ইন্দোনেশিয়ার আদিবাসীদের ঘিরে রহস্যের যেন কোনো শেষ নেই। আজকে আমরা এমন একটি আদিবাসী জনগোষ্ঠী সম্পর্কে জানবো, যারা নিজেদের হাজার বছরের ঐতিহ্য রক্ষা করতে সকল প্রকার আধুনিক প্রযুক্তি বয়কট করছে। নিজেদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ধর্মীয় বিশ্বাস রক্ষার্থে এমন উদাহরণ বিশ্বের বুকে বিরল। আর সেই কাজটিই করে যাচ্ছে ইন্দোনেশিয়ার বাদুই জনগোষ্ঠীর লোকেরা।
ইন্দোনেশিয়ার বানতেন প্রদেশের লিবাক রেজেন্সিতে বাদুইদের বসবাস। বাদুই ছাড়াও তারা স্থানীয়ভাবে সুন্দা ও কেনিকিস নামে পরিচিত। বাদুই নামটি মূলত ডাচ গবেষকদের আরোপিত নাম। তবে অনেকের ধারণা, এই নামটি পার্শ্ববর্তী বাদুই নদী অথবা বাদুই পর্বত থেকে এসেছে। কিন্তু বাদুইরা সব সময় নিজেদের কেনিকিস নামেই পরিচয় করিয়ে দেন। কেনিকিস মূলত তাদের আবাসভূমি, যা কেনডিং পর্বতের চূড়ায় অবস্থিত একটি গ্রাম। তবে গবেষকরা ‘দি বাদুই‘ শব্দটি ব্যবহার করার কারণে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও গবেষণাপত্রে তারা বাদুই আদিবাসী নামেই অধিক পরিচিত হয়ে আসছে। আমরাও জটিলতা পরিহার করার জন্য ‘বাদুই’ পরিভাষাটিই ব্যবহার করবো।
বাদুইরা পৃথিবী থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন একটি জনগোষ্ঠী। তাদের রয়েছে নিজস্ব ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ভাষা। তাদের নিজস্ব ভাষার নাম সুন্দানিজ। আলাদা ক্যালেন্ডারও রয়েছে তাদের।
বাদুইদের মধ্যে আবার কয়েকটি ভাগ রয়েছে। অনেক গবেষক তাদেরকে তিন ভাগে, আবার অনেকে তাদেরকে দুই ভাগে বিভক্ত করে বিশ্লেষণ করেছেন। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করলে তারা তিন ভাগে বিভক্ত। তিন দলের নাম যথাক্রমে তাংতু, পানামপিং ও ডাংকা।
তাংতু শাখাকে ‘অভ্যন্তরীণ বাদুই’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এরা মূলত রক্ষণশীল আদি বাসিন্দা। তাংতুরা কঠোরভাবে তাদের ঐতিহ্যবাহী প্রথা রক্ষা করে চলে। পোশাক হিসেবে তারা সাদা অথবা গাঢ় নীল রঙয়ের পোশাক পরিধান করে। মাথায় সাদা রঙয়ের কাপড়ের স্কার্ফ থাকে।
পানামপিং শাখাকে ‘বহির্ভাগের বাদুই’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এরা তুলনামূলক কম রক্ষণশীল। এরা তাংতু বাদুইদের চারপাশের বিভিন্ন গ্রামে বসবাস করে। ঐতিহ্য রক্ষার ক্ষেত্রে এরা কিছুটা উদারপন্থী। এরা কালো রঙয়ের পোশাক ও মাথায় স্কার্ফ পরিধান করে।
আর বহিরাগত বাদুইদের বলা হয় ডাংকা। অর্থাৎ এরা মূলত এখানকার আদিবাসী নয়। কিন্তু মূল বাদুইদের সাথে দীর্ঘদিন থাকতে থাকতে সংস্কৃতিগতভাবে এরা বাদুইতে পরিণত হয়েছে। নিজেদেরকে বাদুই আদিবাসীদের অন্তর্ভুক্ত দাবি করলেও তাংতু ও পানামপিং শাখার বাদুইরা এদেরকে আদিবাদী হিসেবে স্বীকার করে না। এরা আশেপাশে বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন গ্রামে বসবাস করে।
বাদুইদের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর নেতার নাম ‘পুন’। তিন শাখার বাদুইরাই তাকে মান্য করে। পুনকে সমাজ পরিচালনার কাজে সহায়তা করার জন্য প্রভাবশালী লোকদের নিয়ে গঠিত হয় পরিচালনা পর্ষদ, যাকে বলা হয় ‘কেপুনান’। আর কেপুনানের সদস্যদের বলা হয় ‘জারো’। এই জারো সদস্যদের মধ্যে আবার চারটি ভাগ রয়েছে- তাংতু জারো, পানামপিং জারো, ডাংকা জারো এবং পামারেনথা জারো। এর মধ্যে প্রথম তিন ভাগের সদস্যরা স্ব স্ব গোত্র থেকে এবং শেষ পদটি স্থানীয় সরকারের পক্ষ থেকে মনোনীত করা হয়।
বিশ্লেষকদের মতে, প্রাচীনকালে বাদুইরা শিকারের উপর নির্ভরশীল ছিল, কিন্তু গত কয়েকশ বছর যাবত তারা ধান চাষ শুরু করেছে। পাশাপাশি তারা অর্থোপার্জনের উপায় হিসেবে বন থেকে ফল সংগ্রহ, নিজেদের ভূমিতে ফল চাষ ও মধু উৎপাদনসহ নানা কর্মের সাথে যুক্ত রয়েছে।
তাদের ঐতিহ্যবাহী ধর্মের নাম ‘সুন্দা উইউইটান’। তাদের বিশ্বাস, এক আধ্যাত্মিক পূর্বপুরুষ অত্র এলাকায় প্রাচীনকালে এই ধর্ম প্রচার করেছেন। পরবর্তীতে তিনি জীবন দিয়ে এখানকার মানুষকে রক্ষা করে গেছেন। তাই তারা সকল ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সেই পূর্বপুরুষের উপাসনা করে থাকেন। বিশ্লেষকদের মতে, এই ধর্মের মধ্যে হিন্দু, বৌদ্ধ ও ইসলাম ধর্মের মিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়।
বাদুইদের পবিত্র স্থানের নাম ‘আরকা ডোমাস’। একে তারা পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র জায়গা বলে মনে করে। প্রতি বছরে মাত্র একবার এই আরকা ডোমাসে উপাসনা করা হয়। নিজস্ব ক্যালেন্ডারের ‘কালিমা’ নামক মাসে এই উপাসনা অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় আরকা ডোমাসকে ঘিরে প্রদক্ষিণ করা হয়। কিন্তু সকলে চাইলেই এই উপাসনা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারেন না। সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর পুন ও তার দ্বারা নির্বাচিত স্বল্প কিছু সদস্য এই উপাসনায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ লাভ করেন।
এই আরকা ডোমাসে একটি সংরক্ষিত পাথর খণ্ড ও পাথরকে বেষ্টন করে পানির কূপ রয়েছে। বাদুইদের বিশ্বাস, যদি তাদের উপাসনা কবুল হয়, তাহলে সেদিন ওই কূপ ভরে গিয়ে পাথর ডুবে যায়। এটি সৌভাগ্যের চিহ্ন। এর দ্বারা বোঝা যায় সারা বছর পর্যাপ্ত বৃষ্টি হবে এবং ফসল ফলবে। আর যদি উপাসনা কবুল না হয়, তাহলে সেদিন ওই কূপে পানি বৃদ্ধি পাবে না। এটা দুর্ভাগ্যের পূর্বাভাস। এর দ্বারা বোঝা যায়, সারা বছর পানির অভাব দেখা দেবে। অপর্যাপ্ত বৃষ্টি হবে। ফসল খারাপ হবে।
তাদের মূল ধর্ম বিশ্বাস হচ্ছে ‘পিকুকুহ’, যার মূল কথা দৈনন্দিন জীবনে যা কিছু ঘটে তা পূর্ব নির্ধারিত। এই ধর্মের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বাস হলো প্রকৃতির কোনো কিছু পরিবর্তন করা অনৈতিক। আর এই ‘অনৈতিক’ বিষয়কে নিয়েই মূল তর্ক চলমান- যারা এই বিশ্বাসকে লালন করছে তারা সকল প্রকার প্রযুক্তি বর্জন করেছে। স্বভাবতই তাংতু শাখার বাদুইরা এই বিশ্বাস অকাট্যভাবে মান্য করে। ফলে তারা সকল প্রকার প্রযুক্তিকে নিজেদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও ঐতিহ্য রক্ষার প্রতিবন্ধক হিসেবে মনে করে। যখন আশেপাশের সকল জনগোষ্ঠী বিদ্যুৎ, মোবাইল, টেলিভিশন, এমনকি ইন্টারনেট সুবিধা ব্যবহার করছে, সেখানে তারা তা সম্পূর্ণরূপে বর্জন করে আসছে। তাদের আবাসস্থলের নিকটবর্তী এলাকায় বিদ্যুতের সংযোগ আসলে তারা যৌথ প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে নিজেদের এলাকা বিদ্যুৎমুক্ত রেখেছে। ফলে এই তাংতু শাখার বাদুইরা নিজেদের ‘পবিত্র’ মনে করছে।
কিন্তু আধুনিকতার সুবিধা থেকে তো আর সবাইকে বিমুখ করে রাখা যায় না/ প্রযুক্তি ব্যবহারের সুবিধা বাড়তে থাকলে একপর্যায়ে বাদুইদের একাংশ প্রাচীন নিয়মে আটকে থাকতে নারাজ হয়ে উঠলো। এই বিষয়কে কেন্দ্র করেই মূল আদিবাসীরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল- একদিকে তাংতু বাদুই, অন্যদিকে পানামপিং বাদুই (আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, ডাংকা বাদুইদের এই উভয় গ্রুপই আদিবাসী হিসেবে স্বীকার করে না)। তাংতুরা প্রযুক্তি বর্জন করলেও পানামপিংরা প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করে। এই বিতর্কের জের ধরে তাদের আবাসস্থলও ভাগ হয়ে যায়। ভূখণ্ডের কেন্দ্র ধরে রাখে তাংতু বাদুইরা। পানামপিং বাদুইরা প্রযুক্তির ব্যবহার করে বিধায় তাদেরকে তাংতু বাদুইরা ‘অপবিত্র’ মনে করে।
পানামপিং বাদুইরা মনে করেন, প্রযুক্তির ব্যবহার তাদের জীবনকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। এটি ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক কোনো বিষয় নয়। তারা বিদ্যুতের ব্যবহার করছেন। মোবাইল, টেলিভিশনসহ নানা প্রযুক্তিপণ্য ব্যবহার করছেন। পানামপিং বাদুইদের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ মোবাইল ব্যবহার করে থাকেন।
শুধু বিদ্যুত বা মোবাইল নয়, তাংতু বাদুইরা যানবাহনও পরিহার করে চলেন। কোনো প্রয়োজনে শহরে যেতে হলে তারা পায়ে হেঁটে শহরে যান। তারা আধুনিক রাস্তা নির্মাণেরও বিরোধী। যদিও পাথর সাজিয়ে তারা যে যাতায়াত পথ তৈরি করেছেন তা অনেক ক্ষেত্রে আধুনিক সড়কের চেয়েও টেকসই ও সুন্দর।
প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রভাব রয়েছে অর্থনৈতিক জীবনেও। তাংতু বাদুইদের প্রায় সবাই অর্থনৈতিকভাবে অস্বচ্ছল। পক্ষান্তরে পানামপিং বাদুইরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী। তাংতু বাদুইরা তাঁতের কাপড়, বাঁশের বাদ্যযন্ত্র ও কৃষি কাজের মতো পেশার সাথে সাথে জড়িত অপরদিকে পানামপিং বাদুইরা এগুলোর পাশাপাশি প্রযুক্তির ব্যবহার রয়েছে এমন পেশাতেও নিজেদেরকে যুক্ত করছেন।
তাংতু বাদুইরা নিজেদের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠী মনে করেন। তারা কখনো বসবাসের জন্য তাদের গ্রাম কেনিকিসাসের সীমান্ত অতিক্রম করেন না। কেননা তাদের আধ্যাত্মিক পূর্বপুরুষ এই ভূমির জন্য জীবন দিয়েছেন এবং এই ভূমি তাদের জন্য পবিত্র করে দিয়ে গেছেন। তবে পানামপিং বাদুইরা এই নিয়ম মানেন না। তারা জীবিকার সন্ধানে অন্যত্র গিয়েও বসবাস করেন।
তাংতু বাদুইরা সকল প্রকার আধুনিক শিক্ষাও বর্জন করে আসছে। তারা শুধুমাত্র প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত। তবে পানামপিং বাদুইরা স্বল্প পরিসরে আধুনিক শিক্ষার স্পর্শ পাচ্ছে। অনেকে উচ্চ শিক্ষার জন্য ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার বিভিন্ন স্থানে গমনও করছে।
প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রভাব পানামপিং বাদুইদের ধর্মীয় জীবনেও রয়েছে। যেখানে তাংতু বাদুইরা নিজেদের ধর্ম রক্ষায় অত্যন্ত কঠোর, সেখানে পানামপিং বাদুইদের অনেকেই তাদের আদি ধর্ম পরিত্যাগ করে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হচ্ছেন।
এই সামগ্রিক আলোচনা দ্বারা এই সিদ্ধান্তে আসা অযৌক্তিক নয় যে, তাংতু বাদুইরাই আসল বাদুই জনগোষ্ঠী। কেননা পানামপিং বাদুইরা অনেকটা স্বেচ্ছায় জাতচ্যুত আর ডাংকা বাদুইরা স্বীকৃত বাদুই আদিবাসী নয়। ফলে আমরা এমন একটি আদিবাসী জনগোষ্ঠী সম্পর্কে জানতে পারলাম, যারা আজও নিজেদের ঐতিহ্য ও বিশ্বাস রক্ষায় প্রযুক্তি বর্জন করে চলছে।
ফিচার ইমেজ- banten.travel