কলকাতা শহরে একসময় প্রায় ৬,০০০ ইহুদী জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল। বর্তমানে সেই সংখ্যা কমে গিয়ে মাত্র ২০ জনে উপনীত হয়েছে। দেশভাগ ও ইহুদীদের জন্য আলাদা ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করে বেশ আগেই কলকাতা ছেড়ে চলে যায় বহু সংখ্যক ইহুদী পরিবার। তারপর সময়ের পরিবর্তনে ক্রমান্বয়ে আরও কমতে থাকে তাদের সংখ্যা। সুবিশাল সিনাগগগুলো এখন খালি পড়ে থাকে উপাসকের অভাবে।
কলকাতায় বসবাসরত এই ইহুদীদের বলা হয় ‘বাগদাদি ইহুদী’। মূলত ১৮ শতকের বিভিন্ন সময় তারা ইরাক ও সিরিয়া অঞ্চল থেকে কলকাতায় এসে বসবাস শুরু করে। সেই সূত্রে তাদের এমন নামকরণ।
ভারতবর্ষে যখন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের গোড়াপত্তন ঘটে, তখন কলকাতাকে ব্রিটিশ-ভারতের রাজধানী ঘোষণা করা হয়। ফলে কলকাতা শহর দ্রুত একটি আধুনিক মহানগরীতে পরিণত হয়। সেই সুবাদে কলকাতায় একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র গড়ে ওঠে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে ব্যবসায়ীরা তখন কলকাতায় এসে ভিড় জমাতে থাকেন। বাণিজ্য শেষে তারা আবার স্ব স্ব দেশে ফিরে যেতেন। অনেকে আবার ব্যবসার সুবিধার্থে কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। এই বসবাসকারীদের মধ্যে একদল ইহুদী ধর্মাবলম্বীও ছিলেন।
ইতিহাসের পাতায় কলকাতায় আগত প্রথম নথিভুক্ত ইহুদীর নাম শালোম আহরন ওবদিয় কোহেন। তিনি ১৭৯৮ সালে কলকাতায় আসেন। কোহেন ১৭৬২ সালে সিরিয়ার আলেপ্পোয় জন্মগ্রহণ করেন। কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করার পর তার পরিবারের আরও অনেক সদস্য কলকাতায় আসতে শুরু করেন। এরপর ১৯ শতকের শুরুর দিকে ইরাকের বাগদাদ থেকে প্রচুর ইহুদী কলকাতায় পাড়ি জমাতে শুরু করেন এবং তাদের একটি বড় অংশ কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে।
প্রধানত ইরাক ও আলেপ্পো থেকে আগত এসব ইহুদীর সমন্বয়ে কলকাতায় একটি ইহুদী সমাজ গড়ে ওঠে। তারা সেখানে সিনাগগ, স্কুলসহ নানা ধরনের স্থাপনাও গড়ে তুলতে থাকেন। পরবর্তীতে ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠিত হলে এসব ইহুদী পরিবারের অনেকে আবার সেখানে চলে যায়। ফলে কলকাতার ইহুদী সম্প্রদায়ের সংখ্যা দ্রুত কমে যেতে থাকে। ১৯৬৯ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, তাদের সংখ্যা কমে গিয়ে মাত্র ৭০০ জনে পরিণত হয়েছে।
কলকাতায় তারা মোট ৫টি সিনাগগ প্রতিষ্ঠা করেন বলে জানা যায়। এর মধ্য থেকে বর্তমানে ৩টি সিনাগগ টিকে আছে। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল জাজিরার পক্ষ থেকে দুজন বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা অড্রি গর্ডন এবং বেন হফম্যান একটি ডকুমেন্টারি তৈরির জন্য কলকাতা আসেন। তারা তখন সিনাগগগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তারা এতে ব্যাপক বিড়ম্বনার মধ্যে পড়েন। পথচারীদের কোলাহল, সবজি ব্যবসায়ীদের জায়গা দখল, রিক্সা চালকদের আওয়াজ ও মোটর সাইকেলের আধিক্যের ফাঁকে সিনাগগগুলো খুঁজে পাওয়াই মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ সবগুলো সিনাগগে আগের মতো তেমন জনসমাগম নেই; মানুষ সেসব জায়গা এখন চেনেও না।
সেখানে একটি ইহুদী বালিকা বিদ্যালয় রয়েছে। প্রতিষ্ঠালগ্নে স্কুলটিতে শুধুমাত্র ইহুদী নারীরা পড়ালেখা করার সুযোগ পেতেন। বর্তমানে সেই নিয়ম আর নেই। এখন প্রায় শতভাগ ছাত্রী ইসলাম ধর্মের অনুসারী পরিবারগুলো থেকে আসে। শুধু তা-ই নয়, সিনাগগগুলোর প্রহরীর দায়িত্বে যত কর্মচারী আছে, তারাও সবাই মুসলিম।
কলকাতায় অবশিষ্ট ২০ ইহুদী সদস্যের মধ্যে অন্যতম একজন ফ্লাওয়ার সিলম্যান। তিনি তার স্কুল জীবনের স্মৃতিচারণ করে বলেন,
এখন এটা কেউ চিন্তাও করতে পারবে না যে, শুরুর সময় স্কুলের নিয়ম-কানুন কী ছিল। শুধুমাত্র ইহুদী সন্তানরা এখানে ভর্তি হতে পারতো। সব কিছুতে ইহুদী ধর্মের প্রথা অনুসরণ করা হতো। উৎসবে ইহুদী ধর্ম; শিক্ষক নির্বাচনে ইহুদী ধর্ম; পাঠদানে ইহুদী ধর্ম; কর্মচারী নির্বাচনে ইহুদী ধর্ম- অর্থাৎ স্কুলের সব কিছুই চলতো ইহুদী ধর্মের অনুসরণ করে।
বর্তমানে স্কুলটি পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন অ্যালাইন কোহেন। তিনি বলেন,
আমরা স্কুলে কোনো প্রকারের ধর্মীয় শিক্ষা দেই না বললেই চলে। স্কুলের অধিকাংশ ছাত্রী মুসলিম পরিবার থেকে আসা। মুসলিম সম্প্রদায়ের সাথে আমাদের অত্যন্ত ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
সিনাগগগুলোর মধ্যে ম্যাগান ডেভিড সবচেয়ে বড় ও উন্নত। এর প্রহরী হিসেবে কাজ করেন রবিউল ইসলাম নামের এক মুসলিম যুবক। তার আগে তার বাবা এবং তার আগে তার দাদা এখানকার প্রহরীর দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। দীর্ঘদিন যাবত এখানে দায়িত্ব পালনের সুবাদে সকল ইহুদী ধর্মগ্রন্থ ও উপাসনার মন্ত্র তার মুখস্ত। শুধুমাত্র রবিউল নয়, সিনাগগে দায়িত্বরত সকলেই ইসলাম ধর্মের অনুসারী। মুসলিম হয়েও ইহুদী ধর্মের উপাসনালয়ে দায়িত্ব পালন করতে তাদের কোনো সমস্যা পোহাতে হয় না বলে জানান রবিউল। তিনি বলেন,
আমাদের কখনো কোনো সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়নি। ইহুদী সম্প্রদায়ের লোকেরা আমাদের সত্যিকার অর্থেই অনেক ভালোবাসেন। বর্তমানে এখানে অল্প কয়েকজন ইহুদী বসবাস করেন- তারা প্রায়ই এখানে আসেন এবং উপাসনা করেন। তারা সবাই আমাদের ভালোবাসেন। আমরা তাদের সাথে কাজ করে খুশি। তারাও আমাদের কাজে খুশি।
কলকাতার ইহুদীরা ইরাক ও সিরিয়া অঞ্চল থেকে আসায় তাদের সংস্কৃতির মধ্যে জুদাই-আরব সংস্কৃতির ব্যাপক প্রভাব ছিল। তারা আরবী ভাষায় কথা বলতেন। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মগুলো ব্রিটিশদের দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয় এবং ইউরোপের সংস্কৃতি আপন করে নেয়। এখন যে অল্প কয়েকজন ইহুদী কলকাতায় আছেন তারা তাদের ধর্মীয় ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। তারা নিয়মিত উপাসনালয়ে যান এবং উপাসনা করেন। যেমন ফ্লাওয়ার সিলম্যান নিজের ব্যাপারে বলেন,
আমি প্রতি শুক্রবার দুপরের পর সিনাগগে যাই। সেখানে গিয়ে প্রথমে উপাসনা করি। তারপর সেখানে কিছু সময় ব্যয় করি। সেখানে এখন আমার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে।
ইহুদী ধর্মের উপাসনালয়ে মুসলিম সদস্যদের দায়িত্ব পালনের বিষয়টি সামনে আসলে সহসাই ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের বিষয়টিও সামনে চলে আসে। এ বিষয়ে প্রহরী রবিউল ইসলাম বলেন,
আপনি যুদ্ধ সম্পর্কে শুনে থাকবেন, যেমন ইসরায়েল ও রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধ- এমনকি মুসলিম ও ইহুদীদের মধ্যে যুদ্ধের কথাও শুনে থাকবেন। কিন্তু এসব আমাদের জন্য কোনো সমস্যা সৃষ্টি করে না। কেননা, প্রথমত আমাদের পরিচয় আমরা ভারতীয়, দ্বিতীয়ত আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অত্যন্ত শক্তিশালী। আমাদের সংস্কৃতি বিনা কারণে যুদ্ধ সমর্থন করে না। আমাদের সংস্কৃতি শুধুমাত্র অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। ফলে এখানে আমাদের কোনো সমস্যায় পড়তে হয় না।
ইহুদী বিদ্যালয়ের পরিচালক অ্যালাইন কোহেন বলেন,
মুসলিম পরিবারগুলো আমাদের এখানে তাদের মেয়েদের পড়তে দেয়ার পেছনে কারণ হলো, তারা আমাদের এখানে নিরাপদ অনুভব করেন। মেয়েদের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। তাছাড়া, এখানে কোনো বৈষম্য ও ধর্মীয় বাধ্যবাধকতাও নেই। আমরা প্রধানত শিক্ষার্থীদের উন্নতির দিকেই নজর দেই।
আনাম রহমান ইহুদী বালিকা বিদ্যালয়ের অন্যতম ছাত্রী। তিনি মুসলিম পরিবারে বড় হয়েছেন এবং বর্তমানে এই বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন। তিনি তার অনুভূতি তুলে ধরতে গিয়ে বলেন,
এটি ইহুদীদের তৈরি স্কুল হলেও তা আমাদের জন্য এটি কোনো বাধার সৃষ্টি করে না। শুধুমাত্র আমাদের ইউনিফর্মে একটি ইহুদী ধর্মের চিহ্ন থাকে, এর বেশি কিছুই না। আমার অনেক ইহুদী বন্ধু আছে, তাদের সাথে ফিলিস্তিন নিয়েও কথা হয়, কিন্তু এতে আমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট হয় না। এটি আসলে আমরাদের দৃষ্টিভঙ্গির উপরে নির্ভর করে। আমরা তরুণ প্রজন্ম, আমাদের যুদ্ধ ও রাজনীতির নামে সংঘাতে জড়ানো উচিৎ নয়। আমাদের শান্তির পথ খোঁজা উচিৎ।
সিনাগগ ও স্কুলের পাশাপাশি কলকাতায় ইহুদীদের একটি বড় সমাধিও রয়েছে। নারকেলদাঙ্গার প্রধান সড়কের পাশে অবস্থিত এই সমাধিতে কলকাতায় মৃত সকল ইহুদী সদস্যকে সমাহিত করা হয়।
১৮১২ সালে মোসেদ ডে পাস নামক এক ইহুদী সদস্যকে সমাহিত করার মধ্য দিয়ে সমাধির যাত্রা শুরু হয়েছিল। বর্তমানে সেই সমাধিতেও নেমে এসেছে সুনসান নীরবতা। এই সমাধির মতোই নীরবতা কলকাতার সমগ্র ইহুদী সম্প্রদায়ে। মাত্র ২০ জনের এই ইহুদী সমাজ কি বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দিন দিন? হয়তো সময়ই সেই উত্তর জানিয়ে দেবে তার সময় মতো।