পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ বাঙালির এক অনন্য উৎসব, যার ঐতিহ্য সুপ্রাচীন ও গৌরবমণ্ডিত। কালের যাত্রাপথ ধরে বাংলা নববর্ষের উদযাপন রীতিতে বিভিন্ন পালাবদল ঘটেছে, এবং সময়ে সময়ে তা বিভিন্ন মাত্রিকতা অর্জন করেছে। আবহমান বাংলার চিরায়ত সংস্কৃতি পহেলা বৈশাখের অন্যতম অনুষঙ্গ ‘হালখাতা’। কালীপ্রসন্ন সিংহ বিখ্যাত ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’য় লিখেছেন, ‘‘কেবল কলসি উচ্ছুগ্গুকর্ত্তারা আর নতুন খাতাওয়ালারাই নতুন বৎসরের মান রাখেন।”
বাংলা সনের সূচনার ইতিহাস ঘিরে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। তবে বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের প্রবন্ধ, প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও গবেষক ড. অমর্ত্য সেনের অভিমত, মোবারক হোসেনের সম্পাদনায় বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘বাংলাদেশে উৎসব, নববর্ষ’, সাদ উর রহমানের ‘উৎসবের ঢাকা’ বই এবং ঢাকা কেন্দ্রের তথ্য অনুসারে, মোগল সম্রাট আকবরের নির্দেশনা অনুযায়ী বঙ্গাব্দের সূচনা হয়েছিল। তৎকালীন মোগল আমলে হিজরি বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করে প্রজাদের নিকট থেকে খাজনা আদায় করা হত। চন্দ্র মাসের হিসেবে চলা হিজরি বর্ষপঞ্জির কারণে এই অঞ্চলে প্রজাদের খাজনা পরিশোধে অসুবিধা হতো। এই কারণে মোগল সম্রাট আকবর বিখ্যাত জ্যোতিষবিদ আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজিকে বর্ষপঞ্জি সংস্কারের দায়িত্ব দেন। এরপর আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজি হিন্দু পঞ্জিকা ও হিজরি পঞ্জিকা বিশ্লেষণ করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম নির্ধারণ করেন। অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে, ১৫৫৬ সালে মোগল সম্রাট আকবর বাংলা সন চালু করেন। এটি কৃষকদের কাছে ‘ফসলি সন’ নামে পরিচিত ছিল, যা পরবর্তীতে ‘বাংলা সন’ বা ‘বঙ্গাব্দ’ নামে প্রচলিত হয়ে ওঠে।
বাংলা সন চালুর ধারাবাহিকতায়, চৈত্র মাসের শেষ দিন চৈত্রসংক্রান্তিতে জমিদারের প্রতিনিধিরা প্রজাদের নিকট থেকে খাজনা আদায় করতেন, এবং পরবর্তী বছরের প্রথম দিন পয়লা বৈশাখে জমিদাররা প্রজাদের মিষ্টি, মিষ্টান্ন, পান-সুপারি দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। নববর্ষের হালখাতায় পুরনো বছরের খাজনা আদায়ের হিসাব-নিকাশ সম্পন্ন করে হিসেবের নতুন খাতা খোলা হত। একসময় বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ একটি নতুন রীতি প্রচলন করেন, যেটি একসময় ‘পুণ্যাহ’ হিসেবে পরিচিত ছিল। কালের পরিক্রমায় ‘পুণ্যাহ’ উৎসব হারিয়ে গেলেও হালখাতা এখনও স্বমহিমায় টিকে রয়েছে।
তবে নবাব অথবা, জমিদারদের খাজনা পরিশোধ করার পর নতুন হিসেবের সূচনার পাশাপাশি হালখাতার আলাদা একটি ইতিহাস রয়েছে। ‘হাল’ শব্দটি সংস্কৃত এবং ফারসি– উভয় ভাষা থেকে আসলেও অর্থগত দিক থেকে এর ভিন্নতা রয়েছে। সংস্কৃত শব্দ ‘হাল’ এর অর্থ ‘লাঙল’। অন্যদিকে, ফারসি শব্দ ‘হাল’ এর অর্থ হচ্ছে ‘নতুন’। বাঙালি সমাজে ‘হালখাতা’র ক্ষেত্রে এই দুটো অর্থই প্রসঙ্গিক। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, হালখাতার ইতিহাস কৃষিপ্রথার সাথে সম্পর্কিত। কারণ, কৃষিপ্রথার সূচনার পর হাল বা লাঙল দিয়ে বিভিন্ন কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনের পর সেই পণ্য বিনিময়ের হিসেব একটি বিশেষ খাতায় লিখে রাখা হতো, যেটি ‘হালখাতা’ হিসেবে পরিচিত ছিল।
এছাড়াও ব্যবসায়ী মহলে ‘হালখাতা’ উৎসবের আলাদা তাৎপর্য রয়েছে। কৃষিপ্রধান এই অঞ্চলে একসময় একটি নির্দিষ্ট মৌসুমভিত্তিক ফসল উৎপাদন করা হতো। ফলে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে ফসল বিক্রয়ের মৌসুম ছাড়া অন্য সময়ে কৃষকদের হাতে নগদ অর্থের যোগান থাকত না। একসময় পাট ছিল কৃষকদের জন্য অন্যতম অর্থকরী ফসল। এই কারণে, অনেক সময় একজন কৃষককে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বাকিতে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয় করতে হতো। তখনো সারাদেশে বিস্তৃত যোগাযোগ ও যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে না ওঠা, এবং মানুষের মধ্যে বেশ আন্তরিক সম্পর্ক বজায় থাকার সুবাদে ব্যবসায়ী মহলে বাকিতে জিনিসপত্র বিক্রয়ের ক্ষেত্রে কোনোরকম দ্বিধা কাজ করত না। এরপরে ফসল বিক্রয়ের মৌসুম আসার পর ব্যবসায়ীরা পাওনা পরিশোধ করার জন্য পহেলা বৈশাখের দিনে দোকানে আসার নিমন্ত্রণ জানিয়ে থাকেন। এই সময় বিশেষ নিমন্ত্রণপত্রও বিতরণ করা হতো। এই দিন ব্যবসায়ীরা দেনা-পাওনার হিসেব সমন্বয় করে হিসাবের নতুন খাতা খুলতেন। একে লাল খাতা কিংবা খেরো খাতাও বলা হয়ে থাকে।
‘হালখাতা’ উপলক্ষে ব্যবসায়ীরা ঝালর কাটা লাল-নীল-সবুজ-বেগুনি কাগজ দিয়ে দোকান সাজাতেন। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সামনে ‘শুভ নববর্ষ, শুভ হালখাতা’ লেখা ব্যানার-ফেস্টুন ঝুলিয়ে বর্ণিল রূপে রাঙিয়ে তোলা হতো। কিছু কিছু দোকানে ধূপধুনা জ্বালানো হতো। এ সময় গ্রাহক-খরিদ্দারদের মিষ্টিমুখ করানো হতো, এবং হাসি-ঠাট্টা, গল্পগুজবের মধ্যে বকেয়া আদায়ের পাশাপাশি উৎসব আয়োজন– দুটোই সমান তালে চলত। এছাড়াও আগত অতিথিদের জন্য পান-সুপারি এবং উপহারের বন্দোবস্ত থাকত। একসময় পুরান ঢাকায় হিন্দু ব্যবসায়ীরা বেশ ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে ‘হালখাতা’ উৎসব পালন করতেন। হিন্দু ব্যবসায়ীরা পুরনো খাতা বাদ দিয়ে পয়লা বৈশাখে হালখাতা শুরুর আগে নতুন খাতাটি নিয়ে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে গিয়ে পূজো দিতেন।
বর্তমানে ‘হালখাতা’ উৎসব আর তেমন সাড়ম্বরে উদযাপিত হয় না। সামাজিক বিবর্তনে কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজ এখন নগরভিত্তিক সমাজে রূপান্তরিত হচ্ছে। যান্ত্রিকতার এই যুগে প্রযুক্তির কল্যাণে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমেও কেউ কেউ পাওনা পরিশোধ করছেন। তবে রং ফিকে হয়ে এলেও দেশের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী মহলে, এখনও এই উৎসবের প্রচলন রয়েছে।
বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও এ অনুষ্ঠানটি বেশ ঘটা করে পালন করা হয়ে থাকে। পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু ধর্মাবলম্বী ব্যবসায়ীরা গণেশ এবং দেবী লক্ষ্মীর পূজো করে ‘হালখাতা’ উৎসবের মাধ্যমে নতুন বছরের হিসেব-নিকেশ আরম্ভ করে থাকেন। চিরাচরিত পয়লা বৈশাখে হালখাতার এই উৎসব বাঙালি ব্যবসায়ী মহলে পুরনো ক্রেতাদের সাথে নতুনভাবে ব্যবসায়িক যোগসূত্র অটুট রাখা, ক্রেতাদের কাছে পাওনা পরিশোধ করে উৎসবে শামিল হওয়ার সম্মিলিত প্রয়াস, এবং ক্রেতা-বিক্রেতার মাঝে পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের সেতুবন্ধন তৈরিতে এই উৎসব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।