আজকের বাংলা তারিখটা যেন কত?
প্রশ্নটা হামেশাই নাকানিচুবানি খাওয়ায়। প্রথম হোমো স্যাপিয়েন্সের আবির্ভাব, বাৎস্যায়নের জীবনী কিংবা বুশের ইরাক আক্রমণ- তথ্যগুলো জিভের ডগায়। প্লেটোর পলায়ন থেকে বেনিংটনের আত্মহত্যা– গড়গড় করে বলা যাবে ঘন্টা দেড়েক। অথচ এই একটা প্রশ্নে অস্বস্তিতে পা আটকে যায়- এমন বাঙালি বাংলা মুল্লুকে কম নেই। হাঁড়ির খবর ঘাঁটতে গেলে হয়তো তেতো অভিজ্ঞতা হাসিলের উদাহরণও কম পাওয়া যাবে না। কিন্তু তাতে বাঙালিকে ‘বেখবর জাতি’ তকমা দেয়াটা বিষম ভুল হবে। এই যে বসন্তবরণ, পহেলা বৈশাখ, মাঘসংক্রান্তির মতো উৎসব যাপন, সে তো আর জোর জবরদস্তিতে করানো হয় না। সদিচ্ছাতেই পালন করে।
মানুষের সাথে পঞ্জিকার সম্পর্ক পুরাতন। মেসোপটেমিয়া কিংবা নীলনদের প্রাচীন সভ্যতায় মাঝবয়সী কৃষক দিন-তারিখ দেখে, ঋতু বুঝেই ক্ষেতে নামতো। দিনক্ষণের হিসেব কষেই উপাসনা করতো পুরোহিত। খ্রিষ্টীয় মাসগুলোকে সন্নিবিষ্ট করার ইতিহাস ঘাটলে দ্বিতীয় রোমান সম্রাট নুমা পম্পিলিয়াসের নাম আসে। জানুয়ারিকে বছরের প্রথম মাস করার কৃতিত্বও তার। কয়েক শতক পরে জুলিয়াস সিজার ক্ষমতায় এসে সংস্কার আনেন, যা প্রচলিত ছিল ১৫৮২ সাল পর্যন্ত। এ বছর জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের দুরাবস্থা দেখে এগিয়ে আসেন পোপ অষ্টম গ্রেগরি। আরো একদফা সংস্কার করলেন পঞ্জিকাতে। আজ অব্দি যা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার নামে পরিচিত।
ভারতীয় উপমহাদেশে খ্রিষ্টাব্দের ধারণা আনে পর্তুগীজরা। আর এটিকে জনপ্রিয় করেছে ইংরেজরা। তারও আগে এ মাটিতেই পা ফেলেছিল আরব-তুর্কি-আফগানরা। সাথে করে নিয়ে এসেছে হিজরি সন। নবী মুহম্মদ (সা.) ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন। বছরটাকে ভিত্তি ধরে পরবর্তীতে হিজরি পঞ্জিকার উদ্ভাবন ঘটে। বস্তুত হিজরি সনই প্রথম বিশুদ্ধ চান্দ্র সন। প্রাচীন আরবে মাস চান্দ্র হলেও বছর ছিল সৌর। অর্থাৎ চাঁদনির্ভর মাস পার হয়ে প্রতিবছর এগারো দিন পিছিয়ে পড়তো তারা। কারণ, সৌর বছর ৩৬৫ দিনে হলেও চান্দ্র বছর ৩৫৪ দিনেই আটকে যায়। এভাবে একমাস পিছিয়ে গেলে পরের বছর নববর্ষ পালিত হতো ১ মাস পরে। অর্থাৎ সে বছরে ত্রয়োদশ মাস হিসাবে আরেকটা মাস যোগ হতো।
মুসলমানদের আগমনের আগে ভারতের মানুষ পঞ্জিকা ব্যবহার করতো। আল বিরুনির ভারততত্ত্ব মোতাবেকই সন প্রচলিত ছিল বেশুমার। উজ্জয়নীর রাজা বিক্রমাদিত্যের নামে বিক্রমাব্দ, চতুর্থ শতকের দিকে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের নামে গুপ্তাব্দ, উত্তর ভারতে হর্ষবর্ধনের নামে হর্ষাব্দ, সম্ভাব্য শক-ক্ষত্রপদের নামে শকাব্দ ছিল সবচেয়ে পরিচিত। তাছাড়া বিভিন্ন আঞ্চলিক সন তো ছিলই।
সেনরাজাদের আমলেই বাংলার মানুষ শকাব্দের সাথে পরিচিত হয়। বখতিয়ার খলজির বাংলা অভিযানের পর হিজরি এবং শকাব্দ- দুটোরই ব্যবহার দেখা যায়। সেই সাথে ছিল পরগণাতি নামে আরেক কিসিমের সাল গণনা। সেন বংশের পতনকাল থেকে এই সনের উত্থান বলে ধারণা করা হয়। (নিবন্ধ: প্রাচীন ভারতীয় বর্ষপঞ্জি: একটি সমীক্ষা, অজয় রায়, পৃষ্ঠা: ৩০, গ্রন্থ: বাংলা সন ও পঞ্জিকার ইতিহাস-চর্চা এবং বৈজ্ঞানিক সংস্কার)
অন্যান্য সনগুলোর উৎস যতটা হুটহাট বলে দেওয়া যায়, বঙ্গাব্দের ক্ষেত্রে বিষয়টা অতো সহজ না। বঙ্গ তো আর কোনো শাসকের নাম না, যে শিলালিপি দেখে শাসনকাল খুঁজে একটা কিছু বলে দিলেই কেল্লাফতে। বঙ্গ একটা আঞ্চলিক পরিচয়। হাজার বছর ধরে গড়ে উঠা এক জনপদের নাম। প্রাচীনকাল থেকেই স্থানীয় মানুষেরা জীবনযাপনের তাগিদে ঋতুর হিসেব রাখতো, তেমন ভাবনা স্বাভাবিক। তারপরেও বঙ্গাব্দের জন্মকথায় চারজন শাসকের দাবি নিয়ে পণ্ডিতেরা বিভাজিত। তিব্বতিয় রাজা স্রং সন, গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক, সুলতান হোসেন শাহ এবং মহামতি সম্রাট আকবর।
তিব্বতীয় রাজার দাবিটা আসে ফরাসি পণ্ডিত সিলভ্যাঁ লেভির কাছ থেকে। ভদ্রলোক ‘লে নেপাল’ নামক পুস্তকে বলেছেন, রাজা স্রং সন ৫৯৫ খ্রিস্টাব্দে মধ্য ও পূর্ব-ভারত জয় করেন। তার নামের সন থেকেই বাংলা সন শব্দ যুক্ত করে বঙ্গাব্দ প্রচলিত হয়। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, স্বয়ং তিব্বতেও ঐ সময়ে কোনো অব্দ প্রচলনের নজির নেই। স্রং সনের বাংলা আক্রমণেরও নিশ্চিত তথ্যও পাওয়া যায় না আদতে। অন্যদিকে সন এবং সাল শব্দদ্বয় বাংলা কিংবা তিব্বতি কোনটিই নয়। প্রথমটি আরবি এবং দ্বিতীয়টি ফারসি। অর্থাৎ ইতিহাস কিংবা যুক্তির ছাঁকনিতে দাবিটি ধুপে টেকে না।
বঙ্গাব্দ নিয়ে দ্বিতীয় মতবাদ গৌড়ের রাজা শশাঙ্ককে জড়িয়ে। ‘বঙ্গব্দের উৎসকথা’ বইয়ের ৩৯ পৃষ্ঠায় সুনীলকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এর সমর্থনে তোড়জোড় চালিয়েছেন। তার দাবি, ৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই এপ্রিল থেকে বঙ্গাব্দের গণনা শুরু হয়। সেদিন নাকি শশাঙ্ক সিংহাসনে আরোহন করেছেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, সে সময়ে শশাঙ্কের ক্ষমতায় আসাটা নেহায়েত অনুমান। ৭ম শতকের শুরুর দিকে শশাঙ্ককে গৌড়ের শাসক হিসেবে খুঁজে পাওয়া যায়। বাংলাপিডিয়ায় শশাঙ্কের সময়কাল ধরা হয়েছে ৬০০ থেকে ৬২৫ খ্রিষ্টাব্দ। তারপরের প্রায় এক হাজার বছরের মধ্যেও বঙ্গব্দের ধারণা মেলেনি। অথচ এই সময়ের বহু তারিখ যুক্ত উপাত্ত আমাদের হাতে আছে। তার চেয়ে বড় কথা, “শশাঙ্কের অধীনস্থ মাধব বর্মণ তার গঞ্জাম লেখতেই গুপ্তাব্দ ব্যবহার করেন। ”(এপিগ্রাফিয়া ইন্ডিকা, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা- ১৪৫)
বঙ্গব্দের প্রচলন যদি শশাঙ্কই করতেন, তবে সেখানে বঙ্গাব্দ না হয়ে গুপ্তাব্দ কেন? বঙ্গাব্দের আর কোনো নজির নেই কেন? বস্তুত সুনীলকুমার যুক্তির প্রতি গুরুত্ব দেননি। খ্রিষ্টাব্দ ধরে পেছনে গিয়ে বাংলা ১ম বর্ষে পৌঁছে তাতে শশাঙ্কের সিংহাসনে আরোহনের তকমা জুড়ে দিয়েছেন। অর্থাৎ মতবাদটাই ঐতিহাসিকভাবে ভিত্তিহীন।
সুলতান হোসেন শাহ তৃতীয় মতবাদের নায়ক। যতীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের দাবি এটি। এ কথা সত্য, সুলতান হোসেন শাহ শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং সাহিত্যে ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন। সুলতানি আমলে বাংলার অনেক শাসকই বাংলায় স্বাধীন কিংবা নামমাত্র অধীন হিসেবে শাসন পরিচালনা করেছেন। ইলিয়াস শাহ নিজেকে পরিচিত করেছেন ‘শাহ-ই-বাঙ্গালা’ উপাধিতে। বাংলার স্বাতন্ত্র্য এবং জাতীয়তাবোধ জাগ্রতকরণে তাদের ভূমিকা ছিল বিপুল। তারপরেও বঙ্গাব্দ প্রচলনের কোনো নজির সেসময় দেখা যায় না। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক সুখময় মুখোপাধ্যায়ও এই দাবির সত্যতা খুঁজে পাননি। তার বদলে পাওয়া যায় হিজরি, শকাব্দ এবং পরগণাতির ব্যবহার।
বাংলা সনের উদ্ভব নিয়ে সবথেকে জনপ্রিয় ধারণায় যুক্ত সম্রাট আকবরের নাম। প্রখ্যাত বহু পণ্ডিত এ মতের পক্ষে রায় দেন। সম্রাট আকবর ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহন করেন। তৎকালে প্রচলিত হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে সেটা ৯৬৩সন। বর্তমান খ্রিষ্টাব্দ ২০১৯ থেকে আকবরের সিংহাসন আরোহনের সন ১৫৫৬ বিয়োগ করলে দেখা যায়, (২০১৯ – ১৫৫৬) = ৪৬৩। এই বিয়োগফলের সাথে তৎকালীন হিজরি সন ৯৬৩ যোগ করা হলে দাঁড়ায় (৯৬৩ + ৪৬৩) = ১৪২৬; যা বাংলা বর্তমান সালকে নির্দেশ করে। সহজভাবে বলতে গেলে, বাংলা সন = ৯৬৩ + (খ্রিষ্টীয় সন ১৫৫৬)
সম্রাট আকবরের আমল মধ্যযুগের ভারতে স্বর্ণযুগ হিসাবে গণ্য। শাসন, তদারকি এবং রাজস্ব আদায় সহজ করার জন্য গোটা সাম্রাজ্যকে ভাগ করেন আকবর। টোডরমলের তত্ত্বাবধানে প্রবর্তিত হয় নতুন ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা, যা দশসালা বন্দোবস্ত নামে স্বীকৃত। ঠিক কাছাকাছি সময়ে ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে নতুন সনের সূচনা ঘটে জ্যোতির্বিদ আমির ফতেহ উল্লাহ সিরাজীর তত্ত্বাবধানে। আকবরের প্রবর্তিত এই নতুন সন পরিচিতি পায় ‘ইলাহি সন’ হিসাবে। হিজরি সন পুরোপুরি চন্দ্র নির্ভর হবার কারণে ভারতের ঋতুর সাথে মিলতো না। রাজস্ব আদায়েও অসুবিধা হতো। এজন্য মাসগুলোকে চন্দ্রনির্ভর রেখে বছরকে সৌর করে ঋতুর সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া হয়। ফসলি সন হিসেবে এর কার্যকারিতা ছিল যুগোপযোগী।
১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রবর্তিত হলেও ইলাহি সনের শুরু ধরা হয় ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দে। আর তা ছিল হিজরি ৯৬৩ সন। অর্থাৎ ইলাহি সন যাত্রাই শুরু করেছে ৯৬৩ বছরের তাগড়া জোয়ান হিসেবে। ইলাহি সনে মাসের নাম ফারসিতে। মোগল দরবার পারসিক সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত ছিল কী না! বারোটি মাস যথাক্রমে ফেরিদুন, উর্দি-বিহিস্ত, খুর্দাদ, তীর, মারদাদ, শাহরিয়ার, মিহির, আবান, আজর, দে, বাহমন এবং ইসপন্দর মাজ। আকবরের দরবারি ঐতিহাসিক আবুল ফজলও তার আকবরনামাতে এই সন প্রবর্তনের কথা বলেছেন।
আকবর প্রবর্তিত সেই সনই বঙ্গাব্দ বলে জনশ্রুতি থাকলেও কথাটা পুরোপুরি সত্য না। প্রথমত আকবর বাংলা জয় করেন ১৫৭৫ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে। কররানি বংশের পতন ঘটলেও তখনো বাংলার স্বাধীন বারো ভুঁইয়াদের অনুগত করা যায়নি। অর্থাৎ ১৫৭৫ থেকে ১৬১৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত চলেছে মোগল-বাংলা সংঘর্ষ। ততদিনে মোগল মসনদে আকবর গিয়ে জাহাঙ্গীর উঠেছেন। অর্থাৎ আকবরের ফসলি সন বাংলায় চালু হতে পারেনি। আর যদি হতো, তাহলে আকবরাব্দ বা খোদ ইলাহি অব্দ না হয়ে বঙ্গাব্দ হবার পেছনে নিশ্চই রহস্য নিহিত।
মধ্যযুগের দীর্ঘ সময় বাংলার পরিচয় ছিল গৌড় হিসাবে। চৈতন্যের মতবাদ স্বীকৃত গৌড়ীয় নববৈষ্ণববাদ বলে। হাল আমল পর্যন্ত এর প্রভাব বিদ্যমান, তার প্রমাণ রামমোহন রায়ের ‘গৌড়ীয় ব্যকরণ’। মধ্যযুগের সাহিত্যে হয় একে গৌড়ীয় ভাষা বলা হয়েছে, নাহলে দেশীভাষা। আবদুল হাকিমের সেই কবিতার কথা কে না জানে?
‘‘দেশীভাষা বিদ্যা যার মন ন জুয়ায়
নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশ ন যায়?’’
আমাদের অভিমত হচ্ছে, আকবরের ইলাহি সনকে যেভাবে ঢালাওভাবে বঙ্গাব্দের উৎস বলে সাক্ষ্য দেওয়া হচ্ছে, তা অসম্পূর্ণ।
১৭০০সালে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব বাংলার দীউয়ান হিসেবে নিয়োগ দেন মুর্শিদকুলী খানকে। রাজস্ব এবং অর্থনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দেন তিনি। সে সময় দ্রুত তাকে বাংলা থেকে সরিয়ে ফেলা হলেও ১৭১৬ সালে নাজিম পদে উন্নীত হয়ে আবার ফিরে আসেন। ততদিনে আওরঙ্গজেবের মৃত্যু হয়ে গেছে ১৭০৭ সালে। মোগল সাম্রাজ্য স্তিমিত হয়ে পড়েছে ভেতরে ভেতরে। দিল্লির মসনদ দখলের জন্য উত্তরাধিকারীদের মধ্যে কে কাকে খাবে অবস্থা। এর মধ্যেই ১৭১৭ সালে রাজধানী ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদ স্থানান্তরিত হলো। দিল্লির সেই অস্থির দিনগুলোতেও বাংলা ছিল স্থিতিশীল। আরো স্পষ্টভাবে বললে, রাজস্বের সম্পর্ক বাদ দিলে বাংলা ছিল দিল্লির শাসন থেকে একরকম মুক্ত।
মুর্শিদকুলী খান কেবল দীউয়ান ও সুবাদার ছিলেন, তা না। একজন সত্যিকার শাসকের মতো সংস্কার আনেন পুরো ব্যবস্থার। আগেই বলা হয়েছে, দিল্লি তখন ঝিমিয়ে পড়েছে। ১৭২২ সালে মুর্শিদকুলী খান পূর্ববর্তী টোডরমল এবং শাহ সুজার প্রবর্তিত ভূমিরাজস্ব পদ্ধতির সংস্কার করলেন। রাজস্ব বৃদ্ধি পেলো বিস্ময়কর রকম। তার প্রবর্তিত ব্যবস্থা মালজামিনী নামে বিখ্যাত। এই ব্যবস্থায় জমিদাররা কিছু সম্পত্তি জামিন রাখার মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব পেতো। রাজস্ব আদায়ে অপেক্ষাকৃত বিশ্বস্ততার কারণে হিন্দু জমিদার এবং অভিজাত শ্রেণি গড়ে উঠে ঠিক এই সময়টাতেই।
বাংলা সন এবং আকবরের ইলাহি সনের মধ্যে যে ঐতিহাসিক শূন্যস্থান, তা পূরণের জন্য মুর্শিদকুলী খান গুরুত্বপূর্ণ। রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্যই আকবর ইলাহি সনের প্রবর্তন করেন। সেই সনকে ভিত্তি ধরে ঠিক রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্যই মুর্শিদকুলী খানের সময় বাংলা সন জন্ম নেয়। এ কারণে মাসের ফারসি নামগুলো পরিবর্তিত হয়ে গেল নক্ষত্রের নামানুসারে। বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ… এভাবে।
ইলাহি সন থেকে উৎপত্তি ঘটলেও বাংলা সালের মাস এবং দিনের নাম পূর্বপ্রচলিত শকাব্দ থেকে নেওয়া হয়েছে। আবার স্মরণ করা দরকার, মুর্শিদকুলী খান স্থানীয় হিন্দু অভিজাত এবং সংস্কৃতিকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন।
রাজস্ব আদায়ের জন্য সম্রাটের পক্ষ থেকে চাপ আসতো প্রায়ই। সাধারণ মানুষেরা ফসল না কেটে তো আর খাজনা দিতে পারতো না। অনেকটা সে কারণেই নবাবেরা পূণ্যাহের প্রবর্তন করেন। নবাবের বাড়িতে উৎসব ও খাবার দাবারের আয়োজন থাকতো আর সাধারণ মানুষ তাতে যোগ দেবার পাশাপাশি রাজস্ব পরিশোধ করতো। নবাবের বাড়িতে মেহমান হিসেবে আপ্যায়িত হওয়াটা কম কথা না। রীতিমতো উৎসবে পরিণত হয়ে গেল দিনটা। নববর্ষ চালুর ইতিহাসের পূণ্যাহের তাৎপর্য ব্যাপক। খুব সম্ভবত ব্যবসায়ীরা সেখান থেকেই হালখাতার অনুপ্রেরণা পেয়েছে। ( সূত্র: পূর্বোক্ত গ্রন্থে শামসুজ্জামান খানের নিবন্ধ, পৃষ্ঠা: ১১১)
মোটামুটি সেভাবেই চলেছে ইতিহাস। ১৯৫২ সালে প্রখ্যাত জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা এবং তার কমিটি ভারতের অন্যান্য সালের সাথে বাংলা সনেও সংস্কারের প্রস্তাব করেন। ভারত সরকার তার প্রস্তাব গ্রহণ করে ১৯৫৭ সালে। সেই সংস্কারের কথা মাথায় রেখে ১৯৬৩ সালে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে বাংলা ক্যালেন্ডার সংস্কার কমিটি গঠিত হয়। কমিটির প্রধান ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্। বাংলাদেশ জন্মের পর তাজউদ্দিন আহমদ সরকারি নথিতে বাংলা তারিখের প্রথা চালু করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময়ে তা আরো দৃঢ় হয়। অবশেষে ১৯৮৭ সাল থেকে সরকারি কাজে খ্রিষ্টাব্দ ব্যবহারের পাশাপাশি বাংলা সন লেখার নির্দেশনা আসে।
পরবর্তীতে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে শহীদুল্লাহ্ কমিটির প্রস্তাবনায় উন্নয়ন আনা হয়। ১৩ই আগস্ট, ১৯৯৫ এবং ১৯শে আগস্ট, ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দে পরপর দুই সভায় প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। সংস্কারের পর প্রস্তাবগুলো নিম্নরূপ-
১. সাধারণভাবে বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত প্রতিমাসে ৩১ দিন এবং আশ্বিন থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত প্রতিমাস ৩০ দিন গণ্য করা হবে।
২. গ্রেগরিয় বর্ষপঞ্জির অধিবর্ষে যে বাংলা বছরের ফাল্গুন মাস পড়বে সেই বাংলা বছরের অধিবর্ষ গণ্য করা হবে।
৩. অধিবর্ষে ফাল্গুন মাস হবে ৩১ দিনে।
৪. আন্তর্জাতিক রীতি মোতাবেক রাত ১২টায় তারিখ পরিবর্তিত হবে।
(বাংলা সন ও পঞ্জিকার ইতিহাস-চর্চা এবং বৈজ্ঞানিক সংস্কার, পৃষ্ঠা-১১৯)
সেই সাথে ১৪ই এপ্রিলকে পহেলা বৈশাখ হিসেবে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। আসলে তা ছিল পূর্ববর্তী কমিটির সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধার ফলস্বরূপ। হিজরি, ইলাহি এবং শকাব্দ হাত ধরাধরি করে এই সন এগিয়ে এসে মিলিত হয়েছে বাংলায়। বঙ্গীয় জনপদের আদিতম গুণ ধর্মীয় সম্প্রীতির আরো একটা উজ্জ্বল দলিল যেন এই বাংলা সন।