাজটি সাধারণত সরকারদলীয় প্রথম বক্তা অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী করে থাকেন।
বক্তাদের ভূমিকা: বাংলা সংসদীয় বিতর্কে দুই পক্ষে তিনজন করে মোট ছয়জন বক্তা থেকে থাকেন। সরকারীদলীয় প্রথম বক্তাকে প্রধানমন্ত্রী, দ্বিতীয় বক্তাকে মন্ত্রী ও সর্বশেষ বক্তাকে সংসদ সদস্য হিসেবে অভিহিত করা হয়। অপরদিকে বিরোধীদলের প্রথম বক্তাকে বিরোধীদলীয় নেতা, দ্বিতীয় বক্তাকে উপনেতা ও সর্বশেষ বক্তাকে সংসদ সদস্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
কেস: বিতর্কে দলগত অবস্থান পরিষ্কার করে তা সংসদে প্রতিষ্ঠা করার জন্যে যে নির্দিষ্ট যুক্তিগুলো তুলে ধরা হয়, তার সার্বিক রুপকে ‘কেস’ বলে। অর্থাৎ একজন বিচারক দুটি দলের কেসের তুলনামূলক বিচার সাপেক্ষে একটি বিতর্কের ফলাফল নির্ধারণ করে থাকেন। বিতর্কের কেস মেকিং, কেস ফ্রেমিং এই জিনিসগুলো কিছু জিনিসের উপর মূলত নির্ভর করে থাকে।
কেস মেকিং এর ক্ষেত্রে প্রধান লক্ষ্য থাকতে হবে বিতর্কের বিষয়টির চাহিদা সম্পর্কে। যেকোনো একটি বিতর্কে পক্ষে বা বিপক্ষে কথা বলার আগে এটি মাথায় রাখতে হবে যে কেন এই সংসদে এই প্রস্তাবনাটি উত্থাপিত হয়েছে এবং বর্তমানের প্রেক্ষিতে এর গুরুত্ব ঠিক কোন জায়গাটিতে। সেই হিসেব মাথায় রেখে কেস তৈরি করতে হয়। কেস ফ্রেম করা বলতে মূলত সার্বিক কেসটির একটি সুসংবদ্ধ রূপ প্রদান বোঝায়। অর্থাৎ বক্তব্য প্রদানের সময় কোন যুক্তিগুলো আগে আসবে, কোনগুলো পরে আসবে, কীভাবে বিতর্কের বিষয়ের সাথে সেগুলো যুক্তিযুক্ত তা ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে সাজানোকে বলা হয় কেস ফ্রেমিং। সংসদীয় বিতর্কের ক্ষেত্রে একটি ভালো কেস প্রদান করা ও তারা যথাযথভাবে ফ্রেইম করতে না পারলে বিতর্কের সৌন্দর্য বজায় রাখা কষ্টকর হয়ে পড়ে।
পয়েন্টস: বাংলা সংসদীয় বিতর্কে আমরা সাধারণত তিন ধরনের পয়েন্ট উত্থাপন করতে দেখি।
১. পয়েন্ট অফ ইনফরমেশন।;
২. পয়েন্ট অফ প্রিভিলেজ, এবং
৩. পয়েন্ট অফ অর্ডার।
পয়েন্ট অফ ইনফরমেশনঃ গঠনমূলক পর্বের বক্তব্যের সময় প্রতিপক্ষের যেকোনো সদস্য বক্তার বক্তব্যের মাঝেই প্রশ্ন উত্থাপন করতে হয়। এক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে ‘পয়েন্ট অফ ইনফরমেশন’ উল্লেখপূর্বক বক্তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। বক্তা চাইলে নিজের বক্তব্য থামিয়ে প্রশ্নটি গ্রহণ করতে পারেন। একজনের বক্তব্যের মাঝে কতবার পয়েন্ট অফ ইনফরমেশন তোলা যাবে তার কোনো সুনির্দিষ্ট বাধ্যবাধকতা নেই। বক্তা চাইলে একাধিক প্রশ্ন গ্রহণ করতে পারেন, আবার তার ইচ্ছে না হলে তিনি একটিও প্রশ্ন না নিতে পারেন। তবে পয়েন্ট অফ ইনফরমেশন উত্থাপন করতে হয় দুই থেকে চার মিনিটের মাঝে। এক মিনিটের আগে ও চার মিনিটের পর পয়েন্ট অফ ইনফরমেশন উত্থাপন করা যায় না।
পয়েন্ট অফ প্রিভিলেজ: গঠনমূলক বা যুক্তিখণ্ডন পর্বে যদি কোনো বক্তার বক্তব্যে প্রতিপক্ষ ব্যক্তিগতভাবে আক্রমমণাত্মক বক্তব্যের মুখোমুখি হয় কিংবা প্রতিপক্ষের কোনো বক্তার বক্তব্যকে তার উদ্ধৃতি সহকারে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়, তবে সেক্ষেত্রে ব্যক্তিগত/দলীয় প্রিভিলেজ উত্থাপন করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে বিতর্কের স্পিকার পয়েন্ট অফ প্রিভিলেজ উত্থাপনকারীর অভিযোগ ও বক্তার ব্যাখ্যার ভিত্তিতে পয়েন্টটি চাইলে গ্রহণ করতে পারেন, অথবা বাতিল করে দিতে পারেন। পয়েন্ট অফ প্রিভিলেজ এক মিনিট সময়ের পূর্বে উপস্থাপন করা যায় না।
পয়েন্ট অফ অর্ডার: গঠনমূলক বা যুক্তিখণ্ডন পর্যায়ে কোনো বক্তা যদি সঙ্গায়নের বাইরে গিয়ে বিতর্ক করে, অথবা, কোনো দলের দ্বিতীয় বা তৃতীয় বক্তা যদি তাদের বক্তব্যের সময় সংসদে নতুন কোনো যুক্তি উপস্থাপনের চেষ্টা করেন যা বিগত বক্তার বক্তব্যে আলোচিত হয়নি, সেক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের যে কেউ স্পিকার বরাবর একইভাবে পয়েন্ট অফ অর্ডার উত্থাপন করতে পারবেন। পয়েন্ট অফ অর্ডারের ক্ষেত্রেও তা গৃহীত হবে কি না সে ব্যাপারে স্পিকার সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন। পয়েন্ট অফ প্রিভিলেজ বা পয়েন্ট অফ ইনফরমেশনের মতো এই পয়েন্টটিও এক মিনিটের পুর্বে উত্থাপন করা যায় না।
যুক্তি খন্ডন: সরকারি দল ও বিরোধী দলের গঠনমূলক পর্বের বক্তব্য শেষে যুক্তিখন্ডন পর্ব শুরু হয়। যুক্তিখন্ডন পর্বে প্রথমে বিরোধীদলীয় নেতা এবং পরে প্রধানমন্ত্রী তিন মিনিট করে সময় পেয়ে থাকেন। যুক্তিখন্ডনের মাধ্যমে সংসদের বিতর্ক কার্যক্রম সমাপ্ত হয়ে থাকে।
মূল্যায়ন ও ব্যালট প্রদান: বিতর্ক কার্যক্রম শেষে বিতর্ক অধিবেশনের মাননীয় স্পিকার ও তার সহ-বিচারকেরা বিতর্কের মূল্যায়ন করে থাকেন। দুই দলের অবস্থান, দুর্বলতা, যুক্তির গভীরতা, বাচনভঙ্গি, ভাষাশৈলী ইত্যাদির সার্বিক মূল্যায়ন সাপেক্ষে সরকারি দল অথবা বিরোধী দলের দিকে নিজেদের ব্যালট প্রদান করেন। সর্বাধিক ব্যালট লাভকারী দলটি বিজয়ী হিসেবে ঘোষিত হয়। তবে কখনো কখনো বিচারকদের ব্যালট দুই পক্ষের দিকেই সমান সমান হয়ে গেলে তখন স্পিকারের ব্যালট যে দলের পক্ষে ছিলো সেই দলকে বিজয়ী হিসেবে গণ্য করা হয়।
বিতর্কচর্চা পৃথিবীর অত্যন্ত আদিম একটি শিল্পচর্চা। সৃষ্টির সূচনা থেকেই বিতর্কচর্চা চলে আসছে, কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বা কখনো অনানুষ্ঠানিকভাবে। একুশ শতকের জীবন দক্ষতাগুলো বৃদ্ধির জন্যে বর্তমানে আনুষ্ঠানিক বিতর্ক আর শখের মাঝে সীমাবদ্ধ নেই, বরং বর্তমানে এটি একটি প্রয়োজন হিসেবেই দেখা দিচ্ছে। বাগ্মীতা, ভাষাদক্ষতা, যৌক্তিক চিন্তাধারা ও নেতৃত্ব বিকাশের অন্যতম সহায়ক পদ্ধতি হলো এই বিতর্ক। নিজের ব্যক্তিগত দক্ষতা উন্নয়ন ও জ্ঞানের বিকাশের জন্যে বিতর্ক চর্চার বিকল্প নেই। যারা বিতর্ক শিখতে চান তারা বিতর্ক জগতের আধুনিক ও সবচেয়ে জনপ্রিয় এই সংসদীয় বিতর্কের মাধ্য্যমেই গ্রহণ করতে পারেন বিতর্কের হাতেখড়ি। শুধু প্রয়োজন কিছু সময়, সাধনা ও অনুরাগ। নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে আপনিও হয়ে উঠতে পারবেন চমৎকার একজন বিতার্কিক!